‘আচ্ছা, হিনা জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে পছন্দ করলেন কেন?’
‘তোমার কপালের এই তিলটা দেখে।’
‘শুধু এই তিলটা?’
লোকটার চোখে চোখ রেখে গভীর অরণ্যের মতন স্বরে হিনা জিজ্ঞেস করল। হিনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসল লোকটা। তারপরে আস্তে করে বলল, ‘তোমার এই তিলটার সৌন্দর্য যে কী, তুমি তা জানো না…।’
‘সত্যি বলছেন?’
‘তিন সত্যি করে বলছি। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘বলুন…’
‘আচ্ছা, তুমি তো সেরকম মোটাসোটা নও, তাও তুমি কেন নিজেকে এমন ভাবো?’
‘আপনি বলছেন?’ হিনা কৌতুকের চোখে লোকটার দিকে তাকাল।
‘একশোবার। তাছাড়া তোমার বয়স বেশ কম। তিরিশের নীচেই হবে। আর তুমি মোটেও শ্যামবর্ণা নও।’
‘ঠিক!’
‘তাহলে তুমি একরম করে নিজেকে আন্ডার-এস্টিমেট করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলে কেন?’
‘কী?’
‘এই যে ‘শ্যামবর্ণা, মধ্য তিরিশ, ঈষৎ ভারী চেহারার পাত্রীর জন্যে সুপাত্র প্রয়োজন। বিঃ দ্রঃ পাত্রীর দুই ভ্রূ’র
মাঝে একটা বেশ বড় তিল আছে।’’ লোকটা অবাক হওয়া গলায় জানতে চাইল।
দশ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে রাম্বি বাজারের একটা রেস্তোরাঁতে বসে লোকটার সঙ্গে গল্প করছিল হিনা। কথাটা শুনে লোকটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে রাম্বি ঝোরার ক্ষীণকায়া প্রবাহের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেল ও। এই শীতের মরশুমে বেলা দ্রুত পড়ে আসছে। ইতোমধ্যেই পশ্চিমে তিস্তাভ্যালির পাহাড় বেয়ে শীতল বায়ুস্রোত নামতে শুরু করে দিয়েছে। জাতীয় সড়ক দিয়ে সিকিম, কালিম্পংগামী গাড়িগুলির যাওয়া-আসা দেখতে-দেখতে ওর মনে পড়ে গেল নিজের কাজের কথা। আসল কাজ এখনও যে বাকি!
‘চলুন, যাওয়া যাক।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হিনা বলল, ‘আর হ্যাঁ, আপনি কিন্তু বিল মেটাবেন না। ওটা
আমাকেই করতে দিন।’
‘না, না।’ লোকটা হাত নাড়িয়ে প্রবলভাবে বাধা দিয়ে বলল, ‘সেটা হয় না। আপনি আমার আমন্ত্রণেই এখানে
এসেছেন।’
‘সেটা ঠিক। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাবটা প্রথমে আমিই দিয়েছিলাম।’
‘তা হোক।’ লোকটা পকেট থেকে তড়িঘড়ি মানিব্যাগ বের করে কাউন্টারের দিকে এগোতে-এগোতে বলল, ‘আজ আমাকে এটা মেটাতে দিন। অন্যদিন না হয়…’
কিন্তু সেই অন্যদিন যে আর কখনও আসবে না, সেটা হিনা ভাল করেই জানে। জানে ওই লোকটাও। তবুও। সমাজে অপ্রয়োজনীয় অনেক কথাই বলতে হয়। রাম্বি ঝোরার উজানের দিকে হেঁটে চলেছিল দুজনে। আগাছা, ঝোপ আর গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ি অরণ্য এসে মিশেছে দুই তীরে। সামান্যই জল আছে মোলায়েম পাথরভর্তি ঝোরাটায়। মূলত বর্ষায় উত্তাল হয়ে ওঠে এটি। বছরের অন্য সময়ে পর্দানশীন নারীর ন্যায় প্রায় অদৃশ্য করে রাখে নিজেকে। পাথর-বিছানো ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীটির নদীগর্ভ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে স্মৃতির উজানের দিকে ছুটে চলেছিল হিনার মন।
‘তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?’ লোকটার কথা শুনে চিন্তার বেড়াজাল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বাস্তবে ফিরে এল হিনা। আস্তে করে বলল, ‘মা।’
‘আর কেউ নেই?’
‘এক দিদি ছিল।’
‘ছিল মানে?’
লোকটা চলতে-চলতে সহসা থেমে গিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইল। অগত্যা হিনাও থেমে গেল। হিনা শান্ত গলায় বলল, ‘মারা গেছে বছর দুয়েক আগে।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ। মালবাজারের কাছে বাগরাকোটের উত্তরে রামথি বনের একটি পাহাড়ি ঝরনার কাছে ওর মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল। কেউ ওকে ধর্ষণ করে শেষে নৃশংসভাবে খুন করেছিল।’
‘ছেড়ে দাও হিনা।’ লোকটা দ্রুত বলল, ‘এখন এসব শুনতে মোটেও ভাল লাগছে না।’
‘জানেন…’, হিনা নিজের মনেই বলে চলল, ‘ওর কপালেও না আমার মতন একটা বড় তিল ছিল। ঠিক দুটি ভ্রূয়ের মাঝখানে। ওকে খুন করার পরে সেই তিলের জায়গাটাতে খুনি একটা পেরেক পুঁতে দিয়েছিল। আমাদের পরিচিত একজন পুলিশ অফিসার বলেছিলেন যে, খুনি মনে হয় সাইকো। হয়তো ওই তিল ওর খুব পছন্দের। এই ধরনের খুন ও আবারও করতে পারে।’
‘ওসব কথা ভাল লাগছে না হিনা!’ লোকটা ওর হাত ধরে বলল, ‘এই রোম্যান্টিক পরিবেশে এইসব আলোচনা আজ নাই বা করলে!’
একে অপরের হাত ধরে নদীগর্ভ ধরে পশ্চিমে হাঁটতে-হাঁটতে ওরা লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছিল। রাম্বি ঝোরার উৎস এখান থেকে কাছেই। কানে ভেসে আসছে রাম্বি ঝোরার ঝরনার শব্দ। আর সব নিস্তব্ধ। জনমানবহীন এই পার্বত্য পরিবেশে এখন সন্ধ্যা নামছে। পাহাড়ের গা বেয়ে শীতল মেঘেরা উপত্যকার দিকে নেমে আসছে। ক্রমশ সাদা মেঘ আর কুয়াশার ফেনায় ভরে যাচ্ছে চারিদিক।
‘অনেকটা জল খাওয়া হয়ে গেছে।’ সহসা লোকটা বলল, ‘একটু দাঁড়াও। আমি এখনই আসছি।’ বলে সে এগিয়ে গেল বাঁ-দিকের পাহাড়ি ঝোপের দিকে। যদিও লোকটা কাছেই, কিন্তু মেঘ-কুয়াশার কারণে তার অবয়ব কিছুটা অস্পষ্ট এখন। এরকমই অস্পষ্ট ওদের পারস্পরিক পরিচয়। আর না ভেবে নিজেকে দ্রুত তৈরি করে নিল হিনা। লোকটা জলবিয়োগ সেরে ওর কাছে আসতেই সহসা শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে ডান হাতে লুকিয়ে রাখা ছোরাটা লোকটার পেটে গুঁজে দিল ও। পুকুরের জলের মধ্যে ভারী বাসন তলিয়ে যাওয়ার মতন লোকটার পাতলা সোয়েটার ভেদ করে বাঁট বাদ দিয়ে ছোরার বাকি অংশটুকু নিমেষে অদৃশ্য হল তার তলপেটে। পরক্ষণেই হিনা হ্যাঁচকা টান মেরে ছোরাটা একটু নামিয়ে দিল নীচের দিকে। আগে থেকে ফল-সবজির মধ্যে এমনভাবে ছোরাটা ঢুকিয়ে অনেক চর্চা করতে হয়েছে। তবেই না আজ হিনা এত বড় ঝুঁকি নিতে পেরেছে!
‘আ-হ-হ…’
তীব্র চিৎকার করে পড়ে গিয়ে পেট চেপে ধরে প্রবল যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকল লোকটা। প্রবলবেগে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে তার বিস্তীর্ণ ক্ষতস্থান থেকে। চোখে-মুখে তখনও খেলা করছিল প্রবল বিস্ময়। তার দিকে এক পা এগিয়ে গেল হিনা। এক ঝলক ওকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে সুতীব্র ঘৃণা সহযোগে হিমশীতল স্বরে হিনা বলল, ‘এবারে বুঝতে পারছিস, কেন আমি ওই বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলাম?’