স্পিডবোটের চালক যাতে কিছু শুনতে না পান, সেভাবেই কিশিমোতো ব্রহ্মকে একান্তে বললেন— আমি আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করি ড: ঠাকুর। কিন্তু আজ হয়তো উত্তেজনার বশে আপনি পুরোপুরি ঠিক কথা বলতে পারেননি। আপনার সিদ্ধান্তে খানিকটা ফাঁক রয়ে গেছে। আপনাকেও যে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আপনারই বলা কথা! আচ্ছা, কোন কথাটা বলুন তো দেখি?— কিশিমোতো রহস্য করে হাসলেন। মনে হল তিনি ড: ব্রহ্ম ঠাকুরকে খানিকটা মেপে নিতে চাইছেন।
কথাটা শুনে ব্রহ্ম ঠাকুর চমকে তাকালেন কিশিমোতোর দিকে।
দ্বিধাগ্রস্থ ব্রহ্মের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে, খানিকটা হাসিমুখেই কিশিমোতো বললেন— আপনার বলা সেই কথাটা হল—‘কিশিমোতো একজন নন, দু’জন’। আপনিই বলেছেন, অথচ নিজের কথাটা নিজে তলিয়ে দেখেননি। ভেবে দেখুন তো, কিশিমোতো যদি দু’জন হন, কী কী অসুবিধেয় তাঁরা পড়তে পারেন?
ব্রহ্ম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন ঠিক পাঁচ সেকেন্ড। তার পরেই তাঁর মুখে একটা প্রশান্তির হাসি খেলা করে গেল। কিশিমোতোকে তিনি উৎফুল্ল হয়েই বললেন—
আমি বুঝতে পেরে গেছি জুনিয়র। সব বুঝেছি। তুমি ঠিকই বলেছ— আমি অনেকটাই ভুল ভেবেছিলাম। তোমাকে শত্রুপক্ষের একজন ভেবেছিলাম। সে ভাবনাটা সঠিক না ভুল…
এতটুকু বলেই ব্রহ্মের ভুরু আবার কুঁচকে গেল। তিনি ফের কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন— শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো দেখি। তোমার বাবার ছেঁড়া ডায়রিটা তুমি বেশ কিছুদিন খুঁজে পাচ্ছিলে না। ডায়রিটা হারিয়ে গেছিল। ঠিক তো?
১৪।
কলকাতায়, ব্রহ্ম ঠাকুরের বাড়িতে
একজন রাতের অতিথি
ঠিক যেমনটি সে ছকে রেখেছিল, তেমন করেই রাতের অন্ধকার এবং বাড়ির ফটকে মোতায়েন দুজন প্রহরী-পুলিশের মধ্যে একজনের নৈশাহারে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে লোকটা নিঃশব্দে পেরিয়ে এল দুটো ছাদ। ছাদগুলো কাছাকাছি, তবে গায়ে গায়ে লাগানো নয়। তার জন্য তাকে তার বিশেষ পোশাকের ঢোলা পকেট থেকে বের করতে হল নাইলনের একটা ফোল্ডিং-সেতু, যা সে ব্যবহার করল অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায়। এভাবে অল্প আয়াসেই সে এসে পৌঁছল ড: ব্রহ্ম ঠাকুরের ছাদে।
সিঁড়ির ঘরটি ভিতর থেকে বন্ধ, তাই তা খুলবার জন্য তাকে একটু পরিশ্রম করতে হল। বাড়ির মধ্যে আওয়াজ হলে চলবে না, তাই সে মাল্টিপারপাস স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে খুলে ফেলল ওই ঘরের দরজার পার্শ্ববর্তী জানালার একটি কাচ। কাচগুলো বসানো আছে যে কাঠের ফ্রেমের মধ্যে, সেই ফ্রেমগুলিকে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিল কয়েকটি স্ক্রু। স্ক্রুগুলোকে সাবধানে আলগা করতেই জানালার কাচ খুলে এল।
