ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নলেন গুড়ের সালতামামি


    অমিতাভ পুরকায়স্থ (January 21, 2023)
     

    বাঙালির সারা বছরের রসনা বিলাসের অন্যতম শৃঙ্গ সম্ভবত এই শীতের নলেন গুড়। কলকাতা গড়ে ওঠার পর মিষ্টি রসিকদের গুড়ের চাহিদা মেটাতে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে নৌকা করে গুড়ের হাড়ি আসত শহরে। তাই শহরের অন্যতম প্রাচীন গুড়পট্টি গড়ে উঠল সবেক সুতানুটির কেন্দ্রে, নদীর ধার ঘেঁষে। কলকাতার এই ঐতিহাসিক গুড়পট্টির আড়তগুলির খোঁজ আমরা ক’জন রাখি?  

    নদীপথে আমদানি হওয়া গুড় এই সব আড়ত থেকে শহরের নানা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করত গরুর গাড়ি। তখন আড়তের সব দোকান ছিল খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘর।  ঠিক যেমন দেখা যায় পুরনো চিৎপুরের বাজারের ছবিতে। 

    শীতের মরশুম শুরু হতেই বাংলার নানা প্রান্ত থেকে আসত গুড়ের জোগান। যেমনটা আজও আসে গুড়পট্টির অন্যতম প্রাচীন আড়ত, দুই শতক পেরনো শ্রী শ্রীমন্ত গুড়ের আড়তে। আজ পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ এই পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এখানে খেজুর গুড়ের মরশুম চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বছরের বাকি সময় আখের গুড় ঘিরে কারবার চলে। সেই গুড় মূলত আসে বিহার-উত্তরপ্রদেশের মতো বাইরের রাজ্য থেকে। আখের গুড়ের গল্প অন্য দিনের জন্য তোলা থাক। আজ গল্প হোক খেজুর গুড় নিয়ে। 

    পাটালি কেনার সময়ে, স্বাদ-গন্ধের সঙ্গে দেখে নেওয়া দরকার যে সেটি কতটা শক্ত। পাটালিতে চিনি মেশানো হলেই সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার মতো শক্ত হয়ে যায়। তাই নরম পাটালির দিকেই ভোট দেন রসিকজন

    খেজুর গুড়কে কেন্দ্র করে বাংলায় যে যজ্ঞ বসে শীতকালে, তার সলতে পাকানো শুরু হয় হেমন্তের শেষ থেকেই। খেজুরের রস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গাছ কাটায় পারদর্শী শ্রমজীবী মানুষ, যাদের ‘শিউলি’ বলা হয়, তারা হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই লেগে পড়েন খেজুরগাছের পরিচর্যায়। সে-সময়ে গাছ পরিস্কার, দা তৈরি, দড়ি কেনা ও কলসি কেনা, রস জ্বালানোর পাত্র কেনা, উনুন তৈরি করা সহ রস সংগ্রহ ও খেজুর গুড় তৈরির নানা আয়োজন শুরু হয়। তারপর শীত পড়তেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। 

    খেজুর গুড় মূলত চার রকমের হয়। খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় দিনে দু’বার। প্রথম বার একদম ভোরে আর আরেকবার দিনান্তে, সন্ধ্যায়। রস জ্বাল দিয়ে যে পাতলা চকোলেট রঙের সুগন্ধ যুক্ত তরলটি তৈরি হয়, তার নাম নলেন গুড়। প্রতিটি গাছ থেকে মাঝে দু’দিন রস সংগ্রহের বিরতি রাখা হয়। তারপর যে-রস নেওয়া হয়, তাকে বলে ‘জিরেন’, অর্থাৎ ‘জিরানো’ বা বিশ্রাম দেওয়ার পরের সংগ্রহ। স্বাভাবিকভাবেই এই রসের স্বাদ ও গন্ধ হয় শ্রেষ্ঠ। রস জ্বাল দিয়ে একদম ঘন হয়ে গেলে, এই সান্দ্র গুড় ছোট-বড় ছাঁচে ঢেলে শুকিয়ে শক্ত করা হয়। এটাই পাটালি। পাটালি হয় দু’রকমের— থালা পাটালি এবং মুচি পাটালি। থালা পাটালির আকার বেশ বড় আর মুচি পাটালির খণ্ডগুলি হয় বেশ ছোট আর অনেকটা শঙ্কু আকৃতির। পাটালি কেনার সময়ে, স্বাদ-গন্ধের সঙ্গে দেখে নেওয়া দরকার যে সেটি কতটা শক্ত। পাটালিতে চিনি মেশানো হলেই সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার মতো শক্ত হয়ে যায়। তাই নরম পাটালির দিকেই ভোট দেন রসিকজন। আবার খুব ফ্যাকাশে রং হলে সেই পাটালি না কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ তার মধ্যে অনেক নানা জিনিসের মিশেল দেওয়া হয়। ফলে পায়েসে সেই গুড় দিলে দুধ কেটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। 

    পাটালি হয় দু’রকমের— থালা পাটালি এবং মুচি পাটালি। থালা পাটালির আকার বেশ বড় আর মুচি পাটালির খণ্ডগুলি হয় বেশ ছোট আর অনেকটা শঙ্কু আকৃতির। পাটালি কেনার সময়ে, স্বাদ-গন্ধের সঙ্গে দেখে নেওয়া দরকার যে সেটি কতটা শক্ত। পাটালিতে চিনি মেশানো হলেই সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার মতো শক্ত হয়ে যায়। তাই নরম পাটালির দিকেই ভোট দেন রসিকজন। আবার খুব ফ্যাকাশে রং হলে সেই পাটালি না কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ তার মধ্যে অনেক নানা জিনিসের মিশেল দেওয়া হয়। ফলে পায়েসে সেই গুড় দিলে দুধ কেটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। 



    এছাড়াও নলেন গুড়ের তরল রূপ আর পাটালির কঠিন চেহারার মধ্যে আরও এক ধরনের গুড় হয়, যাকে বলা হয় ‘দানা গুড়’। খয়েরি তরলের মধ্যে ভেসে থাকে গুড়ের দানা বা ক্রিস্টাল। গুড় জ্বাল দেওয়ার শৈল্পিক দক্ষতা ব্যবহার করেই তরলের মধ্যে খুদে-খুদে দানা ফুটিয়ে তোলেন গুড়শিল্পীরা। বিশেষ করে বাঁকুড়ার কারিগররা। তবে একমাত্র গাঢ় শীত পড়লেই উত্তম মানের দানা গুড় ওঠে আড়তে। সারা বাংলাজুড়েই খেজুর গুড় তৈরি হলেও, এখন ভাল নলেন গুড় আসে আড়ংঘাটা, মাজদিয়া থেকে। জলঙ্গি, দেবীপুর থেকে আসে ভাল পাটালি। আর যেমন বললাম, দানা গুড় আসে বাঁকুড়া থেকে। গুড় তৈরির এই সব জায়গাগুলিকে আড়তের ভাষায় বলা হয় ‘মোকাম’।  

    এ-ভাগগুলি ছাড়াও, এ-বছর আড়তে পাওয়া গেল একটি বিশেষ ধরনের পাটালি, যার মান সাধারণ পাটালি থেকে অনেকটা ভাল। প্লাস্টিকের সিল করা বাটিতে পরিবেশিত এই গুড় মূলত বাইরে সরবরাহ করা হয়। কিছুটা স্থানীয় বাজারে আসে। যারা জানেন, তাঁরাই কেনেন। 

    কলকাতা শহরের নামী মিষ্টি-বিক্রেতারা তাদের খেজুর গুড়ের সারা বছরের জোগান এইসব আড়ত থেকে তুলেই গুদামজাত করে রাখেন। সেই জোগানেই জামাইষষ্ঠী থেকে বিজয়ার আপ্যায়নে খেজুর গুড়ের মিষ্টি তৈরি হয়। 

    গ্রাম থেকে উৎকৃষ্ট গুড়ের জোগান কমায় সেই ধাক্কায় টালমাটাল শোভাবাজারের গুড়পট্টিও

    তবে সময় বদলেছে। আরও বহু দেশীয় ঐতিহ্যশালী শিল্পের মতো খেজুর গুড়ের দুনিয়াতেও ভাটার টান।  খেজুরগাছ রাখার থেকে জমি ইটভাটার জন্য দিয়ে দেওয়াই বেশি লাভজনক বলে মনে করছেন জমির মালিকেরা। গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য শিউলি থেকে গুড় জ্বাল দেওয়ার কারিগর— দক্ষ শ্রমিকের অভাব সর্বত্র। এইসব কাজ যে অর্থনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় নয় নবীন প্রজন্মের কাছে। এক সময়ে কলকাতার কাছেই বাদু-মধ্যমগ্রাম অঞ্চল ছিল খেজুর গুড় তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। গুড়শিল্পীদের জীবনের উপর লেখা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প নির্ভর হিন্দি ছায়াছবির শুটিং হয়েছিল বাদু-র এমন একটি গ্রামে। কিন্তু আজ যশোর রোড থেকে বাদু রোড় ধরে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে গুড় তৈরির ছবি প্রায় দেখাই যায় না। 

    মোটামুটি একই ছবি সারা বাংলা জুড়ে। তাই গ্রাম থেকে উৎকৃষ্ট গুড়ের জোগান কমায় সেই ধাক্কায় টালমাটাল শোভাবাজারের গুড়পট্টিও। আড়তের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র হাতে-গোনা কয়েকটিতে। অবশ্য ছোট-ছোট উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হচ্ছে। সোস্যাল-মিডিয়া এবং অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে গুড়ের খুচরো অর্ডার নিয়ে সেইমতো গুড় হোম ডেলিভারি শুরু হয়েছে আড়ত থেকে। তুলনামূলকভাবে ভাল জিনিস কলকাতা-সহ ভারতের নানা প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক সাড়া বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। পাশাপাশি সরকারের তরফে টিউবে করে নলেন গুড় বিপণন হচ্ছে। সব মিলিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে প্রবাসীদের, বিশেষ করে বাংলার বাইরে জন্ম ও বড় হওয়া প্রজন্মের সঙ্গে খেজুর গুড়ের পরিচয় করানোর চেষ্টা হচ্ছে। 

    করোনাকালের লকডাউনের সময়ে যখন সব মিষ্টির দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন রসনা বিলাসে সেই শূন্যতা গুড় দিয়েই ভরিয়েছিল কলকাতা।

    তবে আশার কথা যে, শত সমস্যাতেও বাঙালির সঙ্গে মিষ্টির সম্পর্ক থাকে অটুট। সেই সম্পর্কের জোড়েই ঠিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যায় গুড়পট্টি। এই সূত্রে একটা মজার তথ্য পাওয়া গেল আড়ত থেকে। করোনাকালের লকডাউনের সময়ে যখন সব মিষ্টির দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন রসনা বিলাসে সেই শূন্যতা গুড় দিয়েই ভরিয়েছিল কলকাতা। অন্তত গুড়ের আড়ত থেকে বিক্রির রেখাচিত্রটি সেই দিকেই ইঙ্গিত করে।   

    আসছে পৌষ সংক্রান্তির পার্বণ। গুড়ের তৈরি পিঠে-পায়েস খাওয়ার সময়। খাদ্য সংস্কৃতির হাত ধরে আরেকবার বাঙালির শিকড়ে ফিরে যাওয়ার পালা। সেই পথের অন্যতম সহযাত্রী শোভাবাজারের এই সাবেক এলাকার গুড়পট্টি আর দুই শতকের বেশি প্রাচীন গুড়ের আড়ত। ছোটবেলার স্মৃতির মতো এই শহরের খেজুর গুড়ের পুরনো গল্প নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে তারা। 

    ছবি সৌজন্য : শ্রী শ্রীমন্ত গুড়ের আড়ৎ  

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook