স্বাস্থ্যপরিষেবা, স্বাস্থ্যভাবনা ইত্যাদি আগামী দিনে কোন পথে যেতে চলেছে, লিখতে বসে দেখছি, তার আন্দাজ পাওয়ার কাজটা সহজ নয়। যে-কোনও বিষয়ের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির অনুমান করা যায়— অন্তত করার চেষ্টা হয়— এতদিনকার চলে আসা প্রবণতার ভিত্তিতে। সেই হিসেবে গত এক শতকে চিকিৎসাব্যবস্থার চমকপ্রদ উন্নতির ভিত্তিতে আগামী দিনের স্বাস্থ্যপরিষেবার বদলের অনুমান করা যেতে পারে। আবার আরেকদিকে, সেই পরিষেবার গ্রহীতারা, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সেই সুবাদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নীতিনির্ধারকও বটেন (অন্তত খাতায়কলমে তেমনই), তাঁরা এমন চমকপ্রদ উন্নতিতে খুশি হলেও পরিষেবা গ্রহণের মুহূর্তে তেমন খুশি নন— এক বিরাট অংশ তো সেভাবে পরিষেবা অবধি পৌঁছাতেই পারেন না। আমাদের মতো গরিব দেশের কথা ছেড়েই দিন, এমনকী খোদ মার্কিনদেশেও নাগরিকরা নিজেদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে খুশি নন, অথচ একইসঙ্গে তাঁরা এও মানেন যে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যপরিষেবার বন্দোবস্ত রয়েছে তাঁদেরই দেশে। সংখ্যাগরিষ্ঠের এমন অসন্তোষ কি ভবিষ্যতে চিকিৎসাপরিষেবার অভিমুখ বদলে ফেলতে পারবে?
গলদটা অনেকাংশেই অসাম্যের কারণে। আর্থিক অসাম্য থেকে চিকিৎসার নাগাল পাওয়ার ভৌগোলিক অসাম্য, সবরকম সমস্যাই রয়েছে। কিন্তু সাম্য যদি চাইও, শীর্ষমানের স্বাস্থ্যপরিষেবা গ্রামেগঞ্জের সর্বত্র চটজলদি পাওয়া যাবে, এমন সাম্য কি সম্ভব? মানে, দেশের আর্থিক অসাম্য খুবই দুশ্চিন্তার এবং অত্যন্ত অশ্লীলও বটে— কিন্তু দেশের সবাই আম্বানির মতো, বা নিদেনপক্ষে নেওটিয়া-গোয়েঙ্কাদের মতো ধনী হয়ে উঠুক, এমনটা কি খুব বাস্তবসম্মত চাহিদা? অতএব, স্বাস্থ্যপরিষেবা ‘বিজ্ঞানের অগ্রগতি’র সুবাদে যত হাইটেক ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, ততই সেই ব্যবস্থার ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধাতে থাকবে এবং একইসাথে, সেই পরিষেবা হাতে না পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশাও বাড়বে, এমনটা হওয়াই সম্ভব। কেননা, চিকিৎসা কোনও বিলাসবহুল গাড়ি বা প্রমোদতরণী নয়, যার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা যায়, এবং ভুলেও যাওয়া যায়— চিকিৎসা হল একেবারে নিজের বা একান্ত প্রিয়জনের বেঁচে থাকা বনাম মরে যাওয়ার ব্যবধান, সেখানে ‘অ্যাফোর্ড করতে না পারা’-র তাৎপর্য একেবারেই অন্যমাত্রার। বিজ্ঞানের তরতরিয়ে অগ্রগতি এবং সেই অগ্রগতির সুফল সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারা— আগামী দিনে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই দুই মহৎ লক্ষ্যের ভারসাম্য কীভাবে ঘটাতে পারবে, বা দুইয়ের মধ্যে কোনটিকে প্রাধান্য দেবে, তার আন্দাজ পাওয়া তো সহজ নয়।