এবার সে পকেট থেকে বের করল একটা আঁকশি। আঁকশিটার দৈর্ঘ্য স্যুইচ টিপে বাড়ানো-কমানো যায়। এই আঁকশিটা জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে বাঁদিকে অনেকটা বাড়িয়ে সে বন্ধ দরজার ছিটকিনিটার নাগাল পেল। টান মারতেই খুলে গেল ছিটকিনিটা। হ্যাঁ, ছিটকিনি খুলবার একটা ছোট্ট শব্দ হতেই পারত, কিন্তু লোকটার হাতে ধরা আঁকশিটার মাথায় লাগানো ছিল মোটা কাপড়ের প্যাড দেওয়া চিমটে বিশেষ। ফলে কোনও আওয়াজই শোনা গেল না। দরজা খুলবার পর লোকটা তার রাহাজানির সাজ-সরঞ্জাম ঢুকিয়ে ফেলল নিজের পরনের ঢাউস পার্কা-জাতীয় পোশাকের পকেটে।
হালকা পায়ে একটা বেড়ালের ক্ষিপ্রতায় সে নেমে এল নীচে। খোলা উঠোনে চাঁদের আলোয় চারপাশটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উঠোনে কয়েকটা চেয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসানো আছে, এছাড়া তেমন একটা কিছু চোখে পড়ল না। দ্রুত এদিক ওদিক দেখে নিয়ে সে বুদ্ধিমান চোখে বুঝে নিতে পারল কাজের ঘর কোনটা, অর্থাৎ কোন ঘরে রয়েছে মাস্টার কনট্রোল। কনট্রোল প্যানেলটির সঙ্গে সে যে পূর্ব পরিচিত, ঠিক তা নয়। তবে সহযোগীদের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছে, একটা আন্দাজ করতে পেরেছে ব্যাপারটা কেমন হতে পারে। আপাতত প্যানেলটার মেইন স্যুইচ বন্ধ করে দিতে পারলেই অনেকটা সাফল্য পাবে আজকের মিশন। বাকিটা তারপর দেখে নেওয়া যাবে।
এইবারে সে ঢুকে এল ব্রহ্ম ঠাকুরের বিখ্যাত সেই কনসালটেশন রুমে। অবশ্য গল্পের এই অংশে একটা অপ্রত্যাশিত মোচড় আছে। তার জানবার কথা ছিল না, ঘরটাতে এখন অন্ধকারের অতিথি সে একা নয়। আগে থেকেই এক ছায়ামূর্তি এই লোকটার আগমনের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। সে ঘরে ঢুকতেই ছায়ামূর্তি মনেমনে হিসেব কষল কী যেন। তার হিসেব তাকে চিনিয়ে দিল, ছাদ থেকে নেমে আসা লোকটার মতলব মোটেই সুবিধের নয়।
ছাদ থেকে নেমে আসা লোকটা রংবেরঙের কফির মাগ রাখা টেবিলটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবার একটা কফির মাগের দিকে হাত বাড়াতে গেল এবং…
এবং ঘরটার বদ্ধ বাতাসে ঘুরপাক খেয়েই যেন ভেসে এল একটা গুরুগম্ভীর সতর্কবাণী —ডোনট টাচ। ডোনট টাচ এনিথিং অ্যাট অল।
পেছনদিক থেকে এই বজ্রনির্ঘোষ শুনে লোকটা দারুণ চমকে ফিরে তাকালো। কী দেখল সে ওই ঘন অন্ধকারে? বেশি কিছু না। ভীষণ চমকে উঠে জমাটবাঁধা কালোয় সে শুধু দেখতে পেল সিল্যুয়েটের মতোই ফুটে থাকা এক রহস্যময় ছায়ামূর্তিকে। দেখেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যাওয়া একটা ঠান্ডা শিরশিরানির স্রোত তাকে ভয় পাইয়ে দিল। একটা অপার্থিব ভয়। ভয়, কারণ হিমশীতল রক্তচোখে সেই মূর্তি অপলকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সম্মোহনের কায়দায় উঠিয়ে ছড়িয়ে রেখেছে ফ্যাকাশে সাদা দুটো হাত। হাত দুটো তাকে নিমেষেই বশীভূত করে ফেলল। একটা জড়ভরতের মতোই ‘ধপাস’ শব্দ করে ঘরের জমিতে পড়ে গেল ছাদ থেকে নেমে আসা লোক।
এরপর কী ঘটল, লোকটার আর কিচ্ছু মনে নেই। থাকবেও না। এই সময়বিন্দু থেকে তার সব স্মৃতিই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে।
১৫।
ব্রহ্মের করা প্রশ্নটা শুনে কিশিমোতো একটু অপ্রতিভভাবে তাকালেন। বললেন— আসলে বাবার ওই ছেঁড়া ডায়রিটাকে সেরকম গুরুত্ব আমি দিইনি। বাবার অনেক বয়স হয়েছে, তাঁর পক্ষে তো আর অভিযানে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই হয়তো ওই ডায়রির বিষয়ে তাঁরও আর তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। ডায়রিটা তোকিয়োতে আমাদের গবেষণাকেন্দ্রেই রাখা ছিল, ওই পুরনো বইপত্র যেমন থাকে, তেমনই গাদা করে রাখা কাগজের মধ্যে। ওই গবেষণাকেন্দ্রে বিটিটু প্রকল্পের কাজেই যাতায়াত ছিল বিলি গিলচারের। সেরকমই কোনও একটা সফরে বিলির হাতে পড়ে যায় ডায়রিটা। এ ব্যাপারে ওকে নম্বর দিতেই হবে, যে ও আবর্জনার স্তূপ থেকে এমন একটা সম্পদ খুঁজে বের করেছে। ডায়রিতে লেখা তথ্যের যে এমন প্রয়োগ ঘটতে পারে, তা আমি ভাবিইনি। তেমন ভাবলে চোখেচোখে রাখতাম, লুকিয়ে রাখতাম।
ব্রহ্ম বললেন— একটু আগে যখন তুমি বললে যে তুমি বিলির নেতৃত্বে হওয়া এই পারমাণবিক গবেষণাকে সন্দেহের চোখে দেখেছিলে প্রথমে, তক্ষুনি বুঝে গেলাম তুমি ওর হাতে তোমার পিতার ডায়রিটি তুলে তো দাওইনি, বরং বিলির সঙ্গে এই ডায়রিটা নিয়েই তোমার বচসা হয়েছিল। তার মানে বিলি এটা তোমার অজ্ঞাতসারেই তার দখলে নেয় এবং তারপর চেষ্টা করে তোমায় প্রভাবিত করতে—
— আপনার আন্দাজ সঠিক। এবারেই যখন বিলি তোকিয়ো এলো, ওর হাতবাক্সের মধ্যে এক ঝলকে আমি হঠাৎ ডায়রিটার মলাটটা দেখে ফেলি। মেরুন রঙের একটা প্রচ্ছদ, উপরে ইংরেজিতে লেখা সালের তারিখ। মলাটের উপরের ডান কোণে বাবা একটা নকশা এঁকেছিলেন। সেটা দেখেই মনে হল— আরেহ, এটা তো আমাদেরই! এটা ওর ব্যাগে কেন? তক্ষুনি গিয়ে গবেষণাগারের পুরনো কাগজ আর বইয়ের তাকগুলোতে খুঁজে দেখি, ওটার যেখানে থাকবার কথা ছিল, সেখানে নেই। আসলে শুরুতে একটা ড্রয়ারে বাবা রেখেছিলেন এই ডায়রিটা। বেশ কিছু বছর আগে কয়েকটা আসবাবপত্রে ঘুণ ধরে যায়। সেগুলো ফাঁকা করতে হয়। তখনই ওই বইয়ের স্তূপ তৈরি হয়েছিল। এটা আমারই অবহেলা বলতে পারেন— অন্য এক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় পুরনো ডায়রিটাকে সঠিক মর্যাদা আমি দিইনি। সেদিন ওই তাড়া করে রাখা কাগজপত্র-বই-ম্যাগাজ়িন এসবের মধ্যে যখন ডায়রিটা পেলাম না, তখন সোজা গিয়ে বিলি গিলচারকে চেপে ধরি। বলি— ‘বাবার ডায়রি আপনার বাক্সে কী করে গেল?’ ও তখন আমাকেই উলটে আক্রমণ করল। বলল— ‘তোমার লজ্জা করে না, ওরকম একটা ডায়রি ওইভাবে নষ্ট করছিলে? তোমার তো আমায় ধন্যবাদ দেওয়া উচিত যে আমি এটা উদ্ধার করেছি, সদ্ব্যবহার করছি!’ বিলির কথামতে, ডায়রিটা ওর কাছে থাকাটা পুরনো ব্যাপার, আমার বাবা নাকি ওর এই গবেষণার কথা আগে থেকেই জানেন, তিনি সম্মতিও দিয়েছেন!
— তা তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলে না কিছু?
— করলাম তো! বাবা বললেন, বিলি নাকি তাঁকে গিয়ে বলেছিল— ‘আপনি এই ডায়রির কথাটা পাঁচকান করবেন না, জানি। করলে আপনার ক্ষতি তো হতে পারেই, কারণ এর মধ্যে যে এতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, তা আমাদের শত্রুপক্ষের কানে গিয়ে পৌঁছলে সমূহ বিপদ হবে। তবে আপনার প্রাণসংশয় হলেও আপনার ছেলের ব্যাপারে চিন্তা করবেন না, ওটা আমি সামলে নেব।’ এটাকে বাবা স্বাভাবিকভাবেই প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে ধরে নেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে বিলি ঘুরিয়ে বলছেন— ওঁর অবর্তমানে আমার ক্ষতি করা হবে। যদিও সে কথা প্রমাণ করা যায় না, কারণ বিলি মুখে তো ঠিক উলটো কথাই বলেছে! যাই হোক, আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তখন নাকি তিনি বিলিকে ডায়রিটা নেওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দিতে বাধ্য হয়েছেন, বাধা দিতে পারেননি। আর এবার—
— বুঝেছি। বিলি এবার ঠিক উলটো চালে, তোমার বাবার নিরাপত্তার ভয় দেখিয়ে তোমার মুখ বন্ধ করেছে। কিশিমোতো একজন হলে এভাবে দু’জনকেই দু’জনের নিরাপত্তার ভয় দেখিয়ে হাত করা যেত না। তবে কিশিমোতো, বিলির বিরুদ্ধেও কিন্তু বিরাট নালিশ আনা যাবে না। হাজার হোক, এ ধরনের প্রকল্পে যোগদানকারীকে তো মুখ বন্ধ রাখতেই হয়, সেটাই হল প্রাথমিক শর্ত। নিশ্চয়ই এবার বিলি তোমায় বলেছে— ‘তোমার বাবার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি আছি তো!’ এভাবে বিলি ঠিক উলটো কথা উচ্চারণ করে হালকা ভয়ও দেখিয়েছে, আবার চুপ করে থাকবার পুরস্কার হিসেবে তোমাকে এই পারমাণবিক গবেষণায় যোগদানের টোপও দিয়েছে। তড়িঘড়ি পরিকল্পনা বদলে অর্থাৎ ইজু আরকিপেলাগোতে না গিয়ে তোমায় নিয়েই আন্দামানে এসেছে এই প্রকল্পে তোমায় যুক্ত করাতে। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে এখন ছবির মতো স্পষ্ট। তবে ওর এবারে আন্দামানে আসবার মুখ্য কারণটা কিন্তু অন্য। তোমাকে আনাটা সেকেন্ডারি। ভাল করে ভেবে বলতো— ওর হাতবাক্সের মধ্যে বা ওর কাগজপত্রের মধ্যে তুমি কি একটা ম্যাগাজ়িন দেখতে পেয়েছিলে? ‘ডিসকভার’ সায়েন্স ম্যাগাজ়িনের লেটেস্ট ইস্যুটা?
প্রশ্নটা কিশিমোতোকে ছুড়ে দিয়েই ব্রহ্ম ঠাকুর একটানে তাঁর আলখাল্লার বুকের কাছের এক গুপ্ত পকেট থেকে বের করে আনলেন নৃতত্ত্ব মিউজ়িয়ামের দোতলার র্যাক থেকে তুলে নেওয়া ম্যাগাজ়িনটা। তারপর সেটা মেলে ধরলেন কিশিমোতো জুনিয়রের চোখের সামনে।
(ক্রমশ)
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র