দারুণ এক চঞ্চলতা দিয়ে তৈরি ছিল নিহাল। সে হুশহাশ করে খেত, ফড়ফড় করে লিখত, তার চলন ছিল দ্রুত, সিদ্ধান্ত নিত মুহূর্তে। কলেজের বন্ধুরা তাকে একটা পোস্টার বাঁধিয়ে দিয়েছিল— তাতে বড়সড় হরফে লেখা ‘লুক বিফোর ইউ লিপ’। কিন্তু অত বাছবিচার করে লাফ দেবার কিংবা জিভ ছুড়বার স্বভাব তো হয় অ্যাম্ফিবিয়ানদের, নিহাল বলত। অত নজর করে ফড়িং শিকার করার সময় কি তার আছে? তা একবার চোখ বুলিয়েই মুখস্ত করে নিত সে, যা কিছু শুনত তাই সে স্মৃতিতে গেঁথে নিত; আমরা, মানে আমি-তৌফিক-সানোয়ার আর বেলায়েত, রেন সাহেব অ্যান্ড মার্টিন সাহেবের গুষ্টি উদ্ধার করতে-করতে স্যারের মুখে শুনতাম ইংরেজিতে ওরকম স্মৃতিশক্তিকে বলে— ফোটোগ্রাফিক মেমরি, বাংলায় বলে— শ্রুতিধর। পরীক্ষার হলে ইনভিজিলেটরকে ও-ই প্রথম হাঁক দিত এক্সট্রা পেপার চেয়ে। ইস্কুলে ডবল প্রমোশন পেয়েছিল সে। ওসব সেকালে হত— গতিময়তা দেখলেই বড়রা তখন ছোটদের টেনে লম্বা করে দিত ওসব দিয়ে। আমাদের ভেতর ওরই গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছিল প্রথম, গলা ভেঙেছিল, মাথায় আমাদের সব্বাইকে ছাড়িয়ে উঠেছিল সে। শাপলার মৃণাল নাকি গভীরে, অতি গভীরে বানের টান টের পায়; নিহাল ওরকম কোনো টানেই যেন বেড়ে উঠছিল।
অমন তড়বড়িয়ে বাড়তে থাকলে স্বভাবতই আমাদের গুরুজনরা নানান কথা বলতেন, আমাদের সেইসব ঢিকিয়ে-ঢিকিয়ে চলা মহল্লাগুলো গতি-প্রগতি ইত্যাদি সহ্য করত না। প্রাথমিক বিদ্যালাভের একটি বড় সময় নিহালকে সব শিক্ষকই একবার করে ঈশপের খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার আখ্যান শুনিয়ে ফেলেছেন। বিভূতিস্যার ঋণাত্মক হুমকি দিতেন, ‘অতি বাড় বেড়ো না, ভেঙে পড়ে যাবে।’ কেউ তাকে তারিফ করে বলত না, বৃহৎ ও মহৎ জীবনের সমস্ত লক্ষণ তার শৈশবে ফুটে বেরোচ্ছে। আমাদের দেশে ওসব বলে-টলে না, বড়জোর ‘উঠন্তি মূলো’ বলে। সে অক্লেশে তার প্রতিযোগী সহপাঠীদের বাংলা-ইংরেজির নোট করে দিত, এক-একজনেরটা এক-একরকম। যার নোট করে দিত, সে খুশি হত কিন্তু আড়ালে মুখ বাঁকিয়ে বলত, ‘এহ, বিদ্যা জাহির করতে নিহালের কী আনন্দ!’ খেলার মাঠে নিহাল কখনও পড়ে গেলে মানুষ যেন উল্লসিত হত, সহপাঠীরা তো বটেই, তাদের বাপ-মায়েরাও। সুকুমার রায় শুনিয়েছিলেন, জর্জ স্টিফেনসনের বাষ্পীয় ইঞ্জিনের লোকোমোটিভকে নাকি ঘোড়দৌড়ের সাথে পাল্লা দিতে হয়েছিল প্রথম, ইঞ্জিন স্টার্ট হতে সময় লাগে বলে দুয়ো দিচ্ছিল লোকে, তারপর এক সময় ঘোড়াকে পিছে ফেলে ইঞ্জিন চলে গেল বহু মাইল দূর, তখন তাক লেগে গেছিল লোকেদের। নিহালের ইঞ্জিন তো স্টার্ট হতেও দেরি হয়নি। সে তাই ওসব গায়ে মাখত না, এক রকমের প্রাকৃতিক দার্শনিকতা ওকে ঘিরে থাকত, আর ছিল গভীর মনোবল; অমন জিনিসকে মট করে ভাঙা যায় না, ছাগল দিয়েও মুড়ানো যায় না। খণ্ডিত করে ছাড়া হৃদয়ঙ্গমও করা যায় না বোধহয়। বলতে পারেন আমরা ওকে ওভাবে বুঝবার চেষ্টা করতাম।
