গোদার সম্পর্কে দুটো কথা
অন্য বড় পরিচালকের ছবি দেখলে মনে হয়, ওরেব্বাবা, আমি জীবনে কক্ষনও এই জিনিস করতে পারব না। আর গোদারের ছবি দেখলে বুকটা ধড়াসধড়াস করে, মনে হয়, আরে, তাহলে তো আমিও ছবি করতে পারি! যেমন তেন্ডুলকরের খেলা দেখে মনে হয় পিচে কিচ্ছু গ্যাঁড়াকল নেই, সুইং-স্পিনে কারুকাজ নেই, ইচ্ছে করলেই বলটাকে যেখানে খুশি পাঠানো যায়, গোদার দেখলে মনে হয় আরিব্বাস যে-কোনও চিন্তার সঙ্গে যে-কোনও চিন্তা জুড়ে দিলেই তো একটা সিনেমা হয়ে যায়! এই অনন্ত স্বাধীনতা আর যাখুশি-পনার মিশেলকে সিনেমার মেজাজের মূল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই গোদারের প্রধান অবদান। তারপর সেই প্রভাবে ছবি করতে গিয়ে অবশ্য প্রতিভাহীনেরা দ্যাখে, এই খেয়েছে, কিছুতেই মস্তিষ্কের এলোপাথাড়ি চিন্তাতরঙ্গকে সিনেমায় রূপ দেওয়া যাচ্ছে না, শুধু গোদারের বেলাতেই কেমন করে যেন অসংলগ্ন টুকরোরা মোক্ষম খাপে-খাপ জুড়ে যায় ও সিম্ফনি তৈরি করে— কিন্তু সে তো জিনিয়াসের ব্যাকরণে খাবলা-মারুয়া যে-কোনও পাতি-মানুষেরই ভবিতব্য। আসল কথা হল, যে সিনেমা জিনিসটাকে প্রয়াসীরা ভয় পায় আর ভাবে বাপ রে, সহস্র টেকনিক ও প্রথা-প্যাঁচ জানলে তবেই বোধহয় এতে হাত দেওয়া যায়, গোদার দেখলে তারা ভাবে, কই অত ঘাবড়াবার তো কিছু নেই! এই যে বেদি থেকে একটা মহিমা-গ্রাম্ভারি মূর্তিকে টেনে নামিয়ে তাকে আটপৌরে কাপড়চোপড় পরিয়ে চারপাশের ভিড়ে ঘামে ধুলোয় নিয়নে হাঁটিয়ে দেওয়া, প্রণামের জোড়কর-আড়ষ্টতা ছাড়িয়ে হাতটাকে সিনেমার কাঁধে দিব্যি রেখে চলতে-চলতে ইয়ার্কি মারা, এই হল গোদারের প্রধান বিপ্লব। তাঁর ছবি দেখে একজন দর্শকের মনে হবে, অ্যাঁ, একটা লোক ঘরে ঢুকছে না দেখিয়েও তাকে সরাসরি বসে থাকা অবস্থায় দেখানো যায়? একটা চরিত্র যখন কথা বলছে তখন তার মুখ না দেখিয়ে মাথার পেছনটা দেখানো যায়? হঠাৎ একটা চরিত্র একটা বই থেকে জোরে-জোরে একটা অনুচ্ছেদ পড়তে শুরু করতে পারে? আচমকা একটা নতুন চরিত্রের ইন্টারভিউ শুরু করে দেওয়া যায়? দৃশ্যের মাঝখানে পর্দায় কিছু লেখা ফুটিয়ে যা খুশি কমেন্ট করা যায়? ক্যামেরায় ঝাঁকুনি হচ্ছে, এমন দৃশ্যও অনায়াসে রেখে দেওয়া যায়? কৃত্রিম আলো ব্যবহার না করে যেটুকু আলো জানলা দিয়ে আসছে তাতেও শুটিং করে নেওয়া যায়? চরিত্রগুলো একেবারে ঘটমান সমাজ সম্পর্কে অকপটে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে? রাস্তায় একটা আকর্ষণীয় দেওয়াল-লিখন, বা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং, বা সিনেমার পোস্টার, কিংবা কোনও একটা প্রিয় পেন্টিং বা ফোটোগ্রাফ যখন-তখন দেখানো যায়? ফ্যাটফ্যাটে সাদা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়েও সিনে-চরিত্রেরা কথা বলতে পারে? যদি অনেকগুলো গুলি করা হয়, তাহলে এক-একটা গুলির আওয়াজের পর দৃশ্যের মধ্যে থেকে কিছুটা করে ছেঁটে ফেলা যায়? চরিত্রেরা এক্ষুনি স্লোগান দিল (ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে) ‘ইউএস গো হোম!’ তারপরেই পর্দা জুড়ে লেখা হল ‘দার্শনিক ও চলচ্চিত্রকারেরা একটি প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির শরিক’ আর পিছনে গুলির শব্দ, তারপরেই নারী-চরিত্রের ভয়েস-ওভার শুরু করা যায় ‘…আমার একটা নীল কোট আছে, এলিজাবেথেরটার ধারটা সাদা… পল আমাকে দ্বিতীয়বার চুমু খেয়েছে…’? সিনেমা কি তবে একটা ইচ্ছে-মাতন ডাইরি? একটা প্রিয় আড্ডা, যেখানে মতামত টুকরো-গল্প তর্ক বোনা যায়, কোনও ভূমিকা-উপসংহারের ধার না ধেরেই? ন্যারেটিভকে, ক্যামেরাকে, সম্পাদনাকে, তাহলে অত ভক্তি করার কিছু নেই? এরা স্রেফ বাহন, কোনওমতেই ঘাড়ে-চেপে-থাকা প্রভু নয়? সিনেমা একটা ফুরফুরে বেতোয়াক্কা সিরিয়াস পিকনিক? গোদার বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার শিল্প তোমার যাইচ্ছে-গিরির ময়দান। যন্ত্রকে ভয় কোরো না, রীতিকেও নয়, শুধু নিজের নীতিটা প্রকাশিত হচ্ছে কি না দ্যাখো। গোদার প্রখরভাবে নৈতিক ও রাজনৈতিক, কিন্তু তাঁর প্রাথমিক দান এই সবতোড় স্বাধীনতা। সব শিল্পেরই বহু ঈশ্বর আছেন যাঁরা দিগন্তকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে খোলা প্রান্তর আবিষ্কার করেন, সিনেমা-শিল্পেও কিছু মানুষ চিত্রভাষা এক্কেবারে নিজের ছাঁদে তৈরি করেছেন, তাঁদের মধ্যে গোদার সবচেয়ে সংক্রামক। গোদারের নিন্দুকেরা বলেন, তিনি এক দুষ্টু শিশুর মতো, নিষেধাজ্ঞা শুনলেই তক্ষুনি সেইটাই তাঁর করা চাই, যে-উপহারটাই হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা-ই আগে ভেঙে দেখা চাই। একদম ঠিক। গোদার সিনেমার স্বতঃসিদ্ধগুলোকে অবধি উল্টে ফেলেছেন, দুমড়েছেন, কাহিনিতে ডকুমেন্টারির মেজাজ ঢুকিয়েছেন আর তথ্যে মিশিয়েছেন কল্পনার ধাত, ছবিকে আঁট ও ঠাস হতে হবে এই ধারণাটাকে অবধি জানলা দিয়ে ছুড়ে তিনি এনেছেন বেখাপ্পা অসংলগ্ন বহু দৃশ্যকে পর পর জুড়ে দেওয়ার কোলাজ-ধর্ম, তাঁর বহু চরিত্রের কাজের ব্যাখ্যা অবধি তিনি দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেননি। ঠিক, এসব দেখে লোকের বখে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব, ‘তাহলে তো আলটপকা এতোলবেতোল হাঁকড়ালেই ছবি হয়, গোদারেরটা ভাল বলছ আর আমারটাকে প্রলাপ বলছ কেন?’ তড়পানো বেনোজল হুড়হুড়িয়ে ঢোকার সম্ভাবনা প্রভূত, তা হয়েওছে বিশ্বজুড়ে এক সময়, কিন্তু যে ভীরু প্রতিভাবানের ভেতরে শক্তি নিশপিশ করছিল স্বাতন্ত্র্য সুড়সুড় করছিল, কিন্তু অনিশ্চিতে ঝাঁপ দেওয়ার মুরোদটা কিছুতে আয়ত্ত করতে পারছিল না, গোদারের এই ‘সব চলবে! Anything goes!’ রেলাবান চাল ও লীলা তার কাছে এক আজন্ম আশীর্বাদ, টনটনে টনিক, প্রকাণ্ড প্রশ্রয় ও প্রেরণা। তাঁর মতো ছবি অনেকেই করে উঠতে পারবে না, কিন্তু তারা যাতে অন্তত পূর্ণ নিজের মতো ছবি করতে পারে, সেই সাহসের বীজটা গোদার প্রতি ছবিতে জোগান দেন। স্পর্ধার আমলকি করতলে দিয়ে, গোদার বলেন, কাউকে মেনো না, আমাকেও না।
আর যাঁরা সিনেমায় ঢুকে আছেন, শিল্পে শ্বাস নেন, তাঁদের কাছে গোদার চির-আপসহীনতার ধকধকে ধ্রুবতারা। গোদার সব অলস মেনে-নেওয়ার বিরুদ্ধে। ‘ছবির ভাষা যখন এমনটাই চলে আসছে তখন এরকমই নিয্যস উচিত-কম্ম’ বলে ঘুমিয়ে পড়ার বিরুদ্ধে। ‘সরকার এরকমই তো শাসাবে’ বলে ঢুলে পড়ার বিরুদ্ধে। ‘ক্ষমতাবানেরা তো যুদ্ধ জিতবেই ভাই’ বলে নিস্পৃহ মাইনে-গোনার বিরুদ্ধে। ‘হলিউড যখন দুর্ধর্ষ ব্যবসা করছে তখন ওরাই তো রাজা’ বলে হাল ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। ‘ছবি করতে খুব টাকা লাগে তাই বেনিয়ারাই ঠিক করে দেবে ছবির শর্ত’— এ-ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার তো বিরুদ্ধে বটেই। এবং সর্বোপরি, গোদার সহজতার বিরুদ্ধে। ‘ওগো আমি খুব সহজ সরল তরল গো, মোটে ইন্টেলেকচুয়াল নয় গো, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি মাইডিয়ার লোক, সপরিবার এসে আমার ছবি দেখে হিট করাও গো’ আর্তনাদের বিরুদ্ধে, শিল্পীর দাসবৃত্তির বিরুদ্ধে। গোদার অসম্ভব দ্রুত ছবি করতেন, চিত্রনাট্য না লিখে ছবি করতেন, দিনের-দিন দৃশ্য ও সংলাপ ভেবে ফেলতেন, তাই সমস্যা টাটকা থাকতে থাকতেই তাঁর ছবিতে প্রতিফলিত হত, ছবিতে শুরু-মধ্য-শেষ থাকবে ‘তবে সবসময় ওই ক্রমে নয়’ বলার মতো শাণিত সপ্রতিভতা ও ওজস্বী ঔদ্ধত্য বিশ্বে একটা লোকেরই ছিল, তিনি সবার আগে আগামী দিনের প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করতেন ব্যবহার করতেন সম্ভাবনাগুলোকে খুঁড়ে বার করতেন, তাঁর সতত-বদলক্ষম শৈলী তাই তাঁকে চিরকালীন বর্তমান করে রেখেছে, অবিশ্বাস্য পড়াশোনা-জানা ও সিনেমা-জানা মানুষ বলে তাঁর নখদর্পণে ছিল দুরন্ত দর্শন আর উদ্ধৃতি, সিনেমার গাদা-গাদা চলতি সংজ্ঞাকে তিনি একার হাতে ছুড়ে ফেলেছেন এমন রাজকীয় ভঙ্গিতে যে তাঁর উদ্ভাবিত চিত্রভাষা মূলস্রোতের ছবিতেও এখন চালু, তিনি পরিচালকের স্ববিরোধিতাকে এমনকী অজ্ঞতাকে ‘আমি জানি না’ কথাটাকে ছবির বুনটে এনেছেন বিক্রান্ত বুকের পাটায়— সব অর্থে তিনি অনন্য, অবিশ্বাস্য, অতুলনীয়, তাঁর সহজাত কবচ-কুণ্ডলে অপরাজেয়। কিন্তু তার চেয়েও তিনি বড় তাঁর নাছোড় স্বধর্ম-পরায়ণতায়। গোদারকে যেই পুজো করা শুরু হয়েছে তখনই গোদার নিজের চলতি স্টাইল ভেঙে আরও দুরূহ আরও কট্টর স্টাইলে ডুব দিলেন এবং সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ছবি করতে শুরু করলেন। অর্থাৎ উনি নিজের পূজিত হওয়ারও বিরুদ্ধে, দেবতা বনার বিরুদ্ধে। বিশ্বে খুব কম শিল্পীই জন্মেছেন যিনি উত্তুঙ্গ জনসমাদর পেয়ে মনে করেছেন, হুম, সাফল্য-প্যাটার্ন তো অনেক হল, এবার অন্য কক্ষে ঘুরপাক দিই, নতুন অভিযান, যাতে হুজুগে-প্রশস্তিদারগুলো সটকে পড়বে। গোদার সেই কঠোর পথেও পাঁজর জ্বালিয়ে হেঁটেছেন, তাঁর অতি-বড় ভক্তরাও তাঁকে ১৯৬৭-র ‘উইকএন্ড’ অবধি জ্যান্ত মনে করে, ভাবে, তারপর তিনি কেমন বোরিং ও অহেতুক হেঁয়ালিবাগীশ হয়ে গেলেন। গুটিকয় সমালোচক ভাবে, ওই ছবিগুলোয় গোদার বরং আরও রাজনৈতিক, উদ্ভাবনকারী, নিরীক্ষাময়, মৌলিক। বাকিরা তাঁর পরবর্তী ছবিগুলোকে মৃদু প্রশ্রয় দেয় ও হল-এ বসে হাই তোলে এবং কেউ প্রকাশ্যেই বলে যে, এই পর্যায়গুলোর ছবিতে গোদার অতি-বোধ অতি-বুদ্ধি ও অতি-আমিত্বের গহনে অ্যাক্কেরে হারিয়ে গেছেন। গোদার সবই জানতেন, কিন্তু ভুলে পূর্বাশ্রমে ফেরেননি। অন্যরকম ভাবে জীবনটাকেই চেলে নিয়েছেন, থাকতে শুরু করেছেন সুইৎজারল্যান্ডে, নিজের বাড়িতে এমন সেট-আপ তৈরি করে নিয়েছেন যাতে সেখানেই ছবির পোস্ট-প্রোডাকশন করে ফেলা যায়। এতদূর তাঁর স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষা, আপসহীনতা। প্রথম পর্যায়ের ছবি করার সময়েও তিনি এক-একটা ছবিতে এত শিল্পের রেফারেন্স দিয়েছেন যা বুঝতে ঘাগু রসিকেরও বচ্ছর ঘুরে যাবে। ছবিতে গুচ্ছের চরিত্র এত শিক্ষিত কথাবার্তা বলবে, এত বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকবে, যৌনতার সময়েও কবিতার পংক্তি আবৃত্তি করে উঠবে, এতে দর্শকের তাকধাঁধা লেগে যেত, এবং সাধারণ মানুষ গোদার সম্পর্কে আরও অস্বস্তি ও আড়ষ্টতা লালন করতেন। তাঁর ছবিতে হুড়মুড় করে খবরকাগজের হেডিং, শহরের রাস্তা, চলতি ব্যবসা, রসিকতা, উদ্ধৃতি, বিশ্লেষণ, তুখড় ওয়ান-লাইনার, ফিলসফি ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসতর্ক দর্শকের দম বন্ধ করে দিত। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়গুলোয় তিনি আরও ফটাস তুড়ি মেরে আড়াল-সম্রাট। আরও নিগূঢ়, আরও পুনর্পাঠ-দাবিদার। কোনওভাবেই, কোনও মেনস্ট্রিমেই তিনি থাকবেন না— এ-ই তাঁর পণ। আজকে প্রযুক্তি আমাদের হাতে এনে দিয়েছে এক বিকেলে এক ছবি করে ফেলার সুযোগ। এখন গোদারীয় নির্ভীকতার হরির লুট লেগে যাওয়ার কথা। অথচ এখনই চারিদিকে সবচেয়ে ভয়, সবচেয়ে নিরাপদ ক্রীড়া, ভালয়-ভালয় টোকাটুকলি গল্প বলে বাড়ি ফিরে ইএমআই দেওয়ার চল, ‘টাকার চাকর শিল্পী প্রথার নফর শিল্পী’ সিরিজের বহমানতা। গোদারের যে-কোনও পর্যায় থেকেই আমরা তাঁর জ্বলন্ত ধক আর বুক-চিতিয়ে শিক্ষিত হওয়ার ঠাট শিখে নিতে পারি। তাঁর মারা যাওয়ার পর তিনি কয়েক সপ্তাহ আলোচিত হচ্ছেন। তার মধ্যে এই উদ্দীপনাময় বন্ধুর পরিধিতে বসে, ফুসফুসগুলো একটু মাভৈ-মথিত করে নিলে মন্দ হয় না।