৩.
জায়গাটা দুজনেরই পছন্দ হয়েছে। অবশ্য দুজনের ভাললাগার কারণ আলাদা। তৃণা দেখছে প্রকৃতির সৌন্দর্য, আর সুদীপের মনে ভক্তি, আধ্যাত্মিক আকুতি মিলিয়ে একরকম গদগদ ভাব। মাইলখানেক ওপরে একটা ভিউ পয়েন্টও আছে। সেখানে গিয়েও অনেকক্ষণ বসে থাকে দুজন। দূরে সবুজ পাহাড়ের গায়ে জোঁকের মতো বাড়িগুলো আটকে আছে। এই রক্তচোষা অসুখই হল শহর, সভ্যতা। পশ্চিমের দিগন্ত থেকে এই সভ্যতার দিকেই যেন রাগে, চিৎকার করতে-করতে ছুটে আসছে একফালি কালো মেঘ। তৃণা বিড়বিড় করে উঠল, ‘এখানে মেঘ গাভীর মতো চড়ে! না, গাভী তো না। বাইসন বললে ঠিক হয়।’ সুদীপ বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে। চলো লাঞ্চটা করে নিই গিয়ে।’ মঠের পাশেই একটা কাঠের দোতলা বাড়ির নীচের তলায় দোকান। কতগুলো প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার, জনা দশেক লোকের বসার মতো জায়গা। খাবারের বেশি অপশন নেই। হয় ভাত-ডাল-সবজি, নয় নুডল্স! তৃণা দেখেছে একমাত্র বাঙালিরাই নুডল্সকে চাউমিন বলে। এখানে এসেও সে কয়েকবার চাউমিন বলে ফেলেছে। তার এই একটা ত্রুটিতেই সুদীপ বিরক্ত না হয়ে শুধু হো-হো করে হেসে ওঠে।
লাঞ্চ করে গাড়িতে উঠতেই বাইসন-মেঘ তাদের ছুঁয়ে ফেলল! প্রবল বৃষ্টি এবং তার সাথে হাওয়া! যেন শিঙের গুঁতোয় গাড়িটাকে উলটে ফেলবে। গাড়ি না উলটোলেও এক মুহূর্তে টেম্পারেচার যেন কয়েক ডিগ্রি কমে গেছে! সুদীপ গাড়ির কাচ তুলে দিতে বলল। তাতেও শীত পুরোপুরি গেল না। তৃণা এমনিতেই শীতকাতুরে মেয়ে। তার মধ্যে বাইসনের হঠাৎ আক্রমণে তার ঠকঠকানি শুরু হয়েছে। সুদীপ নিজের জ্যাকেটটা খুলে তৃণার গায়ে জড়িয়ে দেয়। ‘দ্যাখো তো, এবার একটু ভাল লাগছে?’ ‘একটু!’ সুদীপ আর একটু গরম করার জন্য তৃণাকে জাপটে ধরল। ‘এবার?’ ‘ওমা! দেখো সেই প্রজাপতিটা!’
সত্যিই প্রজাপতিটা কী করে যেন গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সুদীপ হেসে বলল, ‘এঃ, এর ভাগ্যটাই খারাপ। বালব থেকে ছাড়া পেয়ে গাড়ির মধ্যে আটকা পড়েছে।’
তৃণা বলল, ‘ও বোধহয় চিনে রেখেছে আমাকে। আমি যেখানেই যাব, আমার সাথে যাবে।’
‘ধুস, প্রজাপতি কখনও মানুষ চিনতে পারে?’
‘যদি পারত, বেশ হত না? আমার একটা পোষা প্রজাপতি থাকত!’
পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টি হলে রাস্তা পেছল হয়ে থাকে। তার ওপর এমন আঁকাবাঁকা রাস্তা! সুদীপ এমনিতেই সরু রাস্তায় ভয় পায়! তারপর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! প্রতিটা বাঁকের মুখেই তার মনে হয় গাড়ি এই বুঝি স্কিড করে খাদের মধ্যে চলে গেল! ড্রাইভার বলল, ‘কাছেই একটা বুদ্ধ পার্ক আছে, যাবেন?’ সুদীপ উত্তর দেয়, ‘এই বৃষ্টিতে পার্কে গিয়ে কী করব? কোথাও বসে অপেক্ষা করার জায়গা নেই? ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে তারপর বৃষ্টি কমলে বেরোতাম নাহয়!’
‘এই বৃষ্টি কমবে না স্যার!’