আর তাছাড়া সমস্যাটা শুধুমাত্র এই ‘অ্যাক্সেসিবিলিটি’ বা নাগালে-পাওয়ার ফারাক ও অসাম্যের মধ্যেই সীমিত নেই। চিকিৎসাভাবনা ও চিকিৎসা-গবেষণার দর্শনেও কিছু মূলগত বদল এসেছে। ধরুন, একটা পুরনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। স্টেজ ফোর ক্যান্সারের (ক্যান্সারের চারটি পর্যায় থাকে, তার মধ্যে সবচাইতে বাড়াবাড়ি অবস্থা বলতে স্টেজ ফোর) চিকিৎসা চলছে, এমন রোগীর ক্ষেত্রে পরিজনের উপস্থিতির গুরুত্ব। সেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে, কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপি যা-ই চিকিৎসা চলুক না কেন, যে-রোগীর বাড়িতে দেখভাল করার মতো পরিজন রয়েছেন, তিনি চিকিৎসায় অনেক ভালো সাড়া দেন। অবশ্য চিকিৎসায় আনুষঙ্গিক যত্নের গুরুত্ব বা পরিজনের উষ্ণ সান্নিধ্যের তাৎপর্য জাতীয় কথাগুলো এমনিই আন্দাজ করা যেত, কিন্তু চালু ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যাচাই করে দেখাটাও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পাশাপাশি সমকালীন একটি ট্রায়ালের গল্প শোনানো যাক। ওই একই স্টেজ ফোর ক্যান্সার। দেখা গেল, নতুন একটি ওষুধ এই একই ক্যান্সারে ইঁদুর-গিনিপিগের শরীরে দিব্যি কাজ করে। ওষুধটি পরীক্ষা করে দেখা হবে মানুষের শরীরে। কিন্তু মুশকিল, ইঁদুর-গিনিপিগের শরীরে মির্যাকল ঘটানো ওষুধটা মানুষের শরীরে বিশেষ কিছুই কাজ করল না। নিরাশ বিজ্ঞানীদের একজন কারণ খুঁজতে শুরু করলেন। দেখা গেল, ওষুধ একেবারে কাজ করেনি এমন নয়, দশ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধ কাজ করেছে, কিন্তু বাকি নব্বই শতাংশের চাপে সামগ্রিকভাবে ওষুধটাকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। উৎসাহিত বিজ্ঞানীরা এই দশ শতাংশ রোগীকে নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন এবং খুঁজে পাওয়া গেল একটি বিশেষ জিনের বদল। বোঝা গেল, এই বিশেষ জিনের বদল থাকলে উক্ত ওষুধটি কাজ করবে, নইলে করবে না। বলাই বাহুল্য, এমন আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগের গবেষণাকাজের তাৎপর্য তো কিছু কম নয়।
এ-কথা অনস্বীকার্য যে, চিকিৎসাবিজ্ঞান যত এগোবে, যত নতুন-নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হবে, যত নতুন-নতুন রোগনির্ণয় বা রোগের ঝুঁকির কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে, ততই এই দ্বিতীয় ধরনের গবেষণার গুরুত্ব বাড়বে— তবু ওই প্রথম ধরনের গবেষণার গুরুত্ব ভুলতে চাইলে মুশকিল।
একটা সত্যি ঘটনা বলি। আমাদের হাসপাতালে একজন ক্যান্সার-রোগাক্রান্ত মানুষ বেশ কয়েক মাস ধরে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। চিকিৎসায় মোটামুটি সুফলও পাওয়া যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি, তিনি বেশ কয়েক সপ্তাহ এলেন না। মাস তিনেক বাদে যখন এলেন, জানা গেল, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যিনি আসতেন, ভদ্রলোকের স্ত্রী, তিনি মারা গিয়েছেন আচমকা। হার্ট অ্যাটাকে। এখন ভদ্রলোক একদম নিঃসঙ্গ, নিজের চিকিৎসা করানোর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁর চিকিৎসা আবার শুরু করা গেল, কিন্তু এবারে ওই একই ওষুধে কাজ হল না। শুরু হল নতুন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা— পরিভাষায় ‘সেকেন্ড লাইন থেরাপি’, কিন্তু আগের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত প্রথম গবেষণাকাজের কথা মাথায় রাখলে সমাধান তো খুঁজতে হত অন্যভাবে। অর্থাৎ ঠিক কীভাবে আশেপাশের মানুষজন দিয়ে মানুষটির শূন্যতা, অন্তত অংশত হলেও, ভরিয়ে তোলা যায়— কীভাবে বাড়িতে তাঁর দেখভালের বন্দোবস্ত করা যায়— কীভাবে মানুষটির চিকিৎসার কাজে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে— এই কথাগুলো না ভাবলে শুধুই নতুন ওষুধে কাজের কাজ হবে কি? যতক্ষণ না নতুন ওষুধ নতুন রোগনির্ণয় হাইটেক চিকিৎসার পাশাপাশি এরকম সাধারণ ও সামাজিক ভাবনার কথা চিকিৎসা-শিক্ষণ পাঠক্রমে গুরুত্ব পাচ্ছে, ততদিন অবধি চিকিৎসাভাবনার জায়গায় একটা বড় ফাঁক রয়ে যাবে। মুশকিল হল, ডাক্তারি শিক্ষার ক্ষেত্রে, মুখে অনেক কথা খরচ করা হলেও, এই ফাঁক বেড়েই চলেছে। মডার্ন মেডিসিনের শিক্ষা ক্রমেই হাইটেক হেলথকেয়ার-এর প্রতি বিস্মিত মুগ্ধতায় পরিণত হচ্ছে। গত পঞ্চাশ বছরের কথা যদি ভাবি, আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যভাবনা ও চিকিৎসাভাবনা চিকিৎসায় বিভিন্ন সামাজিক উপাদানের গুরুত্বের কথা তথা মেডিকেল সোশিওলজি-কে ক্রমশ ভুলে এসেছে— এই ফাটল মেরামত তো দূর, উত্তরোত্তর দূরত্ব বেড়েই চলেছে— ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দূরত্ব বেড়ে চলারই সম্ভাবনা।
আসলে স্বাস্থ্যপরিষেবা উত্তরোত্তর টেকনোলজি-নির্ভর হয়ে চলেছে— ভবিষ্যতের কথা ভাবলে সেই নির্ভরতা বাড়ারই সম্ভাবনা। এখানে টেকনোলজি বলতে যা যা বস্তু আমাদের হেলথকেয়ার-সিস্টেমের ডেলিভারি, সংগঠন এবং ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে, তার সবগুলোই ধরছি। অর্থাৎ নিত্যনতুন রোগনির্ণয় পদ্ধতি থেকে শুরু করে চিকিৎসার কাজে বা ওষুধ তৈরির কাজে মেশিনের ব্যবহার, এমনকী কীভাবে আমরা চিকিৎসার ফল যাচাই করছি বা করব, কীভাবে তথ্য সংরক্ষণ করব এবং আনুষঙ্গিক কাঠামো— টেকনোলজির আওতায় সবই আসছে। এই টেকনোলজি একদিকে একজন মানুষকে কিছু দেহাংশের সমষ্টি করে চিনতে চায় এবং চিনতে শেখায়— যেমন, অমুক দেহাংশের অসুখ— আবার তথ্যসংগ্রহের মুহূর্তে অনেক মানুষের তথ্য একত্রে করে সাজায়, যে তথ্যভাণ্ডার কোনও একটি ব্যক্তিমানুষের অসুখের মুহূর্তে চিকিৎসা-নির্ধারণে কার্যকরী হয়ে ওঠে। ব্যক্তিমানুষকে খণ্ডাংশে ভেঙে ফেলা বা অনেক মানুষের তথ্যকে একত্রে সারিবদ্ধ করে ফেলা, এই দুইয়ের কোনও ক্ষেত্রেই ব্যক্তিমানুষটির স্বাতন্ত্র্য, বা পার্সনহুড, অবশিষ্ট থাকছে কি? সেক্ষেত্রে এই চিকিৎসাদর্শন-অনুসারী চিকিৎসা নৈর্ব্যক্তিক হতে বাধ্য। মুশকিল হল, এই নৈর্ব্যক্তিকতা উভয় পক্ষেই সত্য। চূড়ান্ত নৈর্ব্যক্তিকতা যখন সম্ভব হবে, তখন চিকিৎসকের কাজ যন্ত্রের দ্বারা করে ফেলা যাবে— আবার একই উপসর্গ নিয়ে ক-বাবুর জায়গায় ঞ-বাবু এলেও একই চিকিৎসা করে ফেলা সম্ভব হবে, যদিও দুজনের চিকিৎসা-প্রত্যাশা, হয়তো, ভিন্ন। অথচ, সুস্থ অবস্থায় টেকনোলজি-নির্ভর বা অত্যাধুনিক-ব্যবস্থানির্ভর চিকিৎসার কথা আমাদের যতই বিস্ময়াবিষ্ট করুক, অসুস্থ হয়ে পড়লে, বিশেষ করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে অসহায় হয়ে পড়ার মুহূর্তে, মানুষ চায় সহমর্মিতা, মানবিক উষ্ণতা। একদিকে টেকনোলজির নিস্পৃহ নৈর্ব্যক্তিকতা, আরেকদিকে মানবিক স্পর্শ— সঠিক মাত্রায় দুইয়ের মিলন ঘটাতে পারলে মিশেলটা নিখুঁত হয়, সম্ভবত— তবু ভারসাম্য ক্রমেই টেকনোলজির দিকে ঝুঁকছে। আরও ঝুঁকবে, হয়তো।
আসলে উত্তরাধুনিক দর্শন যখন থেকে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের পরিবর্তে টুকরো-টুকরো গল্পের কথা বলতে শুরু করেছে, তার ঢের আগে থেকেই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান, অর্থাৎ মডার্ন মেডিসিন, সমগ্র মানুষটার শারীরিক কষ্টের সমাধান খুঁজতে শুরু করেছে কোনও একটি দেহাংশের গোলযোগের মধ্যে। অসুখ, অ-সুখ, হয় একজন সমগ্র মানুষের— কিন্তু গন্ডগোল হয়তো নির্দিষ্ট একটি অঙ্গেই সীমাবদ্ধ, যে গন্ডগোল শুধরে নিতে পারলেই হয়তো সমগ্র মানুষটিরই অ-সুখ-এর সুরাহা হয়। এই দর্শন ধরে এগিয়েই চিকিৎসাবিজ্ঞানের এ-যাবৎ জয়যাত্রা। কিন্তু অধিক মাত্রায় প্রয়োগে ওষুধ বিষে পরিণত হওয়ার মতোই, এই দর্শনের চূড়ান্ত রূপ হয়ে দাঁড়ায় ডিহিউম্যানাইজড মেডিসিন। মেডিকেল ইমেজিং টেকনোলজির বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে— সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পেট-সিটি স্ক্যান ইত্যাদি— রোগগ্রস্ত অঙ্গটির সন্ধানও ক্রমশ মানবিক স্পর্শহীন হয়ে উঠেছে। অ-সুখ-এর সমাধানে রোগগ্রস্ত অঙ্গের খোঁজ, সেখান থেকে প্রতিচ্ছবি ধরে দেহাংশের রোগ চিনে চিকিৎসা করা— এ যেন ক্রমশ চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে রোগীর ক্রমবর্ধমান দূরত্বের কাহিনি। আগামী দিনে এই সংকট কমবে, এমন আশার কারণ নেই। বিশেষত, চিকিৎসাব্যবস্থার বণ্টনজনিত অসাম্যের সমাধান হিসেবে ইদানীং যে-কথা খুব চলছে— টেলিমেডিসিন, যা নিয়ে দেশের সরকারবাহাদুরও অত্যন্ত আগ্রহী— তা অনেকাংশেই ইমেজিং টেকনোলজির উপর নির্ভরশীল, যেখানে চিকিৎসক দেখবেন একান্তভাবেই অসুস্থ মানুষটির ছবি, এবং চিকিৎসার নির্ধারক হয়ে দাঁড়াবে মানুষটির দেহাংশের কিছু ছবি। উৎপলকুমার বসুর কবিতার বইয়ের নাম ধার করে বলা যায়, এ এক আশ্চর্য খণ্ডবৈচিত্র্যের দিন, যেখানে মানুষের বিচিত্রতা খণ্ডিত করে না দেখলে আমাদের চলে না। এবং সেই খণ্ডবৈচিত্র্যকেও সারিবদ্ধ করে একটা প্যাটার্ন খুঁজে চলা চিকিৎসকের কর্তব্য। অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে খণ্ডীকরণ ও বৈচিত্র্য, দুইই বাড়ছে— সারিবদ্ধ করার কাজটাও জটিল হচ্ছে— অর্থাৎ আগে যদি এক দুই করে সাজানো যেত, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এখন এক-এর অ আ উপবিভাগ, এমনকী এক-এর অ-এর ক খ উপবিভাগ অনুযায়ী সাজানো যাচ্ছে— চিকিৎসা আরও নিখুঁত করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও নিখুঁত হবে— কিন্তু সমগ্র মানুষটা, তাঁর দেহাংশ মেরামত হলেও সবসময় অ-সুখ-এর সমাধান মিলছে কি?
অর্থাৎ, অনেক জটিল বুলি আওড়ানোর শেষে আগামী দিনের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পূর্বাভাস বলতে, উঁচুতলায় চিকিৎসাব্যবস্থা আরও নিখুঁত হবে, আরও বেশি সংখ্যার অসুখের নিরাময় সম্ভব হবে— কিন্তু চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যক্তিমানুষের যে অ্যালিয়েনেশনের অনুভূতি, তার সুরাহা কতদূর হবে, বলা মুশকিল। আর, অর্থনীতির সমৃদ্ধি চুঁইয়ে আসার তত্ত্বের মতোই, স্বাস্থ্যপরিষেবার যে অসাম্য, ধনী-দরিদ্রের অসাম্য মূলত, গ্রাম-শহরের অসাম্যও কিয়দংশে— সেই অসাম্যের সমাধান আদৌ হবে কি না বলা মুশকিল।
তবে আমরা তো নিজেদের শ্রেণি-অবস্থানের বাইরে চট করে ভাবতে চাই না। কাজেই, হাইটেক হেলথকেয়ার টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চুঁইয়ে পড়ে হাসিম শেখের বউ বা রামা কৈবর্তের ছেলেটাকে সারাতে পারবে কি না, সে নিয়ে আমরা বিচলিত নই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারের উত্তরোত্তর ব্যয়-সংকোচন বা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি ক্রমশ লাটে উঠে যাওয়া নিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মাথাব্যথা বিশেষ নেই। কিন্তু, সারা দুনিয়া যখন ভাবীকালের পার্সোনালাইজড মেডিসিনের আশায় উন্মুখ, তখন এই অ্যালিয়েনেশন বা দূরত্বের অনুভূতি কি আদৌ ঠিক কথা?
আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে, অসুখবিসুখের ক্ষেত্রে জিন-এর গুরুত্ব স্পষ্ট। আপনার বর্তমান অসুখের পিছনে কোন জিন বিগড়ানো দায়ী, জিনের গোলযোগের ক্ষেত্রে কোন ওষুধ কাজ করতে পারবে আর কোন ওষুধ একেবারে বেকার— সবই জেনে ফেলা যায় এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসাকে সাজানোও যায়। তারও আগে, জন্মের পর পরই (বা জন্মানোর আগেই) আপনার শরীরে ঠিক কী কী জিন উপস্থিত, তার মধ্যে কোন কোন মিউটেশন রয়েছে যা কিনা ভবিষ্যতে গন্ডগোল পাকাতে পারে, সেও জেনে নেওয়া যায়। জানাটা একদিক থেকে কাজের, কেননা সাবধান হওয়ার সুযোগটা পাওয়া যায় বা অসুখ অবশ্যম্ভাবী হলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু আরেকদিকে? ধরুন, আপনার জিনে এমন একটি মিউটেশন রয়েছে, যে-মিউটেশন যাঁদের মধ্যে উপস্থিত তাঁদের প্রতি চারজনের একজন ক্যান্সারে মারা যান। কী করবেন আপনি? সাবধানে থাকবেন নিশ্চয়ই, নিয়মিত পরীক্ষানিরীক্ষাও করাবেন অবশ্যই, কিন্তু এছাড়া? মাথায় রাখুন, ওই একই মিউটেশন যাঁদের রয়েছে, তাঁদের চারজনের মধ্যে তিনজনই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন না— আক্রান্ত হন একজনই— কিন্তু আতঙ্কে ভোগেন চারজনই। আজীবন এই আতঙ্ক নিয়ে ভোগার মূল্য তো কিছু কম নয়। আবার, চারজনের মধ্যে চারজনই সারাজীবন নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে চলবেন, চেক-আপ-এর মধ্যে থাকবেন – তার মূল্যও তো কিছু কম নয়। আরও একদিকে, বীমানির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে আরেকরকম সংকট। উপরিউক্ত মিউটেশন যেহেতু ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়, সেহেতু, প্রত্যাশিতভাবেই, বীমা-কোম্পানি সেই মিউটেশন-যুক্ত মানুষের বীমা আদৌ করাতে চাইবে না বা বীমার খরচ বিপুল হারে বাড়িয়ে দেবে। স্রেফ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত মিউটেশন-এর কারণেই একজন মানুষ বিপুল দুশ্চিন্তার ভার ও ব্যয়ভার বহন করে চলবেন আমৃত্যু— যে ভার বহনের সংকট তাঁর ক্ষেত্রে একশো শতাংশ, যদিও তাঁর সেই নির্দিষ্ট অসুখটিতে ভোগার সম্ভাবনা মাত্র পঁচিশ শতাংশ।
অতএব, আগামীদিনে স্বাস্থ্যপরিষেবা বা চিকিৎসাব্যবস্থা কোনদিকে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল হলেও গতিপ্রকৃতির আঁচ যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তাকে এক কথায় ভালো না কি মন্দ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। অনেকটা বিজ্ঞান আশীর্বাদ না কি অভিশাপ রচনা লেখার মতোই ব্যাপার। মোদ্দা কথাটা হল, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিজ্ঞানের আর পাঁচটা শাখার মতোই— বা আরও বেশি করে— কোনও বায়বীয় নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞান নয়। হাজার প্রশ্নের ভিড়ে ঠিক কোন প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা হবে, উত্তর পাওয়া গেলে সেই উত্তর কীভাবে ও কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে— এসব নির্ভর করে নির্ণায়ক প্রতিষ্ঠানের উপর, অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র ও কর্পোরেট বহুজাতিক, যারা কিনা এই বাজারব্যবস্থায় মিলেমিশে একাকার, তাদের উপরে।
বদল তো আসছেই, কিন্তু সেই বদলের আঁচ আমাদের উপর কেমন করে পড়বে তার আন্দাজ পাওয়া অতি দুরূহ। অর্ধশতক আগেকার স্বাস্থ্য তথা সুস্থতার সংজ্ঞা— সুস্থতা বলতে অসুস্থতার অনুপস্থিতি মাত্র নয়, সুস্থতা হল শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা— অর্থাৎ কিনা ‘দাদা, কেমন আছেন’-এর উত্তরে যে-কথাগুলো শুনতে পাওয়ার প্রত্যাশা, আমাদের পুরনো স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা ছিল তেমনই— সেই সংজ্ঞার বিস্তার কমতে-কমতে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সুস্থতার নামে বিবিধ বাস্তব-অবাস্তব ‘স্বাস্থ্যকর অভ্যাস’-এর বিকৃত চর্চায় এসে ঠেকেছে। আগে আমরা ডাক্তারের কাছে যেতাম অসুস্থ হলে, এখন যাই সুস্থ আছি কি না, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হতে। অর্থাৎ আমরা প্রত্যেকেই যেন আপাতত-সুস্থ বা রোগী-হয়ে-ওঠার-অপেক্ষায়-থাকা মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি। জন্মলগ্নে নিজেদের জিনের মানচিত্র জেনে ওঠার পর এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে। জন্মের আগেই জিনগত গঠন জেনে ফেলা গেলে তার ত্রুটি শুধরে নেওয়াও সম্ভব হয়ে উঠতে চলেছে শিগগিরই— অর্থাৎ জিন এডিটিং। তারই আরেক পিঠে, জিন এডিটিং-এর সাহায্যে বাছাই গুণাবলির জিন জুড়ে দেওয়ার চেষ্টাও কম কিছু চলছে না। অর্থাৎ নিখুঁত মানুষ গড়ে তোলার চেষ্টা। ইউজেনিক্স থেকে তার দূরত্ব তো খুব বেশি নয়। নীতিগত বাধা রয়েছে অবশ্যই, কিন্তু বিলিয়নেয়ার পিতা যদি নিখুঁত সর্বাঙ্গসুন্দর সন্তানের আশা রাখেন, তুচ্ছ এথিক্সের বিধিনিষেধ কি কখনও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে!
তো শেষমেশ কথাটা দাঁড়ায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অগ্রগতিতে আলো কিছু কম নেই, আবার কম নেই সেই আলোর নীচে অন্ধকারও। ভবিষ্যৎ অগ্রগতির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অন্যরকম হবে, তেমন কারণ নেই। এই বিপুল অগ্রগতির সুফল এখনও অবধি পৌঁছাতে পারছে উপরমহলের কিছু শতাংশের ঘরে— কিন্তু টেকনোলজির ধর্মই এই, ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সবার সামর্থ্যের মধ্যে আসে, তা উত্তরোত্তর সস্তা হতে থাকে। তবে যতদিনে আগের ধাপের টেকনোলজি নীচের মহলে পৌঁছায়, প্রায়শই ততদিনে পরবর্তী ধাপের টেকনোলজি চলে আসে উপরমহলে— ফাঁকটা অনেক সময়ই রয়ে যায়, তবু কিছু প্রাপ্তি গরিবের ঘরেও জোটে। কিন্তু প্রাপ্তিটুকু কতদিনে কতখানি কত নীচতলা অবধি পৌঁছাতে পারবে, তা অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্র ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। সরকারি সদিচ্ছে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, আমজনতার অধিকার-সচেতনতা ইত্যাদি অনেক ফ্যাক্টর সেখানে।
কিন্তু ভাবীকালের টেকনোলজির আসল খেলার মাঠ যেটি, অর্থাৎ কিনা উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্তের স্বাস্থ্যরক্ষার আশ্বাস ও চিকিৎসাপরিষেবা, সেখানে চিকিৎসাভাবনার উত্তরোত্তর নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠা এবং অসুস্থ ব্যক্তিমানুষটির অ্যালিয়েনেশনের অনুভূতি— হাসপাতাল, যা কিনা আস্তে আস্তে মানবিক স্পর্শের আকুতি বনাম প্রাণহীন কর্মকুশলতার মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে— চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি, অন্তত এই মডেলে এগোতে থাকলে, তার অভিঘাত কী দাঁড়াতে চলেছে, আন্দাজ করা মুশকিল।
মানে, হাসপাতালে আসা অসুস্থ মানুষ তো সরকারি সংজ্ঞায় অনেকদিন যাবৎই ক্রেতা। ক্রেতা সুস্থ হলেও সন্তুষ্ট ‘গ্রাহক’ যদি না হতে পারেন, তাহলে? আর এ তো সবাই জানেন যে, একবার কিনতে এসে অসন্তুষ্ট ক্রেতা পরবর্তী পছন্দের সময় সবক্ষেত্রে যুক্তির হিসেব মেনে চলেন না। তখন?