ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বন্ধু প্রজাপতির জীবনচক্র


    অংশুমান ভৌমিক (December 3, 2022)
     

    টক অফ দ্য টাউন বলতে যা বুঝি, ‘দোস্তজী’ এই মুহূর্তে তাই। প্রসূন চট্টোপাধ্যায় নামে একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল এক পরিচালকের একেবারে অভিষেক ছায়াছবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াজুড়ে যে উচ্ছ্বাসের দীপাবলি তা হাল আমলে দেখিনি। প্রযোজক, পরিবেশকের আনুকূল্য নেই। লম্বাচওড়া পোস্টার-হোর্ডিং নেই। যে-ক’টি আছে তাতে এমন দুটি মুখ দীপ্যমান, যাদের সঙ্গে চেনাশোনা নেই প্রায় কারোর। অথচ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অপার পৃষ্ঠপোষণা আদায় করে নিল ‘দোস্তজী’। একেবারে যেচে একেবারে আনকোরা প্রসূনের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। মিডিয়া নড়েচড়ে বসল। তারপর যেভাবে এতগুলো দিন থেকে গেল, তাকে ভিনি-ভিডি-ভিসি ছাড়া আর কোনো অভিধায় ধরতে পারছি না। 

    গৌরচন্দ্রিকা থাক। ১১ নভেম্বর বিকেলে নন্দনের বড়ো প্রেক্ষাগৃহে দেখেছি ১১৪ মিনিটের এই ছায়াছবি। ‘দোস্তজী’ দেখতে যাবার সময় ভেবে চলেছিলাম, বাংলা ছায়াছবির এমন অদ্ভুত নাম আগে কখনও শুনেছি কি! ‘দোস্ত’— দেশভাগের সময় থেকে বাংলা ভাষায় পেঁয়াজ-রসুন সমস্যা যত প্রকট হয়েছে, আরবি-ফার্সি জবানকে তৎসম সম্মার্জনী দিয়ে যত কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে, তত ‘দোস্ত’র মতো শব্দ আমাদের প্রমিত বাংলা থেকে লোপাট হয়ে গেছে। নারায়ণ দেবনাথের ‘নন্টে-ফন্টে’ গতের কমিকস ছাড়া ‘দোস্ত’দের দেখাই মেলেনি অনেক কাল। অথচ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বেরোনো যুগান্তকারী নাটক ‘নবান্ন’-এ তো বিজন ভট্টাচার্যের লেখা গানে ছিল— ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম মিথ্যা সে বয়ান / হিন্দু-মুসলিম যতেক চাষি দোস্তালি পাতান।’ আলি-অনুসর্গ যোগে ‘দোস্তালি’ পাতানো কত সহজ ছিল ছেচল্লিশের দাঙ্গার আগে। কিন্তু ‘দোস্তজী’! এমন জোড়কলম শব্দ কোত্থেকে আমদানি হল? প্রসূন চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বরের মোড়-ঘোরানো ঘটনার পটভূমি এমন শব্দসংস্কৃতির ধাত্রীগ্রাম। 

    তাই ‘দোস্তজী’ শুরুই হল গৈ-গেরামের এক চায়ের দোকানে। আমাদের কানে ভেসে এল আকাশবাণীর দিল্লি কেন্দ্র থেকে রিলে করা বিশেষ-বিশেষ খবর। নীলিমা সান্যাল, সত্যেন মিত্র, ইভা নাথের গলায় এমন বিচিত্র সংবাদ আমরা শুনিনি, কিন্তু প্রসূনের কলমের খোঁচায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ক-হপ্তা বাদে উত্তপ্ত হয়ে থাকা উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাতাবরণের এমন এক ধ্বনিচিত্র তৈরি হল যে, ‘দোস্তজী’কে কোন চোখে দেখাতে চান চিত্রনাট্যকার-তথা-পরিচালক তার আঁচ পাওয়া গেল। নন্দনের ব্যালকনিতে এই কলমচির পাশে বসে থাকা সুব্রত সেন বাহবা দিলেন, ‘দেখলে, কীভাবে টাইমলাইনটাকে ঘেঁটে দিল!’ আমাদের ঠিক পেছনে বসে থাকা সোহাগ সেন নিজের নাটকের দল অনসম্বলের এই প্রাক্তনীর এই বাহাদুরিতে কি মনে-মনে শাবাশি দিলেন? জানি না। শুধু জানি যে, ধর্মীয় জিগিরে ছেঁড়াখোঁড়া বারেন্দ্রভূমির বুকে বন্ধুতার এই উৎসব আখেরে আমাদের টমাস হার্ডির ‘ইন টাইম অফ দ্য ব্রেকিং অফ নেশনস’ মনে পড়াল। মনে করাল গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’কে। 

    যে-বাংলায় বাবরি ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া বাংলার গ্রামসমাজে হিন্দু-মুসলমানের আপাত সহাবস্থানের কফিনে শেষ পেরেক পড়েছিল, যার ক্ষতচিহ্ন আজও ধারণ করছে জিলা মুর্শিদাবাদ, যার অভিঘাতে মুর্শিদাবাদ থেকে নদিয়ার বুকে গণপ্রচরণের এক অনিবার্য স্রোত আছড়ে পড়েছিল অচিরে, সেই বাংলার বুকে পলাশ (আসিক শেখ) আর সফিকুলের (আরিখ শেখ) দোস্তালি আসলে একটি ব্যতিক্রম। একজনের গলায় মালা থাকতে পারে, আরেকজনের গলায় তসবি ঝুলতে পারে। একজনের বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ির জাতবিচার থাকতে পারে, আড়ালে থাকতে পারে হরিহর রায়ের নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাবার আদিসূত্র। আরেকজনের বাড়িতে গামছা বোনা আর গামছা বিকোনোর দিন গুজরানের মধ্যে লুকোনো থাকতে পারে শিকেয় তোলা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। প্রতিবেশী দুই শিশুর বাড়ির সীমানা গড়ে দিতে পারে নতুন তুলে দেওয়া পাটকাঠির বেড়া। একজন ক্লাস থ্রি-র ফার্স্ট বয় হতে পারে, আরেকজন ‘কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি’ মুখস্থ করতে বারে বারে অপারগ হতে পারে। তাতে দোস্তালির কিছু যায়-আসে না। সহাবস্থানের কলকাঠি ভেঙে গেলেও দোস্তালিতে তার ছায়া পড়ে না। পলাশের হাতে ধরা লাটাই থেকে বেরোনো সুতো দিয়ে দিব্যি ঘুড়ি বাড়তে পারে সফিকুল। নীল আকাশের বুক চিরে নীল ঘুড়ির এই উত্তাল উড়ান বাংলার ভাগ্যাকাশে ঘনায়মান দুর্যোগের ঘনঘটাকে ভোকাট্টা করে দেয়। বড়দের গড়ে তোলা অসহিষ্ণুতার পাঁচিলের বুকের ফাঁকফোকর দিয়ে দিব্যি শোনা যায় কটকটির আওয়াজ। মসজিদ বানানোর জন্য জড়ো করা বালির স্তূপ থেকে সরানো বালি দিয়ে দিব্যি ঝুলন সাজানো যায়। উগ্র-হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীর দল নিজেদের পিঠ বাঁচানোর ধান্দায় কলকাতা থেকে রামযাত্রার দল আনে। দুই দোস্তের অবাক চোখের তারায় চলকে ওঠে ধর্মাধর্মের সনাতন বয়ান। যাত্রাবিরতিতে রাম-সীতা-রাবণকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে দেখে থতমত খেয়ে যাওয়া পলাশ-সফিকুলকে দেখে কুশীলবদের একজন যা বলে ওঠেন তা এ-ই— ‘আমরা আসলে বন্ধু, পেটের দায়ে শত্রু সাজতে হয়।’ 

    দোস্তজী : আরিফ সেখ ও আশিক সেখ

    আমরা যে আসলে এক, রক্ত আর খুনে যে কোনও তফাত নেই, এ-নিয়ে কত ছায়াছবি হয়েছে এত দিন ধরে। মেলোড্রামার পর মেলোড্রামা। কস্টিউম ড্রামা-পিরিয়ড পিসের কত ঢক্কানিনাদ! অথচ কোনো রক্তারক্তি না ঘটিয়ে কী অনায়াসে বাংলার বহুত্ববাদী অতীতের সুতোয় টান মেরে সংস্কৃতির ভাঙা সেতু চিনিয়ে দিলেন প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। এই সেতুর মেরামতি যে আমাদের মতো দেশে যে-কোনও শিল্পের আদত কর্তব্য এবং বুকে-পিঠে গজাল না ঠুকেও যে তা করে ফেলা যায় ‘দোস্তজী’ তারও বিজ্ঞাপন। 

    বলছি বটে বিজ্ঞাপন, অথচ উচ্চকিত কোনও ঘোষণাপত্র ‘দোস্তজী’র ত্রিসীমানায় নেই। জমাট কোনও গল্প অবধি নেই। এই সহজ পাঠের গল্পে আছে দৃশ্যের পর দৃশ্য। নদী-বিধৌত বঙ্গের চিরায়ত চিত্রমালা। পার্শ্বচরিত্রে আছে অধুনালুপ্ত ‘কিশলয়’ আর ‘নব গণিত মুকুল’। আছে অধুনা ‘উঁচাই’তে ওঠা অমিতাভ বচ্চনের প্রখর যৌবনের আঁচ-পোয়ানো উপমহাদেশ। ‘দোস্তজী’র ডিরেক্টর অফ ফোটোগ্রাফি তুহিন বিশ্বাস নাকি আদতে ফোটোগ্রাফার! মুভি ক্যামেরায় হাত পাকিয়েছেন এই অনন্যোপায় পরিচালকের ইলেভেন্থ আওয়ারের অনুজ্ঞা মেনে। অথচ চিত্রায়নের প্রকরণ তাঁর করায়ত্ত থাকায় ‘পথের পাঁচালী’র সুব্রত মিত্রকে মনে করতে কোনও অসুবিধে হয়নি আমাদের। কোনও কোনও দৃশ্যায়নে বেশ সচেতন ভাবেই সত্যজিৎ-সুব্রত যুগলবন্দিকে নজরানা পেশ করেছেন প্রসূন-তুহিন। এ-ছবিতে লং শটের আধিক্য। আছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ফ্রেমের অনুসারী অসংখ্য লং টেক। তুহিনের ওস্তাদি চেনা গেছে কোনও কোনও দৃশ্যে। যেমন অমিতাভ বচ্চনের অনুরাগী এক সাইকেল মেকানিকের (সঞ্জীব পোদ্দার) দোকানের দেওয়ালে সাঁটা ‘দিওয়ার’-এর পোস্টারের সামনে দাঁড়ানো পলাশ-সফিকুলের লো-অ্যাঙ্গেল শটে। দুজনে মিলে বচ্চনের দাঁড়ানোর কায়দা রপ্ত করতে চাইছে, গোড়ালির ওপর ভর করে একটু কাত হয়ে দেহকাণ্ডকে টানটান রাখার সাধনা করছে। পারছে না। ওদেরকে তরিকা শেখাচ্ছেন সেই সাইকেল-মেকানিক। খানিক বাদে স্টুডিয়োয় গিয়ে ওই একই ভঙ্গিতে ছবি তুলল দুই দোস্ত। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আলোড়ন উঠল নন্দনের একতলায়। মনে পড়ল ব্যালকনিতে উঠবার সময় একতলায় স্কুল-ইউনিফর্ম-পরা একদল সারিবদ্ধ কিশোরকে দেখেছিলাম। বুঝলাম, ওই দৃশ্যায়ন তাদের নাড়া দিয়েছে। তারা অমিতাভকে হয়তো চেনে না, হয়তো দেখেওনি কোনওদিন। অথচ দৃশ্য রচনার গুণে বর্তমানের কৈশোর, অতীতের কৈশোরের মধ্যে দিব্য এক আমোদসেতু তৈরি হয়ে গেল এক লহমায়। ‘দোস্তজী’র দুই সম্পাদক সুজয় দত্তরায় ও শান্তনু মুখোপাধ্যায় এর আগে কী কী কাটাকুটি করেছেন জানি না। অনুমান করি, তাঁরা কোনো ফিল্ম ইনস্টিউটের জলপানি পাওয়া কেউ নন। অথচ বিলম্বিত আর মধ্যলয়ের মিশেলে কীভাবে একটি সভ্যতার অন্তরাত্মাকে ছুঁয়ে দেওয়া যায়, তার কৌশল তাঁরা রপ্ত করে নিয়েছেন। তাঁদের পাশে থেকেছে রাজীব পালের ভিসুয়াল এফেক্টস। বিশেষ করে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হবার দীর্ঘ সাবপ্লট জুড়ে নানান রকমের যতিচিহ্নের প্রয়োগে।

    কোনো রক্তারক্তি না ঘটিয়ে কী অনায়াসে বাংলার বহুত্ববাদী অতীতের সুতোয় টান মেরে সংস্কৃতির ভাঙা সেতু চিনিয়ে দিলেন প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। এই সেতুর মেরামতি যে আমাদের মতো দেশে যে-কোনও শিল্পের আদত কর্তব্য এবং বুকে-পিঠে গজাল না ঠুকেও যে তা করে ফেলা যায় ‘দোস্তজী’ তারও বিজ্ঞাপন।  

    ‘দোস্তজী’র তুরুপের তাস এর অভিনয়। নিও-রিয়্যালিস্ট ঘরানার অভিনয়। ভিত্তিরিও ডি সিকা-র ‘বাইসাইকেল থিফ’-এর নায়ক নাকি ক্যামেরার সামনে অবতীর্ণ হবার আগে কোনওদিন অভিনয় করেননি। আশিক শেখ আর আরিফ শেখ একই রকমের অনভিজ্ঞতাকে সম্বল করে এগিয়েছেন। নিশ্চয়ই কোমর বেঁধে রিহার্সাল হয়েছে। নিশ্চয়ই পাখি-পড়ার মতো করে শেখানো হয়েছে ফিল্ম অ্যাক্টিং-এর বর্ণমালা। দুজনে মাত করেছেন সংলাপ প্রক্ষেপণের সরল উৎকর্ষে। প্রসূন তাঁদের মুখের কথাকেই পলাশ-সফিকুলের মুখে বসিয়েছিলেন। অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন ডোমকল মহল্লার কথ্য বাংলার সুর। জিজ্ঞাসাসূচক কিংবা অস্ত্যর্থক ‘হবে’ আমাদের নাগরিক কানে যে চমৎকার শোনাতে পারে, এ যেন প্রসূনের জানাই ছিল। ওই ‘হবে’র নানান মাত্রাকে নানান জায়গায় গেঁথে দিলেন নবীন পরিচালক। আমরা মাত হয়ে গেলাম। ‘দোস্তজী’তে একজন গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অনুজয় চট্টোপাধ্যায়। শিশুর জিজ্ঞাসাকে উস্কে দিতে, তার ভেতর বড়ো হবার আকাঙ্ক্ষাকে গুঁজে দিতে একজন সুশিক্ষক যে ধনাত্মক অনুঘটকের ভূমিকা নিতে পারেন, তিনি তার মর্মে পৌঁছে গেছেন। ছায়াছবির একেবারে শেষে নিজেকে নতুন করে চিনতে পারা সফিকুলকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমবাগানে ঘোরাতে গিয়ে, যাবার সময় শিক্ষক বললেন, ‘চলো, একটু বেরিয়ে আসি, হবে?’ আমাদের চোখের কোল আনন্দাশ্রুতে ভরে গেল। 

    ‘দোস্তজী’র আরও দুই স্তম্ভ যাদবপুরের জয়তী চক্রবর্তী আর বালুরঘাটের স্বাতীলেখা কুণ্ডু। ষোলো আনা থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের দুই অভিনেত্রী। দ্বিতীয়জন সেজেছেন সফিকুলের আপা (পরিচালকের সহকারীর দায়িত্বও সামলেছেন)। স্বাতীর মুখে কথা কম, অভিব্যক্তি বেশি। স্নেহে-শাসনে সমান দড় মগ্ন চরিত্রায়ন। প্রথমজনের মধ্যে সর্বংসহা মাতৃমূর্তিকে স্থাপন করেছিলেন প্রসূন। চোখের তারার সূক্ষ্ম কারিকুরিতে ‘পথের পাঁচালী’র সর্বজয়াকে থেকে-থেকেই মনে করাচ্ছিলেন জয়তী। একেবারে শেষের দিকে শুঁয়োপোকা যেই প্রজাপতি হয়ে আকাশে উড়ে গেল, হাওয়া-ডানা মেলে উড়াল দিল ছেলে-মরা মায়ের আবেগ। তারসানাই বাজল না। অথচ এতক্ষণ পপুলার কালচারের পোঁ ধরে থাকা সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ সংগীতে ভর করে যে-মুহূর্ত রচনা হল, তা সব বয়সের দর্শকের চোখের জলে জোয়ার এনে দিল। বেলঘড়িয়া অভিমুখের নাটক ‘কোজাগরী’তে জয়তী যে-চরিত্র করেন, তার রেখচিত্র কতক একই রকম। মঞ্চে পোড়-খাওয়া অনুভব রুপোলি পর্দায় অগ্ন্যুৎপাতের মাত্রা পেল। 

    কোনো নামী মুখ নয়, সারা বাংলার মঞ্চ থেকে মেথড অ্যাক্টিং-এ সড়গড় আরও বেশ কিছু অভিনেতাকে দলে ভিড়িয়েছিলেন প্রসূন। কলকাতার জগন্নাথ চক্রবর্তী, বহরমপুরের রাহুলদেব ঘোষ-বিপ্লব দে-কে চিনলাম। প্রত্যেকের ভূমিকা ছোট, অভিঘাত কিন্তু বড়। গাঁয়ের এক দীর্ঘদেহী পাগলের ভূমিকায় যাঁকে দেখলাম, তাঁকে চিনি না। চিনবার ইচ্ছে রইল। ‘দোস্তজী’ নিয়ে এমন আরও সাতকাহন ফাঁদা যায়। যে-দৃশ্যবৈভবে ও কাব্যিকতায় ‘ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা গ্রামখানিকে’ এত মায়া দিয়ে ভরিয়ে তুলেছেন প্রসূন ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা, তা ইরানের সিনেমায় যত সুলভ ছিল, বুঝি আমাদের সিনেমায় ছিল না বলেই এত আপ্লুত লাগছে আমাদের। আমাদের লালিত নৈতিক কাঠামোয় কোনো আঘাত না দিয়ে, স্রেফ সংবেদনশীল স্নিগ্ধতায় একটি আটপৌরে গল্প শুনিয়ে ডিজিটাল স্ট্রিমিং-এর ভরা গাঙেও যে সিনেমায় টেনে আনা যায় মানুষকে, টেনে রাখা যায় ভিনভাষী দর্শককুলকে, তা দেখিয়ে দিয়েছে ‘দোস্তজী’।

    সমালোচনা : ‘দোস্তজী’

    পরিচালনা : প্রসূন চট্টোপাধ্যায়
    চিত্রগ্রহণ : তুহিন বিশ্বাস
    কাহিনি ও চিত্রনাট্য : প্রসূন চট্টোপাধ্যায়
    আবহসংগীত : সাত্যকি ব্যানার্জি
    সম্পাদনা : সুজয় দত্ত রায় ও শান্তনু মুখার্জি
    অভিনয় : আরিফ সেখ, আশিক সেখ, হাসনাহেনা মন্ডল, জয়তী চক্রবর্তী, স্বাতীলেখা কুণ্ডু, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়  

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook