সঠিক সামঞ্জস্য রাখতেই হবে, কোনও কিছুরই অতিরিক্ত ভাল নয়। এই কথাটি শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক হওয়ার সময় বহুবার শুনেছি। অগ্রজদের থেকে শোনা এই উক্তির মানে খুঁজেও পেয়েছি, উপলব্ধি করেছি। তবে পৃথিবীর বুকে এই অতিমারী আছড়ে না পড়লে হয়তো এই কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা চিৎকারটা শুনতে পেতাম না। অতিমারী যেভাবে তার সঙ্গে অনিশ্চয়তা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আত্মবিশ্লেষণ-এর প্রয়োজনীয়তা টেনে এনেছে, সেটা বহু নগ্নতাকে পরিষ্কার করে দেখিয়েছে। ভারতীয় ছাত্রজীবনের যে চেনা ছক ছিল, তার শুধুমাত্র যান্ত্রিক বদল নয়, সার্বিক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে সেই পরিবর্তনের ফলে, ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্বও কঠিন হল।
আমি নিজেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে, শিক্ষা আদান-প্রদানের এই নতুন ব্যবস্থার শিকার। হ্যাঁ, শিকার শব্দটাই ব্যবহার করতে হয় এই প্রসঙ্গে। কারণ আমি চেয়েছিলাম ক্লাসরুমের লেখাপড়ায় থাকতে। সে যাক। কিন্তু এখানে কয়েকটা বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, যে অনলাইন পদ্ধতির ব্যবহারে শিক্ষা আদান-প্রদান হচ্ছে, তা একেবারেই কাম্য নয়। মানুষের চরম বিপর্যয়ে, আর কোনও উপায় না দেখতে পেয়ে এই সিদ্ধান্ত, তবে সেই পদ্ধতির মধ্যে বহু ফাঁক আছে। স্কুলের শিক্ষা, ক্লাসরুমের শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বসে (একটি ঘরে বা আকাশের নিচে, প্রতিষ্ঠান মানে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বাড়ি বা গ্র্যান্ট পাওয়া কর্তৃপক্ষ নয়) পড়াশোনা— এগুলোর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। কারণ আমরা মানুষ, আমরা স্পর্শের পিপাসায় তৃষ্ণার্ত। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মানুষ হিসেবে সবচেয়ে বেশি শিখেছি, জেনেছি ও বুঝেছি পড়ার বইয়ের পাতার বাইরে থেকে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে পাঠ্যক্রম আমাকে কম কিছু দিয়েছে। তাই ওই দুইয়ের সামঞ্জস্য খুবই প্রয়োজন। ক্লাসরুমের চৌকাঠের দু’পারেই রয়েছে অবারিত শেখার দরজা। তাই শিক্ষা আসলে দুটোরই যোগফল। দুটোর মধ্যে সঠিক ‘ব্যালান্স’-এর বোধ থেকে, প্রকৃত শিক্ষার জন্ম।
একটি স্কুলে পড়তে যাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের স্পর্শ, বন্ধুত্ব, জীবনের প্রথম কিছু অভিজ্ঞতা, মনন তৈরি করা। সেই অভিজ্ঞতা যখন একটি স্ক্রিনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়, তখন তার স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায়। তাই এই অতিমারী সবার আগে স্কুলের নির্ভেজাল প্রথম অভিজ্ঞতার — ভাল এবং খারাপ— তার সততা কেড়ে নেয়। ভাল অভিজ্ঞতা বন্ধুদের আড্ডায় ফিরে আসে, আর খারাপগুলো মাথায় থাকে ‘লেসন’ হয়ে। ছাত্রজীবনের এই কিছু বছরের যে সার্বিক শিক্ষা, বই ও বইয়ের বাইরের জ্ঞান, তার থেকে বঞ্চিত হলেন অনেক ছাত্রছাত্রী।
তবে কি যাঁরা হোম স্কুলিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষা পান, তাঁরা বঞ্চিত? না, সেই পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়েও একটা বাতাবরণ তৈরি করা যায়। তবে মূল চিন্তার জায়গা হল বোর্ড ক্লাসে পড়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। তাঁরা একটি দীর্ঘ সময় ধরে নানারকম শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রতিষ্ঠান-শিক্ষাদানের ছোঁয়া পেয়েছেন। স্কুল-জীবনের শেষ কয়েকটা বছরে এই বদল একটি শূন্যতা অবশ্যই তৈরি করেছে বলে আমার ধারণা। হয়তো আর কিছুর জন্যই নয়, শুধুমাত্র নিজের বন্ধুকে স্কুলের শেষ দিন ফেয়ারওয়েলে জড়িয়ে কাঁদতে না পারাটা একটা আক্ষেপ হয়ে থাকবে। এমনটা আমার ক্ষেত্রে হলে, আমারও থাকত।
