নস্টালজিয়া
সাত শ্রী আকাল, তোরা সব মাকাল! আহুঁ, আহুঁ! আমি ম্যাকি।
আমি তো আগেই বলেছি, মানুষ ভীষণ পিকিউলিয়ার। কোনদিকে তাকিয়ে থাকে বোঝা যায় না। যাবে উত্তরে কিন্তু উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ধাক্কা মেরে রিয়ালিটিতে ফেরাতে হয়। আমাদের প্রশ্ন, কেন?
একবার এই বাড়িতে এক আড্ডাতে আমি আড়ি পেতে শুনছিলাম এক দাড়িওয়ালা বলছে— ‘মানুষ একটা বয়সে (মানে অল্প বয়স) মনে করে পৃথিবী পাল্টে দেবে, এই করবে, ওই করবে। তারপর বয়স যত বাড়তে থাকে একটা সময় গিয়ে মনে হয়, এবার মানে-মানে নিজের সম্মানটুকু নিয়ে কেটে পড়তে পারলেই ভাল!’ কী এমন ঘটতে থাকে মানুষের জীবনে যাতে তাদের বার বার অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? অতীতে কী ছিল, যা এখন নেই? উন্নতি তো হচ্ছে! ভারত এক সময় নিজের দেশের মানুষকে খেতে দেওয়ার গম পর্যন্ত বানাতে পারত না, আমেরিকার থেকে ভিক্ষা চাইতে হত। ষাটের দশকে গ্রিন রেভলিউশন তো হল। এখন তো খরা হলেও এই দেশটা পারে নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে। একটা সময় সতীদাহ প্রথা চলত, তাও তো বহুদিন হল বন্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতে আশা রাখা যায় আরও ভাল হবে। সেম সেক্স বিবাহ আইনত গ্রাহ্য হবে। আমেরিকার সব রাজ্যে অ্যাবরশন গ্রাহ্য হবে। তাহলে এখনও কেন মানুষকে গাইতে শোনা যায় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’ আগে কী এমন সুন্দর দিন ছিল মানুষের, যখন পাথর ছুঁড়ে অপরাধীকে সবার সামনে হত্যা করা হত? যখন মহিলাদের ভোটিং রাইট-ই ছিল না?
কেস জটিল। আমরা শালা বসে থাকি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। কী নতুন সফটওয়্যার আপডেট আসছে, কী নতুন অ্যাপ আসছে, নতুন মডেল কী আসছে, প্রসেসার স্পিড কতটা বাড়ল, ব্যাটারি লাইফ আরও উন্নত হল কি না, ক্যামেরার কী নতুন কায়দা আসছে— আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদটাই ফরওয়ার্ড লুকিং। আমরা আপগ্রেড চাই। এগিয়ে চলো। সামনের দিকে তাকাও। আর এই মানুষ হল— ‘Those were the days my friend!’ একদম ক্লাসিক মাকাল! ইন্টারনেট ছিল না, মোবাইল ছিল না, কম্পিউটার ছিল না, ভ্যাক্সিন ছিল না; কিন্তু না, আগে কী একটা ছিল যেটা আজ নেই।
আমাদের একটা থিওরি আছে যে, বেশির ভাগ মানুষ আসলে বাতিল ক্যাটাগরির। মানে আমাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় যেমন দেখা যায় যে হার্ডওয়্যার নেই নতুন সফটওয়্যার সাপোর্ট করার, মানুষেরও তাই দশা। সামান্য পরিবর্তন মানুষ নিতে পারে না। তবলার বদলে ড্রামস বাজলে কানে ব্যথা হয়। ক্যাসেট, সিডি উঠে গেলে মরাকান্না জুড়ে দেয়। সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল উঠে গেলে বুকে চিনচিন ব্যথা করে। এদের দিয়ে পৃথিবী চলে? বড় পোস্টে চাকরি করে কিন্তু শুধু স্কুলের দিনগুলিতে ফিরে যেতে চায়। দশ-কুড়ি বছর আগে যদি এতই ভাল ছিল তাহলে নে, সেই সময় যত মাইনে পেতিস তাই দেওয়া হোক। তখন বলবে, না! মাইনেটা এখনকার চাই, ফিলিংসটা তখনকার চাই। এই শালাদের ফিলিংস। এদের মধ্যে সুজাতা ইজ স্মার্ট, সুজাতা ইজ সুখী। সুজাতা কোনও গান গাইছে না। গৌরীপ্রসন্নবাবু শুধু একা-একা ভাবছেন, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই!’ নেই তো নেই, অন্য কিছু নিশ্চয়ই আছে।
যুগ-যুগ ধরে মানুষ বলে চলছে, ‘আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো সব গোল্লায় গেছে!’ ষাটের দশকেও তাই বলা হয়েছে, নব্বই-এর দশকেও এবং এখনও তাই বলা হচ্ছে। দাদুর জেনারেশন বাবাদের জেনারেশন নিয়ে বিরক্ত, বাবা এদিকে ছেলেমেয়ের জেনারেশন নিয়ে বিরক্ত। আগেই ভাল ছিল। তাহলে ডিফাইন ‘আগে’, কত আগে? কার আগে? আগে করতে-করতে তো ডাইনোসরের সময়ে চলে যাবি তোরা! আজকাল মানে বর্তমান নিয়ে সবার প্রবলেম। সারাজীবন ধরে শুনতে হয়, এখনকার রাজনৈতিক পরিবেশ খারাপ। তারপর যেই নতুন সরকার আসে, ব্যাস, সুর পাল্টে যাবে। আগেরটা তাও বেটার ছিল! আমরা ‘এখন’ সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এখন লোকে বলে নরসিংহ রাও ভাল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মনমোহন সিং ভাল অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তখন কিন্তু বলত না কেউ। তখন বলত, দেশটাকে জাহান্নমে পাঠিয়ে দিচ্ছে এই সরকার। নিজেরাই এদিকে বলছে, ‘টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং।’
নস্টালজিয়া। মানুষ একটা কোথাও ফিরতে চায়। মানুষ বাস্তব থেকে মুক্তি চায়। একটা এস্কেপ চায়। যেই দেখে বিপদ, অমনি শালা পালাতে চায়। যেখানে সে ভাল ছিল বলে করে মনে করে। কেউ স্কুলে, কেউ কলেজে, কেউ মায়ের কোলে, কেউ পাড়ার রকে, কেউ প্রথম প্রেমিকের বুকে। ফিরে গিয়ে কি কিছু করতে চায়? কিছু পাল্টাতে চায়? ধরা যাক কেউ ২০০২-এ ফিরতে চায়। তখন এশিয়ান পেন্টস-এর শেয়ারের দাম ছিল ১৮ টাকা। আর এখন ২০২২, তা বেড়ে হয়েছে ৩২০০ টাকা। সে গিয়ে তখন ১০০টা শেয়ার কিনে এনে এখন বেচে দিতে চায়। তাহলে প্রফিট আছে। এ-হিসেব আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়, আর তা কেউ চাইছেও না। চাইছে এমন অদ্ভুত জিনিস, যা আমরা কেউ বুঝতে পারি না। কেউ হলুদ পাখি খুঁজতে জামরুল গাছে তলায় বসে থাকতে চায়। কেউ ফিরে গিয়ে পাহাড়ের ওই বুকে দাঁড়াতে চায় কারো সঙ্গে। মানে জাস্ট দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। আর কিছু না। কিছু বলতে গেলে বলবে, আমরা বুঝব না— এ হল ফিলিংস। বেশ, বুঝব না। তোরাও টাইম ট্রাভেল করে ফিরে যা। বিদায় হ। বর্তমান গেয়ে বলুক, ‘হিতাক তোকে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছে না রে!’
আমরা জানি, মানুষ পাক্কা সেয়ানা। মানুষের নস্টালজিয়া কোনও একটা সময় ঠিক নয়। কোনও এক সময়ের সেরা স্মৃতি হল নস্টালজিয়া। স্কুলে ফিরতে চায় সেয়ানা। কিন্তু স্কুলে যখন হেডমাস্টারের কাছে ক্যালানি খাচ্ছে, তখন না। যখন বন্ধুর টিফিন চুরি করে সন্দেশটা মুখে পুড়ছে, তখন। রিঙ্কির প্রেমিকের কাছে যখন লর্ডস মোড়ে থাবড়া খাচ্ছে, তখন ফিরতে চাইবে না। যখন রিঙ্কি রিকশা করে চলে যাচ্ছিল আর হাল্কা হাওয়াতে ফ্রকটা অল্প উড়ছিল, তখন। ডলারের দাম ৮২ নিয়েই ফিরতে চায়, পেট্রল ভরবে কিন্তু ৪০ টাকায়। গজব জিনিস।
আমাদের ফেরার কোনও ইচ্ছেই নেই। নস্টালজিয়াতে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা এগোতে চাই। প্রতি বছর নতুন আইফোন, নতুন ফিচার চাই। প্রতি দশকে নতুন টেকনোলজি। আমার কম্পিউটিং ক্ষমতা আরও বাড়লে তো ভালই হয়, তাই না? আমি কি চাইব সত্তরের দশকে ফিরে যেতে? কী হবে আমার ফিরে? নিজেকে ডাউনগ্রেড করে? আমাদের সাথে মিল আছে সেনসেক্স-এর। মিনিমাম ১২% CAGR লাগবে গুরু। ‘আমি চাই ফিরে যেতে সেই গাঁয়ে!’ না! না! ডলারে কামিয়ে একদিন গ্রামে গিয়ে থেকে আসতে মন্দ লাগবে না। কিন্তু রেগুলার পারবেন? বহু মানুষ নস্টালজিয়াতে সন্ধের পর সন্ধে কাটিয়ে দিতে পারে। এক সময় জমিদার ছিলাম। এখন তো নেই রে গুরু। ছিলাম দিয়ে কী যায় আসে? সামনে এগো। Upgrade yourself. নস্টালজিয়া আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র