ওকে আমরা চঞ্চল দেখতাম, ওর ভেতরকার অস্থিরতার খবর আমরা পেতাম না। ভাবতাম হয়তো সেখানটা ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রচক্ষুর মতো স্থির। আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে গেলাম, নিহাল তদ্দিনে মেডিক্যাল কলেজে পড়ালেখা করছে। পায়চারি করে-করে পড়া মুখস্ত করত। আমাদের সঙ্গে দেখা হলেই হাড়গোড়-মেদমাংস সব পড়িয়ে ফেলত। দেখা গেল আমাদের সেই পোস্টারের সতর্কবাণীকে সে আমল দেয়নি। নিহালের রুমমেট ছিল প্রবীর, হলের চুনিবাবু, দুর্বুদ্ধি দেবার ওস্তাদ লোক। ওর সঙ্গে মিশে নিহাল বাজারের ব্রিল ক্রিম চুলে মেখে জন ট্রাভোল্টার মতন কানের পেছনে দু-পাশ থেকে ফাঁপিয়ে পেছনে কেমন করে নিয়ে যেত, বার বার আঙুল বা চিরুনি চালিয়ে ঠিক করে রাখত। চালিয়াতটার পরামর্শেই কি না কে জানে, একদিন মেডিক্যালের পড়ালেখা ছেড়েছুড়ে দিয়ে নিহাল ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত, আমরা যারা ভেবেছিলাম নিহাল পদে-পদে কেবল স্বর্ণপদক পাবে, তারা খুশি হয়েছিলাম না কি দুঃখিত, তা আজ অ্যাদ্দিন পরে হলফ করে বলা মুশকিল।
মেডিক্যাল ছাড়বার আগে অবশ্য নিহালের জীবনে একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটেছিল। তাকে একটি মেয়ে ভালবাসত। সারা মেডিক্যাল কলেজে অমন মেয়ে ছিল না। চুল দুলিয়ে-দুলিয়ে যারা এগ শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন করত, তাদের মতো একঢাল রেশমি চুলের বোঝা। মাথার সিঁথি থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন, যেন জ্যোতি বের হচ্ছে গা থেকে। সপ্রতিভ মুখের ভাব, সতেজ তার চলার ভঙ্গি। ভাল ছাত্রী, ভাল গান করত। ফার্স্ট ইয়ারে তাকে দেখামাত্র হুড়মুড়িয়ে প্রেমে পড়ে গেলাম আমরা। আমাদের অসংলগ্ন মনের কল্পনাতে ঢুকে গেল সে। কিন্তু প্রেম হল তার নিহালের সঙ্গে। দুজনে জোড় বেঁধে ঘুরত যখন, কী আশ্চর্য সুন্দর দেখাত ওদের। মেয়েটির নাম সুরাইয়া। সপ্তর্ষিমণ্ডলের তারকা।
প্রেমের গল্প সুরাইয়ার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগল না। নিহালকে তলব করা হল, বা নিহাল নিজেই গেল। ফিরে এসে সে গুম হয়ে রইল কিছুদিন। ডায়রিতে কীসব হাবিজাবি লিখত, সে রুমে না থাকলেই আমরা তার ডায়রি খুলে পড়তাম, পড়ে হাসাহাসি করতাম, তেমনি একদিন তার ডায়রি খুলে দেখি লিখে রেখেছে—
‘ডিম থেকে কীড়া, কীড়া থেকে পুত্তলি, পুত্তলি থেকে পতঙ্গ। স্ত্রীপোকা আর পুংপোকা অন্ধ-প্রবৃত্তিতে সঙ্গম করে, ডিম ফোটানো ছাড়া তাদের আর জীবনের উদ্দেশ্য বলতে কিছু নেই। ডিমের যত্ন বলতে কিছু নেই। ডিম পেড়ে মরে যায় পোকা। আমাকে পোকার মতন হতে বলছ?’
মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না! ডায়রিতে যে-জীবনের ইঙ্গিত নিহাল করেছে, বহু কর্মবীর-বহু জিনিয়াস সেই জীবনই পাড়ি দিয়েছে, তাতে কার কী বা ক্ষতি হয়েছে?
একদিন মধ্যরাতে হলের মোড়ে সেদ্ধ ডিমওয়ালার সামনে পাকড়াও করলাম তাকে, ‘কী রে তর কী হইছে? সুরাইয়ার লগে দেখি না তরে? প্রবীর কইল, সুরাইয়ারেও দেখে না ক্লাস করতে!’ নিহাল হাসল, ফসফসিয়ে সিগ্রেট খেল, উত্তর দিল না। উত্তরের অভাব আমরা যে যার মতো পূরণ করে নিলাম। যেমন— নিহালের পরিবারের অবস্থা সুরাইয়ার পরিবারের পছন্দ হয়নি।
যেমন— নিহালের আসলে বাপই নেই, মরে গেছে তা নয়, নেইই। ওরকম বাড়িতে কেউ মেয়ে দেয় নাকি, তাও সুরাইয়ার মতো মেয়ে!