দ্বিতীয়ত, বাইরের পরিস্থিতির ভয়াবহতা ভেতরের অস্তিত্বকে জোর ধাক্কা দিয়েছে। প্রতিদিন যে ধরনের সংবাদ কানে আসছে, বা যে-দুশ্চিন্তা চোখে দেখে সারা শরীর ও মন দিয়ে হজম করতে হচ্ছে, তা যুবসমাজকে বিভ্রান্ত ও চিন্তিত করছে। এমতাবস্থায় কোনও ধরনের প্রথাগত শিক্ষা আত্মস্থ করা আমাদের বয়সের শিক্ষার্থীদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠছে। নিজের চেনা মানুষদের শোকের খবরে জর্জরিত হয়ে, ভবিষ্যতের শিক্ষা কী হবে— এমন বড় ভাবনার সম্মুখীন হওয়া কঠিন। সেই পরিস্থিতিতে নেটের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করা শুধুই একটা সাময়িক আয়োজন। পরীক্ষা দেওয়া বা প্রজেক্ট করা তো আরও কঠিন ব্যাপার।
তৃতীয় কথা, শিক্ষাব্যবস্থা এখন এতটাই প্রতিযোগিতা-কেন্দ্রিক যে, ‘পরীক্ষার ফলাফলে ভাল নম্বর’ না থাকলে মুশকিল প্রভূত পরিমাণে। তাই হাজার অসুবিধে সত্ত্বেও এই পরীক্ষার কাঠামোতে থাকতেই হবে, নম্বরের রেষারেষি চলবেই। তবে অভিজ্ঞ মানুষ বলতে পারবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কয়েক বছর পর সেই বিশেষ পরীক্ষার ফলাফলের মূল্য কমে আসে। পরীক্ষা ব্যাপারটাকে ঘিরে যে-ধরনের গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য তৈরি করা হয়, তা কয়েক বছরের মধ্যে ফিকে হয়ে যায়। যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি শুধু এই একটি পরীক্ষা নয়।
দু’দিক থেকেই ভেবে দেখতে গেলে এই যুক্তিগুলো উঠে আসবেই, সেইগুলো বুঝে নিতেই হবে, কারণ বিষয়টি সহজ নয়। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি অশ্রুতপূর্ব প্রক্রিয়ার অংশ আমরা সবাই। বোর্ড ক্লাসের পরীক্ষা হবে কি হবে না, হলেও কীভাবে হবে, অনলাইন মাধ্যমের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহার এক্ষেত্রে কীভাবে প্রযোজ্য— তা নিয়ে সারা দেশ জুড়ে আলোচনা চলেছে। সেই পরীক্ষা যদি শেষ পর্যন্ত অনলাইন মাধ্যমে হয় তাহলে আমার ভাইবোনেরা পাবেন না হল-এ গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার যে অভিজ্ঞতা, ইনভিজিলেটর হলে থাকলে সেই প্রথম বুক ধুকপুকুনি, গেটের বাইরে বাবার/মায়ের আশীর্বাদ, টিচারদের শেষ মিনিটের শুভকামনা এবং চেনা-অচেনা বন্ধুদের সংস্পর্শ। সেই পরীক্ষা যদি বাতিল হয়, তাহলে জীবনের অনেকগুলো পরীক্ষার যে প্রথম ধাপ এই একটি বোর্ড একজাম, যা নিয়ে বড় হওয়ার সময় অনেক উপদেশ ও আলোচনা শোনা যায়, তার অভিজ্ঞতা হবে না। এই পরীক্ষা দেওয়ার যে আনন্দ আর মজা, চাপা উত্তেজনা এবং উদ্বেগ, তা আমাকে আসন্ন আরো একশোটা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল। আমার খুব প্রিয় এক শিক্ষক বলেছিলেন সেই প্রসঙ্গে, ফলাফল যা-ই হোক, এই বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ে যে দাবানল তৈরি হয় আমাদের চারপাশ থেকে, সেটা উপভোগ করা উচিত। সেই অভিজ্ঞতা হবে না?
আবার সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে, যদি পরীক্ষা সত্যি হয়, তাহলে এই মানসিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, মুখস্থ করে চারটে উত্তর লেখা— যা ভবিষ্যতে ভাল কলেজ বা ভাল চাকরি নিশ্চিত করবে বলে শোনা যায়, তা কি আদৌ সম্ভব?
এইসব নিয়ে তাই দ্বিধান্বিত সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের বয়সে এই পরিমাণ অনিশ্চয়তা ভয়ঙ্কর; একটি পরীক্ষার ফলাফলের জীবনের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ানোর চাপ যুবসম্প্রদায়কে আরও কুঁজো করে দিচ্ছে। তাই কোথাও একটা সামঞ্জস্য দরকার ছিল বোধহয়।