লোকাল ট্রেনে তিনজনের সিটে চারজন বসা দুষ্কর হলেও ওটাই দস্তুর হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করতে গেলে কথা কাটাকাটি অনিবার্য। তেমন ত্যাঁদড় লোকের পাল্লায় পড়লে তো কথাই নেই, বিশেষ করে যদি তিনি নিত্য যাত্রী হন! বিনা মেহনতে চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার হতে সময় লাগবে না।
যস্মিন শকটে যদাচারঃ! বেঞ্চের তিন নম্বর যাত্রী আমি। তাই সংঘাতের আগে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই হাত-পাগুলোকে যতটা সম্ভব সঙ্কুচিত করে এবং পাশের সহযাত্রীর সঙ্গে নৈকট্য নিবিড়তর করে চতুর্থ পাণ্ডবের পশ্চাদ্দেশ স্থাপনের সুবিধা করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু তাতে হল হিতে বিপরীত। মহাশয় আমার গায়ে হেলান দিয়ে আরামে চোখ বন্ধ করলেন এবং অনতি বিলম্বেই ঝাপতালে নাসিকা-সঙ্গীত শুরু হল।
জীবনে অজস্রবার গাধা সম্বোধন শুনতে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও কিছুটা যাওয়ার পর বুঝলাম, ওই বিপুল কলেবরের ভার বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিরক্ত হয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াব ভাবছিলাম। এমন সময় সামনের সিটে বসা ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু যে! ভালো আছেন তো? গাড়ি ছেড়ে হঠাৎ ট্রেনে? পুরনো মার্সিডিজখানা বেচে দিলেন?’
গলাটা বেশ গমগমে। এক লপ্তে অনেকগুলো প্রশ্নবাণ, কিন্তু যাঁর উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত, আমি অন্তত সেই মানুষ নই। আমার তিনকুলে ডাক্তারি দূরে থাক, কেউ কখনও কোবরেজি কিংবা হেকিমি করেছেন বলেও শুনিনি। উনি যে অন্য কারুর সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ভদ্রলোকের মুখে তখনও কান এঁটো-করা হাসি। মাঝবয়েসি, গায়ের রঙ কালোই বলা চলে, রোগাটে ঢ্যাঙা চেহারা। মাথার লম্বা চুল যত্ন করে কলপ করা, দাঁতে পানদোক্তার ছোপ, গোঁফখানা স্যার আশুতোষ মুখুজ্জের মতো তাগড়াই। গায়ে হাতে বোনা সোয়েটার, বুকের ওপর আড়াআড়ি তুষের চাদর, মাফলার দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে কান-গলা মুড়ে রেখেছেন। ভদ্রলোকের বুঝি ঠাণ্ডার ধাত।
আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি একটু থমকালেন। তারপর মুখের হাসিটা বিস্তৃত করে বললেন, ‘চিনতে পারলেন না তো? খুব স্বাভাবিক। যা পসার আপনার, পেশেন্টদের মনে রাখাই দুষ্কর, তাতে আমি তো পেশেন্টের হাজব্যান্ড! তবু ভেবেছিলাম, আমাকে হয়তো আপনার মনে থাকবে, কারণ–’,
এতক্ষণ যে প্রতিবেশী আমার গায়ের ওপর হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, উচ্চৈশ্বরের আলোচনায় হয়তো তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তিনি ‘ডাক্তার’ শুনে সম্ভ্রম দেখিয়ে কিঞ্চিৎ সরে বসবার ভান করলেন।
উল্টোদিকের সেই ভদ্রলোক ফের খোসামুদে গলায় বললেন, ‘সেই যে আমার স্ত্রীকে নিয়ে আপনার কাছে যেতাম। বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিল না, পাঁচপোতার রাজলক্ষ্মী মল্লিক, মনে পড়ছে? ফর্সা, পানপাতা মুখ, নিজের পরিবার বলে বলছিনে, অমন সুন্দরী তো চট করে চোখে পড়ে না, তাই ভেবেছিলাম-, আপনি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কীসব পরীক্ষা-টরিক্ষা করাতে বলেছিলেন! আমি পাঁচপোতা হাই স্কুলের অঙ্কের মাস্টার নিবারণ মল্লিক, একবার আপনাকে নিজের বাড়ির গোবর সারে তৈরি একখানা ওল দিয়ে এসেছিলাম, সঙ্গে পুকুরের লাফানো চিংড়ি! আহা, আমার নিজের হাতে লাগানো ওল, একবার যে খেয়েছে–’, বলতে বলতে ভদ্রলোক সুড়ুত করে ঝোল টানলেন।
ভাল প্যাঁচে পড়া গেলে দেখছি! ওল আমার দু’চক্ষের বিষ, অ্যালার্জির জন্যে চিংড়ি যে শেষ কবে খেয়েছি, মনে পড়ে না!
আমার স্মৃতিটাকে উস্কে দেওয়ার জন্যে তাঁর একের পর একে রেফারেন্সে আমি পড়লাম মহা বিপাকে।
নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল। আমার চেহারায় হয়তো বড়সড় কিছু গোলমাল আছে। চেহারাতুতো মিলের জন্যে এর আগে একাধিক বার এমনই গোলমালে পড়তে হয়েছে আমাকে। প্রতিবারই অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলায় নানা কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ডের মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাকে!
কয়েক বছর আগের কথা। স্টেট বাসে কুচবিহার থেকে কলকাতায় ফিরছিলাম। দূর পাল্লার বাসে কাউন্টার থেকে অগ্রিম টিকিট কেটে বাসে ওঠাই রীতি। কিন্তু শেষে মুহূর্তে দৌড়ে এসে বাস ধরেছি, টিকিট কাটা হয়নি।
অল্প বয়েসি কন্ডাকটর ভাড়া নিয়ে টিকিট এবং খুচরো টাকা ফেরত দেওয়ার সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি! মাফ করবেন স্যার, ভিড়ের মধ্যে তো, আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি। কুচবিহার কি বেড়াতে এসেছিলেন?’
আমি এমন কেউকেটা নই যে আমাকে চিনতে হবে! স্কুল-কলেজে পড়াই না, সরকারি আমলা কিংবা উর্দিধারী পুলিশ নই, তবু কেন যে সে অত্যন্ত সমীহের সঙ্গে ‘স্যার’ বলছে বুঝে উঠতে পারলাম না।
তবু সে আমার পরিচিত কিনা বোঝবার জন্যে ভালো করে ওর মুখের দিকে তাকালাম। শ্যামলা রঙ, অমিতাভ বচ্চনের স্টাইলে কান ঢাকা চুল, চিবুকে হো চি মিনের মতো হালকা দাড়ির আভাস, কুঁতকুঁতে চোখ, নাকটা সামান্য চাপা, গালের একপাশে মস্ত কাটা দাগ। এ মুখ ইতিপূর্বে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ল না।
বাধ্য হয়ে ওকে বললাম, দেখুন, আপনার বোধ হয় ভুল হচ্ছে।
ছেলেটা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘হচ্ছেই তো স্যার! তা নাহলে আপনার মতো মানুষকে চিনতে পারব না! ছি ছি, এ বড় লজ্জার ব্যাপার হল।’
তারপর গলা নামিয়ে বলল, আপনি এক কাজ করুন স্যার, টিকিটগুলো ফেরৎ দিন, এই নিন আপনার টাকা।
ছেলেটা সত্যি সত্যি আমার দেওয়া ভাড়ার টাকাটা আমার সামনে বাড়িয়ে ধরল।
তারপর দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে রীতিমত দ্বন্দ্ব লেগে গেল। সে টাকাটা ফেরত না দিয়ে ছাড়বে না, আমার পক্ষেও নেওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে অনেক সদুপদেশ দিলাম, ছেলেটির কর্তব্যনিষ্ঠার ভূয়সী প্রশংসা করলাম, কিন্তু তাতেও ভবী ভুলল না। দু’এক স্টপেজ পর পরই সে ভাড়ার টাকাটা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগল।
শিলিগুড়িতে মিনিট পনেরোর জন্যে বাস থামল। সে দৌড়ে গিয়ে নিজের হাতে খাঁটি দুধের চা আর গরম সিঙ্গাড়া এনে হাজির করল। এর পর আরও বার দুয়েক চা এনে খাওয়ানোর জন্যে তার অনুনয় বিনয় রীতিমতো বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছল। বেগতিক দেখে ধুলিয়ানে রাতের খাওয়ার জন্যে বাস থামলে ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে রইলাম, ওর ডাকাডাকিতে সাড়া দিলাম না। সকালে কৃষ্ণনগরে পৌঁছে আরেক প্রস্থ চা, জলখাবার। সঙ্গে এক প্যাকেট সরপুরিয়া। কাকে যেন আগেভাগে ফোন করে রেখেছিল, শহরের ভেতরের কোন বিখ্যাত দোকান থেকে তার কোনও স্যাঙাৎ সেটা কিনে এনেছে।
বাস থেকে নামার সময় সে আমার কানে কানে বলল, ‘খুব বেয়াদপি করে ফেলেছি, স্যার। আপনাকে যে প্রথমে আমি চিনতে পারিনি, এই কথাটা দাদাকে বলে দেবেন না, স্যার। আপনি তো জানেন, ওঁর দয়াতেই আমার এই চাকরিটা! আপনাকে বড়ো শ্রদ্ধা করেন উনি।’
ছেলেটি যে দাদার নাম করল, শুনেই তো আমার আক্কেল গুড়ুম। তিনি রাজ্যের একজন দাপুটে নেতাই শুধু নন,এক সময়ে মন্ত্রীও ছিলেন!
শীতের মধ্যেও দর দর করে ঘামতে ঘামতে বাস থেকে নেমেছিলাম।
আরেকবার ট্রেনে চেপে বীরভূম থেকে ফিরছি, সঙ্গে আমার এক সহকর্মী। হঠাৎ একজন মাঝবয়েসি ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে, প্যালা না? কেমন আছিস?’
বুঝলাম, আবার গাড্ডায় পড়তে যাচ্ছি। আমি বললাম, ’আপনার বোধ হয় ভুল হচ্ছে। আমার নাম প্যালা নয়। তাছাড়া আপনাকেও তো ঠিক’,
—চিনতে পারছিস নে, তাই তো? চিনবি কী করে, চিনলেই যে বিপদ! না হয় একটা ভাল চাকরি পেয়েছিস, তাই বলে নিজের লোকদের এভাবে ভুলে যেতে হয়? দু’হাতে পয়সা কামাচ্ছিস, বালিগঞ্জে ফ্ল্যাট কিনেছিস, গত মাসে ছেলের অন্নপ্রাশনে দুনিয়ার আত্মীয়স্বজনকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ালি, শুধু আমরা বাদ। ভাবছিস, আমি কিছুই খবর রাখি নে, তাই না?
আমার তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। মরিয়া হয়ে বললাম, ‘দেখুন আপনি অন্য কারুর সঙ্গে আমাকে, মানে আমার নাম…’, ভদ্রমহিলা তেরিয়া হয়ে বললেন, ‘জানি তো, অক্কো মুখুজ্জে! তবে প্যালাও এমন কিছু খারাপ নাম নয়। ছোটবেলায় তুই খুব পেটরোগা ছিলি কিনা, তাই তোর মেসো তোকে প্যালা বলে ডাকত। টেনিদা পড়িস নি? তোর মেসো আবার নারাণ গাঙ্গুলির খুব ভক্ত ছিল কিনা, ওঁর ডাইরেক্ট ছাত্র তো’! বোঝা গেল, প্যালা নামক আসামীর মাসি ইনি।
আর প্রতিবাদ করার সাহস হল না। আমি মুগ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলার কথা শুনতে লাগলাম। তিনি অমায়িক হেসে আবার শুরু করলেন, ‘হ্যাঁরে প্যালা, তোর মায়ের বাতের ব্যথাটা কি একটু কমেছে? সেদিন বাংলাদেশের সিরিয়ালে দেখছিলাম, বালি থেরাপি করলে নাকি বাত চলে যায়। বালি, মানে স্যান্ড, বুঝলি? সমুদ্রের ধারে রোদ্দু্রে বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে মাথাটুকু বাদ দিয়ে পুরো শরীরটা বালি চাপা দিয়ে ঘন্টা কয়েক থাকতে পারলেই কেল্লা ফতে। বাত নাকি পালাতে পথ পায় না। আমার আবার হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে, ভাবছি একবার করে দেখব। সামনের মাসে পুরি যাচ্ছি, তোর মাকে বলে দেখ, যায় কিনা। তাহলে দু’জনে বালি থেরাপিটা একবার ট্রাই করা যাবে!’
মনে মনে বললাম, আমার মা তো বহুদিন আগেই বাত বেদনার উর্ধ্বে চলে গেছেন। কিন্তু কথাটা সাহস করে বলা হল না।
ভদ্রমহিলা হাতের ঝোলা থেকে শালপাতার ঠোঙা বের করে আমার হাতে একখানা প্যাঁড়া দিয়ে বললেন, ‘মাথায় ঠেকিয়ে খা। তারাপীঠ গিয়েছিলাম মায়ের পুজো দিতে, সুমির আবার বাচ্চা হবে তো, তাই মায়ের কাছে মানত করে এলাম। পর পর দুটো তো, যাকগে, সাবুর খবর কী? ওদের কি ডিভোর্স হয়ে গেছে? আমি আগেই বলেছিলাম, ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে তবে সম্বন্ধ করো। তোর বাপ এনআরআই দেখে নেচে উঠল, এখন ঠ্যালা সামলাও!’
ভদ্রমহিলা আরও কত কী যে বলে যেতেন, খোদায় মালুম। গাড়ি বর্ধমান ঢুকছে দেখে উনি হাঁক পাড়লেন, ‘শম্ভু, এই শম্ভু, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? চল, নাবতে হবে।’
তাকিয়ে দেখি, একটা ষোল সতেরো বছরের রোগাভোগা কিশোর, ব্যাগপত্তর নিয়ে ভদ্রমহিলার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘একে চিনিস? ও হল শম্ভু, আমাদের মালতীর ছেলে। সামনের বার মাধ্যমিক দেবে। বাপটা চলে গেছে, ওর মা পাঁচ বাড়ি ঠিকে কাজ করে খায়, পড়াবে কোত্থেকে, বল! লেখাপড়ার খুব ঝোঁক দেখে আমার কাছে রেখেছি, পড়াশুনোর ফাঁকে একটু ফাইফরমাশ খাটে, বাজার ঘাট করে দেয়!’
উনি একতরফা বকে যাচ্ছেন, নিজেই প্রশ্ন করছেন, নিজেই উত্তর দিচ্ছেন। নির্দোষ কথাবার্তা, প্যালা না হয়েও খারাপ লাগছিল না। তবে উনি মোক্ষম বোমাটি ফাটালেন ঠিক নেমে যাওয়ার আগের মুহূর্তে।
খুব অমায়িক কন্ঠে বললেন, ‘ধারের টাকাটা যে তুই ফেরত দিবিনে, তা জানতাম। আপন জ্যাঠতুতো বোনের ছেলে, তুই তো আমার পর নোস। পথেঘাটে দেখা হলে অমন না চেনার ভান করিসনে প্যালা, বড্ডো আঁতে লাগে!’
—কী ডাক্তারবাবু, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? অবশ্য শীতকালে একটু ওম পেলে সবারই ঘুম ঘুম পায়। তা আপনি কি বনগাঁর চেম্বারটা বন্ধ করে দিলেন? দেখলাম বিশ্বাস মেডিকেলের বোর্ডে আপনার নামের ওপর সাদা কাগজ সেঁটে দিয়েছে! গেল হপ্তায় বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, চাইল্ড স্পেশালিস্ট অনির্বাণ ধরকে দেখাতে। আপনার খুব সুখ্যাতি করছিলেন উনি। মেডিকেল কলেজে উনি বুঝি আপনার বছর দুয়েকের জুনিয়র। আপনার গোল্ড মেডেল পাওয়ার গল্প, ডিবেটের গল্প, আচ্ছা, কলেজ জীবনে আপনি নাকি খুব ভাল গানও গাইতেন?
চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, সকলেই আমাদের কথা শুনছে। একে গোল্ড মেডেল পাওয়া ডাক্তার, তার ওপর আবার ডিবেট এবং গান, সকলের চোখে বেশ শ্রদ্ধার ভাব।
তোয়াজটা বেশ লাগছিল। খুব গম্ভীর গলায় বললাম, গান? ক্ষেপেছেন? এখন যাকে বলে নাওয়া খাওয়ারই সময় হয় না!
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই! ডাক্তারবাবুদের এই এক সমস্যা। অনেকটা দর্জির মতো। নাওয়াখাওয়াই জোটে না, তার ওপর আবার গান!’
ভদ্রলোক সোৎসাহে সায় দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার ওপর গোল্ড মেডেলিস্ট ডাক্তার ভর করেছে, তাই দর্জির সঙ্গে তুলনাটা মানতে পারলাম না। ঈষৎ ক্ষুণ্ণ গলায় বললাম, ‘আপনার কথাটা ঠিক ধরতে পারলাম না। মানে দর্জির সঙ্গে ডাক্তারদের তুলনা, অবশ্য উভয় পেশার মানুষকেই কাটাকাটি কিংবা সেলাই ফোঁড়াই করতে হয়, কিন্তু নাওয়খাওয়ার ব্যাপারটা…’, উনি মুখে একটা চুক চুক শব্দ করে বললেন, ‘সহজ কথাটা বুঝতে পারলেন না? আরে বাবা, দর্জির যখন কাজ থাকে না, তখন পয়সার অভাবে খাওয়া জোটে না, আর যখন কাজ থাকে, তখন সময়ের অভাবে, ডাক্তারবাবুদের অবস্থাও ওর’ম কিনা বলুন!’
লোকটা নিজের রসিকতায় নিজেই একচোট হেসে নিলেন। তারপর প্রসঙ্গ পালটে বললেন, ‘জানেন ডাক্তারবাবু, আমার ছেলেটা চোখে যেন একটু কম দেখছে। ওইটুকু বাচ্চা, তার আবার চোখের ব্যামো! আচ্ছা ডাক্তারবাবু, কেন এমন হয় বলতে পারেন?’
—ডাক্তার ধর কিছু বলেননি?
—ওঁকে তো আপনি জানেন, উনি কি আপনার মতো বুঝিয়ে বলার মানুষ! এক কথা দু’বার জিজ্ঞেস করলেই চটে যান। আপনাকে পেয়ে ভালই হল, একটু যদি বুঝিয়ে বলেন, বাচ্চার চোখের ব্যাপার তো, খুব টেনশানে আছি।
টোপটা যখন গিলেই ফেলেছি, এখন ওগরানো মুশকিল। বিশেষ করে এতগুলো মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে! বাধ্য হয়ে ক্লাস টুয়েলভের বায়োলজি জ্ঞান নিয়ে একটা ভাসা ভাসা বক্তৃতা দিতে হল। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, উনি যেন মিটিমিটি হাসছেন।
ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করলাম। বললাম, ‘পেশেন্ট না দেখে তো এর চাইতে বেশি কিছু বলা সম্ভব না, তা ছাড়া অপথ্যালমোলজি আমার বিষয়ও নয়। আপনি বরং কোনও চোখের ডাক্তারকে দেখিয়ে নিন।’
ছেলের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এবার উনি ওঁর স্ত্রীকে নিয়ে পড়লেন। প্রসবের পর তাঁর কী কী সমস্যা হচ্ছে, সেসবের সবিস্তার বিবরণ দিতে লাগলেন।
আমি দেখলাম, আর বসে থাকা সমীচীন হবে না। ভাবলাম সামনের স্টেশানে নেমে টুক করে অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ব।
ভিড় ঠেলে সবে গেটের কাছে পৌঁছেছি, দেখি উনি কখন উঠে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
একগাল হেসে বললেন, উঠে পড়লেন কেন? আমি তো জানি, আপনি ডাক্তার নন। ইন ফ্যাক্ট ওর’ম কোনও ডাক্তারকে আমি চিনিও না। নেহাৎ দেখলাম আপনি ক্যাজুয়াল প্যাসেঞ্জার, ভদ্রলোকমার্কা চেহারা, ওদের গুঁতোগুঁতির সঙ্গে পেরে উঠবেন না, তাই—, তা ছাড়া বোরিং ট্রেন জার্নি, সময়টা কিন্তু দিব্যি কেটে গেল, কী বলেন! আর হ্যাঁ, অভিনয়টা কিন্তু আপনি চমৎকার করেন, মশাই। বিনা স্ক্রিপ্টে যা ফর্মা দেখালেন!
আমি ভ্যাবলার মতো ওঁর মুখের দিকে চেয়ে আছি দেখে চোখ মটকে হাসলেন। বললেন, ‘আমি নিজে থিয়েটার করি। সামনে যে নাটকটা করতে যাচ্ছি, তাতে একটা ডাক্তারের রোল আছে, আপনার চেহারার সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যাবে! করবেন নাকি?’
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র