মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২, করোনা-কবলিত এই সংকটকালের মধ্যে কিছুদিনের জন্য কিছু ক্লাসরুম খোলা হলেও, সব ক্লাসরুম খোলা যায়নি করোনার আতঙ্কে। বন্ধ ক্লাসরুমে সার-সার বেঞ্চে, স্যারের চেয়ার-টেবিলে ধুলোর আস্তরণ, নীরব দেয়ালের আনাচেকানাচে মাকড়শার অবাধ সংসার। নতুন গড়ে ওঠা ক্লাসরুমের কথা ছেড়ে দিলাম, হয়তো এই দীর্ঘ নীরবতা কোনও সুপ্রাচীন ক্লাসরুমও তার স্থাবর-জীবনে প্রত্যক্ষ করেনি। অথচ ক্লাসরুম মানেই ছোট-বড় ছাত্রছাত্রীদের নানারকমের কোলাহল, কৌতূহলভরা এক স্থল। পর্যায়ক্রমে শৈশবের উচ্ছাস, কৈশোরের উদ্দীপনা আর যৌবনের স্পর্ধার ভাষামহল তো ওই ক্লাসরুম! ক্লাস চলাকালীন একরকম, আবার অফ-পিরিয়ডে ‘ফুল-অন’, আদতে তখনই ছাত্রছাত্রীদের আসল ‘ক্লাস’ চেনা যায়। যেমন পড়ানোর সময়ে মাস্টারমশায়ের ভাষার ধরন একরকম, রেগে গেলে তাঁর ধার-ধমকের চমক আলাদা। একদিনের একটি ক্লাস-রুটিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই বাঁধা, কিন্তু বিষয়বিন্যাসে, উপস্থাপনায়, উচ্চারণে, উত্তরদানে ভিন্ন-ভিন্ন। বিষয়গত ভাষার ভিন্নতা বাদ দিলেও শুধুমাত্র পারস্পরিক সংযোগে গড়ে ওঠা ভাষা-বৈচিত্র্যের এক অনন্য জগৎ হল ক্লাসরুম।
সময়ের উজানে গেলে দেখা যাবে, ফেলে আসা সময়কালের ভাঁড়ারে সঞ্চিত আছে সেদিনের ক্লাসরুমে ব্যবহৃত ভাষার রকমারিত্ব। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বদলের সমান্তরালে বদলেছে শিক্ষালয়, শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধরন, ফলস্বরূপ বদলেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আলাপচারিতা, বদলেছে ভাষায় ব্যবহৃত শব্দাবলি। যেমন গুরুমশাই থেকে মাস্টারমশাই হয়ে আজকের সম্বোধনে ‘স্যার’। উনিশ শতক তো দূর, বিশ শতকের মাঝামাঝিতেও দিদিমণি, ম্যাডাম, ম্যাম ডাক বিরল। টোল, চতুষ্পাঠী, আটচালা, পাঠশালার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজকের স্কুল এবং ক্লাসরুম। ততদিনে পাঠদানে, পাঠের উপকরণেও ঘটেছে বিস্তুর বদল। সেদিনের পাঠশালায় পড়াশোনার শ্রেণিবিন্যাস ছিল মেঝে-তালপাতা-কলাপাতা-কাগজ। তালপাতা থেকে কলাপাতা বা কলাপাতা থেকে কাগজে উত্তীর্ণ হওয়া মানে পোড়োর (পড়ুয়া) বাড়িতে উৎসব লেগে যেত। গুরুমশাইকে সিধে দিতে হত, ক্ষেত্রবিশেষে ঘটি, বাটি উৎকোচ পর্যন্ত। পাঠশালা চলত সকাল থেকে বিকেল, জলখাবারের সময় এড়াভাতের ছুটি, আর দুপুরবেলায় গরম ভাতের ছুটি। শেষ বেলায় সমবেতভাবে নামতা অথবা ডাক-বলাবলি। তারপর ছুটির চিৎকার, পরবর্তীকালে এই সোল্লাসে জুড়ে ছিল দু-ছত্র আনন্দগান, ‘ছুটি,ছুটি,ছুটি/ গরম গরম রুটি’। এছাড়াও সময়ে-সময়ে তালপাতা, তক্তি, শ্লেট ধোওয়ার সুবাদে ছোট-ছোট ছুটির ফুরসত মিলত। তবে অহেতুক দেরি গুরুমশায়ের নজরে পড়লে, একেবারে বাঘ-হুংকার ‘ক্যারা, বেতখানা কই রে…!’ হাড় হিম করা সেই বজ্রনির্ঘোষই ছিল কড়া পণ্ডিতমশায়দের এক বড় মূলধন। স্মরণে আসবে অপুর পাঠশালায় প্রসন্ন গুরুমশায়ের সেই গুরুগম্ভীর জিজ্ঞাসা, ‘…হাসচ কেন খোকা, এটা কি নাট্যশালা? অ্যাঁ! এটা নাট্যশালা না কি?’ বা একটু পরে-পরেই ‘… এসব কী খেলা হচ্ছে শ্লেটে? সতে ধরে নিয়ে আয় তো দুজনকে, কান ধরে নিয়ে আয়।’ এই সতে হল সুবোধ বালক গোপালের প্রতিনিধি, পড়াশোনায় ভাল নিয়মনিষ্ঠ, ফলে মাস্টারমশায়-ঘনিষ্ঠ। সাধারণত এরাই হত ‘সর্দার পোড়ো’, পরবর্তীকালের ‘মনিটর’। এক সময়ে প্রয়োজনবোধে এরা নীচু ক্লাসে-পড়া শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছে, আর পড়া না-পারাদের বেত্রাঘাতের জন্য মাস্টারমশায়ের হাতে ধারাবাহিক ভাবে বেত জুগিয়েছে, এমনকী শাস্তির ভয়ে লুকিয়ে থাকা অপরাধীকে গুরুমশায়ের বেতের নাগালে এনে দিয়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেছে। শিকারকে শিকারির সমীপে পৌঁছে দেওয়ার তালে তাল দিয়ে আওড়ানো হত ছড়া—
‘গুরুমশায়, গুরুমশায় আর বলব কী
বেত বনের আসামি হাজির করেছি।
রাম তুলসী, রাম তুলসী, রাম তুলসীর পাতা
গুরুমশায় কয়ে দেছেন কান মলার কথা।’
তবে এ-কথা অনস্বীকার্য, পড়াশোনার বাইরে, শিখন-সংক্রান্ত শব্দের সীমা পেরিয়ে একজন মাস্টারমশায়ের বেশির ভাগ আঁতের কথা বেরিয়েছে কিন্তু দুষ্টু অবাধ্য রাখালদের অ-সৌজন্যে। পাঠশালা বা স্কুল চিরকালই স্যারেদের ‘ভোকাল’ ও ‘ভোকাবুলারি’র পরীক্ষা নিয়েছে লাস্ট-বেঞ্চাররাই। কেননা, ক্লাস চলাকালীন কাটাকুটি খেলা, ইশারা-ইঙ্গিত, চিঠি-চিরকুট চালাচালি, চিমটি কাটা, জান্তব শব্দ, স্যার-ম্যাডামদের ইউনিক নেম, তাঁদের মুদ্রাদোষ, তাঁদের নামে গান-কবিতা রচনা প্রভৃতি ওই পিছনের সারিতে সার দিয়ে থাকা অনন্য প্রতিভাধরদের। আর এই অভিনব বিচিত্র প্রতিভার উদ্দেশ্যেই বরাবর বর্ষিত হয়েছে মাস্টারমশায়দের বাক্যবাণ। যদিও এখন শাস্তিতে নিষেধাজ্ঞা তো আছেই, এমনকী কোনওরকম কটুশব্দও ব্যবহার অনুচিত। আজকের কোনও শিক্ষক, কোনও ছাত্রের উদ্দেশ্যে কি বলতে পারবেন, ‘অ্যাই ড্যাকরা, পড়ে-পড়ে ল্যাখ তুই ব্যাটা বড় হারামজাদা!’ না, বলা যাবে না। এমনকী তাদের উদ্দেশ্যে গোরু, গাধা, বাঁদর, প্রভৃতি চতুষ্পদী সম্বোধন নৈব নৈব চ। অথচ গত শতকের নয়ের দশকে আমরা যারা স্কুলে পড়েছি, মাস্টারমশায়দের কাছ থেকে এ-জাতীয় শব্দ খুব স্বাভাবিক নিয়মে প্রায়শই তেল-সাবানের মতো গায়ে মেখেছি, কোথাও কোনও ফোস্কা পড়েনি। আর একটু পিছিয়ে গেলে বাবা-কাকাদের পাঠশালায় বেল্লিক, জানোয়ার, গর্দভ, মর্কট, রাস্কেল পর্যন্ত দেদার বর্ষিত হত, এবং তাঁরা অধোবদনে তা শিরোধার্য করতেন। আর শুধু কি সম্বোধন, তখন শাস্তিরও খুব নামডাক ছিল। উনিশ শতকের পাঠশালায় হাতছড়ি, ছাট, নাড়ুগোপাল, হাঁটুগাড়া, বিছুটি লতার ঝাড়, ঘাড় ঝিঁকরে, একপায়ে খাড়া, ঘোড়দৌড়, চটাচট প্রভৃতি শাস্তি ছিল জলভাত। ইংরেজি ও ফারসি স্কুলে ছিল ফ্রেল দিয়ে মার, নীলডাউন। আর ছিল বাজখাঁই গলায় ‘ক্যারা ছোঁড়া’। এবং এই হুংকারেই অবাধ্য বেয়াদপ ছাত্রদের পিলে চমকে যেত। ‘কেঁড়েলের জীবনচরিত’-এ, মনোমোহন বসুর পরিভাষায়, ‘… নেত্রজল শুখাইয়া মূত্রজলে পুঁথি মাদুর ভাসিয়া গেল।’ তবে এই বুনো-ওল মাস্টারমশায়ের বিপরীতে বাঘা-তেঁতুল মার্কা ছাত্রও ছিল। সেরকম এক অভিনব বেয়াদপ ছাত্রের ক্লাস-কবিতার একটু নমুনা দিই। (সূত্র : প্রদীপ, পৌষ ১৩০৭) মাস্টারমশায়ের অঙ্কের ক্লাস চলাকালীন শ্লেটে বড়-বড় অক্ষরে লেখা :
‘হেডমাস্টার মুদে কামড়
তার নীচেতে নবনে বানর
নবনে বানর বেড়ায় গাছে
বেণী বাঘ তার নীচে আছে।
বেণী বাঘের দাঁত খিটমিটি
ফোর্থ মাস্টার বামা টিকটিকি
গুপে পণ্ডিত নষ্টের গোড়া
বিদ্যা বুদ্ধি কচু পোড়া।’
মদনমোহন নামক ছাত্রের শ্লেটপাথরে যাচাই করা এহেন সাহিত্য-নমুনা চোখে পড়ে গেল ‘বাঘ’ বিশেষণে বিশেষিত অঙ্কের মাস্টার বেণী চক্রবর্তীর। ব্যস, তারপর যা হবার তাই হল। প্রথমে উত্তম-মধ্যম তারপর বেঞ্চের উপর একপায়ে খাড়া। কিন্তু তারপরও স্বভাবকবি ছাত্রের কবিতা-ছত্রে কোনও মিলের অভাব পড়েনি। তাই আবার একদিন মিলে গেল, সেদিনের শাস্তিজনিত একটি অনবদ্য পদ্য :
‘ফোর্থ কেলাসে থার্ড মাস্টার ফোর্থ জানুয়ারি
করে দিলে বেঞ্চির উপর মোহন বংশীধারী।
বেণী মাষ্টার মানুষ-বাঘ সদাই থাকে চোটে
চক্ষু দুটি মুদিত সদা পাছে নেশা ছোটে।
আর জন্মে বোলতা ছিল বেণী মাস্টার ***
এ জন্মে তার হুলের বিষে প্রাণটা ঝালাপালা।’
সবার জ্ঞাতার্থে জানাই, বেণী মাস্টারের আফিমের নেশা ছিল, আর এটা নিশ্চয় জানানোর দরকার নেই যে, পদ্যমধ্যে ওই তারকাচিহ্নিত স্থানে ‘ঝালাপালা’র সঙ্গে কী ‘সম্বন্ধী’য় শব্দ ছিল।
বদরাগী শিক্ষক আর বেয়াদপ ছাত্রের রসায়নে ক্লাসরুমের ভাষা, বরাবরই শিক্ষণের সীমা লঙ্ঘন করে এক অন্যমাত্রার ভাব ও ভাষা গড়ে তুলেছে। আমাদের স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন নরহরিবাবু, একদিন ক্লাস টেনের জনাদশেক ছাত্রকে সঙ্গত কারণেই দিলেন বেধড়ক মার। পরের দিন ক্লাসরুমে দেয়াল লিখন— ‘নরসিংহ নরহরি/ ভয়ে কাঁপি থরহরি’। খুব মারকুটে ছিলেন ভাস্করবাবু। মেয়েদের বিরক্ত করার অপরাধে একদিন জিতেনের পিঠে অবিরাম সপাং সপাং। এরপর ইটের চাকলা দিয়ে দেয়ালে লেখা, ‘ভাস্কর স্যার একটি শয়তান।’ এছাড়াও ক্লাসরুমের লিখন হিসেবে, ফি বছর ক্লাস টেনের ছেলেরা নিজেদের নাম দেয়ালে বা বেঞ্চে কম্পাসের কাঁটা দিয়ে লিখে যেত। পরীক্ষার প্রাক্কালে কেউ-কেউ বেঞ্চে বা দেয়ালে লিখে রাখত বীজগণিতের সূত্র, ইতিহাসে যুদ্ধ ও সন্ধির সন-তারিখ। ক্লাসরুমের ঘেরাটোপে বয়ঃসন্ধির ইতিউতি চাউনি থেকে বন্ধুমহলে ফিসফাস গুঞ্জনের প্রতিফলন উঠে আসত দেয়ালে, তিরবিদ্ধ হরতনী ছাঁদের হৃদয় মাঝে লেখা S+M. শুধুমাত্র দুটি নামের আদ্যাক্ষর। কিন্তু ক্লাসসুদ্ধ সবাই জানে এর নেপথ্য রসায়ন। এইভাবেই প্রতিটি ক্লাসরুমের দেয়ালে, বেঞ্চে বছর-বছর কত বিচিত্র-ভাষ ভেসে বেড়ায়, মুছে যায়, আবার লেখা হয়।
স্কুল, কলেজ, ক্লাসরুম, তার উপকরণ যত দ্রুত বদলাচ্ছে, ততই বদলাচ্ছে তার ভাষা। তখন শিক্ষার উপকরণ ছিল ওই পাততাড়ি, পুথি, বেত্রী, চট, চেটাই আর কিছু পুস্তক। আর পুথিপত্রকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্য লাল শালুতে মোড়া দপ্তরী। আমরা প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন নিয়ে যেতাম অ্যালুমিনিয়ামের ছোট্ট বাক্স, স্কুলে হাত ব্যাগ, এখন রুকস্যাকের ঢঙে পিঠে স্কুল-ব্যাগ। লেখনীর ক্ষেত্রে তালপাতা, কলাপাতা তামাদি হয়ে শ্লেটও গেছে হারিয়ে, দোয়াত-কালি, খাগের কলম, ঝরনা কলম সময়ের গহ্বরে। এখন কাগজ কলমই অস্তিত্বের সংকটে। করোনা-অতিমারী সর্বত্র নিয়ে এল ‘অনলাইন ক্লাস’, নানান ‘অ্যাপ’, ‘ওয়েবিনার’। অডিও, ভিডিও মাধ্যমে ডিজিটাল ক্লাসের ধারণাও এগিয়ে আসছে। পাঠশালার পর্ব শেষ, সেই ইস্কুল নেই, স্কুল হয়ে যাচ্ছে ই-স্কুল। এই ই-স্কুল স্বরাগমের উদাহরণ ও সরগরমের স্থল ইস্কুল নয়, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট পরিচালিত ই-স্কুল। ভয় হয়, একদিন হয়তো হারিয়ে যাবে ক্লাসরুম, হারিয়ে যাবে ছাত্র শিক্ষকদের সংযোগ ও সম্পর্ক। হারিয়ে যাবে ক্লাসরুমের ভাষা।
*শব্দার্থ : সিধে— চাল, ডাল, শাকসবজি (সিদ্ধযোগ্য খাবার), এড়াভাত— বাসিভাত/পান্তাভাত, ডাক-বলাবলি— একসাথে সুর করে মুখে-মুখে বলা অঙ্ক, তক্তি— কাঠের দোয়াত, ড্যাকরা— অভদ্র, বেল্লিক— বেহায়া নির্লজ্জ, মর্কট— ছোট বানর বিশেষ, রাস্কেল— পাজি/বদমাশ, নাড়ুগোপাল— একপ্রকার শাস্তি (হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বসে, একটি হাত সামনে প্রসারিত সেখানে হাতে নাড়ুর পরিবর্তে এক থান ইট), চটাচট— দ্বিখণ্ডিত বাখারি দিয়ে সশব্দে মার, পাততাড়ি— লেখার জন্য তালপাতার তাড়া/বোঝা, চেটাই— তালপাতার তৈরি আসন।