অতিমারীতে ঘরবন্দি এক জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু কী করতে পারেন? “প্রথম দিকে মনে হয়েছিল যে আমি দাবা নিয়ে খুব খাটব, নিজের খেলাটা যতটা পারি উন্নত করে ফেলব! কয়েক সপ্তাহ পরেই মনে হল, কেন? অন্তত এক বছর তো কোনও প্রতিযোগিতাই হবে না!” তাই সাধারণ ১৯ বছরের তরুণদের মতো ইরানের অন্যতম দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার পারহাম মাঘসুডলু চুটিয়ে ভিডিও গেম খেলতে শুরু করেছিলেন— “প্যান্ডেমিকের শেষে দেখা গেল যে আমি প্রায় চার হাজার ঘন্টা ‘কাউন্টার স্ট্রাইক’খেলেছি!”
গোলগাল, মিষ্টি চেহারার পারহামকে এক নজরে দেখে বোঝার জো নেই যে তিনি ইরানের ১ নং পুরুষ দাবা খেলোয়াড়, যিনি ২০১৮-তে দাবা দুনিয়াকে চমকে দিয়ে, ১০-এ ৯.৫ স্কোর নিয়ে জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতেছিলেন। ইরানে দাবার বর্তমান স্বর্ণযুগের অন্যতম কান্ডারী, বিশ্ব দাবায় সাড়া ফেলে দেওয়া আলিরেজা ফিরৌজা (যিনি বর্তমানে ফরাসি নাগরিক এবং FIDE র্যাংকিং-এ পুরুষদের বিশ্ব দাবায় ৪ নং খেলোয়াড়) তাঁর সতীর্থ।
কলকাতায় সদ্য-সমাপ্ত টাটা স্টিল চেস ইন্ডিয়া, ব়্যাপিড অ্যান্ড ব্লিৎজ, ২০২২ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসা বছর বাইশের পারহাম তাজ বেঙ্গল হোটেলের লবিতে নেমে এলেন টি-শার্ট, হাফ-হাতা ট্রেন্ডি জ্যাকেট, ট্র্যাক প্যান্ট আর স্নিকার্স পরে— আর পাঁচটা বছর বাইশের তরুণের মতোই। কিন্তু তাঁর চোখ-মুখ বদলে গেল দাবার কথা উঠতেই। “দাবার প্রতি আকর্ষণ সাড়ে নয় বছর বয়স থেকে; আমাকে দাবা খেলা মূলত শেখান আমার বাবা। আমি অন্যান্য খেলাও খেলতাম; ফুটবলে আমার প্রদেশের ১২-বছর অধীন দলে সুযোগ পেয়েছিলাম, সাঁতারে জুনিয়র জাতীয় দলের ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হই। কিন্তু দাবা খেলাটা একটা অন্যই প্যাশনে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটা গুটির চলা-ফেরা ভালোবেসে ফেলি; আজকের দিনেও আমার কাছে খেলাটার নিয়মাবলী একটা অন্য আকর্ষণ ধরে রাখে, একটা স্পেশাল আকর্ষণ,” এক নিঃশ্বাসে, হাসিমুখে এতগুলো কথা বলে ফেললেন তরুণ দাবাড়ু।
এই নিয়ে পারহামের এবার পঞ্চমবার ভারতে আসা— দু’বার কলকাতা ছাড়াও যাওয়া হয়েছে মুম্বই, চেন্নাই আর ভুবনেশ্বরে। “ভারতবর্ষ আমার দারুণ লাগে, বিশেষত খাওয়া-দাওয়ার কারণে! ‘ভারতীয়’ খাবার আর ইরানের খাদ্যাভ্যাসে যথেষ্ট মিল আছে; আপনাদের চিকেন কারিটা তো বাড়ির মতনই, হয়তো একটু বেশি মশলাদার!” বলেন পারহাম, “আসলে, ইরানিদের মতোই, ভারতীয়রা খুবই অতিথিপরায়ণ।” আর কলকাতা? “এই নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসা— এখানে দাবার পরিবেশটা অসাধারণ! কত লোক খেলা দেখতে ভিড় করে আসেন, খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে দাবা টুর্নামেন্টের রিপোর্ট ফলাও করে ছাপা হয়! এটা একটা দারুণ ব্যাপার!”
তবে কি ইরানে দাবার পরিবেশ খুব আলাদা?
একটু ভেবে নিয়ে পারহাম বলে ওঠেন, “ইরানে দাবাকে এখনও কেউ প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসাবে চিহ্নিত করেন না; ব্যাকগ্যামনের মতো অবসরের বিলাসিতা হিসাবে দেখেন। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই দাবার বোর্ড দেখা যায়, কিন্তু তা খুবই ক্যাজুয়ালি খেলা হয়।”
কথা ঘুরে যায় সরকারি উদাসীনতার দিকে। নিজে ফুটবল খেলতে ভালবাসতেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফলো করেন, এবং অবশ্যই বিশ্বকাপে ইরানের ফুটবল দলকে পাগলের মতন সমর্থন করেন। কিন্তু ফুটবল, ভলিবল, কুস্তি এবং ভারোত্তোলনের ক্ষেত্রে যে সরকারি সমর্থন ইরানে দেখা যায়, দাবার ক্ষেত্রে তার সিকির সিকিও মেলে না, আক্ষেপ করেন তরুণ দাবাড়ু। “ইরানে দাবার ক্ষেত্রে সরকারি সমর্থন প্রায় শূন্য। দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী এবং বাকি মন্ত্রীরাও আমাদের অনেক আশ্বাস দিয়ে থাকেন, কিন্তু তা কখনই সত্যিকারের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে ওঠে না। গত এক দশকে এক ঝাঁক অল্পবয়সী দাবাড়ু উঠে আসা সত্বেও, সত্যি বলতে, দাবা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথাই নেই,” সাফ বলেন পারহাম, “আলিরেজা যে আর ইরান দলের অংশ নন, সেটা দুঃখের কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যা শুনছি, সেই ইজরায়েলি খেলোয়াড়দের সঙ্গে বিতর্কিত ব্যানের কারণে আলিরেজা ফ্রান্স অভিবাসী হয়ে ওঠেননি— ওঁর ফ্রান্সে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। একজন প্রথম সারির দাবাড়ুর পক্ষেও নিজস্ব পুঁজি খরচ করে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, উন্নত মানের কোচিং, বাকি আনুষঙ্গিক খরচ বছরের পর বছর টেনে যাওয়া অসম্ভব।”
এ-ছাড়াও, ২০১৭ সালে মহিলাদের দাবা বিশ্বকাপ সংগঠিত করার পর থেকে ইরানের দাবা ফেডারেশন খুবই চাপে রয়েছে। টুর্নামেন্টে কিছু বিশ্বমানের খেলোয়াড় অংশগ্রহণ না করায় স্পনসরাররা পিছিয়ে যায়, এবং সেই ব্যয়ের দায় বর্তায় ফেডারেশনের উপর। প্রচুর আর্থিক ক্ষতি সামলাতে হয়। “আমি ইরানকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, দেশের হয়েই খেলতে চাই, কিন্তু সরকারি সমর্থন ছাড়া এটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আলিরেজা এবং তাঁর পরিবার যা করতে পেরেছেন, তা সবাই পারবে না,” বলেন পারহাম, “একই অবস্থা কবড্ডির ক্ষেত্রে—২০১৮’র এশিয়ান গেমসে ইরানের পুরুষ এবং মহিলা দল দুই-ই ভারতকে হারিয়ে সোনা জেতে! কিন্তু সেই খেলাটার প্রতিও দেশে অসীম অবজ্ঞা; আমার বেশ কিছু বন্ধু বরং ভারতে কবড্ডি প্রো লিগে খেলেন!”
ওদিকে, ইরানে এখন দাবার স্বর্ণযুগ— এই প্রজন্মের সবাই একজন কোচের ছাত্র-ছাত্রী, তাঁর নাম ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার (IM) মোহসেন শারবফ। আদতে পারহামের শহর গোরগন-এর অধিবাসী শারবফ এখন থাকেন তেহরানে। “এই মুহুর্তে ইরানের প্রথম সারির দাবাড়ুদের প্রায় সবাই মোহসেনের কোচিং-এ বড় হয়েছি। আমি, আলিরেজা, আরিয়ান ঘোলামি– আমরা সবাই মোহসেনের কাছে তালিম নিই এবং পরবর্তীকালে ইরানের জাতীয় দলে ডাক পাই। আমার খেলার উন্নতি, FIDE-তে ২৭০০-র উপর রেটিং-এ পৌঁছনোর পেছনে মোহসেনের ভূমিকা বিরাট। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ কোচ উনি; আমি ওঁর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ,” বলেন নম্রভাষী যুবক।
নয় বছর বয়সে দাবা খেলা শুরু করে মাত্র তিন মাস পরেই পারহাম তাঁর শহরে প্রতিযোগিতামূলক দাবায় মেডেল জেতেন, এবং ছ’মাস পরে তাঁর প্রদেশের খেলাতেও মেডেল পান। দাবায় তাঁর উৎসাহ এবং প্রতিভা দেখে পারহামের বাবা তাঁর খেলাকে সাপোর্ট করতে শুরু করেন; সময় এবং অর্থ, দুই-ই ব্যয় করেন, থাকে বহু ত্যাগ।
“আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়েস, আমার আইডলেরা ছিলেন (জাপানি গ্র্যান্ডমাস্টার) হিকারু নাকামুরা এবং রুশ কিংবদন্তী ভ্লাদিমির ক্রামনিক। আমি প্রায় সারাক্ষণ এঁদের খেলা দেখতাম। ওঁদের স্টাইলের খেলায় তখন মনে হত কিছু না কিছু ঘটেই চলেছে। আরো একটু অভিজ্ঞ হওয়ার পর, ধরুন যখন আমার ১৯ বছর বয়েস এবং FIDE রেটিং ২৭০০ পেরোয়, আমি (নরওয়েজিয় জি-এম এবং বর্তমানে বিশ্ব নং. ১) ম্যাগনাস কার্লসেনের খেলা খুটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। আমার বিশ্বাস, ম্যাগনাস একটা আলাদা মানেরই দাবা খেলে চলেছেন, এবং ওঁর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ওঁর খেলা দেখে আমার দাবাও অনেক উন্নতি করেছে,” হেসে বলেন পারহাম।
পারহাম মনে করেন, ক্লাসিকাল দাবার পাশাপাশি, প্রত্যেক দাবাড়ুরই ব্লিৎজ এবং র্যাপিড দাবা খেলার অভ্যাস রাখা উচিৎ। “পরের মাসেই কাজাখস্তানের অলমাটিতে ব্লিৎজ এবং র্যাপিড বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে মুখিয়ে আছি; এটা গোটা বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা,” বলে ওঠেন চ্যাম্পিয়ন।
একজন বিশ্বমানের দাবা খেলোয়াড়ের একটি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি কী হয়? “কিছু ট্রেনিং ম্যাচ খেলার পাশাপাশি, যে-শহরে যাচ্ছি, নিজের দিনটাকে তার টাইম জোনের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করি, চেষ্টা করি অন্তত দু-দিন আগে সেই শহরে পৌঁছতে। যদি ম্যাচ শিডিউল অনুযায়ী আমার দুপুর তিনটের সময়ে খেলা থাকে, আমি বাড়িতে থেকেও দুপুর তিনটের সময়ে দাবা খেলতে চেষ্টা করি,” বলেন পারহাম।
দাবায় তরুণ প্রজন্মের উত্থান ইতিবাচক ইঙ্গিত; বিশেষত আজ যখন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরান। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, নীতি পুলিশের হাতে ২২ বছরের যুবতী মাহসা আমিনি’র গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীকালে মৃত্যুর প্রতিবাদে সারা ইরান জুড়ে শুরু হয় উথাল-পাথাল বিক্ষোভ। কঠোর হাতে এই বিক্ষোভ সামলানোর সরকারী সিদ্ধান্তে এই তিন মাসেই প্রাণ দিয়েছেন ৪৫০ জন ইরানি নাগরিক, যাঁদের মধ্যে ৬০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। সত্তরের দশকে ‘মহান বিপ্লব’-এর পর দেশজুড়ে এত বড় সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবাদ-যজ্ঞ দেখছে ইরান, যার ফলস্বরূপ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠছে। “এই মুহুর্তে যে কারণে উত্তাল ইরান, তা নিয়ে আমি খুবই দুঃখিত। এই প্রেক্ষাপটে, আমার কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ ম্যাচটাও যদি আমি খেলে ফেলি, আমি ভীষণ খুশি হতে পারব না,” বিষণ্ণ সুরে বলেন তরুণ গ্র্যান্ডমাস্টার। এই বক্তব্যের কোনো সান্ত্বনা হয় না। ইরানে শান্তি ফিরুক, বিশ্বজয় করুন পারহাম, এটুকুই কামনা করব।