যেমন— সুরাইয়ার বড় ভাই বুঝিয়েসুঝিয়ে নিহালকে ঘরজামাই হতে বলেছিল, নিহাল রাজি হয়নি।
যেমন— সুরাইয়া আসলে প্রেগন্যান্ট, তাই মেডিক্যাল কলেজে আর আসছে না, সেজন্যই নিহালকে ডেকে নিয়েছিল ওরা, উড়নচণ্ডীটা বিয়ে করবে না।
এসব ভেবেচিন্তে আমরা যে খুব নিরুচ্চার ছিলাম, তাও নয়। মনভাঙা সেই হতোদ্যম দশায় নিহাল হয়তো আবিষ্কার করেছিল, রুচি বিসর্জন দিয়ে মানুষের সান্নিধ্য পেতে হয়, বড় চড়া তার দর। আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত… আমরা জানি না, নিহাল মুখ ফুটে কিছু বলেনি।
বিয়েও করে নিয়েছিল খুব শিগগিরি। ইংরেজির আকমলস্যার যে বলতেন, ‘নিহাল পুটস কার্ট বিফোর দ্য হর্স’, সেটা তদ্দিনে সত্যি হল দেখে আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মেয়েটি অবশ্য ভারি শান্ত-সুশীলা, নরম-সরম, কথায় সামান্য উত্তরবঙ্গের টান আছে। অত জঙ্গম স্বামীর পাশে যেন একটি স্থাবর স্ত্রী। নাম রাখী। রাখী সরকার। মুভি অফ দ্য উইকে চল্লিশের দশকের একটা সাদাকালো ছবি দেখিয়েছিল, সেখানে আমরা ক্যারি গ্রান্টের সাথে রোজালিন্ড রাসেলকে খুব দ্রুতলয়ে ক্থা বলতে দেখেছিলাম, ঠাট্টা করে বলতাম— নিহাল আর ওর বৌয়ের কথাবার্তা হবে ওরকম, ছররার মতো শব্দ বের হতে থাকবে। তা হয়নি। সুরাইয়ার বান্ধবীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরা খুশিমনে বললাম, ‘নিহাল আসলে সুরাইয়ার যোগ্য ছিল না, ওই গাঁওগেরামের রাখী-পাখীরাই ওর মতন গোঁয়ারগোবিন্দর লগে সংসার করার উপযোগী, নিহাল যাই কইব— ঘোমটার ভিতর থিকা বৌ সুর তুইল্যা কইবো ‘আফনে যা বলবেন’।’ অনেক পরে আমরা বলাবলি করতাম, ক্ষয়ই ক্ষতি, মানুষের অত কথায় নিহালের কোথায় ক্ষয় ধরে গেছিল সে নিজেও হয়তো টের পায়নি, হয়তো সমস্ত মন স্থবিরতা চাইছিল তার। নিহালের ক্ষয়ক্ষতি বা স্থবিরতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দুঃখ করতে বেজায় ভালো লাগত। মেডিক্যাল হোস্টেলের সামনে তড়বড় করে বেড়ে ওঠা নীলগিরি গাছগুলো একবার ঝড়ের পরে মুখ থুবড়ে পড়ল, ওরা খানিকটা যেন নিহালের মতো। সত্যি বলতে কি, যার নাম করে চিরকাল চড়চাপড়-কিল-জুলপি-টানা খেয়েছি, যার পা-ধোয়া পানি আমাদের পান করতে নিত্য উপদেশ দিতেন বড়রা, তাকে অমন করে নিভে যেতে দেখে ভারমুক্ত হয়েছিলাম যেন।
নিহাল কখনও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি, মানুষ চেনেনি, ও ব্যবসা করবে কী করে! বইই ছিল নিহালের বোরাক এবং খোরাক। বদমাইস প্রবীরের প্ররোচনায় কক্ষচ্যুত হবার পর কেন্দ্রাতিগ গতিতে সে কোন দূরে গিয়ে পড়ল তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে সময় পেলাম না, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার নানান প্রশ্ন ততদিনে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত, যে যার মতো পাশ করলাম। আমাদের মায়েদের বনস্পতির টিনে ডাল থাকত, কেরোসিনের টিনে চাল… সেইরকম করে আমরা এক-একজন এক-এক বিষয়ে পড়ালেখা করে সম্পূর্ণ অন্য পেশায় চলে গেলাম, কেউ-কেউ বিসিএস দিলাম, কেউ ডবল এমএ করে সরকারি ইস্কুলে ছাত্র-ঠেঙানোর গুরুদায়িত্ব নিলাম, কেউ বিমা কোম্পানির দালাল। আমাদের নিহালকে উসকে দিয়ে ওর ফিউচার নষ্ট করলেও হতভাগা প্রবীরটা নিজে ক্যান্টিনের টাকা মেরে, স্যাম্পল বিক্রি করে, ডাক্তারি পাশ দিয়ে অবশেষে গণস্বাস্থ্যে চলে গেল। নিজেদের তবু কেউ ‘নষ্ট প্রতিভা’ ডাকলাম না, প্রতিভা তো আমাদের ছিল না।
আমাদের ছাত্রাবস্থায় তো মোবাইল ফোন ছিল না, খুব সহজে একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। প্রবীর এসে একদিন বলল, নিহাল নাকি জয়পুরহাটে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ডিসপেন্সারি খুলে বসেছে। সে পরে ডাক্তারি পাশ করেছিল কি না, সেটা প্রবীরও সঠিক জানে না! ‘তোরা ভাই বিশ্বাস করতে পারবি না, সেই গ্রামে গরুর গাড়িও যায় না, খবরের কাগজও পৌঁছায় না!’ গ্রামে গিয়ে চাষবাস করব, ক্ষেতিখোলা করব, নিরক্ষর চাষার ভাই আরেক চাষা হব, ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’… ‘দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিলেন বড়’… এইসবই না লিখেছিলাম আমরা রচনায়? নিহালও লিখেছিল তো। লিখলেই বিশ্বাস করতে হবে নাকি!
আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত রওনা হলাম পাঁচবিবির সেই গণ্ডগ্রামে, নিহালের দুর্দশা দেখতে। শ্রীপ্রমথনাথ বিশী নাকি লিখেছিলেন, ‘অন্বেষণেই তো মৃগয়ার আনন্দ।’ চললাম মৃগয়ায়। গাবতলী থেকে মুড়ির টিন বাসে, এই রুটে মানুষ কম ছিল তখন, যাত্রীর আশায় বেলার তোয়াক্কা না করে বাস বসেই থাকত। সারাবেলা ইঞ্জিনের ধ্বস-ধ্বস অন্তহীন, ধুলোভরা আকাশের রং বাঁশকাগজের ঠোঙার মতো, গরম বাতাস, মোবিলের গন্ধ, খানাখন্দে ভরা পথ। জানালাজোড়া কখনও সবুজ ধানের ক্ষেত, ঈদগাহ ময়দান। চন্দ্রা-টাঙাইল। আড়িচায় ফেরির জন্য সেই অন্তহীন অপেক্ষা। সিরাজগঞ্জ-মোকামতলা। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার দুই ধারে তরুণ গাছেদের পাতায় পড়ন্ত বেলার আলোর ঠুমকি। জয়পুরহাট থেকে পাঁচবিবি কাঁচাপাকা সড়ক। এরপর গরুর গাড়িতে কাশিয়াবাড়ী, তারপর পদব্রজে সনকা গ্রাম।
বললে বিশ্বাস যাবেন না, সেই গ্রামের একটা আশ্চর্য উগ্র সবুজ গন্ধ ছিল, মনে হল যেন একেবারে লতাগুল্মে আচ্ছন্ন কোনও শৈবালদেবী স্নান সেরে সামনে এসে দাঁড়াল। বাঁওড়ের পাশেই সবুজ গাঁ, মাঠের ওপর বিমানহীন বিহঙ্গহীন আকাশ। মোটামুটি সম্পন্ন গ্রাম। বাখারির গোলায় ধান, গোয়ালে অলস গাইবাছুর, পুকুরে মাছের ঘাই। ভাঙা জমিদারবাড়িটার ছোট তরফের মহলে নিহালের থাকার ঘর। বাড়ির নাম ‘স্মৃতিসুধা’। জমিদারবাড়ির বড় তরফের দিকটা পোড়ো। বিকেলে এক পশলা ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে, কম্পাউন্ডে বড়-বড় জাম গাছ দমকা বাতাসে দুলতে-দুলতে বৃষ্টিভেজা ঝোপের অন্ধকারে জাম ঝরিয়ে দিচ্ছিল। অসীম অবসন্নতায় তখন আমাদের শরীর মুড়িয়ে আসছে। নিহাল বোধহয় কেবল বাড়ি ফিরেছে তখন, আমাদের দেখেই আয়-আয় করে গামছা কাঁধে ছুটে এল সে। গরুর গাড়িতে এসেছি শুনে খুব রাগারাগি করল, আগে জানলে সে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। কালিবর্ণ হয়েছে নিহাল, আগের চেয়ে সুঠামও। ঘামের বিন্দু-বিন্দু জলে মুখখানা ভেজা, চোখগুলো যেন জ্বলছে— এমন নির্লজ্জ নির্মল হিংস্র। মুখের হাসিটা আগের মতোই, প্রীতিস্নিগ্ধ। বউটিকে দেখলাম কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, হাতে নিহালের লুঙ্গি আর স্টিলের গেলাসে পানি। কাঁচকলার মতো শ্যাম গায়ের রঙ। নাকটা চাপা। টানা চোখ। কপালে সুড়কি-রং কুমকুমের টিপ।
নিহালের আশপাশে দেখলাম সেইসব লোক, মাড়ি বার করে যেসব চল্লিশ পেরুনো গেঁয়ো লোক বলে— ওদের বয়স পঁচিশ, ওরা যারা গুনতে জানে না, ওরা যারা অগাধ সবুজে ডুবে থেকেও কেবল গোশ্ত-ভাত খেতেই সবচেয়ে ভালবাসে, একপেট খেতে পেলে কুকুরের মতো বশ্যতা স্বীকার করে, শীতকালে আগুন পোহাতে গিয়ে আগুনে পোড়ে প্রত্যেক বছর। গ্রাম-পরিক্রমায় বের হয়ে দেখতাম, সে যে কত মানুষের স্বজন! কত লোকে চেনে তাকে। ডাকবার আগে ছুটে আসে। আনাজের দর নিয়ে গেঁয়ো আলাপ করে। আদিবাসীদের চিকিৎসক সে, কোনোদিন তার ডিসপেন্সারির দরজা বন্ধ হয় না। রংচঙে শার্ট পরে রাজমিস্ত্রি কাজ করছে তার উঠোনে, কানে গোঁজা এক শলা সিগারেট। কী না, ছেলেমেয়েদের স্কুলের চেয়ার-টেবিল বানানো হবে! সেইসব ন্যাংটা বাচ্চাকাচ্চার ইস্কুল, শিশুমৃত্যুর ভয়ে মানত করে যাদের বাপ-মা নাম রাখে— ফ্যালানি-কুড়ানি-পেঁচি-আকালি-এককড়ি-রাখোহরি-অমরচাঁন।
গ্রামের বাজারে নিয়ে গেল নিহাল, কলাপাতা পেতে টাটকা মাছ বেচছে লোকে। দেখলাম ময়রা সুতির কাপড়ে বাতাসা ফেলছিল কপ কপ করে, সমাদর করে বসাল, ওর নাম মথুর। প্রাণহরা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মেঝে কাঁচা মাটির, শূন্য অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় খলসে মাছের মতো রং চিনির সিরা, পেছনের দিকটায় তখনও মস্ত চু্লায় ঢিমে আঁচে মালপোয়া ভাজছে মথুরের জোয়ান ছেলে শ্রীধর। আমরা সেই মাটির মেঝেয় বসে স্টিলের থালায় ভরপেট মিষ্টি খেলাম। গ্রামের পথ মেঠো, খানিক দূর হাঁটলেই ধুলো মেখে যায় হাঁটু পর্যন্ত। গ্রাম্য নদী তুলসীগঙ্গা, মন্থর তার বেগ। একধারে ঝুঁকে বটের ঝুরি নদীর পানিতে নেমে গেছে। পানিতে ঝুঁকে থাকা একটা গাছের ডালে বসে আমরা সূর্য ডোবা অব্দি কত গল্প করলাম। এই যেমন— রাখীর বংশের নবম পূর্বতন পুরুষ নাকি রাজা ছিল, জমিদারি আইন বিলোপ পাবার আগ অব্দি রাজা-ই ছিল ওরা, ওদের বংশের শেষ রাজা আদিবাসী একটি মেয়েকে ধরে এনে আটকে রেখে দিনের পর দিন টর্চার করেছিল, ধর্ষিতা মেয়েটি পাগল হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরে আর মরবার আগে অভিশাপ দিয়ে যায়— এ বংশের কেউ সুখী হবে না। এই যেমন— সনকা আর তার আশপাশের গ্রামে প্রচুর হিন্দু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বাস, পাশের গ্রাম কাশিয়াবাড়ীতে যুদ্ধের সময় বহু মানুষকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, নিহাল টাকা জোগাড় করছে, ছোটখাট একটা স্মৃতিসৌধ বানাবে।
ফিরবার সময় মথুর ময়রা বলে দিয়েছিল পাগলা কুকুর বের হয়েছে একটা, সাবধানে পথ চলতে। অন্ধকার অগ্রসরমান। টর্চের আলো ফেলে-ফেলে বাড়ি ফিরবার সময় আমাদের হঠাৎ পানাপুকুরে ভেসে থাকা সবুজ সরের মতো থকথকে কী একটা ক্লান্তি ছেঁকে ধরল! এই ধ্রুবতারা পষ্ট জ্বলা আকাশ, এই গাঁক-গাঁক করে মরা খাল থেকে ডাকতে থাকা ব্যাঙ, বাজারের এই মশলাভাঙানি কলের-মশাতাড়ানি ধুনোর-সিঙারা ভাজার ঘ্রাণ, এই আউশ ধানের দর নিয়ে কথোপকথন দিনের পর দিন সইবার সহ্যক্ষমতা আমাদের নেই। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই মথুরের মিষ্টির গামলার অবশিষ্ট সবটা সিরা ঢেলে দিলেও রাত দিন এক ধারসে এ নিস্তরঙ্গ জীবন গিলতে পারব না। বরফহীন-বায়ুহীন বিকল হিমাগারের ভেতর থাকছি মনে হবে আমাদের। তবু, নিহাল কিন্তু বেশ আছে।
এরপর আরও দু-একবার সরকারি ছুটিছাটায় আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত নিহালের কাছে গেছি। শহরের ধোঁয়াগেলা নাকে লাগত জংলি ঝাপটা, রাহাখরচ বাদে আর কোনও খরচ নেই কয়েকদিন। গেলেই নিহাল বাড়ির গাইয়ের দুধের সর আর খইয়ের মুড়কি খাওয়াত, দুপুরের ভাতে তিস্তার উজান বেয়ে আসা তাজা বৈরালি মাছের চচ্চড়ি। জমিদারবাড়ির মস্ত আমবাগান। টানা সবজিক্ষেত। শসা-চিচিঙ্গা-ঝিঙে-পেঁপে কিছুই ওর কিনতে হত না। দেখে গভীর বিদ্বেষ চাগাড় দিয়ে উঠত মনে। গ্রাম্যতা নিয়ে আমাদের বিষ আমরা সনকা গ্রামের মাটিতেই উগরে দিতাম, নিহাল হাসত, স্বীকার করত যতটা সবুজ গ্রামকে দেখায় ভেতরে ততটা কালো। ফিরে আসবার সময় বস্তায় ভরে দিত ঝুনা নারকেল, ক্ষেতের নতুন আলু, আখের গুড়, ঘানির তেল, পোলাওয়ের চাল। মানা করলেও শুনত না। জীবনের আনন্দ-ফূর্তিকে সচ্ছলতাকে-স্বাদুতাকে যেন সে মুষ্টিমেয় দ্রব্যের মতো মুঠোয় ধরেছে। নিহাল যেন আবারও আমাদের চোখে অপরাজেয় দানবের আকার নিচ্ছিল, যাকে হারকিউলিস মাটিতে আছড়ে ফেললেও দ্বিগুণ বেগে উঠে দাঁড়াত মল্লযুদ্ধ করবে বলে, কী যেন নাম ছিল তার? মাটি, যে দানবের মা ছিল?
প্রবীর বিদেশ চলে যাবার পর অনেকদিন নিহালের কোনও খবর পেতাম না। প্রবীরের ছোটো ভাই সুবীর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে একদিন বলল— নিহালভাইয়ের তো বউ গেছে গিয়া। এমন খবর পাবার পর আমরা কি আর বসে থাকতে পারি? সতীর্থের এমন দুঃসময় চাক্ষুষ করতে আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত পাঁচবিবি চললাম। গিয়ে শুনলাম অত গল্প। ঘোড়াঘাটের চৌধুরীদের এক ছেলে ছিল, নাম খুরশেদ আলী চৌধুরী, তা খুরশেদ বহুদিন যাবত নিরুদ্দেশ থাকবার পর একদিন খুঁজে-খুঁজে নিহালদের গ্রামে এসে উপস্থিত। সে নাকি নিহালের বউ রাখী সরকারের আগের জন্মের ছেলে। রাখীর বিয়ে হয়েছে অনেকদিন, ছেলেপুলে হয়নি। শক্তসমর্থ সুদর্শন সেই যুবক এসে পায়ে পড়ে থাকত মা বলে। সনকাগ্রামে প্রচার হয়ে গেল, রাখীর গতজন্মের ছেলে এসেছে। গণক ঠাকুর বললেন, আগের জন্মের কাউকে দর্শন দিলে লোকে বাঁচে না, রাখী মরবে। নিহাল স্বভাবতই ওসব কথায় কান দেয়নি। কার্তিকমাসের একদিন মোকদ্দমায় সাক্ষী হতে সে জেলাশহরে গেছিল, বাড়ি ফিরে দ্যাখে রাখী নেই। কোথায় চলে গেছে। জমিদারবাড়ির পেছনে পুকুর আর মাঠ, মাঠের পরে সতীদাহ মঠ। জনশূন্য মঠের প্রাঙ্গণে বসে বেচারা নিহালের মুখে ওরকম গল্প শুনে বেদনায় আমাদের মুখ কালো হয়ে উঠল। আমাদের সেই ফার্স্টবয়ের জীবনের এ কী দশা! এ-কথা সে-কথায় সাহসে ভর করে একবার বলেই ফেললাম, ‘ক্যারিয়ার নষ্ট কইরা গ্রামে আইসা থাকলি! আমাদের ভেতর তোরই কিছু হইল না ভাই!’ বলতে পেরে এত হালকা লাগল, কী বলব! একবার মনে হল, এ-কথা শুনে নিহাল মঠ-পুকুর-মাঠ কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠবে, তারপর বাগে পেলে সিংহ যেভাবে টুঁটি টিপে ধরে হায়েনাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয় সেভাবে আমাকেও। কিন্তু নিহাল হেসে উঠল না। মনে হল, যদি বলে, ‘হওনের অত তাড়া কীসের?’ বলল না। এরপর ওভাবে নিহালকে নিয়ে ওর সামনে বা পেছনে দুঃখ করাটা সহজ হয়ে গেল। আমাদের ওর ঘরের দিকে এগিয়ে দিয়ে ও গ্রামের কোনও বাড়িতে গেল, হয়তো আমাদের নৈশাহারের আয়োজন করতে। আমরা শূন্যতাপরিহারী প্রাণী, নিহালের অবর্তমানে সে-ঘরেই আমরা বলে বসলাম— ‘নিহাল নিশ্চয়ই ধ্বজ। কীসের মা। বউটা ওই খুরশেদের সঙ্গে পলায়া বাঁচছে!’ কিংবা, ‘হিন্দুর ম্যায়া তো, মোসলমানের ঘর আর কত করব, ইন্ডিয়া গ্যাছে গা!’
‘আমগাছের বাকল কি আর গাবগাছে লাগে!’
নিহালের কাঠের টেবিল তন্নতন্ন করে খুঁজে পেলাম একখানা চিঠি, হয়তো রাখীকে লিখেছে—
‘আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, তুমি আসলে চলে গেছ। আমি আহাম্মক টের পাইনি। যাবারই কথা। তুমিই বলতে— কখনো যাবে না। কিন্তু বিশ্বাস হত না আমার, যাবেই জানি, যেমন যায় লোকে। যাবার যথেষ্ট কারণ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ফিরে আসবার যদি সামান্য কারণও থাকে, ফিরে এসো।’ ‘চলে যাবারই কথা’ মানে? তাহলে ধ্বজই হবে। ‘যাবেই জানি, যেমন যায় লোকে’ মানে কি? সুরাইয়াও কি একই কারণে চলে গেছিল? আহা বেচারা।
‘তগো খালি বাজে কথা! লাস্ট টাইম আইস্যা নিহালের বউরে দেখসি সারা বচ্ছরের আলু একটা-একটা কইরা চুনের পানিতে ডুবায়া শুকাইয়া রাখল, তারপরে খাটের তলায় বস্তা পাইত্যা বালির উপ্রে সেই আলু সাজাইল, সুরাইয়ার কী ঠ্যাকা পড়সিল নিহালের ওইরম সংসারে বউ হওনের!’
‘হ, ভাবতে পারস সুরাইয়া বইস্যা-বইস্যা নিহালের ঘামাচি গাইল্যা দিতাছে?’
সানোয়ারের কথায় আমরা সবাই হেসে ফেললাম। কীসের মনস্তাপ!
নিহালের দুঃসময়ে তার পাশে থাকবার জন্য কয়েক মাস পরে আমরা আবার এলাম গ্রামে। বেগবতী নদী যেভাবে নিঝুম হয়ে যায়, ‘সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে’, তেমন হয়ে গেছে নিশ্চয়ই নিহালটা। কী হবার কথা ছিল তার, আর কী হল তার জীবনটা! তখন গ্রামের মাঠভরা ফসল, বাঁওড়ের জলে কার্তিক-শেষের টান লেগেছে, অনুভূমিক বায়ুবেগ নেই, নিথর খরিফ ঋতু। নিহাল কিন্তু আগের মতোই হই-হই করে উঠল আমাদের দেখে। এবেলা একটু বেশিই বিশ্রাম নিয়ে উঠে দেখি অপরিচিত গন্তব্যে ধূসর সন্ধ্যায় নেমে যেমন জ্বর-জ্বর লাগে, তেমন লাগছে। সাইকেলে ঝরঝর করে কারা যেন গ্রামের পায়ে চলা পথে চলে যাচ্ছে। পাড়াগাঁয়ে প্রায় রাত নেমে গেছে, ভেতরের উঠানে পাটকাঠির আগুনে লাল হয়ে বসে আছে আদিবাসী মেয়েটি, রান্নার তদারকি করছে, পটাপট শলা ভাঙছে, উদোম গায়ে তার সাত-আট মাসের শিশু খেলছে— মায়ের একবুক তার দুধের শিশি, আরেক বুক হাতের খেলনা। এদিকের উঠোনে পুরুষপোলা কেউ আসলে হনহন করে লাকড়িঘরের দিকে চলে যায় বড়জোর, আগুনের দিকে আসে না। পল্লীবিদ্যুতের আসা তখনও সুদূরপরাহত, চুলার অদূরে তাই নিবিড় আন্ধার। মেয়েটি তাই অচঞ্চল, নিরুদ্বিগ্ন। ঢেঁকিঘরের পিছে শেয়ালমুতোর ঝোপ আর বাঁশঝাড়— প্রথমবার এসে দেখেছিলাম কত পদের জানোয়ার ডাকাডাকি করত ওখানটায়, হুতোম পাখা-ঝটাপটি করত বড়-বড় গাছের ডালে, আজকাল আর তারা কেউ ডাকে না। গাছ সাবড়াচ্ছে ইটভাঁটা। আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত গুটিগুটি পায়ে নিহালের বৈঠকখানায় দেখি তার ছাত্ররা হাজির। ছোট-ছোট ছাত্রদের রাতে সে বর্ণপরিচয় করাচ্ছে, জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গল্প শোনাচ্ছে। তন্নতন্ন করে জানে বলে অনর্গল গল্প বলে যাচ্ছে সে, তার গল্পের মূল কথা— পৃথিবীর পরিচয়। সেইসব রাতে অপ্রতুল আলোয় বসে অমন শিক্ষকের মুখে যারা গল্প শুনছে, তারা কি জানে তাদের জীবনে ওই মানুষটি শিখবার আনন্দ নিঃশব্দে রুয়ে দিচ্ছে! অবশ্য সব লোকে যে আলোর আশ্বাস চায় না, তা নিহাল জানত না, জানলেও মানতে পারত না নিশ্চয়ই।
ছাত্ররা চলে গেছে অনেকক্ষণ। ধানে দুধ জমছে সে-মৌসুমে। রাতের বাতাসে ধানক্ষেতে শব্দ হচ্ছে শরশর করে। খেতে বসে একবার নিহাল বলল, ‘ভাদ্র-আশ্বিনমাসে এইবার খুব মেঘ ডাকল। চাষির মন ভয়ে ভরা, ওরা কইল ধানের থোড় শুকায় যাইব, শিষ হইব না… তখন ক্ষেতে আমরা খইল ছড়াইলাম!’ এখানে সেচের অভাব, সারের অভাব নিয়ে আরও কিছু বলল সে। কীটনাশকে বিষিয়ে যাওয়া নদীর কথা। পোলট্রির মুরগির গু খেয়ে চাষের মাছ বেড়ে উঠছে, কিন্তু সে -মাছে বড় বিষ। চাষার গল্প। আমরা ওসবের কী উত্তর দেব! টানা বারান্দায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে, সেই শান্ত নরম আলোয় বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখা যাচ্ছিল। পেট ভরে ভাত খেয়ে বসে-বসে অন্য গল্প করলাম আমরা। কৈশোরের দিনগুলোর গল্প। আমাদের কাকে ভূতে ধরেছিল, কার-কার জলবসন্ত হয়েছিল, কে তোতলাত। আমাদের সামান্য বড় টুকুমামার বিয়ের রাতের গল্প, গরমে বাসরঘরে টিকতে না পেরে মামা বাইরের দাওয়ায় এসে কত গান শুনিয়েছিলেন— ‘হায় বরষা এমন ফাগুন কেড়ে নিও না’। ছাদে প্যান্ডেল টাঙিয়ে বিয়ে হয়েছিল, নীচতলায় ইটের চুলায় রান্না, সিঁড়িতে আলপনা। রাতে সেই প্যান্ডেলের ছায়ায় শুয়ে আমরা বলছিলাম— ‘বরষা কী কইরা ফাগুন কাইড়া নেয়, আমরা তো দেখলাম গ্রীষ্মকালের রাত মামার ফাল্গুন কাইড়া নিল!’ সে-কথা মনে করে অত বছর পরেও হো-হো হাসি। সুরমা রঙের আকাশ, চাঁদের ভেতর খরগোশ কোলে একটা ছোট্ট মেয়ে বসে আছে, চাঁদের নাম শশধর। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমরা এও মনে করতে পারলাম, টুকুমামাকে ভালোবাসত পাশের বাড়ির বেবী আপা; বেবী আপা সেই রাতের আড্ডায় গান গেয়েছিল— ‘ছয়টি ঋতু দাও ফিরিয়ে ওগো নিয়তি’। বেবী আপার নিরক্ত সেই মুখ মনে করে আমাদের মন নরম হল। হঠাৎ মনে হল, যে-নিহালের সঙ্গে নীচু গলায় আমরা বেবী আপা তথা দুনিয়ার তাবত মেয়ের শরীর নিয়ে এত কথা কইতাম অল্পবয়সে, তার সঙ্গে যেন একটা আড়াল তৈরি হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ আমরা কেউ আর কথা কইলাম না। কলাগাছের ঝোপে ছায়ার গাঢ়তা বাড়ছিল। তামাকফুলের মিষ্টি গন্ধ পোকাদের টানছিল। রাতের কাজলা-নীল আকাশে সন্নিবেশিত তারাদের দিকে চেয়ে-চেয়ে মনে হতে লাগল যেন তারা ঘূর্ণায়মান, দুধের ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত সেই গ্যালাক্সি। নিহাল কী যেন ভাবছিল, এক সময় জোছনামগ্ন গলায় সে বলল, ‘দ্যাখ, চারধারে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মনে হবে তুই য্যান আম্বিলিক্যাল ফ্লুইডে ভাইস্যা আছিস, যেন ভ্রূণদশায় ফিরত গেছিস।’ সত্যিই তাই মনে হল তাকিয়ে। মহাকাল নাকি পরাভূত হয় খোদার কাছে! তিনি কালের যাত্রা থামিয়ে দিতে পারেন, কালকে তার মাপমানতার বাইরে তুলে আনতে পারেন। সেইরকম একটা মাপহীন সময়শূন্যতায় ভেসে রইলাম অনেকক্ষণ। অত নির্জনতায় মনে হল, আমাদের মনের কথাগুলো পর্যন্ত ঠাস ঠাস করে শোনা যাবে। ঢাকা থেকে আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত থলে ভরে উপদেশ এনেছিলাম নিহালের জন্য, ল্যাট্রিনটা পাকা কর, ঘরদোর সারায়া বিয়াশাদি কর আবার, সংসারী হ, এই বেলায়েতের খালাতো বোনরেই বিয়া কর— সেইসব নিরর্থক মনে হল।
পাঁচবিবিতে শেষবার এসেছি ভয়ানক একটা খবর পত্রিকায় পড়ে। স্থানীয় দুর্গামন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের প্রতিবাদ করেছিল বলে (নিহাল কবে আগুপিছু চিন্তা করে ঝাঁপ দিয়েছে!) নিহালকে তারই গ্রামের কিছু মানুষ কুপিয়ে খুন করে ফেলার চেষ্টা করেছে। নিহালের ডিস্পেন্সারি তো কখনও বন্ধ হত না, ঘরের দরজাও না। গ্রামের ঘরে-ঘরে তার ছাত্র। এমনকী যে-ছাত্র চোর বনে গেছে, সেও সারারাত চুরির ফিকির করে শেষরাতে তার দরজা ঠেলে এসে ঘরের মেঝেয় একঘুম দিয়ে উঠত। তার সনকাগ্রামে তারই ‘স্মৃতিসুধা’ বাড়িতে তাকে কেউ মারতে আসতে পারে, তা সে কখনও ভাবতে পারেনি। পালাবার কোনও চেষ্টাই সে করেনি।
সদর হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরাও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হামেদুর রেজা সাহেব হাসপাতালে নিহালকে দেখতে এসেছেন, এসেছেন স্থানীয় মসজিদকমিটির প্রধান তারিখ কামাল, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মোত্তালেব সরদার। পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি ফণীন্দ্র দেবনাথের বাড়ি থেকে নিয়মিত এসেছে খাবার। আমরা কয়েক বন্ধু দিনরাত তার শিয়রে জেগেছি, সেবা করেছি, টয়লেটে নিয়ে গেছি ধরে-ধরে। যদিও ও বহুকাল ধরেই আর হিংসার বস্তু নয়, হিংসার বাঁধন ঢিলে হয়ে যাবার পরে আর কী বাকি ছিল? কেন চোখের সামনে ওকে ধ্বসে পড়তে দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল— কী যেন ভেসে চলে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে! ভগ্নস্তূপ হিসেবেও কবে থেকে ও অত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। আন্তরিক কষ্টে বেলায়েত কেঁদে উঠছিল বার বার, সানোয়ারও শার্টের হাতায় চোখ মুছছিল। ও-ই তো আমাদের শৈশবের প্রাণবিন্দু। আমাদের গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক।
চিরপরিচিতের চোখে হত্যার অভিপ্রায় দেখলে আর কার কী হত কে জানে, সে-যাত্রায় নিহাল প্রাণে বেঁচে গেল! মাথার ক্ষতগুলো শুকিয়ে আসছিল, মাথা বাঁচাতে গিয়ে ডান হাতটার অবস্থা খারাপ— পাবলিক একজ্যামে যে-হাত দিয়ে লিখে সে একদা উল্কার বেগে পার হয়ে যেত, সেই হাতটা। কিন্তু শক তো লেগেছিল, চট করে কোনও সরু বর্তনী যেন ছুটে গেছিল ওর মাথায়। আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকত, জীর্ণমূল কোনও বিশাল গাছের মতো হেলে পড়ে রইত হাসপাতালের বিছানায়, দেখত জানালার বাইরে আকাশে সাদা মেঘগুলোকে ধাক্কাতে-ধাক্কাতে চলেছে শেষ শরতের পাগল হাওয়া। আমি-তৌফিক-সানোয়ার-বেলায়েত তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আশ্বাস দিতাম, ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথাও বলতাম, সে জবাব দিত না, চেয়েই রইত। যেন স্বরবর্ণের সহায়তাহীন অনেক ব্যঞ্জনবর্ণ ওর মনে ঘুরছে, তাই মুখে আসছে না। মানুষ তার অনিষ্ট ঘটতে দেখে চিরদিন আনন্দিত হয়েছে, আজ নতুন করে সমব্যথী-কল্যাণকামী বলে কেউ গায়ে হাত রাখলে তাকে তো সে চিনতে পারবে না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র