ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শব্দ ব্রহ্ম দ্রুম: পর্ব ১


    রূপম ইসলাম (October 8, 2022)
     

    লেখকের নিবেদন

    মনোরোগবিশেষজ্ঞ ড: ব্রহ্ম ঠাকুর এবং গবেষক-অভিযাত্রী এরিক দত্তর নতুন অভিযানে ডাকবাংলা ডট কমের পাঠকদের স্বাগত জানাই। ব্রহ্ম ঠাকুর সিরিজ়ের নানা পর্ব লিখছি, তা খুব বেশিদিন তো নয়! এই বছরখানেক ধরুন। ফলে এবারের উপন্যাসের আগে লেখা চারটি কাহিনি এখনও নিশ্চয়ই অনেকে পড়েননি। সেই সমস্ত নতুন পাঠকের কাছে আগে ঘটা কিছু ঘটনার কথা বলে রাখা দরকার। নতুন উপন্যাসটির পটভূমিকাটা জেনে রাখলে অভিযানে অংশ নিতে তাঁদের সুবিধে হবে। আসুন, জেনে নিই আগের গল্পগুলিতে কী কী হয়েছে। 

    বাংলা ছবির তরুণ তারকা আশ্চর্য বর্ধন ড: ব্রহ্ম ঠাকুরের কাছে মনোরোগের চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়। তার কল্পবাস্তবে নিয়মিত হাজির হওয়া নিশাচরীর রহস্যের জট খোলেন ব্রহ্ম। এভাবেই ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে একটি সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্রহ্ম ঠাকুরের একটা গোপন ইতিহাস আছে, যা তিনি কাউকেই বলতে চান না। কিন্তু হঠাৎ একদিন স্বভাববিরুদ্ধভাবেই আশ্চর্যের কাছে তিনি খুলে বলেন ক্ল্যাসিফায়েড বিজ্ঞান প্রকল্প বারমুডা ট্রায়াঙ্গল টু বা ‘বিটিটু’-র কথা। এই প্রকল্পের মূল নির্যাস হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে অবস্থিত ওয়র্মহোলের কল্পনার বাস্তবরূপ দেওয়া। ‘ঐতিহাসিক বাঁকবদলের যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ও সমান্তরাল সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গবেষণা, যা এরিক দত্ত বলে একজন শুরু করেছিলেন, তাই গ্রহণ করে এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিতে রাজি হয়েছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী হকিংসাহেব। এই প্রোজেক্টেরই তৃতীয় মাথা হলেন ব্রহ্ম ঠাকুর, যিনি বহুদিন পাশ্চাত্যে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক জ্যোতিষগুরুর ছদ্মবেশে। এই ছদ্মবেশ নেওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন হয়নি কারণ, জ্যোতিষ, ফেসরীডিং ইত্যাদি নানা ব্যাপারে আগ্রহ এবং তালিম আছে ব্রহ্মের। হকিংসাহেবেরই নির্দেশে ব্রহ্ম ঠাকুরের কলকাতায় ফেরা। ‘ব্যালেন্স’ নামের এক উগ্র রাজনৈতিক গুপ্ত সংগঠনের ঘোষিত শত্রু তিনি, তাই ব্রহ্মের লুকিয়ে থাকা। হকিংসাহেব মারা যাওয়ার পর তাঁর পক্ষ থেকে প্রোজেক্ট ‘বিটিটু’-র দায়িত্ব নেন উইলিয়াম ‘বিলি’ গিলচার। সম্প্রতি আমেরিকার সিয়াটেলে ‘বিটিটু’-র একটি গুপ্ত-গবেষণাগার ধ্বংস হয়, সেখান থেকে পলায়নরত কয়েকজন ল্যাব-অফিসার গ্রেপ্তার হয় সন্দেহজনকভাবে। এরা যাতে কোনওভাবেই ‘বিটিটু’-র আসল নাম ও উদ্দেশ্য ফাঁশ না করে, তাইজন্যই বিলি গিলচারের নির্দেশে তারা জেরার মুখে জানায়, ‘বিটিটু’ প্রকল্পের পুরো নামটা হল ‘ব্রহ্ম ঠাকুর প্লাস টু’। এর জেরে খুন হন ব্রহ্মের ভাই অম্বরীশ। ব্রহ্মকেও পালাতে হয় কলকাতা ছেড়ে। স্পিডবোটে করে দীর্ঘ সমুদ্রপাড়ি দিয়ে ব্রহ্ম এবং এরিক দত্তকে আসতে হয় বিলি গিলচারের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হতে। ব্রহ্ম খেপে আছেন গিলচারের উপর, তিনি মনে করেন তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য বিলির হঠকারিতাই দায়ী। এরিক দত্তের অবশ্য ধারণা— বিলি গিলচার জানতেন না অম্বরীশের উপস্থিতির ব্যাপারে, তিনি শুধুই একটা ভুল তথ্য সরবরাহ করতে চেয়েছিলেন মিশনটিকে বাঁচানোর জন্য। ব্রহ্ম যে নিজেকে বাঁচিয়ে আন্দামানে চলে আসতে পারবেন সে ভরসা তাঁর ছিল। ব্রহ্ম ঠাকুর তাঁর স্নেহের পাত্র আশ্চর্যকে এসব কথাই খুলে বলেন কারণ তাঁর অবর্তমানে তাঁর বাড়ির মহাকাশের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী যন্ত্রগুলির দায়িত্ব দিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আশ্চর্যকেই নির্বাচন করেছেন। এ কথা আশ্চর্য বুঝতে পারে একদম শেষবেলায়। সে উদ্বেগ নিয়ে বিদায় জানায় সমুদ্রপাড়িতে বেরিয়ে পড়া দুই বৃদ্ধ অভিযাত্রী ব্রহ্ম ঠাকুর এবং এরিক দত্তকে। তার মনে ছায়া ফেলে যায় কোনও অচিন্তিত-পূর্ব বিপদের আশঙ্কা।

    আন্দামানে কী ঘটবে? কীই বা ঘটবে কলকাতায় তরুণ অভিনেতা আশ্চর্যের জীবনে? এসব নিয়েই ব্রহ্ম ঠাকুর সিরিজ়ের নতুন পর্ব ‘শব্দ ব্রহ্ম দ্রুম’। চলুন, অভিযানে বেরিয়ে পড়ি।

    ১।

    ঝিঁঝিঁপোকাদের পছন্দের ঝোপ বা এলাকা থাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে চললেই বেশ বোঝা যায়, ঝিঁঝিঁর ডাক কোথাও বেশি, কোথাও কম। এই মুহূর্তে যে তিনজন একটা জোরালো টর্চের আলোয় ঘন জঙ্গলের মধ্যে শুঁড়িপথ খুঁজে, কাঁটাঝোপ বাঁচিয়ে আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে আসছে, তারা প্রকৃতির শব্দময়তা এবং নৈশব্দ, দুটো জিনিসই বেশ উপভোগ করছে বলে মনে হয়। এরা হয়তো টহল দিতে গেছিল বনের অন্য দিকটায়। এখন রাত বাড়ছে, তাই ফিরে আসছে। জঙ্গলের মধ্যেই একটা ফাঁকা অংশ খুঁজে বের করে খাটানো হয়েছে কয়েকটা তাঁবু। তাঁবুর দিকেই ফিরছে তারা। তাঁবুগুলোর অস্থায়ী এই আস্তানায় আপাতত ঘাঁটি গেড়েছে কিছু লোক। হেঁটে এদিকে আসা তিনজন এই ছোট দলটিরই অংশ।

    এই দলটির সদস্য সংখ্যা অবশ্য আজই বেড়েছে। চারজন লোক এসে পৌঁছেছে দুপুরে, স্পিডবোট চালিয়ে সমুদ্রপাড়ি দিয়ে উঠে এসেছে তারা নামগোত্রহীন এই নির্জন জঙ্গুলে দ্বীপে। সম্পূর্ণ এলাকাটাকে লোকে ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ’— এই নামে চেনে। পূর্ণদৈর্ঘ্যের বিশ্বমানচিত্রে দোয়াত-কলমের হাত ঝাড়া কালির ছিটের মতোই এর উপস্থিতি। কিন্তু সেই ম্যাপের উপর যদি আতসকাঁচ রাখে কেউ, তখন হয়তো সে দেখতে পাবে— এই দ্বীপপুঞ্জের একেবারে উত্তরপশ্চিম অংশে ‘পশ্চিমী দ্বীপ’ বলে একটা লম্বাটে ভাসমান টুকরো আছে। এই ছোট দলটি আপাতত যেখানে আছে, সেখান থেকে উত্তরদিকের সমুদ্রে তাকালে এই মানচিত্রে আতসকাঁচ লাগিয়ে খুঁজে পাওয়া পশ্চিমী দ্বীপটিকে দেখা যায়। বলা বাহুল্য, এই মানুষদের অস্থায়ী আস্তানা সংবলিত ক্ষুদে দ্বীপটির ঠিকানা— ম্যাপের কোত্থাও নেই। এমনকী স্যাটেলাইট ম্যাপেও এটা দেখা যায় না, কুয়াশায় ঢেকে থাকে প্রায়সময়। অর্থাৎ এই লোকগুলির অবস্থানের একটা ভৌগোলিক স্থানাংক বের করা যেতেই পারে, কিন্তু স্বীকৃত মানচিত্রের নিরিখে, এই মুহূর্তে এরা একেবারে উধাও হয়ে গেছে। যাকে বলে— কমপ্লিটলি ভ্যানিশড ফ্রম দ্য ফেস অফ দি আর্থ।

    এই মুহূর্তে যে তিনজন একটা জোরালো টর্চের আলোয় ঘন জঙ্গলের মধ্যে শুঁড়িপথ খুঁজে, কাঁটাঝোপ বাঁচিয়ে আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে আসছে, তারা প্রকৃতির শব্দময়তা এবং নৈশব্দ, দুটো জিনিসই বেশ উপভোগ করছে বলে মনে হয়। এরা হয়তো টহল দিতে গেছিল বনের অন্য দিকটায়। এখন রাত বাড়ছে, তাই ফিরে আসছে। জঙ্গলের মধ্যেই একটা ফাঁকা অংশ খুঁজে বের করে খাটানো হয়েছে কয়েকটা তাঁবু। তাঁবুর দিকেই ফিরছে তারা।

    যে চারজন এতটা বিপদসংকুল আর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করে এখানে এসেছে আজ দুপুরে, তাদের মধ্যে দৃশ্যতই নেতাগোছের হলেন দু’জন। আপাতদৃষ্টিতে এঁরা প্রায় সমবয়স্ক দুই ফিটফাট ছিমছাম বৃদ্ধ। সাধারণ স্বাভাবিক গৃহস্থ মানুষের তুলনায় এই দুই ব্যক্তির বিপদবোধ বেশ কমই বলা চলে। জীবনের নানা পর্বে বহুবার এঁরা বিপদকে তুচ্ছ করে অকুলপাথারে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছেন। আজকের সমুদ্র অভিযান তারই একটি আক্ষরিক উদাহরণ বলা যেতে পারে।

    এই দু’জনকেই আপাতত দেখা যাচ্ছে বনবাদাড় পেরিয়ে হেঁটে আসতে। তাদের সঙ্গে রয়েছে টর্চ হাতে তৃতীয় লোকটি। এই লোকটির বয়স খানিকটা কমই হবে বাকি দু’জনের তুলনায়। হেসে খেলে একে প্রৌঢ়ই বলা যায়। হাসিখুশি এই শ্বেতাঙ্গ লোকটির মাথা ভরা চমৎকার কালো কোঁকড়া চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। গঠন মজবুত, লম্বাচওড়া। লোকটা পরে আছে সাফারি স্যুটের মতো একটা আধা ফরম্যাল আধা ক্যাজ়ুয়াল পোশাক। এই ভদ্রলোক আমেরিকান। এর নাম উইলিয়াম গিলচার। লোকটা এমনিতে হাসিখুশি, তবে ওই বহিরঙ্গের ভেতরে লোকটার একটা কঠিন গাম্ভীর্যও যে আছে, তা মাঝেমাঝে বোঝা যায়।

    বিলি গিলচার চাপদাড়ি পনিটেল হাফ-জার্মান হাফ-বাঙালি এরিক দত্তের সঙ্গে ততটা নয়, গায়ে পড়ে একটু যেন বেশি কথা বলছেন আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘ চুলের দাড়িগোঁফহীন ব্রহ্ম ঠাকুরের সঙ্গেই। যেন কতদিনের পরে দেখা হওয়া প্রিয়তম বন্ধু। ব্রহ্মও হেসেহেসে অংশ নিচ্ছেন আলোচনায়। কে বলবে, এখানে পৌছনোর আগে ব্রহ্ম ঠাকুর সখেদে এরিককে বলেছিলেন, তিনি বিলি গিলচারকে দেখা হলেই ছুড়ে ফেলে দেবেন। মুচকি হেসে ব্রহ্মের এহেন কাণ্ডকারখানা দেখছেন এরিক দত্ত। তিনি অবশ্য অবাক হচ্ছেন না। বুড়োর গিরগিটি স্বভাবের সঙ্গে তিনি ভালই পরিচিত।

    এই দু’জনকেই আপাতত দেখা যাচ্ছে বনবাদাড় পেরিয়ে হেঁটে আসতে। তাদের সঙ্গে রয়েছে টর্চ হাতে তৃতীয় লোকটি…

    বিলি গিলচার এবার এরিকের দিকে তাকিয়ে বললেন— এরিক, আমার এই গুণটা তো আছেই, তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। পরিস্থিতি, সে যতই প্যাঁচে ফেলুক না কেন আমায়, আমি ঠিকই তার একটা না একটা হেস্তনেস্ত করি। তোমরা যে শেষপর্যন্ত এখানে আসতে রাজি হলে এবং এলে, খুব ভাল করলে। কিন্তু তোমরা দু’জন বোধহয় এ ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছিলে না, তাই না? একেই বলে অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, দ্য এপিক প্রবলেম অফ ডেমোক্রেসি! আরও আগেই তো চলে আসতে পারতে!

    ব্রহ্ম ঠাকুরকে খানিকটা ঠেস দিয়েই কথাটা বলা হল কি? ব্রহ্ম হাসিমুখে বললেন— বিলি, তুমি দারুণ বলেছ কথাটা, বেড়ে বলেছ! আমি একদম একমত। গণতন্ত্রে তো বহুস্বর— কাজেই সমস্যা একটা নয়, হাজারটা। আমি খালি তোমার কথার উত্তরে আমাদের একজন বাঙালি কবি সুকুমার রায়ের একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শোনাচ্ছি। অনুবাদ করে দিলে তুমি নিশ্চয়ই বক্তব্যটা ধরতে পারবে… 

    এই বলে ব্রহ্ম নাটকীয়ভাবে সুর করে কিছু লাইন আবৃত্তি করলেন, সেই শব্দে চমকে উঠে কয়েকটা ময়ূর বনের মধ্যে ঝংকার তুলে উড়ে গিয়ে বসল অন্য ডালে। ময়ূর যে, তা তাদের কর্কশ ডাক শুনেই বোঝা গেল। আবৃত্তি শেষ হলে ব্রহ্ম কবিতাটা অনুবাদ করে বিলি গিলচারকে বুঝিয়েও দিলেন মানেটা—

    জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,
    ফড়িঙের ঢং ধরি’ সেও চায় উড়িতে।
    গরু বলে “আমারেও ধরিল কি ও রোগে?
    মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?”
    হাতিমির দশা দেখ, – তিমি ভাবে জলে যাই,
    হাতি বলে, “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।”

    বিলি গিলচার শুনলেন। এটা শুনে তাঁর এতো আনন্দ হল, তিনি রক এন রোল ভঙ্গিতে তিন পাক নেচেই নিলেন ব্রহ্মের কবিতার সঙ্গে। এরিকের দিকে তাকিয়ে বললেন—  আমরা যখন অত্যন্ত সিরিয়াস কথা বলি, ঠিক তার মাঝখানে টেগোর যেন একটু ফাজলামি করবেই! এটা ওর স্বভাব, এটা না করে ও আবার পারে না। ফর দিজ় আটার ননসেন্স, আই রিয়েলি হ্যাভ আ লাইকিং ফর দিস চ্যাপ। বেশ। হাসি হল, ঠাট্টা হল, এবার একটু কাজের কথায় আসা যাক?

    টর্চের আলোয় সামনেই এবার একটা গর্ত দেখা গেল। গর্তে জল জমে আছে, বোঝা গেল সময় সময় সমুদ্র পাড় থেকে এতটা দূরেও উঠে আসে। গর্তটা সাবধানে পেরোলেন তিনজন। তারপর সামনের পথে টর্চের আলো ফেলে যেন খানিকটা আপনমনেই বিলি গিলচার বললেন— প্রথমেই আমি কী প্ল্যান করেছিলাম সেটা তোমাদের দু’জনকে বলি। আমি যখনই বুঝলাম আমাদের মহাকাশ গবেষণা এবং সময়াভিযান তত্ত্ব এবার আমাদের শত্রুপক্ষ ‘দ্য হিডেন ব্যালেন্স’-এর রেডারে ধরা পড়তে চলেছে, কয়েকজন অনুচরকে নিয়ে সঙ্গেসঙ্গেই বিশ্বমানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেলাম। আন্দামানে যে অনেক লুকনো দ্বীপ আছে, ম্যাপে যাদের চিহ্ন নেই, মানুষের পা যেসব জায়গায় এখনও পড়েনি, তা আমার জানাই ছিল। তোমাদের ডেকে আনবার জন্যও দু’জন লোককে— একজন স্পিডবোট চালক, আরেকজন গানম্যানকে পাঠিয়ে দিলাম ওয়েস্ট বাঙ্গালে। তাদের থেকেই জানলাম, আসার ব্যাপারে তোমরা দু’জন মনস্থির করতে পারছ না—   আরে আরে! আর লুকিয়ে লুকিয়ে থেকো না! প্লিজ় শো ইওরসেল্ফ টু ইয়র ওল্ড ফ্রেন্ডস। জেন্টলমেন, মে আই ইন্ট্রোডিউস টু ইউ ওয়ান্স এগেইন, ইউ মাস্ট বি মিটিং হিম আফটার আ ভেরি লং টাইম— ড. কিশিমোতো!

    ওঁরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে তাঁবুগুলোর সামনে পৌঁছেই গেছিলেন, ঠিক সেই সময়েই একটা তাঁবু থেকে বেরিয়ে অন্য তাঁবুতে ঢুকছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী, গবেষক এবং আবিষ্কারক ড. কিশিমোতো। তাঁবুর জ়িপ খুলতেই ভেতর থেকে এক ঝলক ব্যাটারি চালিত আলো এসে পড়ল তাঁর গায়ে, তাতেই দেখা গেল তাঁকে। কিশিমোতোর হাতে একটা ইনস্ট্যান্ট স্যুপের কাপ। ব্রহ্ম ঠাকুর এবং এরিক দত্তকে দেখে একটু তটস্থ হাসি হাসলেন তিনি। তারপর যেন চোখাচুখির পালা দীর্ঘ না করতে চেয়েই চট করে ঢুকে গেলেন দ্বিতীয় তাঁবুতে। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না ব্রহ্মের। তিনি সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়া  জাপানি তরুণের দিকে।

    বিলি গিলচার ফের ফিরলেন নিজের কথায়। বললেন— খুব ভাল হল তোমরা এলে, আর আমার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ড. কিশিমোতোও তোকিয়ো থেকে এখানে এসে যোগ দিতে পারলেন। আমাদের বিটিটু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা সিরিয়াস আলোচনা করে নেওয়া দরকার। অপ্রয়োজনীয় শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে বিস্তর। এবার ব্যাপারটাকে একটু গুটিয়ে আনতে হবে।

    এরিক দত্ত বললেন— অবশ্যই বিলি। তাহলে কালকেই আমরা আলোচনায় বসি? শুভস্য শীঘ্রম। তবে আজকের রাতটা আমাদের রেস্ট নিতেই হবে। কাল রাতে না ডাক্তারের, না আমার— একবিন্দু ঘুম হয়েছে। মাঝসমুদ্রে বেশ কিছু জলজ বিপদও আমাদের সামলাতে হয়েছে, তাতেও ধকল কিছু কম যায়নি। ভাবছি তাঁবুর মধ্যে ঢুকে একটা লম্বা ঘুম লাগাব আমি আর ডাক্তার…

    এরিক দত্ত ব্রহ্ম ঠাকুরকে গোড়া থেকেই এই ‘ডাক্তার’ নামেই সম্বোধন করে এসেছেন। পেশায় মনোরোগবিশেষজ্ঞ ড: ব্রহ্ম ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তো কমদিনের নয়!

    বিলি গিলচার বললেন— বেশ অনেকদিন হল, আমরা ‘দ্য হিডেন ব্যালেন্স’-এর রেডারের বাইরে আছি। পাশাপাশি তোমরা কলকাতায় একটা মোক্ষম প্রত্যুত্তর ওদের দিয়ে এসেছ। এটা দারুণ করেছ। আপাতত ওদের নজর কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গেই ফোকাসড থাকবে। জলপথে যে তোমরা আন্দামান চলে আসবে, সে খবর চট করে ওরা পাবে না, ওদের স্থানীয় গুপ্তচরসংস্থার মেরুদণ্ড তো তোমরা ভেঙে দিয়েই এসেছ! পাশাপাশি আমরা কেউ মোবাইল ফোনও ক্যারি করছি না, যে তার মাধ্যমে আমাদের ট্র্যাক করা যাবে। আমাকে তো ওরা কেউ চেনেই না, আর টেগোরের খোঁজ যারা পেয়েছিল, তারা ধরা পড়ে গেছে। ফলে আমরা এখন নিরাপদ। এই সাপ-খোপের আস্তানায় পড়ে থাকবার প্রয়োজন তাই ফুরিয়েছে। চলো, কালকেই এখান থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে এই দ্বীপপুঞ্জের মাঝামাঝি অঞ্চলে, আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে চলে যাই। বাকি কথা সেখানেই হবে। তবে পোর্ট ব্লেয়ারে যাওয়ার অন্য একটা কারণও আছে। তোমরা কি কেউ প্রোফেসর লতিকা মুরুগান সুব্রহ্মণ্যমের নাম শুনেছ?

    এরিক দত্ত ভুরু কুঁচকে তাকালেন বিলির দিকে। 

    (ক্রমশ)

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     

    পরবর্তী পর্ব

      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook