নাট্য সমালোচনা: চেতনার ‘অপ্রিয় সত্য’
নাট্যকার হিসেবে সুমন মুখোপাধ্যায়ের এমন এক দর তৈরি হয়েছে যে কেউ হাঁকডাক পাড়ুক না-পাড়ুক ‘তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত’, ‘মেফিস্টো’র কথাই বারে বারে আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। নিদেনপক্ষে ‘গন্তব্য’ বা ‘বিসর্জন’ বা ‘যারা আগুন লাগায়’-এর গতের কাজ না হলে যেন সুমনের নামের পাশে খাপ খায় না। বছর আটেক আগে বাহির পথে বিবাগী হয়ে আরব সাগরের লোনা হাওয়া খেয়ে এসেছেন সুমন। কলকাতায় ফেরার পর থেকে মোটের ওপর পুরোনো নাটকের কেঁচে গণ্ডূষ করেছেন। নতুন নাটক করেননি। এবারে করলেন। ঘরের দল চেতনার প্রযোজনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল ‘অপ্রিয় সত্য’। গেল ৭ জানুয়ারি দুপুরে-সন্ধেয় একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে দু-দুটো শো হল সুমনের নতুন নাটকের।
বলছি বটে ‘সুমনের নতুন নাটক’, আসলে ‘অপ্রিয় সত্য’র আদত নাটককার রাজীব নায়েক। আধুনিক মরাঠি নাটকের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর অর্থাৎ তেন্ডুলকর-এলকুঞ্চওয়র-আলেকরে মজে থেকে আমরা সবসময় খেয়াল করি না যে গত তিন দশকে ঢের এগিয়ে গেছে মরাঠি নাটক। শিরীষ অঠবালের মতো দুয়েকজনের নাটক আমাদের এখানে হয়েওছে। গান্ধারের ‘কাছের মানুষ’ মনে পড়ে? ওটা শিরীষের লেখা। রাজীব নায়েকের ‘শাঠেচা কে করেচা?’ বাংলায় আগে হয়েছে। আজ থেকে ছ বছর আগে, কনকনে শীতের মরসুমে, এই একাডেমিতেই, থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক করেছিল ‘মিত্রকে নিয়ে কী করিতে হইবে?’ জয়রাজ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় জয়রাজ আর দামিনী বসু তাতে অভিনয় করেছিলেন। বেশি শো হয়নি, তবে স্বল্প আয়োজনে অল্প আয়াসে আমাদের মনে দাগ কেটেছিল সেই নাটক। জয়রাজের গুরু সুমন এই নাটকটাকেই ফের মঞ্চে আনলেন। অনেক দিনের সহযোগী উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের হাতে এর বাংলা রূপান্তর হল ‘অপ্রিয় সত্য’।
হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কানায় কানায় ভরা একাডেমিতে ঢুকে মনে হচ্ছিল, এই নাটকটা সুমন বাছলেন কোন আক্কেলে? বাঘের পিঠে সওয়ার-হওয়া যাঁর কাছে জলভাত, তিনি হরিণশাবকের পিছু নেবেন কেন? সময়টাকে কামড়ে-ধরা যাঁর সহজাত শিল্পধর্ম, তিনি পুরোনো ধাঁচার রিলেশনশিপ ড্রামার চক্কর কাটতে যাচ্ছেন কোন দুঃখে? এও ভেবেছি যে সুমন এর আগে ‘ফাল্গুনী: সূচনা পর্ব’, ‘কালান্তক লাল ফিতা’ বা ‘শূন্য শুধু শূন্য নয়’-এর মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের হিরেমানিক পয়দা করেছেন। কোনোটাই বড়ো মাপের নাটক নয়। আবার এও জানি যে সে-সব বিভাস চক্রবর্তীর ফুসমন্তরে, নাট্যস্বপ্নকল্পের মাঝরাত্তিরের খোরাকি হিসেবে তৈরি করা। আজকালকার তুমুল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘অপ্রিয় সত্য’ নির্দেশনা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের বেশ ফাঁপরেই ফেলেছিলেন সুমন।
ধান ভানতে শিবের গীত অনেক হল। এবারে বলি, কেমন দাঁড়াল সুমনের নতুন নাটক।
‘অপ্রিয় সত্য’ নামের মধ্যেই এর রত্নবস্তু বিদ্যমান। সত্য (সুজন মুখোপাধ্যায়) নামের এক ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারের খুব নামডাক হয়েছে আজকাল। ছেলে-বুড়ো-ছোঁড়া-খুড়ো সবাই এই সত্যর নামে মুচ্ছো যান। সত্যর বিভূতি পেলে বর্তে যায়। কৃপাদৃষ্টি পেলে কৃতার্থ হন। না, এই সত্য আদপে সত্যজিৎ রায় নন। তবে বিদেশে না হোক, দেশ জুড়ে তাঁর খ্যাতি ক্রমবর্ধমান। আর এটাই আমাদের নাটকের নায়ক অভয়ের (দেবশঙ্কর হালদার) গাত্রগাহের কারণ। ফিল্মের প্রিমিয়ারে সত্যকে ঘিরে মধুচক্র জমে ওঠে। দেখে পিত্তি জ্বলে যায় অভয়ের। বিদেশি ফান্ডিং এজেন্সি যাতে সত্যকে ছপ্পড় ফাড় কে খয়রাতি না করে তার জন্য ঘুষ দিতেও আটকায় না অভয়ের। অবিশ্যি অভয় এলিতেলি নন, অ্যাড-ফিল্মমেকার হিসেবে তাঁরও কদর আছে। ছোটো একটা ফিল্ম ইউনিট আছে। আরও বড়ো স্টুডিও করার বাসনা আছে। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে অমিত আকাঙ্ক্ষাও আছে তাঁর। মুশকিল হয়েছে কী, সত্যর মাপে নিজেকে না বসাতে পারলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না তিনি। বাংলায় যাকে শাঁখের করাত বলে, সত্য তাঁর কাছে তাই। অভয়ের স্ত্রী সলমা (সেঁজুতি রায় মুখোপাধ্যায়) ব্যাপারটা জানেন। কলেজে ইংরিজি সাহিত্য পড়ানোর পাশাপাশি ঘরকন্না সামলাম এবং স্বামীর এহেন হিংসুটেপনা নিয়ে খুনসুটি করেন। মাত্রা রেখেই করেন। অভয়ের ঈর্ষা যাতে ছেলেমানুষির স্তরে নেমে না যায় সেদিকে নজর রাখেন। এই নিয়ে নাটক এগোতে থাকে।
রাজীবের নাটকে সত্য আড়ালে ছিলেন। মেঘের আড়ালে শূন্যের মতো। সুমন তাঁকে মঞ্চে নিয়ে এলেন। রিয়্যালিস্টিক ড্রামার মোড়ক ছাড়িয়ে একটু ফ্যান্টাসি এলিমেন্ট জুড়ে দিলেন। কোনো স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের খেই ধরে নেই, এমনিই। উজ্জ্বলের হাতযশে এমন কিছু সংলাপ জুড়ে গেল সত্যর মুখে যে অভয়-সলমার ড্রয়িংরুমের মধ্যে দিব্যি আনাগোনা চলতে থাকত তাঁর। দুই কুশীলব তাঁকে দেখেও দেখলেন না, অথচ আমরা ওই ত্রিমুখী টানাপড়েন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। ‘অপ্রিয় সত্য’র ভারী মঞ্চসজ্জায় এমন কোনো মুন্সিয়ানা ছিল না। তারই মধ্যে সত্য ওরফে পনিটেল-দোলানো সুজনকে আনাগোনা করার সুরাহা করে দিলেন সুমন। আলোক পরিকল্পক সৌমেন চক্রবর্তী একটু আলাদা করে নজর দিলেন তাঁর দিকে। তেলে-জলে মিশ খেল না, আবার আমাদের চেনাজানা চৌহদ্দিতে এমন কোনো ধাক্কাধাক্কি লাগল না যে পরিপাকে অসুবিধে হবে। নিজের ডিরেক্টর তকমার আগে আজকাল ‘ডিজাইন’ কথাটা জুড়ে দিচ্ছেন সুমন। এটা ওই থিয়েটার ডিজাইনারের কামাল। এন্তার সুইঁফোঁড় হল, অথচ সেলাইয়ের দাগ চোখে পড়ল না।
নাটক শুরু আগে যে আবহসংগীত বাজছিল তাতে ১৯৯০র দশকের মাঝামাঝি সময়কার টেলিভিশন কমার্শিয়ালের টুকরোটাকরা শুনছিলাম আমরা। রাজীব নায়েক এই নাটকটা লিখেছিলেন ১৯৯৮তে। সুমন ওই সময়কালকে টেনেহিঁচড়ে আজকের দিনে আনেননি। ল্যাপটপের বদলে অভয়ের নাকের ডগায় ডেস্কটপ কম্পিউটার বসিয়ে দিয়েছেন। ঠিক করেছেন। মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে যে অনন্ত জটিলতায় বেঁধেছে (এবং ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে) তার আঁচ লাগতে দিলে রিলেশনশিপ ড্রামার টানটান মেজাজ টসকে যেত। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জায়গাটাও আখেরে নড়বড়ে হয়ে যেতে পারত।
তা বলে ‘অপ্রিয় সত্য’ কোনো ছাপোষা ড্রয়িংরুমে ড্রামা নয়। এর আপাত সরল গতিপথের অন্ধিসন্ধিতে উঁকি মারছে নাগরিক দাম্পত্যের এক আধুনিক রূপ। উজ্জ্বল তাঁর নাট্যরূপে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতা উদ্ধার করেছেন, বিবাহবার্ষিকীতে নায়ক মিলান কুন্দেরার নতুন উপন্যাস উপহার দিয়েছেন নায়িকাকে – এসবের মধ্যে বিদগ্ধবিধুর যে প্রণয় আখ্যান সশরীরে বর্তমান, তার মধ্যে কি ফাটলের চিহ্নও দেখাননি তাঁরা? দেখিয়েছেন। সত্যর ডকুমেন্টারি ফিল্মের প্রোজেক্টে জেফ্রি চসারের ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলসে’র রেফারেন্স লাগবে বলে সলমাকেই এত্তেলা পাঠিয়েছেন সত্য। কার্যোদ্ধার করার জন্য সলমা আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছেন, জ্বলেপুড়ে খাক হয়েছেন অভয়। মাঝেমাঝে গুটিসুটি মেরে যাওয়া-আসা করেছে এলিয়টের কবিতার পংক্তি, বিশেষ করে ‘হলো মেনে’র “বিটউইন দ্য আইডিয়া এন্ড দ্য রিয়্যালিটি ফলস দ্য শ্যাডো”। মডার্নিটির এই মোক্ষম মোচড়ে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার যতেক ঘুণপোকা আমাদের চোখের সামনে উঠে এল। আপস্টেজে একটা হোয়াইটবোর্ড রেখে তাতে ক্রমাগত আঁক কাটার উপলক্ষ করে ওই ঘুণপোকাদের নজরটান দিলেন সুমন। সেঁজুতি গোটা গোটা হরফে যে ঠেকা দিয়ে গেলেন, তা মূল নাটকের সুর-তাল-লয়ের সমান্তরালে এক নিজস্ব পরিসর গড়ে নিল।
‘অপ্রিয় সত্য’র মতো নাটক অভিনয়কেন্দ্রিক। সুজনের কথা আগেই বলেছি। সত্যর উঁচকপালে চরিত্রায়ণে দিব্যি মানানসই তিনি। দেবশঙ্কর হালদারকে নিয়ে কিঞ্চিৎ সংশয় ছিল। হাল আমলে যে ধরনের ঢালাও চরিত্রায়ণে তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তাদের যতেক মুদ্রাদোষকে আড়াল করে অভয়ের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা জীবনানন্দীয় বিপন্ন বিস্ময়কে তিনি সেঁচে বের করতে পারবেন তো? বলতে ভালো লাগছে যে তিনি অনেকটাই পেরেছেন। অভয়ের অন্তর্গত ছটফটানি বের করে আনা তাঁর কাছে জলবৎ তরলং ছিল, বাদ সাধতে পারত সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক অভিনয়ের জায়গাগুলো। মেথড অ্যাক্টিংয়ের ভিত পোক্ত থাকায় দেবশঙ্কর এ যাত্রায় তরে গেলেন। কতক একই কথা প্রযোজ্য সেঁজুতির বেলায়। যে রঙ্গশালায় তাঁর তৈরি হওয়া তাতে করে সলমার চরিত্রের আঁতের কথা বের করে আনার তরিকা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। একটুও চাঞ্চল্য না দেখিয়ে – দরকার মাফিক ফোঁসফাঁস করে – সলমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সেঁজুতি। তাঁর হাতে বারেবারে আইফর ইভান্সের ‘আ শর্ট হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচর’ তুলে দিয়ে ইংরিজি সাহিত্যের অধ্যাপিকার প্রতি বেশ অবিচার করেছেন সুমন। ও বই আমরা গ্র্যাজুয়েশনের অ্যাডমিশন টেস্টের পর ছুঁয়ে দেখিনি। তাছাড়া সাত তারিখ সন্ধের শো-তে সেঁজুতির মুখে চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলসে’র বদলে ‘পিলগ্রিমস প্রগ্রেস’ শুনলাম। গোত্র এক হলেও সেটা জন বানিয়ানের লেখা। এসব খুঁটিনাটির দিকে নজর দেওয়া দরকার। এর বাইরে যা রইল তা হল রসায়ন – দেবশঙ্কর-সেঁজুতির নিখাদ রসায়ন। এমন দুটো চরিত্র ওঁরা পেয়েছেন যে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে ক্রমে কন্দের কাছে পৌঁছে যাওয়াটাই এর ভবিতব্য। মহড়ার মওকা পেলে ভালো, নইলে শোতেই মুলাকাত জমবে আরও।
শেষে ফিরি সুমনের কথায়। স্টেজক্র্যাফটে সুমনের সিদ্ধি অবিসংবাদিত। আমাদের অগতির গতি একাডেমি অফ ফাইন আর্টস যতই মান্ধাতার আমলের হোক, এবং ইঁদুর-বাদুরের মৃগয়াভূমি হোক, তাকে প্রযুক্তিবান্ধব করে তুলতে চেষ্টার কসুর করেননি তিনি। মনে হচ্ছে, বড়ো একটা নাটক করার আগে নতুন করে হাত পাকাচ্ছেন। লম্বা বিশ্রামের পর ওয়ার্ল্ড কাপে নামার আগে বিরাট কোহলি যেমন টুক করে একটা রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে নেমে যান, কতক তেমন।
‘অপ্রিয় সত্য’র অছিলায় আমরা আপাতত ওই ওয়ার্ল্ড কাপের দিকেই তাকিয়ে রইলাম।
ছবি সৌজন্য কোয়েলা বাগচী