তৃণার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শীতের বৃষ্টি তার ভাললাগে না। শীত হল বিষাদের মতো। তাকে মিঠে রোদের র্যোমান্টিকতা দিয়েই বরণ করতে হয়। সিমপ্যাথি আদায় করা কাঁদুনে মেয়ের মতো বৃষ্টিকে টলারেট করা যায় না। গ্রীষ্মে আবার অন্যরকম। গ্রীষ্ম হল অহংকারের ঋতু। সেই অহংকারকে ঘনীভূত বাষ্পের মতো হাজার-হাজার মাইল বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি বৃষ্টি এসে খণ্ডন করে যায়। মানুষ সেই বৃষ্টিকে ভালবাসে। সেই বৃষ্টিকে বরণ করে কবিতা, গান তৈরি হচ্ছে হাজার বছর ধরে।
গাড়ি যখন হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল, তখনও বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণ নেই। বোঝা গেল দিনটা হোটেলেই কাটবে। তাহলে দরকার প্রচুর পরিমাণে কফি আর স্ন্যাক্স। তার সাথে একটা রুম হিটারের কথাও সুদীপ বলে দিল রিসেপশনে। নেপালি টুপি পরা ছেলেটা বলল, ‘কালকে সূর্যোদয় দেখতে যাবেন স্যার?’
সুদীপ বলল, ‘এই যা ওয়েদারের অবস্থা, তাতে সূর্য কি উঠবে?’
‘উঠবে স্যার। আজকে তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়ুন। আটটায় সার্ভ করে দেব?’
‘আচ্ছা।’
রুমে ঢুকে জানলার দু’পাশে দুটো চেয়ারে বসল দুজন। দুটো চেয়ারের মাঝে কাচঢাকা জানলায় বৃষ্টি এসে টোকা দেয়। সেই টোকার শব্দে শতরঞ্চি, চেয়ার-টেবিল, বিছানার ওপর এলোমেলো কম্বল— সব যেন আরও ঠান্ডা হয়ে ওঠে। এই ঠান্ডাতে আবার তৃণার দু’চোখ জুড়ে আস্তে-আস্তে ঘুম আসে। মাথার মধ্যে ধোঁয়া-ধোঁয়া মেঘ উড়ে বেড়ায়। এমন সময় হঠাৎ সুদীপ চিৎকার করে ওঠে, ‘তৃণা, প্রজাপতি, প্রজাপতি!’
দুজনে অবাক হয়ে দেখে ঘরের মধ্যে এলোমেলো ঘুরে চলেছে প্রজাপতিটা।
তৃণা ছেলেমানুষের মতো হাততালি দিয়ে বলে, ‘আমার পোষা প্রজাপতি! আমাকে চিনে পিছু-পিছু এসছে। এই প্রজাপতি আয়-আয়, আমার হাতে এসে বোস।’
ঘরের মধ্যে কয়েকবার ঘুরপাক খেয়ে প্রজাপতিটা তৃণার হাতের তালুতে এসে বসে। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকে তৃণার প্রসারিত হাত। আর মেরুদণ্ডটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে সুদীপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘ইমপসিবল!’
প্রজাপতিটাকে নিয়েই রাতটা কেটে যায় তাদের। তৃণা খালি-খালি প্রজাপতিটাকে এখানে যেতে, সেখানে যেতে অর্ডার করে আর সুদীপ কাপের পর কাপ কফি শেষ করে, যেন সে মদ খাচ্ছে, যেন মাতাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিছু না বললেও বোঝা যায় যে, প্রজাপতির পোষ মানায় সে মোটেই খুশি হয়নি। আবার নিজের চোখে দেখা ঘটনা অবিশ্বাসও করতে পারছে না। মনের মধ্যে অস্বস্তি নিয়ে সে শুয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। মাথা অবধি কম্বল টেনে নিতে ভোলে না, বলা তো যায় না কখন অলক্ষণে প্রজাপতিটা মুখে-চোখে এসে বসে!
৪.
সুদীপের ঘুম খুব গভীর। টুকটাক শব্দেও চট করে ভাঙে না। তাই প্রথমবার বেলের শব্দে তার ঘুমের দেওয়াল পুরোপুরি ভাঙল না। একখানা ইঁট খসে পড়ল মাত্র। সে নাকডাকা বন্ধ করে পাশ ফিরে শুল।
দ্বিতীয়বার বেল বাজার সাথে-সাথে অচেতনের রাজপ্রাসাদ বালির বাঁধের মতো ঝুরঝুরিয়ে পড়তেই সুদীপ ধড়ফড় করে উঠে বসল। তারপর কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে দরজা খুললে নেপালি টুপি পরা ছেলেটা বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার!’ বাঁ’হাতের তালুতে নিখুঁতভাবে ব্যালান্স করা সাদা রঙের ট্রে-তে একটা কেটলি, দুটো কাপ, ছোট বাটিতে চিনি, দুটো চিনি গোলার চামচ আর একপাশে ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশনের বিবরণ দেওয়া চার পাতার কার্ড। ট্রে-টা টেবিলে রেখে ছেলেটা বগলের তলা থেকে খবরের কাগজ এগিয়ে দিল। খবরের কাগজটা হাতে নিতেই ভ্রূ দুখানা কুঁচকে গেল সুদীপের, ‘নেপালের হোটেলে দু’বছরের শিশুকে কুপিয়ে খুন মায়ের।’ তারিখ ২৫ মার্চ। সে ধমকে বলল, ‘এই গতকালের কাগজ এনে দিয়েছ কেন?’
ছেলেটা বলল, ‘না স্যার, আজকের কাগজ।’
‘এই দ্যাখো ২৫ মার্চ লেখা।’
‘আজ তো ২৫ মার্চই স্যার। গতকাল ২৪’এ মার্চ আপনারা চেক ইন করলেন!’
‘তোমার কি মাথার ব্যামো-ট্যামো আছে না কি? আমরা এসেছি পরশুদিন। তারপর গতকাল গাড়ি নিয়ে ধুংফা মঠ দেখতে গেলাম না? বৃষ্টির জন্য তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম… সব কি ভুলে গেছ না কি?’
সুদীপ আর নেপালি টুপি পরা ছেলেটি একে অপরের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনেই বোঝার চেষ্টা করছে অন্যজন সাতসকালে ইয়ার্কি মারছে কি না।
ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে সুদীপ কাপে চা ঢেলে নিল। নতুন কাগজ না পেয়ে তার বিরক্ত লাগছে। সোয়েটারটা জড়িয়ে সে বারান্দায় এল। কালকে যে সারারাত বৃষ্টি হল, তার চিহ্নমাত্র এখন মালুম হচ্ছে না। শহর যেন পুনরুজ্জীবন লাভ করেছে। তাহলে নিশ্চয়ই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে!
চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে চাতালে নেমে আসে সুদীপ। চাতালের বেশ কিছু জায়গায় বরফ জমে আছে এখনও। তবে বেশির ভাগ জায়গাতেই গলে মাটির সাথে মিশে নরম হয়ে রয়েছে। দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম তার বুকটা কেঁপে উঠল। কিছু দূরে একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক হনুমানটুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা দাদা, আজকে কত তারিখ?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘২৫।’
সুদীপ ঠান্ডা মাথায় ঘরে ফিরে এল। মোবাইল খুলে দেখল ২৫ মার্চ। ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস ২৪ মার্চ। তার মানে গতকালের ঘটনাটা পুরোটাই সে স্বপ্ন দেখেছে। পসিবল। কোনও-কোনও স্বপ্ন খুব ভিভিড হয়। সে দুটো কাপে চা ঢেলে তৃণাকে গুঁতো মারল, ‘এই ওঠো, ওঠো, আরে ওঠো তো! বিরক্তিকর মানুষ একটা, বেড়াতে এসে খালি ঘুমিয়ে যায়!’
তৃণা ধুঁকতে-ধুঁকতে উঠে বসল। ঠান্ডায় কাঁপতে-কাঁপতে জড়ানো গলায় বলল, ‘আরেকটু, আরেকটু শুই!’
না-না-না, বলতে-বলতে ঘুম কাটাবার জন্য সুদীপ বালিশখানা তুলে দুম করে তৃণার মাথায় মারে। সাথে-সাথে তৃণার গলা থেকে অস্ফুট আর্তনাদের সঙ্গেই খাটের তলা থেকে হুট করে বেরিয়ে আসে একটা প্রজাপতি। বিকট অট্টহাস্যের মতো পাক খেতে খেতে প্রজাপতিটা সিলিং-এর দিকে উঠতে থাকে। সেই নিঃশব্দ রহস্যহাসির স্বরে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে সুদীপ।
‘কী হয়েছে? শীত লাগছে না কি?’ তৃণা জিজ্ঞেস করল।
সুদীপ কাঁপতে-কাঁপতেই বলল, ‘প্রজাপতিটা কী করে এল?’
‘প্রজাপতিটা কী করে এল মনে নেই? আমার পোষা প্রজাপতি তো!’
যেমন দুম করে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎ কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেল সুদীপের।
‘ওয়েট, তোমারও মনে আছে কালকের কথা?’
‘হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন?’
‘রাইট। তার মানে আমরা টাইম-লুপে পড়ে গেছি তৃণা। বার বার করে একটাই দিন আমাদের কাটিয়ে যেতে হবে।’
এরপর তৃণার চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়। সে গোটা গল্পটা মন দিয়ে শোনে। তারপর বলে, ‘ওয়াও! তবে এসব তো পশ্চিমি সিনেমা-টিনেমায় অনেক হয়! এখন ক্লিশে হয়ে গেছে।’
‘তাই? দেখেছ তুমি এরকম সিনেমা?’
‘হ্যাঁ, প্রচুর আছে। গল্প-উপন্যাসও আছে। আমি পড়িনি অবশ্য। কলেজের বন্ধুরা বলত।’
‘ঠিক কী হয় বলো তো ওসব গল্পে?’
‘কী আবার হবে! যা এক্কেবারে ভাবা যায়নি, সেরকম কিছু একটা দিয়ে শেষ হয়! ধরো, একজন মানুষ, যে কখনও ভালবাসেনি, সে গল্পের শেষে ভালবাসা খুঁজে পায় বা হয়তো একজন খুনি খুন করতে-করতে অনুতপ্ত হয়ে ওঠে, বা ধরো…’
বলতে গিয়ে থেমে যায়। দুজনের মনেই একই কথা ভেসে উঠেছে। তাদের উদাসীন দাম্পত্যজীবনে এবার কি তবে ভালবাসা আসতে চলেছে? নতুন একটা জীবন তারা কি শুরু করতে পারবে এবার? সুদীপ হাত বাড়িয়ে তৃণার হাতখানা ধরে। এই প্রথম নতুন জীবনের আশায় তৃণা সেঁধিয়ে আসে সুদীপের কোলের কাছে। নতুন বউয়ের মতো লাজুক মুখ তুলে বলে, ‘ভাগ্যিস, লুপটা বেড়াতে এসে পড়েছে! তোমাকে যদি প্রতিদিন উঠে অফিস যেতে হত, গিয়ে একই ফাইলে সই করতে হত, কেমন কেলেঙ্কারি ব্যাপারই না হত!’
সুদীপ হেসে বলল, ‘যেতামই না অফিস, সেরকম হলে!’
‘তুমি যেমন ওয়ার্ক-অ্যাহলিক, পোষাবে তোমার অফিস না গেলে?’
‘আগে মনে হত অফিসই সব। লুপে পড়তেই এখন মনে হচ্ছে ওসব একেবারে ফালতু!’
‘সিনেমাগুলোয় লুপ তো অমনই দেখায়। যে-সত্যগুলোকে দেখা যায় না, সেগুলোকে চোখের সামনে এনে দেয়। মানুষকে সত্য চেনাতে শেখে।’
এই বিকট অসম্ভব-অবাস্তব ঘটনার মুখোমুখি হয়েও সুদীপ আর তৃণা তেমন অবাক হল না! রেস্টুরেন্টে রুই মাছের কালিয়া অর্ডার করার পর চিংড়ির মালাইকারি পাতে পড়লে যতটা চাঞ্চল্য হয়, উত্তেজনা ও আনন্দ হয়, এও যেন তেমনি। সুদীপ আর তৃণা আলোচনা করতে লাগল কীভাবে তারা এই টাইম-লুপ কেটে বেরোবে… যে-যাপনের স্বপ্নও তারা কখনও দেখেনি আগে, কীভাবে সেইসব উন্মাদ যাপনের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন তারা এক-একটা নতুন জীবন উড়তে-উড়তে পেরিয়ে যাবে…
এদিন কিন্তু স্নান করতে বেশি সময় নেয় না তৃণা। ঝটপট তৈরি হয়ে ওঠে। সে যেন এতদিন ঘুমিয়ে ছিল, আজ হঠাৎ সোনার কাঠি, রূপোর কাঠির স্পর্শে জেগে উঠেছে। চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন সূর্যের জ্যোতি! আজকে কোথায় যাওয়া হবে তা সেই ঠিক করে ফেলেছে। গন্তব্যটি ধুংফা মঠ থেকে আরও দশ কিলোমিটার উত্তরে সবুজ পাথর বলে একটি পাহাড়ের চূড়োয়। মাঝপথে শিবমন্দির পড়ে। শিবমন্দির দেখে তারা যাবে চূড়োয়— যেখানে গোটা এলাকার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় টুরিস্টরা এসে জড়ো হয় প্যারাগ্লাইডিং করার জন্য। নেপালি টুপি পরা ছেলেটা চায়ের সাথে যে-কার্ডটা রেখে গিয়েছিল, দর্শনীয় জায়গাগুলোর বিবরণী সমেত, তাতেই দেখেছে তৃণা। উত্তেজনার বশে সুদীপও প্রথমে বলে ফেলেছিল, গোল্লায় যাক, ভার্টিগো-ফার্টিগো কুছ পরোয়া নেহি।
কিন্তু সাহস আর অতক্ষণ টিকল না। শিবমন্দিরে পুজো দেওয়ার পর থেকেই রোগা রকেটের অপর্যাপ্ত জ্বালানির মতো ক্রমশ পুড়তে-পুড়তে সাহস ধীরে-ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল। পাহাড়ের মাথায় তাদের গাড়ি যখন এসে থামল, তখন সুদীপের মুখখানা ভয়ে থমথম করছে। তৃণা বলল, ‘যেতেই হবে তোমাকে। টাকা দেওয়া হয়ে গেছে।’
সুদীপ বলল, ‘তা হোক, টাকা যাক, আমার মরার ইচ্ছে নেই। উড়িব্বাবা ওই দ্যাখো আকাশের মধ্যে কীভাবে কাঁপছে…’
তৃণা বলল, ‘মরে যেতে ভয় পাচ্ছ কেন? মরে গেলেই তো আমরা এই লুপ ভেঙে বেরোতে পারব। যতক্ষণ না মরছি, ততক্ষণ আমাদের অনন্তকাল এর মধ্যেই আটকা থাকতে হবে।’
‘নোপ। আমি যাচ্ছি না বাপু, তোমার ইচ্ছে হলে যাও গে…’
তৃণার চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। এই অদ্ভুত ঘটনাবলির প্রশ্রয়ে অনেকদিন পর একটা চাপা উত্তেজনা ও আবিষ্কারের আনন্দ আবার বেলুনের মতো উড়ছিল। সে চেয়েছিল ওজন ও বয়স উপেক্ষা করে, অসাড় ও বন্ধ্যা দাম্পত্যজীবন অনেক নীচে রেখে তারা দুজন উড়ে যাবে। নর্মাল মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা জীবনটাকে আকাশ থেকে না দেখলে কি চেনা যায়? বোঝা যায় যে, জীবনের সব পথ খালি কাটাকুটি খেলছে, যত পেঁচিয়ে উঠছে তত শীর্ণ হচ্ছে? প্যারাগ্লাইডিং করতে-করতে সে দেখতে চেয়েছে জীবনের চড়াই-উতড়াই, মানচিত্র খুঁজে বুঝে নিতে চেয়েছে বিশল্যকরণীর লুকানো পায়ে-চলা পথ। অনেকদিন পর সুদীপের কাছে তার এটুকুই চাহিদা ছিল খালি। অথচ শেষ মুহূর্তে এসে বরাবরের মতো সুদীপ পিছিয়ে গেল। প্রতারণা করে সরে গেল তৃণার পাশ থেকে।
বোধহয় সুদীপকে শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে তৃণা একা-একাই প্রস্তুত হয় প্যারাগ্লাইডিং-এর জন্য। গাইড তার কোমরের সাথে বেল্ট বেঁধে দিয়েছে। এখন অপেক্ষা হাওয়ার। মিনিট কয়েকের মধ্যেই হাওয়া এসে পড়ে। সেই কয়েকটা মিনিট যেন জলের মধ্যে ডুবে ছিল তৃণা। শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। দু’ঠোঁটের ফাঁক থেকে হতাশা বেরিয়ে বুড়বুড়ি কেটে উঠে যাচ্ছিল মেঘের মধ্যে। তবে মিনিটখানেকের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। হাওয়ার ঝাপট এসে পড়তেই ছোট্ট রান-আপের পর তৃণা ভেসে চলল বাতাসে। তার পায়ের নীচ থেকে যখন মাটি সরে যায়, আর খোলা বাতাসে থরথর করে কাঁপতে থাকে প্যারাসুটখানা, তখন মৃত্যুর ভয় আর মুক্তির আনন্দ একই সাথে খেলা করে তার মনের মধ্যে। তাজা ফুলের মতো চোখের কোনায় একফোঁটা জল জমে ওঠে। সে বোঝে, মৃত্যুর ভয়কে অতিক্রম না করে মুক্তির স্বাদ পাওয়া চলে না।
৫.
গাড়ি যখন তাদের হোটেলে ফিরিয়ে দিল, তখন সন্ধে নেমেছে সবে। ইতোমধ্যে সুদীপ অনেকবার পরখ করার চেষ্টা করেছে। গাড়ির ড্রাইভার, যে গতকালই তাদের ধুংফা মঠে নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছেও কোনও স্মৃতি নেই। সেও বলছে আজই প্রথম এই হোটেল থেকে তাকে ডাকা হল। আজ ২৫ মার্চ। ২৪ মার্চ সে ব্যাটা গিয়েছিল দার্জিলিং, অন্য একটি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে।
তারা যে সত্যিই একটা টাইম-লুপে আটকে পড়েছে, বার বার সেই সত্যটিই যখন প্রতিভাত হতে থাকল, তখন সুদীপের কেন যেন তৃণার ওপরেই খুব রাগ হল। যেন গোটা ব্যাপারটা তৃণার দোষেই, তৃণার প্ররোচনা ও চক্রান্তেই সংঘটিত হয়ে চলেছে। কিন্তু রাগ প্রকাশেরও একটা সুযোগ দরকার হয়। সুদীপ সেই সুযোগ পেল না। কারণ তৃণা কোনও কথারই উত্তর দিচ্ছে না। সিটে মাথা রেখে পাথরের মতো বসে আছে। এই পাথর-মূর্তিকে সুদীপ চেনে না; তার অস্বস্তি বাড়ে, বরাবরের মতো একটা জলজ্যান্ত মেয়েমানুষকে খুঁজে না পেয়ে তার উৎকণ্ঠা বাড়ে, রক্তচাপ বাড়ে, মাথার শিরাগুলি দপদপ করতে শুরু করে। একটা বুকফাটা চিৎকার তার আলজিভের ডালে সুতোর মতো এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে, সারাটা সময় অনেক চেষ্টা করেও সেই জট সে সারাতে পারে না।
রুমে ঢুকে তৃণা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। সুদীপ কিছুক্ষণ একা-একা পায়চারি করে হুইস্কির বোতলটা নিয়ে বসল টেবিলে। বিছানার দিকে পিছন ফিরে। দু’পেগ চড়াতে-না-চড়াতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। মাথার মধ্যে এখন একটা সমুদ্র খালি ফুঁসছে, আর উথালপাতাল দুলে চলেছে… ঠিক এমন সময় তৃণার গলা পাওয়া যায়, ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি কোথায় গেলি? এই তো, এই তো, আয় এখানে এসে বোস, এখানে এসে বোস…’
তৃণা আবদার করে আর বাধ্য পোষ্যের মতো প্রজাপতি তার কথা শোনে। যেখানে বসতে বলে বসে, যেখানে উড়তে বলে ওড়ে। এভাবে উড়তে-উড়তে প্রজাপতি একবার যখন সুদীপের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে, তখন সুদীপ আর স্থির থাকতে পারে না। সে চিৎকার করতে-করতে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো প্রজাপতির দিকে ছুটে যায়। প্রজাপতিকে মুঠোয় ধরে পিষে ফেলতে চায়, থেঁতলে ফেলতে চায়… অথচ প্রজাপতি কীভাবে যেন তার মোটা-মোটা আঙুলের ফাঁক গলে ঠিক পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াতে থাকে। আর তৃণা হাসে। ডাকিনীর অট্টহাসির মতো ভয়ঙ্কর সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে সুদীপের মাথার মধ্যে চক্রের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সুদীপ হাঁপিয়ে যায়। গোটা শরীর কাঁপতে থাকে। রক্তচাপ বাড়ে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুতগামী হয়। মাথার শিরা ফুলে ওঠে। কিন্তু এত দৌড়ঝাঁপ করেও প্রজাপতির নাগাল সে পায় না। তখন সে বিছানার ওপর ধপ করে বসে। বলে, ‘তৃণা, আমি আর পারছি না। আমি এই লুপ থেকে বেরোতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করো। তুমি কথা বলো…’
তৃণা বিছানা থেকে এবার নামে। দু’কাপ চা বানায়। ব্যাগ থেকে একটা টি-কেক বের করে ছুরি দিয়ে কাটে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা তুমি সুইসাইড করতে পারবে?’
‘কী?’
‘মরতে পারবে? মরলে হয়তো লুপ ভেঙে বেরোতে পারবে।’
‘পারব না।’
‘তাহলে এক কাজ করো। ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে না কেঁদো না। তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখলেই তোমার মায়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে আমার।’
‘মায়ের মৃত্যু?’
‘তখনও এভাবেই কাঁদছিলে। মনে নেই?’
‘তো মা মারা গেলে কি হাসব না কি?’
‘আমার মা’ও মারা গিয়েছে অনেক ছোটবেলাতে। আমিও কষ্ট পেয়েছি। তাই বলে সারাদিন ধরে সানাইয়ের মতো প্যাঁ-প্যাঁ করে কাঁদতে হবে?’ তৃণা গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলছে আর মনে-মনে হাসছে। তার এখন মজা করতে ইচ্ছে করছে সুদীপের সাথে। মনের দেওয়ালে তার দীর্ঘ কষ্টের ম্যুরালখানায় যেন নতুন রং লাগতে শুরু করেছে। প্রজাপতির পাখার রং। এতদিন যে হৃদয় ছিল শুঁয়োপোকার মতো মন্থর, আজকে তাই ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে এক ঘর থেকে আরেক ঘর। এখন শুধু জানলা খুলে দেওয়াটাই বাকি।
কিন্তু তৃণার ঠাট্টা সুদীপ ঠিক ধরতে পারে না। চাপা রাগে তার মুখখানা বেগুনি হয়ে ওঠে। বলে, ‘তুমি মায়ের মর্ম বুঝবে না।’
‘কেন? আমার বুঝি মা ছিল না?’
‘তা বলিনি’, সুদীপ আবার নরম হয়ে আসে, কিছুক্ষণ দাড়ি চুলকে, দোনামনা করে বলে, ‘আসলে তুমি তো ঠিক আমাদের মতো স্বাভাবিক মানুষ না।’
‘স্বাভাবিক নই?’
‘আসলে তোমাকে কখনও বলিনি। আজকে বলছি। তুমি অভিশপ্ত মানুষ তৃণা। তুমি অপয়া।’
‘কী?’
‘হ্যাঁ। তোমার সাথে বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে মা মারা গেল। তোমার সাথে বিয়ের পর আমার পদোন্নতি হচ্ছে না, আমি পারফর্ম করতে পারছি না। একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে তোমার জন্য। এই দ্যাখো, এই যে বেড়াতে এসে বিকট সমস্যার মধ্যে আমরা আটকে পড়লাম… আমি তো আগেও এসেছি, একা, কখনও তো এমন উদ্ভট কথা কেউ শোনেনি!’
‘তোমার ধারণা তুমি আমার জন্য টাইম-লুপে আটকে পড়েছ?’
‘আচ্ছা তুমি একটু ভেবে দেখো, নিজেই বুঝতে পারবে। কোনওদিন দেখেছ প্রজাপতি মানুষের পোষ মানে? এখনও বলবে তুমি সাধারণ মেয়েমানুষ? তোমার সাথে বিয়ের পর থেকে আমার জীবনটা…’
সারা পাহাড়ের বরফ যেন হোটেলের এই ঘরটায় গলে গলে পড়ে। মিনিটের পর মিনিট যায়, দুজনের কেউই কথা বলতে পারে না। অনেকক্ষণ পর সুদীপ বলে ওঠে, ‘কোনওদিন বলতে পারিনি। আজকে বলতে পেরে হালকা লাগছে।’
তৃণা একদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল দেওয়ালের দিকে। তার মনের মধ্যে কষ্টের প্রকাণ্ড ডেলাটা আবার ফিরে এসেছে। হৃদয় যেখানে নানা দিকে ডালপালা ছড়িয়ে দিতে চায়, ঠিক সেই সন্ধিস্থলে মৌচাকের মতো জমে আছে কষ্টটা। একটু-একটু মধু চুঁইয়ে পড়ছে চাকের গা বেয়ে। এই মধুর রং টকটকে লাল। রক্তের লাল না ভালবাসার লাল পরিষ্কার করে বুঝতে পারে না তৃণা। সুদীপের প্রতি ঘৃণা আর ভালবাসা মেশানো এক অদ্ভুত দমবন্ধকর অনুভূতি তার শিরার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়।
ঠিক এই সময়ে প্রজাপতিটি এসে তার হাতের ওপর বসে, তারপর যেন তৃণার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই মুখের চারপাশে বারদুয়েক ঘুরে দেওয়ালের দিকে উড়ে যায়। এই আবছা অন্ধকারের মধ্যেও তৃণা দেখতে পায় টিউবলাইটের পেছন থেকে একটা টিকটিকির মুখ উঁকি দিচ্ছে। প্রজাপতি উড়ে গিয়ে বসে টিউবের কিছুটা নীচে। তারপর টিকটিকিকে ছুটে আসতে দেখেও নড়ে না, স্থির পাথরের মতো বসে থাকে। টিকটিকি যখন তার শরীর কামড়ে ধরে, মুখের ভিতর নিয়ে নেয়, তখন তৃণার মনে হয় কাঁপতে-কাঁপতে প্রজাপতিটা তাকে কিছু বলছে… কী বলতে চাইছে টিকটিকিটা?
‘এতদিন চেপে ছিলাম। কোনওদিন তোমাকে বলতে পারব ভাবিনি।’ সুদীপ চোখের জল মুছে তৃণার দিকে তাকায়। যেন কিছু উত্তর প্রত্যাশা করে।
এতক্ষণ পর সুদীপের চোখে চোখ রেখে তৃণা শুধু একটা শব্দ বলে, ‘না।’
‘কী না?’
‘আমি অভিশপ্ত নই। যদি অভিশপ্তই হই, তবে সুদর্শনের কিছু হল না কেন?’
‘সুদর্শন কে?’
‘আমার প্রথম ভালবাসা। যার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার মামা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিল। তুমি আমাকে ভালবাসতে পারোনি। অথচ সুদর্শন এখনও আমার অপেক্ষায় আছে। প্রতিদিন তুমি অফিসে বেরিয়ে যাবার পর ও আসে। তোমার বেডরুমে। তোমার বিছানা ও চাদরে আমরা শরীর বিনিময় করি।’
‘ছি ছি ছি, বিয়ের আগের প্রেমিকের সাথে এখনও তুমি…’ সুদীপ ঘৃণায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। সেই ফুটন্ত উত্তেজনায় প্রতিহত না হয়ে খুব ধীরভাবে তৃণা বলে, ‘রেখেছি। কারণ ওকে আমি ভালবাসি। কারণ, ও তোমার মতো কাপুরুষ নয়। তোমার মতো…’
তৃণা বাক্যটি শেষ করতে পারে না। তার আগেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়। অথচ তৃণার কাছে এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল কি না নিশ্চিতভাবে আমরা বলতে পারি না। সুদীপ যখন জন্তুর মতো চিৎকার করতে করতে কেক কাটার ছুরিটা তৃণার বুকে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, আর তৃণা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠছিল তখন একটা চাপা অট্টহাসিও চিৎকারের সাথে অতর্কিতে মিশে যাচ্ছিল কি?
৬.
দ্বিতীয়বার বেল বাজতে তৃণা পাশ ফিরে তাকাল। বিছানায় সে একা। সুদীপ নেই। এত সকালে সুদীপ কোথায় গেল? কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরও দু’বার বেল বেজে ওঠে।
কম্বলখানা গায়ে জড়িয়েই উঠল তৃণা। দরজা খুলতে নেপালি টুপি পরা ছেলেটা একগাল হেসে বলল, ‘গুড মর্নিং ম্যাম!’ সাদা রঙের ট্রে-তে একটা কেটলি, দুটো কাপ, ছোট বাটিতে চিনি, দুটো চিনি গোলার চামচ আর একপাশে ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশনের বিবরণ দেওয়া চার পাতার কার্ড। ট্রে-টা টেবিলের ওপর রেখে ছেলেটা বগলের তলা থেকে খবরের কাগজ এগিয়ে দিল তৃণার দিকে।
ব্যাপারটা তৃণা এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও কাগজের তারিখটা দেখার আগে তার হার্ট বিট বেড়ে যায়, পেটের ভেতর গুড়গুড় করে। মিনিট কয়েক পর কাপে চা ঢেলে সে ফ্লাইটের টিকিট কাটতে বসে। না, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। সোজা কলকাতা, বালিগঞ্জের তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট। কিন্তু সেখানে গিয়েই বা সে করবে কী? থাকবে কার কাছে? বাবা-মা মারা গেছে অনেক বছর হল! আত্মীয়দের কারোর সাথেই সে সম্পর্ক রাখেনি। নিদেনপক্ষে কলেজের বন্ধুদের সাথেও যদি বন্ধুত্ব থাকত! এসব ভাবতে-ভাবতে তৃণা হাসে। ইশ, সত্যিই যদি সুদর্শন বলে তার কোনও গোপন বন্ধু থাকত…
২৬ মার্চ সন্ধেবেলা যখন সে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ঢোকে, তখন দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। এই সময়, এই শব্দ তার খুব প্রিয়। যেন বহু দূর থেকে এক ভিক্ষু ঝোলা ভর্তি করে মানুষের দুঃখ নিয়ে ফিরছে। তৃণা ছুট্টে পশ্চিমের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। গোটা আকাশ অপূর্ব রঙে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আর ওই যে, ঝোলা হাতে নিয়ে তার দিকেই একমুঠো দুঃখ চাইতে আসছে এক ভিক্ষু। অথচ অদ্ভুত, এই প্রথম গোটা হৃদয় কাঁচিয়েও তৃণা একবিন্দু দুঃখ খুঁজে পায় না। জীবনে এই প্রথম, কে জানে হয়তো এই শেষ, পবিত্র ভিক্ষুকে সে একেবারে খালি হাতে ফেরাবে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র