একটা হাওয়া উঠেছে চারদিকে ‘হাওয়া’ ছবিটা নিয়ে। চঞ্চল চৌধুরী দীর্ঘ দিন সুনামের সঙ্গে অভিনয় করে চলেছেন কিন্তু এপার বাংলা হঠাৎ করে কিছু দিন যাবৎ তাঁকে নিয়ে মহা চঞ্চল হয়ে উঠেছে।তার ওপর ‘সাদা সাদা কালা কালা ‘ গানের জ্বর। ছবিটা আবার বাংলাদেশ থেকে অস্কারের অফিসিয়াল এন্ট্রি। এর আগে নন্দনে গুটিকয় শো-এ শোরগোল তুলেছিল।স্বীকার করতে দ্বিধা নেই খুব উৎসাহ নিয়েই ‘হাওয়া’ দেখতে গিয়েছিলাম।গিয়ে এক মিশ্র অভিজ্ঞতা লাভ হলো। গল্পটা এরকম, কক্সবাজার থেকে একটা বোট (ট্রলার) যাচ্ছে সমুদ্রে মাছ ধরতে।সেই বোটের মাঝি (মুরুব্বি) চান মিয়া। সঙ্গে আরও কয়েকজন পুরুষ। ইব্রাহিম, এজা, উরকেস,পারকেস,নাগু,ফণি,মোরা এই কজন। ছবি শুরু হয় এক জড়িবুটির ফেরিওলার বক্তৃতা দিয়ে যেখানে বিশ্বাসে সব ঘটে গোছের কথা বলে গাছের গুণাগুণ প্রচার করে লোকটা। বলে, সমুদ্রে কোনো বিজ্ঞান চলে না। আমরা বুঝতে পারি সম্ভব অসম্ভবের এক মায়াজগতে ঢুকতে চলেছি।শুরু হয় একটা আশ্চর্য ভ্রমণ! আদিগন্ত জলের মাঝে একাকী ট্রলার নিয়ে চান মাঝি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ। একটা ষড়যন্ত্রের আভাষ থাকে। কারণ ইঞ্জিন মেকানিক ইব্রাহিম বোটের মালিকের অগোচরে লুকিয়ে মাছ বিক্রি করার প্রতিবাদ করে। কারণ তাতে তার হিস্যা থাকে না। অন্যদের যুক্তি,সে তো মাছ ধরে না।সমান হিস্যা চায় কি ভাবে? এদিকে ভাগ না পেলে সে ফিরে গিয়ে মহাজনকে এদের কীর্তি কলাপ ফাঁস করে দিতে পারে। ঠিক হয় সুযোগ বুঝে ইঞ্জিন মেকানিক কে নিকেশ করা হবে। অনেক আশা নিয়ে বোট বেরিয়েছে, কিন্তু মাছ তেমন ধরা পড়ছে না। এমন এক সময় জালে এক রহস্যময়ী নারী ওঠে। প্রথমে তাকে মৃত মনে হলেও কিছুক্ষণ পরে জানা যায় সে জীবিত কিন্তু কথা বলতে পারে না।আদ্যন্ত পুরুষ অধ্যুষিত জগতে হঠাৎ নারীর আগমন। মৃণাল সেনের ‘জেনেসিস’ ছবির কথা এক ঝলক মনে পড়ে।
কিন্তু এছবির অভিমুখ অন্য। ইঞ্জিন মেকানিকের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক হয়। তাদের কথোপকথনেই (আসলে বোবা নয়,ভাণ)জানা যায় মেয়েটি বেদেনি, নাম গুলতি।বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সে এই বোটে এসেছে। চান মাঝি এককালে জলদস্যু ছিল।আজ থেকে সাত বছর আগে সে-ই নির্মম ভাবে তার বাবাকে হত্যা করে । এরপর একে একে দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। ইঞ্জিনের বেঞ্জো নাট কেটে যায়,যেটা ছাড়া ইঞ্জিন চলবে না। রহস্যজনক ভাবে বহুমূল্য জাল কেটে জলে ভেসে যায়। পাল নষ্ট হয়ে যায়। জ্বালানির ড্রাম ফুটো হয়ে যায়। ফুরিয়ে আসতে থাকে পানীয় জলের মজুত।শুরু হয় পরস্পর কে অবিশ্বাস, সন্দেহ। তারপর এক ধুন্ধুমার লেগে যায়। চঞ্চল চৌধুরী চান মাঝির ভূমিকায় অপূর্ব। ওইরকম অনাবিল হাসি আর মায়াময় চোখের অভিনেতা নিজেকে কতটা ভাঙচুর করলে ‘আনকুথ’ চান মাঝিকে সৃষ্টি করা যায় তা কল্পনার বাইরে। নিজেকে ভেঙেছেন, কন্ঠস্বর ভেঙেছেন আর সঙ্গে পান চেবানো ম্যানারিজম আর কুটিল চাউনি। এককথায় দুর্দান্ত। নাসির উদ্দিন খান আরেকজন পছন্দের অভিনেতা। নাগুর চরিত্রে তিনিও অনবদ্য। বিশেষ করে,’ আমি বলি কি…’ কয়েকবার বলেও কথা বলার সুযোগ না পাওয়ার সময়টা। এবং অবশেষে বলে ফেলা,মেয়েটা বোটেই থাক। কিংবা জ্বলন্ত সিগারেট মুখের ভিতর ঢুকিয়ে জলে ডুবে জাল ছাড়ানোর সময়। অন্যান্য অভিনেতারা চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। একমাত্র গুলতির ভূমিকায় নাজিফা টুশি কে আঁকা ভুরুর জন্য বেমানান লেগেছে। অসাধারণ চিত্রগ্রহণ। আর পরিমিত রঙের ব্যবহার। মাঝিদের আঁকাড়া জীবনের চমৎকার দৃশ্যায়ন। আবহসংগীতেও একটা ছমছমে বুক মোচড়ানো অভিঘাত।
মুশকিল হলো, গল্পের শেষটা নিয়ে। সেটা এতটাই কষ্টকল্পিত, না হয়েছে রূপকথা, না হয়েছে যাদুবাস্তব।যার একমাত্র লক্ষ্য চান মিয়াকে হত্যা করে বাবার হত্যার বদলা নেওয়া,সে প্রথম সুযোগেই,যখন চান মিয়া সকলে গান বাজনায় ( সাদা সাদা কালা কালা)ব্যস্ত দেখে আড়ালে গুলতিকে কু প্রস্তাব দেয়, তখন হাতে অস্ত্র থাকতেও সে চান মিয়াকে শুধুই হুমকি দিয়ে ছেড়ে দেয় কেন? কেন একজনের আগের অন্যায়ের খেসারত দিতে বেঘোরে প্রাণ যায় সবার? রূপকথার চালু ট্রোপ তো ধর্মের জয়, অধর্মের পরাজয়। এ ছবিতে মুড়ি মিছরি সবার এক অবস্থা। আরও গুলিয়ে যায় রহস্যময়ী নারীর ‘টাট্টিখানা’ যাওয়ার মতো জৈবিক প্রয়োজনও দেখিয়ে দর্শকদের বোঝানো হয় এই রহস্যময়ী আদতে রক্তমাংসের মানুষ।একের পর এক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে থাকলে আমরা বুঝতে পারি বার্নাম বন বুঝি হেঁটে নামছে। কিন্তু চান মিয়া কোনো ম্যাকবেথ না। তাই মহাকাব্য না হয়ে ‘হাওয়া’ নেহায়েত একটা ইচ্ছাধারী নাগিনের গাঁজাখুরি ছবি হয়ে থাকে। মেজবাউর রহমান সুমন বড় যত্ন নিয়ে ছবিটা বানিয়েছেন।তাই মন খারাপ হয়। বাংলা ছবিতে আগে না দেখা এক আশ্চর্য জগৎ থেকে ধপাস করে রামসে ব্রাদার্স কার ভালো লাগে বলুন?