কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সংশয়ের অবকাশ
আজ থেকে প্রায় চব্বিশশো বছর আগে ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এথেন্সের (মতান্তরে গোটা গ্রিসের মধ্যে) সবথেকে বুদ্ধিমান মানুষটি কে? পিথিয়া নামের সেই মহিলা পুরোহিত জানান, মানুষটির নাম সক্রেটেস, গ্রিসের সর্বখ্যাত (এবং আঁফা তেরিবল) দার্শনিক। প্লেটোর বই ‘অ্যাপোলজি অফ সক্রেটেস’ থেকে জানা যায়, সক্রেটেস পিথিয়ার সিদ্ধান্ত শুনে বলেন, ‘’আমি শুধু এটুকুই জানি যে, আমি কিছুই জানি না।’ মনে হতে পারে সক্রেটেস তাঁর অতুলনীয় প্রজ্ঞা নিয়ে অনর্থক বিনয় করছেন। আদতে তা নয়। সক্রেটেস বলতে চেয়েছিলেন, যথার্থ জ্ঞান বা দর্শনের গোড়ার রয়েছে সংশয়। প্রচলিত ধারণা, এমনকী ঐতিহ্যকেও প্রশ্ন করে চলা যে-কারণে অতীব জরুরি, সংশয়ের আমূল নিরসন না হওয়া পর্যন্ত সত্যান্বেষণে ঘাটতি থাকবেই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence, সংক্ষেপে AI) নিয়ে চর্চা করার আগে এই সামান্য ভনিতাটুকু দরকার ছিল; কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক গবেষণা, বিনিয়োগ এবং ফলিত ব্যবহারের বিশ্বজোড়া বিস্তার দেখলে মনে হতে পারে মানবকল্যাণে এই প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ বাজারের চোখে নিজেকে অনর্থক এক লুডাইট (Luddite) হিসাবে প্রতিপন্ন করা। লুডাইট, অর্থাৎ উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডের যে-মানুষগুলি তুলোর কারখানায় মেশিন নিয়ে আসার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। যে-ইতিহাসের সূত্র ধরে আজ যে-কোনও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুললেই বহু বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তিউদ্যমীরা রে রে করে ছুটে আসেন। সক্রেটীয় কথোপকথন চালালে অবশ্য টের পাওয়া যায় যে, লুডাইটদের বিক্ষোভ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের H1B ভিসা রদের সিদ্ধান্ত প্রায় একই অর্থনৈতিক কার্যকারণ সম্পর্কের ফল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রসঙ্গেও এরকমই এক সক্রেটীয় কথোপকথনের আশায় কিছু প্রশ্ন তোলা নিতান্তই জরুরি। বিষয়ভিত্তিক নির্দিষ্ট আলোচনার খাতিরে অবশ্য আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বিশেষ ব্যবহারিক আঙ্গিককেই কাটাছেঁড়া করব— ব্যক্তিগতকরণ বা Personalization।
অর্থনীতির ইতিহাস দেখায়, প্রতিটি মানুষের নির্দিষ্ট চাহিদাকে বোঝার ইচ্ছা বাজারের বহুদিনের। সেই সতেরোশো শতকে হল্যান্ডে যখন টিউলিপ-ম্যানিয়া চলছে, টিউলিপ বিক্রেতারা প্রতি খরিদ্দারের নির্দিষ্ট ক্রয়ক্ষমতা বোঝার জন্য চালু করেছিলেন ডাচ অকশন, যেখানে অত্যন্ত চড়া দামে শুরু করে ধাপে-ধাপে কমানো হত ফুলের দাম এবং উপস্থিত ক্রেতারা নিজেদের সামর্থ্যমতন ভিন্ন-ভিন্ন দর দিতেন। তবে এহেন উদাহরণ হাতে গোনা। একুশ শতকের আগে অবধি প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার মতন উন্নত প্রযুক্তি বাজারের কাছে ছিল না। এবং শুধু ক্রয়ক্ষমতার কথাই বা বলি কেন? বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে পণ্য পরিকল্পনা (Product design) সব কিছুই ব্যক্তিনির্দিষ্ট হতে পারে। এবং বহু বছর ধরে বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়ে আসছে মানুষ ব্যক্তিনির্দিষ্ট পণ্য, মূল্য বা বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট উৎসুক। ইন্টারনেট ঘরে-ঘরে এসে যাওয়ার পর ব্যক্তিগতকরণের প্রথম ধাপটিতে আমরা পা রাখি। শুরুটা হয়েছিল নিতান্ত অনুরোধ দিয়ে— আপনি যখন আমাদের ওয়েবসাইটে এসেই গেছেন আপনার সম্বন্ধে কিছু কি তথ্য আমরা পেতে পারি? আপনার দেওয়া লিঙ্গ-বয়স-জাতি জাতীয় কিছু জনতাত্ত্বিক (Demographic) তথ্য বা পছন্দের ব্র্যান্ড— পণ্য ইত্যাদি জাতীয় কিছু আচরণভিত্তিক (Behavioural) তথ্যের সূত্র ধরে আমরা তৈরি করব কিছু মার্কেটিং ক্যাম্পেইন, শুধু আপনারই জন্য। ফলে নিয়ন আলোয় নয়, ল্যাপটপের LED লাইটে পণ্য হল যা কিছু ব্যক্তিগত। অবশ্য মনে রাখা দরকার এ-পণ্যায়নের শুরু আমার-আপনার সম্মতি নিয়েই। দু’হাজারের গোড়ায় গুগল এবং অন্যান্য সার্চ এঞ্জিনের জয়যাত্রা শুরু হলে এই ব্যক্তিনির্দিষ্ট প্রচার-অভিযান অন্য এক মাত্রা পায়। আমাদের প্রতিটি সার্চের ওপর নির্ভর করে তৈরি হতে থাকে নির্দিষ্ট মার্কেটিং ক্যাম্পেইন। এবং শুধু তো সার্চ এঞ্জিন নয়, ২০০৪ সালে এসে গেছে জিমেল, ২০০৮ সালে পাওয়া গেছে গুগলেরই ক্রোম ব্রাউজার। ইন্টারনেটে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ইতিহাস থেকে যাচ্ছিল বৈদ্যুতিন জগতের বিট আর বাইটে। আর সেই প্রতিটি পদচিহ্নের সূত্র ধরে ব্যক্তিনির্দিষ্ট প্রচারাভিযানে ভরে উঠছিল আমাদের ইমেল-ইনবক্স, প্রতিবার ব্রাউজার খুললেও চতুর্দিক থেকে ছেয়ে আসছিল বিজ্ঞাপনী বার্তা। আপনি রক মিউজিকের ভক্ত বলে ফ্রেডি মার্কারির গানের অ্যালবামের বিজ্ঞাপন আসছে আপনার স্ক্রিনে। আমি হয়তো ভালবাসি সরোদ শুনতে, অতএব আমার স্ক্রিনে ধরা পড়ছে আলি আকবর খানের গানের স্কুলের বিজ্ঞাপন।
এ-অভিজ্ঞতা আমাদের সবার। ভেতরের প্রযুক্তিগত কৌশল সম্পর্কে আপনি ওয়াকিবহাল নাও হতে পারেন, কিন্তু এই অভিজ্ঞতাটুকু নিশ্চিতভাবেই ভোলেননি। এবং এও ভোলেননি যে, প্রায় প্রথম থেকেই এই অভিজ্ঞতা আপনাকে অস্বস্তিতে রেখেছিল, আপনার বারেবারেই মনে হয়েছিল আপনার ব্যক্তিগত পরিসরে এই বিপণনী প্রচার বড় বেশি আক্রমণাত্মক রূপ নিচ্ছে। যারা প্রচার করছিলেন তারাও কিন্তু এই সীমালঙ্ঘন বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁরা জানতেন এই দৌরাত্ম্য বেশিদিন চলবে না। খুব শীঘ্রই এমন এক সময় আসবে যখন উপভোক্তাদের ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান তাঁদের দিতেই হবে। গুগল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০২৩ সাল থেকে ক্রোম ব্রাউজারের মাধ্যমে কোনও ওয়েবসাইট উপভোক্তাদের ব্রাউজিং ইনফরমেশন জমিয়ে রাখতে পারবে না। প্রায় তিন বছর আগে একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অ্যাপল তাদের সাফারি ব্রাউজারের প্রেক্ষিতে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থার ভূয়োদর্শী কর্ণধাররা বহু আগেই এই অশনি সংকেতটি দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু আগামী দিনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সহায়ক প্রযুক্তি তাঁদের কাছে ছিল না। এই প্রতিবন্ধকতা কাটতে শুরু করল গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌলতে ব্যক্তিগতকরণের কৌশলটিই আমূল বদলে গেল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক কীভাবে বাজারকে সহায়তা করল, সে-প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক কেন শুধু ডেমোগ্রাফিক বা মামুলি বিহেভিয়রাল তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তিনির্দিষ্ট প্রচারকৌশলে বাজার অনীহা দেখাচ্ছিল। দুজন বাঙালির কথা ভাবুন— পদবির হিসাবে দুজনেই ব্রাহ্মণ, প্রত্যেকের পছন্দের গান বলতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, দুজনেই সাদা রং পছন্দ করেন, এবং অবসর সময়ে প্রত্যেকেই লেখালেখি করেন। শুধু এই তথ্যের ভিত্তিতে কোনও সংস্থা যদি একই বিজ্ঞাপন বা একই পণ্য যথাক্রমে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠান, তাহলে সেই সংস্থার হারাকিরি করার সমূহ সম্ভাবনা। এবং এহেন ভুল কৌশল অদূরদর্শী ব্যবসায়ীরা প্রায়ই করেন, সে-অভিজ্ঞতাও আমার-আপনার আছে বইকি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাই ডেমোগ্রাফিক তথ্য বাদ দিয়ে পুরোপুরিই মনোনিবেশ করল আমার-আপনার আচরণগত তথ্যের ওপর। সকালবেলা কোন গান শুনছি, রাত্রে কোন ওয়েবসিরিজ দেখছি, অফিসে যাওয়ার তাড়ার মধ্যে কোন ধরনের ধূমায়িত কফি ভরে নিচ্ছি কাপে বা ছুটিছাটা পেলে কোন ধরনের পর্যটনকেন্দ্রের সুলুকসন্ধান জানার চেষ্টা করছি— এহেন অগুনতি ডেটাপয়েন্টে ভরে যেতে শুরু করল AI system-গুলি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সৃষ্টিশীল হওয়ার জন্য দরকার অগুনতি তথ্য, একজন মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সেই শর্ত পূরণ করে না। অতএব, সমমনস্ক, সমআচরণকারী মানুষদের সমস্ত তথ্য জড়ো করে বানিয়ে নেওয়া হল এক অনুরূপী ব্যক্তিত্ব— যে আছেও বটে, নেইও বটে। আছে কারণ সেই রিপ্রেজেন্টেন্টিভ প্রোফাইলটি তৈরি হয়েছে আমার আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে, কিন্তু নির্দিষ্টভাবে সেই ব্যক্তিত্বটির কোনও অস্তিত্ব নেই।
মনে রাখা দরকার, এর কোনও কিছুই তত্ত্বকথাও নয়, গল্পকথাও নয়। খাঁটি বাস্তব। আজ নেটফ্লিক্সে লগ ইন করে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ সংক্রান্ত যা যা সুপারিশ দেখতে পাচ্ছেন বা স্টারবাকস আপনার হাতে যে-কফির কাপটি তুলে দিচ্ছে বা মেক মাই ট্রিপ আপনাকে যে যে হোটেলে থাকার জন্য বিশেষ ছাড় দিচ্ছে— সে সবই এসেছে AI-এর হাত ধরে। বিজ্ঞাপন, মূল্য, পণ্য পরিকল্পনা, পরিষেবা— সবই শুধু আপনার কথা মাথায় রেখে।
প্রায় অতিলৌকিক প্রযুক্তির এই জয়যাত্রা যে নিশ্চিত, এমনটাই ভাবা গেছিল। বাস্তবে কিন্তু এমন কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও আন্দাজ করতে পারেনি। আধুনিক অর্থনীতি যেদিন থেকে Homo economicus নামক যুক্তিযুক্ত কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক সত্তাটিকে স্বীকার করে নিয়েছে, প্রায় সেই দিন থেকেই ধরে নিয়েছে ‘Consumers prefer variety’। যে-কথাটা অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে চট করে দেখা যায় না, তা হল এই বৈচিত্র্যের সন্ধান কিন্তু বহুলাংশে আসে আমাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, বিশেষজ্ঞ এমনকী পেশাদার সমালোচকদের থেকেও। এক কথায়, বৈচিত্র্যের ফলটি ব্যক্তি খেলেও বৈচিত্র্যের খোঁজ একটি সমষ্টিগত প্রক্রিয়া। এও মনে রাখা দরকার সমষ্টিগত প্রক্রিয়াটিতে কিছু আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে আমরা যাই দেখি তাই তুলে নিই না, না হলে বৈচিত্র্যের ভারে আমাদের চাপা পড়ে মরতে হত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই বৌদ্ধিক সুবিধাটুকু কেড়ে নিচ্ছে। শুধু যে কেড়ে নিচ্ছে তাই নয়, উলটে একটি বুদ্বুদের মধ্যে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে যেখানে যাবতীয় আইডিয়া, যাবতীয় পছন্দ-অপছন্দ বড়ই একমাত্রিক। অতীত যা দিয়েছে শুধু তার ভিত্তিতেই কি আমাদের ভবিষ্যৎ ঠিক হয়? নতুনের খোঁজ পাওয়ার মধ্যে যে অবিমিশ্র আনন্দ, সেই আনন্দের রেশমাত্র থাকছে না এই শ্বাসরোধকারী বুদ্বুদে।
অথচ এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। অন্তত আইজ্যাক আসিমভের কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ‘ফাউন্ডেশন সিরিজ’ তাই বলে। সে-কাহিনির অন্যতম মূল চরিত্র গণিতবিদ হারি সেলডন, যিনি অতীত তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ধরতে চেয়েছেন। এই কাল্পনিক বিজ্ঞানের নাম ‘সাইকোহিস্ট্রি’, এবং সাইকোহিস্ট্রি দাঁড়িয়ে আছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বতঃসিদ্ধর ওপর— ভবিষ্যতের ফল সম্পূর্ণভাবেই গোপন রাখা দরকার, কারণ ফল প্রকাশ হওয়া মাত্র সে কল্পবিশ্বের অধিবাসীরা নিজেদের আচরণ বদলে ফেলবে। বলা বাহুল্য যে, আসিমভের গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা আমাদেরই প্রক্সি বিশেষ। কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে আসিমভ বলতে চেয়েছেন, নিশ্চিত ভবিষ্যৎকে মেনে নেওয়াটা মানুষের জিনে নেই। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আগ্রহ চিরকালীন কিন্তু সেই আগ্রহ রয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হল অনিশ্চয়তা।
সমস্যাটা শুধু একঘেয়েমিজনিতও নয়, আকারে ও গুরুত্বে আরও বড়-বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। এবং প্রতিনিয়ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে যে-কোম্পানিগুলি সর্বাপেক্ষা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে ফেসবুক বা টুইটারের মতন সামাজিক মাধ্যমও। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে, খবরের সঙ্গে আমাদের আচরণগত তথ্যের বিস্তর অমিল, সেরকম খবর ক্রমেই আমাদের নিউজ ফিডে আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিপ্রতীপ মতামতের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগটুকুও চলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমার মতের সঙ্গে মেলে এরকম খবরের বেশ ধরে কত ভুয়ো খবরও যে সেই নিউজ ফিডে ঢুকে পড়ছে তার ইয়ত্তা নেই। সারা পৃথিবীতেই তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ যখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছ তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এহেন অপপ্রয়োগ যে নিতান্তই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ থাকে না। তবে সবথেকে বড় বিপদের কথায় যাওয়ার আগে একটি নতুন শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার— নজরদারি পুঁজিবাদ (Surveillance capitalism)। শব্দবন্ধটির উদ্ভাবক হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ভূতপূর্ব অধ্যাপক সুশানা জুবফ। সুশানা জানাচ্ছেন গুগল, ফেসবুক এর মতন অতি বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থাগুলি ‘বিগ ডেটা’-র যুগে তথ্য বেচে অপরিসীম পুঁজি তৈরি করছে। এবং সেই পুঁজি আবারো বিনিয়োগ করা হচ্ছে আরো উন্নত প্রযুক্তি নির্মাণে, যার সাহায্যে অনলাইন এবং অফলাইনে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ইতিহাস ধরে রাখতে পারবে এই প্রযুক্তি সংস্থাগুলি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাজনিত গবেষণায় যে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে সেই বিনিয়োগ কিন্তু এই নজরদারি পুঁজিবাদেরই অংশ।
তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, নজরদারি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা সহজ কথা নয়। সচেতনতার অভাব তো অবশ্যই একটি বড় কারণ, কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল এই লড়াইটা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত। আমি স্বেচ্ছায় যদি প্রযুক্তিসংস্থাগুলিকে নজরদারি করতে দিই, তাতে সমষ্টির আপত্তিতে কি আদৌ কিছু যায় আসে? কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন, নিজেদের স্বার্থেই উপভোক্তাদের আরও ব্যক্তিগত তথ্য প্রযুক্তিসংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়া উচিত, যাতে বিজ্ঞাপন হোক বা খোদ পণ্য, উপভোক্তারা ঠিক কী চাইছেন তা বোঝা যায়। সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমীক্ষা দেখাচ্ছে, এ শুধু তাত্ত্বিক কথা নয়, বহু মানুষ এই ভাবনাচিন্তা থেকেই তাঁদের স্মার্টফোনকে প্রতিনিয়ত নিজেদের গতিবিধির হদিশ রাখতে দিচ্ছেন। কিন্তু বহু উপভোক্তা (এবং কিছু গবেষকও) যে-কথাটা বুঝছেন না তা হল, নজরদারি পুঁজিবাদের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতাতেও তৈরি হচ্ছে প্রবল অসাম্য। কীভাবে? একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তো বটেই, আপাত-গণতান্ত্রিক কাঠামোতেও আমাদের সম্পত্তির অধিকার বা মুক্তকথনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় বহুমুখী আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। সবাইকে সে-আলোচনার শরিক না করতে পারাটা কখনও ব্যর্থতা, কখনও-বা সংস্থান না থাকার বাধ্যবাধকতা; কিন্তু এ-কথা অনস্বীকার্য যে, প্রতিনিধিত্বের হিসাবে এই আলোচনাটা নেহাতই একতরফা নয়। নজরদারি পুঁজিবাদের স্রষ্টারা সেখানে গোপনীয়তা রক্ষার প্রেক্ষিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন একতরফা ভাবে। প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকার দরুন হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্র বাদ দিলে বাকিরা এই আলোচনার টেবলেই পৌঁছতে পারছেন না। এই ২০১৮ সালেও নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে ফেসবুকের দৌলতে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থার হাতে পৌঁছে যাচ্ছে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত চ্যাট, তাঁদের বন্ধুদের নাম-ঠিকানা, এমনকী প্রতিটি কমেন্ট, শেয়ার বা পোস্টের ইতিহাস। বৈদ্যুতিন চুক্তিপত্রের লাখ-লাখ শব্দের মধ্যে কোনও চার-পাঁচটি শব্দের চাতুরিতে ফেসবুক নাকি আইনত এই যাবতীয় তথ্য বিক্রির অধিকার পেয়ে গেছে! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্রমশই যে পার্সোনালাইজেশনের টোপ দেখিয়ে চলেছে সেও কিন্তু এই অবিরত তথ্য নিষ্কাশন ও তথ্য বিক্রয়ের আরেকটি মুখ। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভরতার দরুন বহু উপভোক্তা ভুলে যাচ্ছেন যে গুগল এবং ফেসবুক থেকে নিখরচায় প্রাপ্ত পরিষেবার আসল মূল্যটি রীতিমতন চড়া।
সক্রেটেসের পথ অনুসরণ করে তাই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে— যন্ত্রের বুদ্ধির গোড়ায় যাঁরা ধোঁয়া দিচ্ছেন, তাঁরা কী আসলে জানেন তাঁদের লক্ষ্যটি কী? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেহাতই উপলক্ষ, লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবজাতির কল্যাণসাধন। ওপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার সে কল্যাণসাধন নেহাতই কথার কথা, একুশ শতকের বিকৃত ধনতন্ত্রে মুষ্টিমেয় মানুষের উন্নতিসাধন বই আর কিছু হচ্ছে না। উদ্দেশ্য (Intention) এবং পরিণতির (Outcome) যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব মানবসভ্যতা দেখে এসেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য বইকি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। যে-পক্ষপাতদুষ্ট মানবিক ভুলভ্রান্তি এড়ানোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করেছিলাম আমরা, সেই একই ধাঁচের ভুল করে চলেছে যন্ত্র নিজেও। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেনঢিল মুলাইনাথন, যিনি ঘটনাচক্রে মুক্ত অর্থনীতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সদর্থক প্রভাব নিয়ে বিস্তর আশাবাদী ছিলেন, সম্প্রতি দেখিয়েছেন অ্যালগরিদমের সমস্যার জন্য পার্সোনালাইজড স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রেক্ষিতে আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষরা চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষের স্বীকার হচ্ছেন। মুলাইনাথনের গবেষণা জানাচ্ছে, যাঁরা এই অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন সেই প্রযুক্তিবিদরা আদৌ বর্ণবিদ্বেষী নন, কিন্তু যন্ত্রকে তালিম দেওয়ার জন্য যে-তথ্য দরকার সেই তথ্যেই রয়ে গেছে বহু অসঙ্গতি। মুলাইনাথন নিজে না বললেও তাঁর গবেষণাপ্রাপ্ত ফলাফল থেকে বোঝা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও বহুলাংশেই নির্ভর করছে মানুষের বিচারবিবেচনার ওপর। বলা বাহুল্য, সে বিচারবিবেচনা অধিকাংশ সময়েই ত্রুটিযুক্ত। ফলে অসম্পূর্ণ ট্রেনিং ডেটাসেট হোক বা ভুল কোডিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘অ্যাকিলিস হিল’ও একাধিক। যে-কারণে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে শুরু করে আবহাওয়া পরিবর্তন, অপরাধদমন থেকে শুরু করে পার্সোনালাইজেশন, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ার মতন।
এই নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আদৌ মুক্তি পাবে? সত্যিকারের কল্যাণকর প্রযুক্তি হিসাবে অদূর ভবিষ্যৎ-এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আদৌ কার্যকর হয়ে উঠবে? সক্রেটেসের দর্শন অনুযায়ী এহেন উত্তর খোঁজার চেষ্টা নেহাতই পণ্ডশ্রম। জীবনে শেখার জন্য দরকার প্রশ্ন তোলা, যেনতেনপ্রকারেণ একটি নির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে বার করা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্যও তাই দরকার যথাযথ প্রশ্নগুলিকে সর্বাগ্রে চিহ্নিত করা। মানুষ যেদিন যন্ত্রের অধীনস্থ হবে এহেন দার্শনিক পরিসর সেদিন টিকে থাকবে কি না, সে নিয়ে চিন্তা আদৌ অযৌক্তিক নয়। আপাতত উল্টোটাই সত্যি, তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিটি বিনিয়োগ ও প্রতিটি প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ছাড়া গতি নেই।