ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল : পর্ব ২১


    শ্রীজাত (November 26, 2022)
     

    সলিল চৌধুরীর আশীর্বাদ

    পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবতে বসলে মাঝেমধ্যে এত বেশি দূরের, এত বেশি অলীক বলে মনে হয় যে, আজকের পৃথিবীটাকেই অবিশ্বাস্য লাগে। বা মনে হয়, যেন দুটো জীবন বেঁচেছি, যেন দু’খানা জন্ম। একটা অতীত, একটা বর্তমান। আর সে-অতীত এত বেশি আলাদা আজকের বেঁচে থাকার চেয়ে যে, মাঝেমধ্যে তাকে দূর থেকে দেখে স্মিত হেসে আবার কাজে বেরিয়ে পড়ি। জানি, তার খুব কাছাকাছি আর পৌঁছনো হবে না কোনওদিন। তাকে ছুঁয়ে দেখা তো দূর, তার পাশে, একটু ফারাক রেখে বসে দুটো খোশগল্প করারও সুযোগ আসবে না কখনও। তবু, সে তো আমারই অতীত, আমারই ফেলে আসা পথঘাট, আমারই বাতিল করা বালিশের রূপকথা। তাকে ছেড়ে খুব দূরেই বা যাই কী করে! তাই মাঝেমধ্যে সেসব রোদের জানলা, সেসব বৃষ্টির বারান্দা বুকে নিয়ে ঘুমোতে যাই। অলীক সেই পৃথিবীতে কখনওই আর জেগে উঠব না, এ-কথা জেনেও। 

    বাড়িতে গানবাজনার চল আমাদের অনেকদিনের। জন্মে ইস্তক কেবল গানবাজনাই শুনে আসছি। মা ক্লাস করাচ্ছেন ছাত্রীছাত্রদের, মায়ের অনুষ্ঠানের তৈয়ারি চলছে, চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ। আর এসবও যখন চলছে না, অন্তত তানপুরাটা বেজে চলছে কোথাও। বাড়িতে তানপুরার শব্দ থমকে গেলে আমরা বুঝতাম, কিছু একটা গরমিল ঘটে গেছে নির্ঘাত। নইলে সে তো থেমে থাকবার যন্ত্র নয়। আমাদের বাড়িতে যা, মামার বাড়িতেও তাই। সেই এক ছাত্রীছাত্রদের অনর্গল যাতায়াত, গানবাজনার গন্ধে ম-ম করতে থাকা একটা ঘর আর টানটান সুরে বাঁধা রোদ্দুর। তাই গানবাজনা ছাড়া কোনও পৃথিবী হয়, সে আমাদের ধারণাতেও ছিল না। 

    আমি তখন বেশ ছোট, ক্লাস এইট কি নাইন হবে। বাড়িতে সদ্য একখানা গম্ভীর মার্কা ফোন এসেছে, ভারী আর ছাই রঙের তার রিসিভার। আমার নামে কোনও ফোন-টোন আসে না। বাবা আর মায়ের জন্য ফোন করেন অনেকে, আর বাবাকে দেখি মাঝেমধ্যে ডায়াল ঘুরিয়ে এর-তার সঙ্গে কাজের কথা সারতে। তা তেমনই একদিন বেজে উঠল ফোন, ঝনঝন করা মন-ভাল শব্দে। আমি অন্তত ফোন এলে ধরতে পারি, সেই অনুমতিটুকু ছিল। আর সেই ছিল আমার দেদার উত্তেজনার উৎস। একবার ক্রেডল থেকে রিসিভারটা তুলে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলবার আনন্দ। তা সেদিন রিসিভার কানে ঠেকিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই শুনলাম মামার গম্ভীর গলা, ‘মা-কে ফোনটা দে তো।’ দিলাম, দিয়ে পাশে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। একদিকের কথা শুনে গোটা সংলাপ বুঝে ফেলবার একটা বৃথা খেলা খেলতাম তখন, সেই সুবাদে। বুঝলাম, কোনও একটা কারণে জরুরি তলব দিয়েছে মামা, বিকেলেই যেতে হবে মামার বাড়ি। দিনটা ছিল রোববার, বাবা তাই বাড়িতে, আর আমারও ছুটি। আমরা থাকতাম গড়িয়ায়, মামার বাড়ি লেক গার্ডেন্সে। হপ্তায় অন্তত একদিন যাওয়া তো হতই, তার বাইরে আরও একটা দিন যাওয়া হবে শুনে মন ভাল হয়ে গেল। কেননা সেখানে যাওয়া মানেই আরও একদফা গানবাজনা। হয় মামা কোনও নতুন বাঁধা বন্দিশ শোনাচ্ছে, নয় মা কোনও বাংলা গান নিয়ে বসে পড়ছে, সঙ্গে তবলা সঙ্গতে মামা নিজে আর হারমোনিয়ামে বাবা। এসবের মজা যত বেশি পাওয়া যায়, ততই ভাল। কিন্তু বাবা আর মা’র কথাবার্তায় বুঝলাম, সেই রোববারের বিকেলে সেরকম কিছু হবার জো নেই। কেননা কোনও একজন বিশেষ অতিথি আসছেন মামার বাড়িতে, তাঁর সঙ্গে দেখা করা, কথা বলাটাই আসল ব্যাপার। মামা তাই মা-কেও ডেকেছে। বাবা আর মা দেখলাম বেশ উত্তেজিত। এমনিতে রোববার অনেক বেলা পর্যন্ত মা-র গানের ক্লাস চলে, স্নান খাওয়া সারতে বিকেল হয়ে যায় প্রায়। সেদিন সাত-তাড়াতাড়ি সকলকে ছুটি দিয়ে মা উঠে পড়ল। বাবাও রোববারটা এদিক-ওদিক আড্ডা মেরে বা নিজের লেখালেখি নিয়ে বেলা অবধি কাটিয়ে দেয়, সেদিন সেসবের দিকে গেলই না। বেশ তাড়াতাড়ি সব কিছু সেরে বেলা তিনটের মধ্যে সকলে তৈয়ার। আমিও রেডি, কিন্তু আর কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে জিগ্যেস করেই ফেললাম, ‘কে আসছেন আজ মামাবাড়িতে?’ মা সদর দরজায় তালা দিতে দিতে বলল, ‘সলিলদা, সলিল চৌধুরী।’

    অতিথির ডাক অগ্রাহ্য করা যায় না, এদিকে জানি পরে কপালে নির্ঘাত বকুনি আছে। তাও পায়ে পায়ে ঢুকে এলাম বসবার ঘরে, আমরা তিন ভাইবোন। সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরেছেন তিনি, সঙ্গে চোস্ত, চোখে ভারী কালো ফ্রেমের চশমা, আর কাঁধ অবধি নেমে আসা চুল। মুখে যে-হাসিটা রেখেছেন, সেটার সঙ্গে কেবল বিকেলের আলোর তুলনা চলে। 

    মামাবাড়ি যখন পৌঁছলাম, তখন বিকেলের ঝমঝম রোদ সে-বাড়ির ছাদ-আলসে-বারান্দা ধুইয়ে দিচ্ছে। অন্যান্য দিন বাড়ির বাইরে থেকে তানপুরা আর গানের আওয়াজ ভেসে আসতে শোনা যায়, আজ সেসব নেই। কিন্তু কী এক যেন অদেখা আনন্দে ছেয়ে আছে সবটুকু। বাড়ির মেঝেয় পা রেখে তার মন বোঝা যায়, আমিও সেভাবেই টের পেলাম, আজ দিনটা অন্যরকম আনন্দের। ঢুকে দেখি চেতলানিবাসী মেজো মাসিও এসেছে, সঙ্গে তার কন্যা, আমার বোন। মামা আর মামিমার মেয়ে, ছোটো বোনটি তখন নেহাতই কুট্টি, কিন্তু সেও বেশ পরিপাটি হয়ে এ-ঘর সে-ঘর করছে। যা বোঝা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিথি এসে হাজির হবেন। কড়া নির্দেশ, বাচ্চারা তখন যেন বসার ঘরে ঢুকে হুটোপাটি না করে। এমনিতেই এটা উল্টে দেওয়া, সেটা ভেঙে ফেলার একটা চল ছিল আমাদের দৌড়ঝাঁপের মধ্যে, সেটা সেদিন যেন না হয় কিছুতেই, তারই বন্দোবস্ত আর কি! 

    অতিথি অভ্যর্থনার জন্য নোনতা আর মিঠে আয়োজনের গন্ধে গমগম করছে তখন চারপাশ, এরই মধ্যে শোনা গেল বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ। তখন দিনে সাকুল্যে দশটা গাড়ি যেত সামনের রাস্তা দিয়ে, তাই আলাদা করে সেসব শব্দ আমরা বুঝতে পারতাম। যেমনটি কথা ছিল, তেমনটিই করতে হল। আমরা তিন ভাইবোন ভেতরের ঘরে বিছানায় গিয়ে বসলাম, মামা আর মা নেমে গেল তাঁকে নিয়ে আসতে। সলিল চৌধুরী, নামটা তো শুনেছি কতবারই। গান তৈরি করেন, এটুকু জানি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর লতা মঙ্গেশকরের গলায় তাঁর তৈরি কত-কত গান তো বাজতে শুনি হামেশাই। মায়ের গলায় গুনগুনিয়ে দু’খানা গান তো রোজই শুনি প্রায়। ‘না, মন লাগে না’ আর ‘কী যে করি, দূরে যেতে হয় তাই’। ঘুরতে-ফিরতে এ-গান আমাদের বাড়ির সঙ্গী। সেই গানের কারিগর আজ আমাদের পরিবারে দেখা দিতে আসছেন, এ-কথা ভেবে আমারও অজানা এক আনন্দ হচ্ছিল বইকি! 

    মামিমার কাছে শুনলাম, দূরদর্শনের এক ধারাবাহিকের জন্য কয়েকটি রাগাশ্রয়ী গান বাঁধতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি চান, মামাকে দিয়ে সেই গানগুলো গাওয়াতে। সেসব নিয়ে কথা বলতেই আসা। এরই মধ্যে কখন তিনি বাইরের ঘরে বিরাজমান হয়েছেন, কথাবার্তা আর হাসির হই হই শব্দে সেসব মালুম হচ্ছে দিব্যি। চায়ের পেয়ালা সারি বেঁধে হাজিরা দিয়েছে সে-ঘরে, সঙ্গে হাওয়া বইছে নির্ভার, নিশ্চিন্ত বিকেলবেলার। মামা, মা আর বাবা তাঁর সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছে, মাসি আর মামিমাও যোগ দিয়েছে। আমরা তিন ভাইবোন আর থাকতে না-পেরে উঠে গিয়ে বসার ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়েছি। কাজটা ঠিক হচ্ছে না জেনেও দিয়েছি। আর তখনই তাঁর চোখ পড়েছে আমাদের অপরাধী মুখগুলোর দিকে। পড়ামাত্র, হাতের নরম ইশারায় তিনি ডেকেছেন আমাদের। 

    এ এক আজব দ্বৈরথ। অতিথির ডাক অগ্রাহ্য করা যায় না, এদিকে জানি পরে কপালে নির্ঘাত বকুনি আছে। তাও পায়ে পায়ে ঢুকে এলাম বসবার ঘরে, আমরা তিন ভাইবোন। সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরেছেন তিনি, সঙ্গে চোস্ত, চোখে ভারী কালো ফ্রেমের চশমা, আর কাঁধ অবধি নেমে আসা চুল। মুখে যে-হাসিটা রেখেছেন, সেটার সঙ্গে কেবল বিকেলের আলোর তুলনা চলে। সুরেলা মানুষজনের হাসি বোধহয় ওরকমই হয়। প্রণাম করলাম একে-একে, মাথায় হাত রাখলেন তিনি সক্কলের। কার কী নাম, কে কোন ক্লাসে পড়ি, সব জানতে চাইলেন। আমরা বাধ্য শিশুর মতো বলে গেলাম সব। তারপর একটাই প্রশ্ন তিনজনকে করলেন, আমরা গানবাজনা করি কি না। আমাদের বাড়িতেও বরাবর এই প্রশ্নটাই সবার উপরে স্থান পেয়ে এসেছে, তাই মাথা নেড়ে জানান দিলাম, করি। কার সামনে কী নিয়ে কথা বলছি, সে-জ্ঞান তো তখনও হয়নি। এই আলাপ-পর্ব মিটতে আবার আমরা ঘরে ফিরে এলাম, বকুনির ভয়ে থাকলাম বাকিটা সময়। যদিও পরে সেটা জোটেনি কপালে। বরং সেটা জুটেছিল সেদিন, তার মর্ম অনেক পরে বুঝেছি। সলিল চৌধুরীর আশীর্বাদ। মাথায় সেই হাতের স্পর্শ লেগে আছে আজও, আর চোখে লেগে আছে বিকেলের আলোর মতো সেই হাসি। সুর দিয়ে তৈরি করা, কথায় মুড়ে রাখা একজন মানুষের দেখা যে পেয়েছিলাম এক বিকেলে, আজকের এই কোলাহলের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে সেটাকেই অবাস্তব বলে মনে হয়। আর শঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে শব্দ ধার নিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, এখন সব অলীক…  

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook