কাজলভৈরবী
স্পর্শের অধীন নয়
এখন দৃশ্যমানতার আড়ালে দেখি
লুকিয়ে-পড়া সব পাখি, যাদের ক্রন্দন
মিশেছে হৃত নদীর ছলছলে
যেভাবে অরণ্যে কাজল মিশেছিল
গূঢ় আলোহৃদয়ের সাথে পেতেছিল
নিঝুম সংসার
কুঠারসীমানা থেকে দূর
আমার আঙুলে আজ ওদের গেরস্থালি
স্মৃতির অমোচ্য আশ্লেষ ছিঁড়ে কে কাকে
ভোলাতে পারে নাড়ি!
আলগা মুঠির থেকে কেবল খসে যায়
ধাতব মুদ্রাসকল
যশ, নাম পরিচয়
যে জানে সে জানে
আলোর ওপারে আলো
স্মৃতির অরণ্যে জমা কাজলভৈরবী।
অসন্তাপ
যে আমাকে নিয়ে এল এতদূর তোমার সমীপে
সে-ই ফিরিয়ে দেবে এক ঝটকায়
অকস্মাৎ কোনও একদিন
পথের দুঃখগুলি সব আমি তবু পালক করে রাখি
জানি তোমামুখী অভিগমনের এই পথ
এক গভীর নিঃস্বতার নাম
এরও এক অপার আলো আছে
যা লেগে রয় সমূহ প্রার্থনার গায়ে
শুধু ভাবি, ঘোর ছিল অসম্পূর্ণ নিদ্রার
এই জাগরণটুকুর আগে যেমন
ঘুমিয়ে পড়ব ফের তার নিপুণ প্রত্যাখ্যানে
মাঝখানে এই সুকোমল ধৈবতে
বেজে যায় আমাদের যাপিত সময়
বিরহ লুকিয়ে রেখেছি সুপ্রাচীন
এক বৃক্ষের গোপন খোঁড়লে
তোমার কাছ থেকে ফিরে আসতে আসতে
তারই সঙ্গে আমার সমস্ত আলাপচারি
সবকিছু দৈব দান ভেবে সযত্নে কুড়াই
আর ভরে নিই শূন্য হাতের ঝাঁপি
তবু তোমাকে না ভোলার প্রত্যয়
আমার জীবনজুড়ে থাক
আমার তাবৎ কষ্টগানে
আমার ছায়া কুড়াবার ঘোরে
ক্লান্তিহীন নিরুপদ্রুত কোনও ঘুমের ভেতর…
যৌথজীবন
যদি সত্য হও, তবে খুলে নাও ছায়া
ভেঙে এসো দ্বিধার দুয়ার, খাঁচা
পরিযায়ী পালকের বেগবতী গানে
অগ্নিময় নীলের ফণায় লেখা যে-নিমন্ত্রণ
তার আহ্বানে দুরন্ত শুশুকের পিঠে
একদিন নামহীন নাবিক এক ছেড়েছিল ঘর
কোরাল রিফের গায়ে কে এঁকেছে
সেই ভ্রমণের সব স্মৃতি—
অবিকল স্থির স্মৃতির ম্যুরাল
যদি সত্য হও, তবে একটানে
খুলে নাও সব পিছুটান, বুকের জমিন চিরে
পুঁতে নাও প্রণয় আদ্যবীজ
আগুনে আত্মাহুতি
ওইখানে জেগে আছে নীল সমিধের ফণা
ওইখানে ঘূর্ণিহাওয়া, ভাসমান মেঘ
আমি-তুমি অলোকের ধ্যানের আরক
যদি শুদ্ধ হও, ফেলে এসো মৃত্যুভীতি
যুদ্ধহীন যত পরাজয়, নিয়তি নতির লিখন
আমাদের ঘর হোক দুরন্ত শুশুকের পিঠ
হাওয়ায় ভাসান, উড়ানের অভ্র অপার, লঘু
আমাদের ঘর হোক অচিন অবাক
দারুচিনি দ্বীপ, কাজলের মেঘ সারি সারি…
একটি ছায়াঘন মুখ
হেমন্তমঙ্গল পড়ি উঠানে চাঁদের পাটি
সান্ধ্যাভোজের পর লেখা প্রাণসমাবেশ
সর্ষেশিরিষ ঘ্রাণে উড়ে যায়
আজও কামার্ত পাখির পাল—
ডাকাতিয়া-পথ বেয়ে খাল; শাপলার বিল
ছেড়ে পাটগাঁও— জলের নম্র কোমলে
জ্বরতপ্ত-হাত
ফেরে এক ধেয়ানী বালক :
ঘন বাঁশঝাড় ফেলে যেতে যেতে
নিঃশব্দ দুপুরের গায়ে এসে নামে
অসংখ্য সাদা বক, দুধেল ডানায়
ধানের চারার পাশে নত কোমল মুখখানি কার
ভাঁজ খুলে পড়ে প্রিয়তম চিঠি
ঢেঁকিছাঁটা চালের মতন তার
হাতের আঙুল; প্রগাঢ় বিনুনী পিঠে
আচানক নেচে ওঠে গোপন খুশির ঝিলিকে
ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাতে দুধরাজ কচুপাতা
নীরবে আলপনা বোনে
নদীপথ-শাপলার-বিল-বাঁশঝাড়
ধান্যচারার পাশে স্থির সেই ছায়াঘন মুখ
আজও আছে— বিমূর্ত ছবির ন্যায়
শুধু চারপাশে তার ঘনায়িত প্রেতিনী আঁধার…
জলবায়ু বদলের ঢঙে পাল্টে যাবার এই গল্পে
বেবুশ্যার বিক্ষত যোনির ভেতর
ঢুকে গেছে মাঙ্গলিক গ্রাম
ধবধবে শাদা ভাতের অন্ধ থালায় পথহীন
আমাদের আর ফিরবার তাড়া নেই
আড়াল পটের ’পরে ভাসমান
শুধু এক বিমূর্ত মুখরেখা।
একটি পাখির পালক, তার হেমন্ত গান
অনন্তনীলের থেকে আলগোছে নেমেছে শার্সিতে
এক পাখির পালক, চুপে— ‘মনে পড়ে, পাখি ছিলে
সবুজ পাতার ফাঁকে? ফিরে দেখো, ছোঁও,’ এই বলে
সে ঢুকে পড়ে মানবীর রূপে; তার চুম্বন থেকে
ঝরে চলে হেমন্তের শব্দরাশি, কলকল তানে
না, কিছুই বলিনি, কেবল তার সুকোমল স্তন
ছুঁয়ে দেখি, পাঁচ আঙুল বেয়ে নেমে যাচ্ছে পাঁচটি
গানের সুর, ধবল দুধের নহর। কৈশোরক
স্বপ্নের ঘোরে আমি মেতে উঠি নক্ষত্রের আলোয়
হেমন্ত বাতাসে আবার এইমাত্র উড়ে গেছে সে
আকাশ ভেঙে শব্দেরা অবিরল সঙ্গমনন্দনে
ঝরে যাচ্ছে সেই থেকে নদীজল-অরণ্য-পর্বতে
খরাদগ্ধ মাঠে, ঘুমে, জাগরণে। দিনের ব্যস্ততা
জুড়ে তোর ঘনচুম্বনলীলা, কল্পকলনাদে
শুনি কামার্দ্র সঙ্গীত, স্বপ্নবিদ্ধ উড়ে চলি দূর।