ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ৩


    শুভময় মিত্র (June 4, 2021)
     
    পড়শি

    ছোট জানলাটা দিয়ে সব দেখা যায়। রাস্তায় নেমে, পাশের পার্কে গিয়ে নজর করেছি যে আমার জানলাটা বিশেষ দেখা যায় না। আমি কিন্তু ওখান দিয়ে দেখতে পাই পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির দক্ষিণ গা-টা। সেখানে যার যতটা দেওয়াল, ততটা রং করা বা না করা। জোকারের বাড়ি। একজন কোনওদিন কিছুই করেনি, তার দেওয়ালে আপনা-আপনি রেন ফরেস্টের ম্যাপ তৈরি হয়েছে, বাড়ছে। জানলার ওপরে টানা কার্নিশ। সব কটা ফ্যামিলির একমাত্র এক্সটার্নাল কানেক্ট। হাত বাড়িয়ে যে জানলা থেকে দানা দেওয়া হয়, তার নিচে পায়রা, চড়াই, কাক খেয়োখেয়ি করে। ঘুঘু ঘোরে, আলাদা। অনেক ওপরে, ডিশ অ্যান্টেনার ওপর বসে সব দেখে চিল। নানারকম গ্রিল। কেউ শুকোয় গেঞ্জি, কেউ রোদ খাওয়ায় ক্যাকটাসকে। মূল ঘষা কাচের পাল্লা, পর্দা এর ভেতরে। খোলে। বন্ধ হয়। দিনের বেলা রোদ থাকলে ভেতরটা ঠিকমতো দেখা যায় না। আলো পড়লে, সন্ধে হলে, কোথাও-কোথাও ভেতরের আলো জ্বলে ওঠে। যেমন ঘরের দেওয়াল, তেমনি রং। মনে হয় একটু একটু করে বাড়তে থাকে রাতে, দপ দপ করে নিভে যাওয়ার আগে। কে উশখুশ করছে, পায়চারি করছে, ফোন ঘাঁটছে বা মেঝেতে পা ছড়িয়ে চাল বাছছে, দেখতে পাই আমি। আমার চারতলার জানলা থেকে ও-বাড়ির দোতলায় হামাগুড়ি দেওয়া একটা বাচ্চাকে দেখতে পেতাম ক’দিন আগেও। আবার ভোরবেলা সাত তলায় যে-মেয়েটা এক্সারসাইজ করে, তার শুধুমাত্র হাতদুটো চোখে পড়ে। আমার একেবারে উল্টোদিকের জানলায় যারা থাকে, তাদেরই একমাত্র চিনি। ও-বাড়ির একজন মহিলা মাঝে মাঝেই জানলায় এসে এদিক-ওদিক কী সব খোঁজেন। অন্য ফ্ল্যাটগুলোয় যারা থাকে, তারা নিশ্চয়ই অবাঙালি, চিনি না। চিনতে চাইওনি। অদ্ভুত ব্যাপার, এই এতগুলো পরিবারের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, অথচ আড়চোখে নজরটা আছে। কীসের ইন্টারেস্ট বলতে পারব না। কিছু ফ্ল্যাটে সবসময় লোক থাকে না, তাই আলোও জ্বলে না। জানলাও আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ থাকে। একবার ওইরকম একটায় খোলা জানলার ভেতরে টিভি চলছিল নিশ্চয়ই। কানে আসছিল একজন চেনা নেতার বাঁজখাই হুঙ্কার, হিন্দিতে। ভোটের ঠিক আগে। এই লোকটাকে আমার একদম সহ্য হয় না। ফট করে মাথা গরম হয়ে গেল। রাগ হল ওই ফ্ল্যাটের লোকেদের ওপর, ওরা টিভিতে ওসব শুনছে বলে। অন্য জাতের, অন্য জায়গার লোক, বিশেষ করে অবাঙালি সম্পর্কে হালকা বিদ্বেষ শুনে শুনেই বড় হয়েছি। হয়তো সেই ভাইরাস আজও রয়ে গেছে। আজকাল অবশ্য এমনিতেই কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না, প্রমাণ রেখে মুখে কিছু বলে না। আমিও তাই। নিজেকে রোজই অচেনা লাগে। 

    আমাদের ফ্ল্যাট আর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মাঝখানে একটা একতলা বাড়ি আছে। ওখানে পাঞ্জাবিরা থাকে, বরাবরই। রাভিন্দর তো আমার ছোটবেলার বন্ধু। একটা গুজ্জু ছেলে আমাদের সঙ্গে খেলতে আসত পার্কে, খুব ছে ছে করে কথা বলত। একটা দাঁত পড়ে গিয়েছিল বলে ওকে ঢোকলা বলে ডাকতাম। খেপানোর জন্য, ‘পাছে ওই গাছে পেখম তুলে হুতুম প্যাঁচা নাচে’ ওর ভাষায় বলতে বলতাম। রেগে যেত না। বলত, ‘মজাক করছে।’ ছোটবেলায় আমরা সবাই এক সাইজের ছোট ছিলাম। পরে দু’একজন বিশাল কিছু হল। আমার মতো অনেকে, প্রধানত বাঙালিরা, বেশির ভাগই মাঝপথে আটকে গেল। যারা হাঁকিয়ে খেলল, তারা কেউ এ তল্লাটে থাকে না আর। কেউ আবার তেমন বাড়লই না। আমাদের পাড়ার বাড়িগুলোরও একই অবস্থা। পাঞ্জাবিদের বাড়িটা ঘরই রয়ে গেল। দু’পাশে দুটো, আমাদের ন’নম্বর আর একটু পরে পাঁচ নম্বর একদম ভেঙে ফেলে আবার সটান তুলে দেওয়া হল। বেধড়ক্কা লম্বাও হল, কয়েক বছরের মধ্যে। এসবের অনেক আগে আমাদের পুরনো বাড়ির দোতলার রান্নাঘর থেকে একদম পাশের ছাদে গুড্ডিকে দেখতে পেতাম। এখন সে উপায় নেই। সময়ের এলিভেটর আমাকে চারতলায় তুলে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এখন নিচে তাকিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি হয়। সন্ধেবেলা আমি মাঝে মাঝে ঘরের আলো নিভিয়ে দিই। দিয়ে জানলার আড়ালে বসে থাকি। 

    ছোটবেলায় আমরা সবাই এক সাইজের ছোট ছিলাম। পরে দু’একজন বিশাল কিছু হল। আমার মতো অনেকে, প্রধানত বাঙালিরা, বেশির ভাগই মাঝপথে আটকে গেল। যারা হাঁকিয়ে খেলল, তারা কেউ এ তল্লাটে থাকে না আর। কেউ আবার তেমন বাড়লই না। আমাদের পাড়ার বাড়িগুলোরও একই অবস্থা।

    টিভি দেখি না। ইন্টারনেট গোঁজা কম্পিউটার অনেক স্বস্তির। রাস্তায় দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডার বারোটা বেজে গেছে। প্রায় সবাই চলে গেছে পাড়া ছেড়ে। এখন দুনিয়ার অচেনা লোকের সঙ্গে আলাপ। নিজের ককপিটে বসে বড় স্ক্রিনের জানলায় মহানন্দে উড়ে বেড়াই, কত কী নড়ে চড়ে, দেখি। কত কথামৃত, কত চিত্ররেণু। অচেনারাও কমফোর্টেবলি চেনা-চেনা। তারাও আমারই মতো। লিখে-লিখে বলে কত কথা। ফোঁপরা জীবনটা লুকোতে ভরাট মিথ্যেও লেখে অনেকে। যা আমি লুকোই, তাও বলে। স্যাডিস্টিক আনন্দ পাই। সিম্বলে দুঃখ প্রকাশ করি। আমার ঝাড় তো বটেই। তাহলে তোমারও ঝাড়। ভরসা পেয়ে কিছুদিন পরে আমিও শুরু করলাম ওসব। সঙ্গে সঙ্গে শিলাবৃষ্টির মতো বন্ধু পড়তে লাগল। লগ ইন করলেই আমার পছন্দের কথার ইকো। বাসি হিউমার ডেইলি। ‘ওদের ক্যানো লিটারেচারে একটাও ডি.লিট নেই জানেন? ওরা ভাবে, কী দরকার? ওটা তো শেষে ডিলিট হয়ে যাবে’ এইসব। ডিজিটাল বহুগামীতার আহ্লাদে ঝড়ের মতো সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল জানলার ধারে বসে-বসে। লোকের গায়ে পড়ে মেশামেশির কী দরকার! নেটে খ্যালো চলমান অশরীরীর মতো, অপছন্দ হলে ঘুসি মেরে খুলি ইমোজি দাও। এইসব করতে-করতে কেন কে জানে, মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হত। কতবার ক্লান্ত হয়ে ওই চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছি। একবার তো ধড়াম করে মাথা পড়ে গেল কি-বোর্ডের ওপর। কোনওমতে মাথা তুলে দেখি ঘেঁটে গেছে স্ক্রিন। খুলে গেছে অচেনা বাড়ির অনেকগুলো জানলা। সেখানে রাজ্যের বহুরূপী। ঠান্ডার সময়, গরম কিছু চাপাতে ভুলে গিয়েছিলাম। সামনের প্লেটে পোট্যাটো চিপসের কয়েকটা মলিকিউল। উত্তুরে হাওয়ায় সারা টেবিলে সিগারেটের ছাই দৌড়োদৌড়ি করছে। চটচটে খালি গ্লাসে নকটারনাল পিঁপড়েরা। কপালটাও চটচট করছে। ব্যথা। ওষুধ খুঁজে পেলাম না, আয়নায় নিজেকে দেখে খুব খারাপ লাগল। একটা জানোয়ার তৈরি হয়েছি। সারাক্ষণ রোঁয়া ফুলিয়ে বসে আছি। ঠিক করলাম, আর নয়, এনাফ! মাঝরাতে দাঁত মেজে ফেললাম।

    পরের সন্ধেতে ওই চেয়ারে বসিনি, নেশাও করিনি। সময়ে রাতের খাবার খেয়ে ‘নায়ক’টা আবার দেখলাম। ঘুম না এলেও জোর করে শুয়ে পড়লাম। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে যাওয়ার আনন্দে ঘুম এল না। জিতে যখন গেছিই, নিজেকে আবার রিসেট করেছি, করেছিই যখন, তাহলে আর চিন্তা কী! গুটি গুটি পায়ে আবার চেয়ারে বসলাম। চোখ বাইরে। রাতের ব্ল্যাক লাইটে দামড়া কালো ফ্ল্যাটবাড়িটা ঢুলছে। পড়ে যাবে না তো? কয়েকটা বন্ধ জানলার কাচের ভেতরে চাপা আলোর আভা। তার মানে শুধু আমি নয়, অনেকেই জেগে। এত রাতে ওদের আলো-অন্ধকারের চিত্রনাট্যটা কল্পনা করলাম কিছুক্ষণ। আমার এক প্রবাসী বন্ধু ইন্ডিয়াতে লাইফস্টাইল কেন খারাপ, ওয়েস্টে কেন সুপিরিয়র বোঝাতে মন্তব্য করেছিল, ‘সব ব্যাপারে আমরা নিজেদের জড়াই না। অন্যের স্পেসে ইন্ট্রুড করি না। হেল্প করি, কোঅপারেট করি। বাট অলওয়েজ মেনটেইনিং আ ডিস্টেন্স। কোয়ালিটি লাইফ, কোয়ালিটি টাইম।’ গড়বড়ে মন্তব্য, তর্কে লাভ নেই। সবই করে, সবেতেই থাকে, ইনভিজিবল হয়ে, প্রমাণ না রেখে। একদিক দিয়ে ভালো। নিজের আসল চেহারাটা সবার সামনে খ্যালখ্যাল করে খুলে উদোম হওয়ার কী দরকার? বিন্দুমাত্র নেশা না করেও একটা আচ্ছন্ন ভাব আসছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়িটা একটা মস্ত নোটিশবোর্ড। তার নানা রঙের স্টিকি নোট মেরে দিয়েছে কেউ না কেউ। যাতে কিছু একটা ভুলে না যায়। নির্ধারিত সময়ের পর সেগুলো খোলা হয় না আর। তার ওপরেই নতুন রঙের আরও স্টিকার পড়ে। কোনও কোনও তাঁবাদি  টুকরো অনাদরে, ধুলো জমে ভারী হয়ে, নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে আপনি ঝরে যায়। ও-বাড়িতেও তাই। যার আর নতুন করে আলো জ্বালার উৎসাহ নেই, তারটা একসময় আপনিই নিভে যায়। এটা মনে হতেই আমার খুব শীত করতে লাগল। 

    এতদিন যেসব রাস্তায় পায়ে হেঁটেছি, আজ সেখানে উড়তে লাগলাম মনে-মনে। ওপাশ থেকে কিছু একটা কানে এল। টুকরো কথা। তাতে যেন সুরের প্রলেপ লাগবে-লাগবে করছে। দৌড়ে গেলাম উত্তরের পাঁচিলে, যেদিক থেকে পাশের ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি দেখা যায়। এই মুহূর্তে আমি সে-বাড়ির ছাদের একতলা ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছি, অনেকগুলো শতরঞ্জি পেতে অনেকে বসেছে গোল হয়ে, দূরত্ব রেখেই। বুড়ো-বুড়ি চেয়ারে। মাঝখানে একটা ইলেক্ট্রিক লণ্ঠন।

    খেয়াল করছিলাম চারতলার ফ্ল্যাটটা বেশ কিছুদিন ধরেই একদম বন্ধ আছে। দুটো বুড়ো-বুড়ি থাকে। মরে গেল নাকি? খারাপ সময় চলছে। আগে অচেনা লোকজন চলে যাচ্ছিল, এখন তা নয়। ওখানে আলো জ্বলছে আজ, দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। হয়ে, সোশ্যাল মিডিয়া নয়, ওখানে আর ভাল্লাগে না, ঢুকে পড়লাম আমাজনের সব পেয়েছির নির্জন ডিজিটাল অরণ্যে। খুলতেই আমাকে সাজেস্ট করা হল প্রেশার কুকার কিনতে। আমার যা যা চাই সব বেছে আলাদা করে কার্টে সাজিয়ে রেখেছি। কিছুদিন পরে সব কটা বাদ দিয়ে দেব। এটাও দারুণ খেলা। কিনতে না পারার হীনমন্যতায় ভুগতে হল না, দুনিয়ার বৃহত্তম মুদিকে অবজ্ঞা করা গেল। এরপর ইউটিউব। ওখানেও হরেক মজা। যারা স্টেজ পায় না, গ্যালারি পায় না, তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের পসরা সাজায়। তবে প্রথমেই, বা পরে, খুব বিখ্যাতরাও দেখেছি কাঁচুমাঁচু মুখে বলে, সাবস্ক্রাইব কর না বাপু। 

    গতকালই খবর পেলাম ও-বাড়িতে অনেকগুলো ফ্ল্যাটে একসঙ্গে অনেকে সংক্রামিত হয়েছে। বহুতবার বারণ করা সত্ত্বেও অনলাইন ডেলিভারির লোকজনের যাতায়াত নাকি কমেনি। পয়সা আছে, কাজ নেই, বসে বসে দেদার টাকা ওড়াচ্ছে, রোগ ছড়াচ্ছে। রাগ ছড়িয়ে গেল আমাদের কাজের মাসি। দুপুরে দেখলাম আমার চেনা বাঙালি ফ্যামিলি ছাড়া বাকি সবার জানলা বন্ধ। অস্বস্তি শুরু হল। যতবারই চেয়ারে বসছি, ততবারই চোখ চলে যাচ্ছে ওদিকে। আস্তে আস্তে পুরো বাড়িটাই কি ব্ল্যাকহোল হয়ে যাবে? মাঝের কুঁকড়ে থাকা বেঁটে বাঁটকুল ঘরের ওপর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে আসবে মাইক্রোফাইন বিষ? স্লাইডিং জানলা টেনে দিলে কি তার ঝাপট থেকে বাঁচা যাবে? উত্তর দিকের সব জানলা বন্ধ করে দিলাম। করতেই হত, ঝড়জল চলছিল। ক’দিন ইন্টারনেট ছিল না। তাই ওই চেয়ারে বসাও হয়নি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাইওনি। ভেতরে-ভেতরে বুঝতে পারছিলাম, আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। সাংঘাতিক রাগ হচ্ছে গোটা বাড়িটার ওপর। এরপর ফোনে যখন উপকূলের ক্ষয়ক্ষতির ভিডিও দেখা হয়ে গেল, সাহসীরা ত্রাণ নিয়ে সেখানে যাচ্ছে বোঝা গেল, ইন্টারনেট ফিরে এল, তখন আমার অসুখ একটু কমল। সারাদিন অনেক কাজ ছিল। রাতে চান-টান করে, এক পাত্তর নিয়ে ককপিটে বসলাম আয়েশ করে। জানলাটা খুলেই দিলাম, যা হয় হবে। একবার চোখ তো গেলই। আজ সব কটা জানলা খোলা, আলো জ্বলছে, কিন্তু ভেতরে একটাও লোক দেখা যাচ্ছে না। টপ ফ্লোরে, যেখানে একটা মেয়ের হাতদুটো দেখতে পেতাম, তার ওপরেই ছাদ। মনে হল সেখানে একটা আলোর আভা। আমার জানলা থেকে অনেকটা ওপরে। তাই কিছু বুঝতে পারলাম না। কিছু কথাবার্তা শুনতে পেলাম, থেমেও গেল। সিকিউরিটির কারণে অনেক ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে কাউকে উঠতে দেওয়া হয় না।

    উঠলাম। সিঁড়ি দিয়ে আমাদের ছাদের দরজায় পৌঁছলাম, জায়গাটা অন্ধকার। আন্দাজে দরজা ছুঁয়ে বুঝলাম, তালা নেই। নিঃশব্দে হ্যাচ টেনে সেটা খুলে ফেলা গেল। পাঁচিলের একপাশে পৌঁছলাম। সন্ধের পর কখনও আসিনি এখানে। রাতের আকাশের আলোয় ছাদের মেঝেটা মঙ্গলগ্রহের মতো লাগছিল। তিনশো ষাট ডিগ্রি রাতের স্কাইলাইন। এদিক-ওদিক চেনা বাড়ি খুঁজতে লাগলাম। এতদিন যেসব রাস্তায় পায়ে হেঁটেছি, আজ সেখানে উড়তে লাগলাম মনে-মনে। ওপাশ থেকে কিছু একটা কানে এল। টুকরো কথা। তাতে যেন সুরের প্রলেপ লাগবে-লাগবে করছে। দৌড়ে গেলাম উত্তরের পাঁচিলে, যেদিক থেকে পাশের ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি দেখা যায়। এই মুহূর্তে আমি সে-বাড়ির ছাদের একতলা ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছি, অনেকগুলো শতরঞ্জি পেতে অনেকে বসেছে গোল হয়ে, দূরত্ব রেখেই। বুড়ো-বুড়ি চেয়ারে। মাঝখানে একটা ইলেক্ট্রিক লণ্ঠন। কমবয়সি একটা ছেলে, আগে দেখেছি ওকে, জানলায় বসে মাঝে মাঝে গিটার নিয়ে টুংটাং করে। এখন বসেছে বাবু হয়ে। সাদা-কালো লম্বা রিডগুলোর ওপর আলতো করে খেলাচ্ছে তার আঙুলগুলো। হারমোনিয়ামের ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি সুরে বোনা ধোঁয়ার মিহি আলপনা। নকশাটা একটু ঘনীভূত হতেই, ধুনোর গন্ধ পেলাম এত দূর থেকেও। একে একে গলা খুলে দিল কেউ কেউ। সুরের তবকে কথা ঝলমল করে উঠল। কখনও বাংলায়, কখনও হিন্দিতে। কখনও সদ্য নেমে আসা অদৃশ্য মেঘের ওপর দিয়ে গান ভেসে যেতে লাগল কথা ছাড়াই। এই প্রথমবার চারপাশের ডিশ অ্যান্টেনাগুলো আকাশের কাছে ভিক্ষা চাইল না। মহাশূন্যে উড়িয়ে দিল অনেকগুলো কথা, সদর্পে।

    ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্দ্ধ-পানে। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook