জরা
প্রথমে আপনি বলত। পরে তুমি। ঠিক কখন থেকে, মনে নেই। জিজ্ঞেস করতাম, কবে ছাড়া পাব। কতদিন হয়ে গেছে জানতে চাইলে বলত, সে অনেকবার বলেছে, আমি ভুলে গেছি। আমি নাকি নিজেই ভর্তি হয়েছি, কেউ ধরে বেঁধে আনেনি। রাখেনি। এদিকে সময় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেছে আমাকে ফেলে রেখে। আমাকে জানানো হয়েছে, আমি মাঝে মাঝে কোমাতে চলে যাই। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরি। আবার ডুবে যাই ঘুমে। অথচ প্রচুর ইনভেস্টিগেশন করেও আমার শরীরে কোনও দোষ ধরা পড়েনি। কোমাতে আমার আংশিক চেতনা থাকত। দেখতে পেতাম মনিটরগুলোয় উত্তেজনাহীন ছন্দ ফুটে উঠছে। দৌড়ে চলেছে সাপের মতো সবুজ রেখা। কয়েকটা আলো অপলক। কয়েকটা বিনবিন করছে। আমি আপাদমস্তক প্লাগ্ড। অনেকগুলো তার শরীর থেকে রওনা হয়ে চলে গেছে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানাতে। নড়াচড়ার উপায় নেই। মনের ভুল নিশ্চয়ই, অনেকদিন কিছু খাওয়া হয় না। ডাক্তারবাবুদের দেখতে পাই না আর। একজন আছে। আমার পায়ের কাছে বসে থাকে সামান্য ঝুঁকে। সারাক্ষণ তার দৃষ্টি ফোনের দিকে। নিঃশব্দে টাইপ করে চলে কত কী! আমি নড়াচড়া করলে, কিছু বললে মুখ তুলে তাকায়। নিজে থেকে কিছু বলে না। একদিন দুম করে বলে বসেছিলাম, ‘তুমি ওখানে সারাক্ষণ কী লেখো?’ উত্তর দেয়নি, শুধু হেসেছিল চোখ তুলে।
আমার শরীরে একটা সুতো-ও নেই। অনন্ত নীল এক কাপড় বিছোনো আছে। এক সময় অসুবিধে হত। একদিন মনে হল, আমি তো আর সবার মতো নই। অনেককে চিনতাম। আমি এখন কোথায়, তারা জানে না। আমিও না। জামা-প্যান্ট পরে করবটা কী? যাব কোথায়? আমার নীল আকাশ ঢাকা জ্যান্ত খোয়াই নিয়ে কারুর মাথাব্যথার কারণ থাকতে পারে না। ভয় একটাই। স্বপ্ন দেখি হরেক রকম। তখন কী করি জানি না। কী করি, জানতে চাওয়ায় শুনলাম, কিছুই না। একদিন হাত-পা ছুঁড়েছিলাম। ইলেক্ট্রোড খুলে গিয়েছিল। মনিটরগুলো আঁতকে উঠেছিল। বিপাররা খুব চিৎকার করেছিল। ব্যাস, এটুকুই। আমার জীবনে মাঝে মাঝে কমা পড়ে। কিছুদিন পরে আবার লাইন-বাই-লাইন শব্দ জমতে শুরু করে। মনে হয় মৃত্যু ঘুরঘুর করে ডাংগুলি হাতে। জীবনের লাস্ট পোস্টটা একবার পেরিয়ে গেলে পূর্বজন্মের হিসেব-খাতাটা কষ্ট, দুঃখ, আক্ষেপের ডেটা ফাইল-সহ অটো ডিলিট হয়ে যায়। ভয়ের কিছু নেই। কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় এসব বুঝেছি। এই কথাটা নার্স বলেনি, বলতে পারে না। এটা ডেলিভারি হয়েছিল স্বপ্নে। সেবারে আমার জুতো সোল হারিয়ে ফেলেছিল।
সিগারেট খাব। হবে না। এই জানলাগুলো খোলার নয়। বাইরের হাওয়া খারাপ। আমার জন্য পিওর বাতাস আসে ভেন্ট দিয়ে। যা কিছু খারাপ, শুষে নেয় অন্য ভেন্ট। ধোঁয়া বলে এখানে কিছু হয় না। একদিন সুন্দর গন্ধ পেলাম। বেবি ক্রিমের। চোখ খুললেও একটু যেন অন্ধকার, আমার মুখের খুব কাছে নার্সের হাতের খোলা তালু। আমার চোখ ঢেকে গেছে। বলল, নিঃশ্বাস কেমন, দেখছে। হাত সরিয়ে নিতে আবার খুব আলো। হাসছে। এবারে যা বলল, তা শুনে কী করা উচিত বুঝতে পারলাম না। ‘সবাই চলে গেছে, পেশেন্টও নেই।’ চলে গেছে মানে? আমার কী হবে? ইলেক্ট্রিসিটি থাকবে তো? জল? নার্স? এই অবধি ভেবে তাকালাম মনিটরের দিকে। উথালপাথাল হচ্ছে। কষ্ট বলে সেভাবে কিছু নেই। ব্যথার বোধটা সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে। একটা ছোট স্ক্রিন, কী একটা দপদপ করছে। আশ্চর্য, আমার মাথার মধ্যে সেরকমই অনুভূতি হচ্ছে। একই তালে। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রচুর ফ্লাইটের আনশিডিউল্ড অ্যারাইভাল। রাডারে অস্পষ্ট।
সুখে কোনও বৈচিত্র নেই। অসুখে প্রচুর ভ্যারাইটি। সেবারে সাইনাস খুব ভোগাচ্ছিল অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। প্রায় প্রতি রাতে শুরু হত ব্রেন বিদ্রোহ। গরম জলের ভেপার নিয়ে ফের ঘুমোনোর চেষ্টা করতাম। একদিন ভোর রাতে মনে হল, একজনের গলা শুনলাম। উত্তেজিত। পলিটিকাল স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। কখনও চড়ছে, কখনও নামছে। অদ্ভুত এক সুরে। মহালয়া। সঙ্গে আরও অনেকের শান্ত কণ্ঠ। এর ক’দিন পরে ঘুমের মধ্যে শুনতে পেতাম, কারা যেন সব ভেঁপু বাজিয়ে, বেলুনে বেলুন ঘষতে-ঘষতে চলে যাচ্ছে। পাখাটা হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়ে আবার ঝিঁ ঝিঁ ডেকে চাগিয়ে উঠল তন্দ্রা ভেঙে। ওপরের ফ্লোরে কে যেন সাবধানে কী একটা ঠুকে যাচ্ছে, সাবধানে। অনেকটা সময় পেরিয়ে যেত দপদপ করে। লাভের মধ্যে ভোর আসত পাশবালিশ সেজে। পাশের বাড়ির বিস্কিট দেওয়াল অল্প সময়ের জন্য পেত রোজ ফ্লেভার। আলো ফোটার আগের মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঢাক বেজে উঠেছিল একবার, তাও মনে পড়ল। আবার জল চাপিয়ে দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে কেটলি বলেছিল, ঊষা ঊষা। যত অশান্তি অন্ধকারে। রোদে-জলে কিছু হত না। যা না করলেই নয়, করে যেতাম সারাদিন। রাতের ঘুম যদিও চাঁদোয়ার মতো ভেসে থাকত মাথার ওপরে। ভারী মেঘে ঢাকা শরতের কলকাতায় বসে বুঝতে পারতাম সূর্যঘড়ি কাজ করছে না। একদিন বিকেলে মেঘের স্তরের নীচে নেমে রোদ মখমলিয়ে উঠেছিল পাশের বাড়ির বারান্দায় শুকোতে দেওয়া চাদরে। ঠিক তখনই কড়মড় করে বাজের মতো ফেটে পড়েছিল সৃষ্টিস্থিতি বিনাশানাং। সন্ধে নেমে আসত ঘন নীল বাদুড়ের মতো। ঝুলে পড়ত আমার চারপাশে। ঘাপটি মেরে আমি বসে থাকতাম রাতের ভয়ে। টের পেতাম, প্রহরে-প্রহরে বাইক নিয়ে অসুররা দাপাদাপি করছে রাস্তায়, যে যার দুর্গা নিয়ে। আমার খারাপ ল্যাপটপ বন্ধ থাকলেও তার একমাত্র লাল বাতিটা নিভত না। কি-বোর্ডে কান পাতলে শুনতে পেতাম ভেতরে কে যেন একা-একা কীসব বিড়বিড় করে চলেছে। সেদিনও অপেক্ষা করে ছিলাম। অষ্টমী আর নবমীর সন্ধিক্ষণে ফিরে আসবে একজন। সময়ের সামান্য হেরফের হতে পারে। কিন্তু সে আসবেই। দশ আঙুল দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছিলাম নিজের একমাত্র মাথা। ফেটে পড়তে পারে সেই ভয়ে। সব মনে পড়ে যাচ্ছিল আবার। এরপর আর কিছু নেই। স্ক্রিন ঝিরিঝিরি।
‘আজ অষ্টমী না?’ জিজ্ঞেস করায় নার্স বলল, ‘একবার নবমী ছিল না। অষ্টমীর পরেই দশমী।’ অষ্টমীটা তাহলে গেল কোথায়? এ যেন এক রহস্যময় উপত্যকা, যার প্রথম দিগন্তে এক ধারালো গিরিবর্ত্মের ওপরে চুরি হয়ে যায় কত কী, সবার নজর এড়িয়ে। ওপারের খবর কেউ রাখে না। মহাকাল কিডন্যাপ করে সময়কে, নিজের যাবতীয় ম্যাথেম্যাটিকাল এররজনিত অনন্ত ঘাটতি পুষিয়ে নিতে। ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দুর্গাপুজো হয় এখনও?’ যখন হত বলে আমার ধারণা, তা কি অনেক আগেকার কথা? কতদিন আগে? আমার বয়স কত এখন? নার্স বলল, ‘সব হয়। আরও অনেক কিছু হয়। ভিড় হয় না। যাক গে, ধুনুচি নাচ দেখবে?’ বলেই এক প্যাকেট সিগারেট বের করল অ্যাপ্রনের পকেট থেকে। আর একটা লাইটার। ধরাল ফস করে। অনেকদিন পরে এই আওয়াজ শুনলাম। অনেকটা ধোঁয়া টেনে খুব সাবধানে ছাড়তে লাগল অন্যমনস্ক ভাবে। কিছুক্ষণের জন্য তার মুখটা আবছা হয়ে গেল। দু’হাত দু’দিকে এলানো। সিগারেটটা যেন মিনি ত্রিশূলের ফলা। বাকি শরীরের চালচিত্রে প্রচুর আলো জ্বলছে-নিভছে। নার্স হঠাৎ উঠে গিয়ে আমার শরীর থেকে ইনফরমেশন সাপ্লাই করা সব ক’টা তার খুলে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে স্ক্রিনগুলো বেকুব বনে গেল। ফিরে এসে সিগারেটটা চেপে ধরল আমার মুখে, থার্মোমিটারের মতো। নিকোটিনের চেনা অর্গ্যাজম। উঠে পড়ার চেষ্টা করলাম। আমাকে চেপে ধরে, ফের শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘তাড়া কীসের, হবে। সব হবে।’ সিগারেটটা ফিরিয়ে নিয়ে নিজে খতম করে এক তুড়িতে জানলার বাইরে উড়িয়ে দিল সে। জানলা তাহলে খোলা যায়। এই প্রথম দেখলাম অদ্ভুত একটা টিপ তার কপালের সেন্টারে। ‘সবাই এসে পড়ার আগে যা করার করতে হবে, সময় কম।’
লোহার খাট থেকে এক পা নামালাম। অন্য পা নিয়ে কী করি? সেও নামল। কেমন যেন দেখাচ্ছে আমাকে। ‘তোমার তো কিছু হয়নি। ঠিক পারবে। উঠে পড়ো। সময় নেই।’ অধৈর্য শোনাচ্ছিল ওর কথা। ঘরের দরজা খুলে ধরল। আলো নেই বাইরে। আমি নিশ্চিন্তে এগোলাম অন্ধকারের দিকে। প্যাসেজের শেষে জানলার বাইরে আলোর আভা। পর পর ঘরের বন্ধ দরজা পেরিয়ে দেওয়াল ধরে-ধরে কিছুটা এগোলাম। দেওয়াল ফুরিয়ে গেল। অথচ প্যাসেজ শেষ হয়নি। গ্যাপ পড়েছে। ওই সেই আমার মতো। অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে। সিঁড়ি। উঠতে শুরু করলাম। দিব্যি পারছি। বেশ কয়েকটা ল্যান্ডিং, প্যাসেজ পেরিয়ে একবার থামায় শুনলাম, ‘আর একটু।’ মুখ ঘুরিয়ে দেখি সে আমার নীল চাদরটা সঙ্গে নিয়েই এসেছে। আবার সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম। শরীরে ওজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। এক জায়গায় পা রেখে বুঝলাম আর ওপরে ওঠার দরকার নেই। চিলেকোঠার দরজা দেখা গেছে। খোলা। ছাদের মেঝেতে আকাশ মেঘের কর্কশ ওয়ালপেপার। ওপরে আলোয় ভেজা কালো আকাশ। মাঝখানে পাঁচিলের রেখা। কিনারায় পৌঁছে আন্দাজ পেলাম, ঠিক কতটা ওপরে রয়েছি। হাসপাতাল এত উঁচু হয়? এত বড় জায়গা? এখন কেউ নেই এখানে? ঝুঁকে নীচে দেখলাম। ঝমঝম করে আলো জ্বলছে শহরে। অথচ একেবারে নিস্তব্ধ। মুখ ঘুরিয়ে দেখি নার্স নেই। মেঝেতে আমার চাদরটা পড়ে আছে। তুলে নিয়ে জড়ানোর চেষ্টা করলাম। যেভাবে হ্যাঙার থেকে জামা-কাপড় ঝোলে, তেমন ব্যাপার হল।
পিছনে আবার ফস করে আওয়াজ হয়েছে। ফিরে এসেছে নার্স। একসঙ্গে দুটো সিগারেট ধরিয়েছে। মুখটা দপ করে উঠেছে। আমাকে দিল একটা। কিছু বলল না। দূরে দেখতে লাগলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম জায়গাটা কোথায়। আমি চাইছিলাম ও আমার কাছেপিঠে থাকুক। কিছুটা দূরে পাঁচিলে হেলান দিয়ে ফোনে টাইপ চলছে। ‘ওখানে কী করছ?’ শুনল, তাকাল না। আমাকে একা ছেড়ে দিয়েছে। একটা শখ মিটিয়েছে। পেশেন্ট যদি ইমপেশেন্ট হয়ে ওঠে, তার আর কী কী ইচ্ছে হতে পারে ও কি জানে? শেষ কয়েকদিনে অনেকবার বলেছে, আমার নাকি আর একফোঁটা অসুখ নেই। নেই যখন, তাহলে আর কেন? এই অবধি ভেবে ভয় করল। যদি চলে যেতে বলে, কোথায় যাব? ছাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গেলাম। এদিকে আলো বেশি। অজস্র প্লেন উড়ছে স্লো মোশনে। একটা কিছুক্ষণ দঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়। আমি তার দিকে কাল্পনিক বন্দুক তাক করলাম। তার মানে, আমার রোগ সারেনি পুরোপুরি। ‘এদিকে দেখে যাও’, ডাক পড়ল। পুজোয় অনেক টাওয়ার হয়েছে শহরে। তার ওপর থেকে লেজার লাইট ঘুরছে এলোপাথাড়ি। পরস্পরের সঙ্গে আলোর তরোয়াল খেলা চলছে। তলায় নানা চেহারার আলোর বাগান। একটা জায়গা, লাল হয়ে আছে। ধীরে-ধীরে নীল হয়ে গেল। আরও রং আসছে। তারপর অন্ধকার। আবার লাল দিয়ে শুরু। মাঝখানে একটা কালো চৌখুপি, ওটা প্যান্ডেল। নার্স জানাল, ‘ওরা প্রাইজ পেয়েছে। প্রিভিলেজ পাস জোগাড় করে ঠাকুরের কাছে পৌঁছে চোখের দিকে তাকালে একটা ব্যাপার ঘটছে। দুর্গা স্ক্যান করে জেনুইন ভক্তকে স্পট করছে। বেছে নিচ্ছে একজনকে। নিজে মুখ ঘোরাচ্ছে তার দিকে। তৃতীয় নয়ন থেকে আলো এসে পড়ছে বাছাই লোকটার ওপর। সে যতক্ষণ না দুর্গার পায়ের কাছে পৌঁছতে পারছে, দুর্গা দৃষ্টি ফলো করছে। ওদের থিম হল রেটিনা।’ এই ব্যাপারটা নিয়ে পড়েছিলাম একবার। সেন্সর লকিং ডিভাইস। ফাইটার প্লেনের মিসাইল সামনে শত্রুর জেট ইঞ্জিনের তাপমাত্রাকে সেন্স করে লক করে ফেলে। এর সঙ্গে মিশেছে ফেস রেকগনিশন। এবং আরও কিছু। নিঃশর্ত সমর্পণের মুহূর্তে খুব অল্প সময়ের জন্য অদৃশ্য এক জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয় ভক্তের শরীর। দুর্গা সেই তাপ, উত্তাপ, সন্তাপ টের পায়। নিমীলিত হয় দুর্গাদৃষ্টি। কত কী হচ্ছে দুনিয়ায়। দূর থেকে হলেও, এত কিছু দেখতে পেলাম। নার্সের প্রতি কৃতজ্ঞ লাগছিল। কী একটা কটকটে সাদা ড্রেস পরে থাকে সারাক্ষণ, একটা শাড়ি গিফট করতে পারলে কী যে ভাল হত! আমার নীল চাদরটা দিয়ে দিই?
ভগবানরা আরও অনেক ওপর থেকে সব দেখেন। আমি সেরকম নই। নার্স আমাকে যেমন বলছে, শুনছি। এক সময় বিশ্বাস করতাম না কিছু। এখন করতে ভাল লাগছে। ভগবানদেরও কি কেউ বুঝিয়ে বলে? ‘ওইটা দেখো, ওই যে।’ এক জায়গায় আগুন লেগেছে, ধোঁয়া উঠছে। ওপরে কীসব উড়ছে। একটা গান শুনতে পাচ্ছি। ‘আমার বুকে, লুকোনো এক, নিভু-নিভু আলোর শিখা’। একটু পরে থেমে গেল। দমকল এসে গেছে নিশ্চয়ই। কিছুক্ষণ পরে ফের আগুন শুরু হল। নার্স হেসে বলল, ‘ওদের থিম ভিয়েতনাম। প্রাইজ হয়নি।’ এত আগুন কী করে করল? ‘মায়ার খেলা, আচ্ছা, এদিকে এসো’, বলে, আলতো করে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল আর এক দিকে। এভাবে হাঁটা যায় না। চাদরটা বার বার টানছিলাম। আবার ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আমার কিছু নেই, বা থাকলেও সেসব কোথায়, জানা নেই। সারা শহরের সব আলো নিভে গেল এক মুহূর্তের জন্য। আবার জ্বলে উঠল। নার্স তার ফোনে কীসব দেখে জানাল, এইমাত্র দশমী পড়েছে। ওর নাম কী? এতদিন জানা হয়নি। ‘ওই দেখো, ওই দেখো’ বলে সে আবার নতুন কিছু একটা দেখাল। ঝিকিমিকি শহরের আলোয় মোড়া কার্পেটের মধ্যে এক জায়গায় যেন অনেকটা ফুটো হয়ে গেছে, অন্ধকার দেখাচ্ছে। কোথাও আলোর দাপট বেশি, যেখানে মন্ডপ আছে। মনে হল প্যান্ডেলগুলো নড়তে শুরু করেছে। সরে যাচ্ছে একটু-একটু করে। স্রোতের মতো চেহারা নিচ্ছে। এর সঙ্গে ও মিশে যাচ্ছে। এগোচ্ছে রাস্তা ধরে। বাড়ি-ঘর রাস্তার আলো নিজের জায়গায় মিটমিট করছে আগের মতোই। পুজোর আলোর মণ্ডগুলো গড়িয়ে আসছে। আগের জায়গাকে অন্ধকারে রেখে। সারা শহরে অজস্র চলন্ত আগ্নেয়গিরি। শেষ লাভাটুকু উগরে দিয়ে নিজেরা নিভে যাচ্ছে একে-একে। পুজোর আলো গলে, মিশে স্রোতের মতো এগোচ্ছে সেই মাঝের অন্ধকার পকেটের দিকে। আমি কি ভাসানের শোভাযাত্রা দেখছি? নদীতে ভাসান বন্ধ হয়ে যাবে শুনেছিলাম। মনের কথা বুঝে নার্স বলল, ‘ঠাকুরসুদ্ধ প্যান্ডেল ভাসানো হয় এখন, জানো না বোধ হয়। সেন্ট্রাল ডাইজেস্টর সব টেনে নেয়। তলায় ক্রাশার আছে, একেবারে ধুলো করে ফেলে। এই ডাস্টের অনেক দাম। আচ্ছা, আর কিন্তু দশ মিনিট।’
দশ মিনিট পরে কী হবে তা জানি। বললাম, ‘হল তো অনেক, আর না, এবারে নামা যাক।’ পা রাখলাম সিঁড়িতে। ও আমার পিছনে। বলছে না কিছু। কোন তলায় এসে থামতে হবে জানি না। আসার সময় হিসেব রাখিনি। প্রত্যেক ল্যান্ডিংয়ে একটু যেন বেশি আলো। মাঝখানে সিঁড়ির ধাপে-ধাপে হিসেব করা অন্ধকার। দাঁড়ালাম এক জায়গায়। একটু দূরে খোলা দরজা দিয়ে আলো পড়েছে প্যাসেজের মেঝেতে। আমার মধ্য জন্মের ঘর। ওখানে আর যাব না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলে আমার একমাত্র সঙ্গিনী বাধা দেবে কি? আমার জন্যই তো সে ছিল, এখন? অন্য পেশেন্টের জন্য অপেক্ষা করবে? এই যে আমাকে ছাদে নিয়ে গেল, পুজো দেখাল, এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আমার মনে পড়া অনেক চাওয়া, দাবি-দাওয়া ফুরিয়ে গেছে। বুঝে গেছি যে, আমি কোনও জায়গায় নেই। আছি একটা সময়ের মধ্যে। গোল নয়, একটা সোজা দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা আমি। ত্রিশূলের মতো এগোচ্ছি সময়ের টানেল ধরে। থামছি। আবার জাস্ট যাচ্ছি। এই তীর্থযাত্রায় আমার কোনও হাত নেই। সময় পিছোতে পারে না। আমিও আর পিছিয়ে যাব না। নিশ্চিন্ত অতীত যতই টানাটানি করুক। আমার ফ্লোর থেকে নামার সিঁড়িতে প্রথম পা দিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকালাম। ভাবলাম বলি, ‘নামবে না কি?’ এগিয়ে এসে সে আমার চাদর, সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার দিয়ে বলল, ‘দেবার মতো আমার আর কিছু নেই, আপনি যেতে পারেন।’ বলে, আস্তে-আস্তে হাঁটতে শুরু করল প্যাসেজ শেষের খোলা জানলার দিকে। তার বাইরে এখনও পুজোর আলোর আভা।
যেন একটা কুয়োতে নামছি। একা-একা। এই প্রথম। অনেকটা নামার পর মনে হল, দেখা উচিত আর কত বাকি। একটা প্যাসেজের শেষ জানলা দিয়ে মুখ বের করে ওপরে দেখলাম, তারপর নীচে। শহর অনেক কাছে চলে এসেছে। আবার কী যেন একটা গানের সুর ভেসে আসছে। লোকজনের হল্লা, গাড়ির হর্ন, ঢাক জোরালো হয়ে উঠছে। নামা শেষ হল। একটা মস্ত হলঘর। একপাশে শূন্য রিসেপশন। বাইরে বেরোনোর খোলা দরজা দেখতে পাচ্ছি। তার আগে আর একটা দরজা। লোহার কোলাপ্সিবল গেট, বন্ধ, তালা দেওয়া। খাঁচাটা ধরলাম। ডাকাডাকি করে লাভ নেই। আমি আটকে গেছি লাস্ট ল্যাপে। ঘুরে, ফের এগোলাম সিঁড়ির দিকে। মনিটরগুলো দেখা দরকার। নার্সটা জানত না এসব? না কি জানত যে আমাকে ফিরতেই হবে! এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে এভাবে মারবে বলে? এক হাসপাতাল অসুখ নিয়ে আমি রোগ ছাড়া কতযুগ ধরে একটা জায়গায় নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিলাম। রোগী, নার্স, বেড, অক্সিজেনভরা ভূতের বাড়িটা হাসপাতাল সেজে রইল। কেউ আপত্তি জানাল না। মাঝে মাঝে কোমার নাম করে ব্ল্যাকআউট। সেটাও নির্ঘাত সাজানো ঘটনা।
উঠতে-উঠতে টের পেলাম, দমে টান পড়ছে। শরীরে ওজন ফিরে এসেছে। চারপাশের শব্দ কমতে শুরু করেছে। বাইরে দেখার আর কিছু নেই। যেখানে পৌঁছে একটা দরজা নিয়ে আসা এক চিলতে আলো দেখতে পাব, সেখানে চড়াই শেষ। ল্যান্ডিংয়ের পর ল্যান্ডিং পেরোতে লাগলাম, গতি কমে আসছিল।
‘বলে আয়রে ছুটে, আয়রে
ত্বরা
হেথা নাইকো মৃত্যু,
নাইকো জরা’
গানের টুকরো-টুকরো লাইনগুলো তলিয়ে যাচ্ছিল নীচে। শীত-শীত করছে। হেমন্ত স্কিপ করে গেলাম মনে হয়। কিছু সুরমাখা শব্দের নকশা করা একটা কাঁথা, কে যেন বার বার টেনে দিচ্ছিল গায়ে। সস্নেহে মুড়ে দিতে চাইছিল আমাকে।
‘হেথা চির-শ্যামল
বসুন্ধরা
চির-জ্যোৎস্না নীল
আকাশে’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র