রচনা বুকস, গ্যাংটক: হিমালয়ের কোলে এক তৃতীয় পরিসর
পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুকস্টোরে যে কাঠের ঘোরানো সিঁড়িটা উঠে গেছে একতলা থেকে মেজেনাইন ফ্লোরে, সে ছিল এককালে পকেটে টান পড়া ছাত্রছাত্রীদের স্বর্গরাজ্য। তখন বইয়ের দোকানিরা আমাদের মতো হতদরিদ্র পড়ুয়াদের বিশাল এক ভল্যুম বই নামিয়ে ঘণ্টা পার করে বসে বসে পড়তে দেখলেও চোখ কটমট করে তাকাত না, অনেক পরে একটু কঠিন অথচ করুণার দৃষ্টিপাতে বুঝিয়ে দিত আপত্তি। সে সময় অনেক দুপুর কাটিয়েছি এই সিঁড়িতে। স্পষ্ট মনে আছে, যেসব বই কেনবার সামর্থ্য ছিল না মোটে, তাদের পাতা উল্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি ওই কাঠের ঘোরানো সিঁড়ির ধাপিতে। গ্যাংটকের ‘রচনা’-তে একতলা থেকে দোতলায় উঠবার জন্য তেমনই একটা কাঠের সিঁড়ি এক লহমায় আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল অক্সফোর্ডের সেই দুপুরগুলোতে। এ যেন অন্য এক জগতের সিংদরজা, নয় পূর্ণ পৌনে এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম, যা পৌঁছে দেবে বইয়ের দোকান নামক জাদুর দুনিয়ায়।
২০১৯ সালে গ্যাংটক যাবার আগে পর্যন্ত রচনা বুকস্টোর, বুকম্যান’স, ক্যাফে ফিকশন, রমন শ্রেষ্ঠা সম্পর্কে আমি কিচ্ছু জানতুম না। গ্যাংটকে থাকার জন্য বুকম্যান’স-এর ‘বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’ বিভাগে ঘর বুক করেছিলাম কেবল এইজন্য, যে সেটা দেখে দার্জিলিংয়ের আইকনিক ‘রিভলভার’ হোটেলের মতো মনে হয়েছিল। নভেম্বরের এক হিমেল দুপুরে ‘রচনা’-তে গিয়ে প্রথম যা দেখেছিলাম সেটা হল, কাচের দরজার উপর রংচংয়ে অক্ষরে লেখা ‘ইয়োর লাইফ ইজ আ স্টোরি।’ (তোমার জীবনই একটা গল্প)। আমার ন’বছরের ছেলে যখন সরু কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে যাচ্ছে ঘরগুলো দেখতে, আমি দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লুম ‘ক্যাফে ফিকশন’-এ। আর ঢোকামাত্র তার আশ্চর্য পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে ফেলল। পরের তিনটে দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটল এখানে, আলাপ হল রমন শ্রেষ্ঠা আর তার পরিবারের সঙ্গে।
বাইরে থেকে দেখলে বুকম্যান’স/ রচনা মধ্যবিত্ত গ্যাংটকের আর পাঁচটা বাড়ির মতোই। আয়তাকার বিল্ডিং তিন-চারতলা খাড়া উঠে গিয়েছে, সামনের দিকে পরপর ঝুলবারান্দা নিয়ে। সবগুলো ব্যালকনিতেই ঢোকা যায় ঘর দিয়ে। আর এগুলো বাদ দিলে এ বাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা একটা ‘গেস্ট হাউস’। বেশ একটা আরামদায়ক ‘লিভড-ইন’ গেরস্তবাড়িই মনে হয়। ‘ওয়েল মেনটেইনড’ হলেও বাণিজ্যিক ঝাঁ চকচকে ব্যাপার নেই বাড়ির গায়ে। গত দু’দশকে পূর্ব হিমালয়ের অন্যতম প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে সসম্মানে জায়গা করে নিয়েছে ‘রচনা বুকস’। এ জায়গার নাম উঠে এসেছে সমসাময়িক সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার অপরিহার্য পরিসর হিসেবে, যেখানে কখনও বক্তৃতা, কখনও আলোচনা, কখনও পারফরম্যান্স, কখনও বই পড়া, আবার কখনও বা ওয়র্কশপ বা সিনেমা/তথ্যচিত্র দেখানো হয় নিয়মিত। উদ্দেশ্য? একদিকে সারা পৃথিবীতে কী হচ্ছে তার একঝলক হিমালয়ের কোণে নিয়ে আসা, অন্যদিকে হিমালয়ের এ কোণের জীবনযাত্রা বাকি পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। ‘রচনা বুকস’-এর কর্ণধার রমন শ্রেষ্ঠা সারা দেশের সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতে বেশ পরিচিত, অনেক জায়গায় বক্তৃতা দেন। জয়পুর লিট ফেস্ট, দ্য হিন্দু লিট ফর লাইফ, গোয়া আর্ট অ্যান্ড লিট ফেস্ট, জয়পুর বুকমার্ক, ব্রহ্মপুত্র লিট ফেস্ট, কাঠমান্ডুর কান্তিপুর কনক্লেভে বক্তব্য রেখেছেন। ২০২২-এর ‘ব্রিটিশ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং ফেলোশিপ’-এর জন্য যে একডজন প্রকাশককে (ছ’জন ভারত থেকে, অন্য ছ’জন ব্রিটেন থেকে) বেছে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম রমন শ্রেষ্ঠা। ২০২২-এর শারজা বুকসেলার্স কনফারেন্সেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। হায়দ্রাবাদ লিট ফেস্টেও দুই দু’বার পুরস্কার পেয়েছে ‘রচনা বুকস’। ২০১৫-তে ‘বেস্ট বুকশপ: পাবলিশিং নেক্সট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০২০-তে ‘ফুড ফর থট বেস্ট বুকস্টোর অ্যাওয়ার্ড।’
বই ব্যবসা, সরাইখানা, প্রকাশনা— রমন শ্রেষ্ঠা এই তিনদিক একা হাতে সামাল দিচ্ছেন তো বটেই, সঙ্গে আরও অনেক কিছু করছেন। সিকিমে নতুন ধারার সাহিত্যচর্চার অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছেন, আর আগলে রেখেছেন সেই অনির্বাণ অগ্নিশিখাটি, যাকে তিনি নিজের হাতে নতুন করে উসকে দিয়েছিলেন শূন্য দশকের গোড়ায়। সে আগুনের পরশমণি প্রাণে প্রাণে পৌঁছে দিতে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন রমন। ডাকবাংলা ডট কম-এর সঙ্গে আড্ডায় রমন বললেন তাঁর একমাত্র দোকানটির কথা, লেখালিখি, প্রকাশনার কাজের কথা এবং এক কিংবদন্তী চায়ের আড্ডার কথাও…
‘রচনা’-র শুরুর দিকের কথা বলুন: প্রথম বছরগুলো কেমন কেটেছিল?
আমার পরিবার ১৯৭৯ সালে ‘রচনা বুকস’ শুরু করে। তখনকার দিনে কাজের শেষে মানুষে মানুষে বেশ দেখা হত। দিনভর পরিশ্রমের পর লোকে খবরের কাগজ পড়বার জন্য বইয়ের দোকানে ভিড় জমাত। সেখানেই দেখা হয়ে যেত অন্যান্য পরিচিতজনের সঙ্গে। আসলে আশির দশকের সেই সময়টা খুব সুন্দর ছিল, যখন মানুষের মধ্যে সামাজিকতা বোধ ছিল। কারও সঙ্গে দেখা করা, তার বাড়ি যাওয়া এসব চলত। কেবল টিভির দৌরাত্ম্য তখনও শুরু হয়নি। একরকমের বন্ধন ছিল, পারস্পরিক টান ছিল। বই আর রেডিও এতে খুব সাহায্য করত।
‘রচনা’-র দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ এখন একে যে অবস্থায় দেখছি, আপনিই এর কেন্দ্রে। নতুন করে এই ব্যবসা শুরু করলেন কেন?
বই ব্যবসা শুরু করার সৌভাগ্য যে হল, তার কারণ হয়তো অনেকই ছিল। তবে আমি নিয়তির কথাই বলব। এটাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য বলতে পারেন। বেঁচে থাকার রসদ। হ্যাঁ, সাহসি পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে— বইয়ের ব্যবসা কেরিয়ার হিসেবে তো খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষত আমি যে সময় শুরু করি, তখন এ শহরে প্রতি তিনটে দোকানের একটা ছিল হয় অনলাইন লটারির, নয় মদের। এখন পিছনে তাকিয়ে মনে হয়, যা করতে ভালোবাসি তাই করতে পেরেছিলাম, চালিয়েও গিয়েছি সেটা… এ এক বিরাট সৌভাগ্য।
‘স্বাধীনভাবে’ ব্যবসা করতে গিয়ে কী কী বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে?
‘স্বাধীন’ ব্যবসায় বাধা প্রচুর, আর সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। একেবারে গোড়ার দিকে, মানুষকে আকর্ষণ করে দোকানে নিয়ে আসাটাই একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। যেদিন এলাকার একজনও নতুন লোক দোকানে আসত, সেদিনটাকে আমি ‘সফল’ বলতাম। পরে এটাই বদলে গিয়ে হল, একই লোক ফিরে ফিরে আসছে কিনা! কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পরিকাঠামোর অভাবজনিত কারণে বইয়ের যোগানে টান পড়ত। কখনও বা আমাদের ভাঙাচোরা, ভুলে ভরা, দীর্ঘসূত্রী সাপ্লাই চেন সিস্টেমের সঙ্গে লড়তে হত। আর প্রায়শই যে বাধাটা পেয়েছি তা হল, ছোট, অনামী বইয়ের দোকানের প্রতি প্রকাশনা শিল্পের অসহযোগিতা, অনাস্থা। আজও সমস্যার তালিকা করতে গেলে এটা এক নম্বরে থাকবে।
‘স্বাধীন’ বইয়ের দোকান হিসেবে ‘রচনা’-র নিশ্চয়ই একটা জোরালো সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় আছে। গত দু’দশকে সেটা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে?
যে বই আমরা রাখি, যেসব অনুষ্ঠান আমরা করি, তা দিয়েই আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় নির্ধারিত হয়। আমাদের দোকানে যা বিক্রি করি, বলতে পারেন অনেকাংশে সেটাই আমাদের বিশ্বদর্শন। কোন বইয়ের পাশে কোন বই রাখা হচ্ছে, তা থেকেও নাকি ব্যবসায়ীর দৃষ্টিভঙ্গি চেনা যায়, এমন অনেকে বলেন। আসলে পর্যটকেরা যখন জানান আমাদের বইয়ের অনন্য সম্ভার ওঁদের ভালো লাগছে, এমনটা সাধারণত বড় দোকানে (চেন-স্টোর) মেলে না, সেটাই আমাদের রোমাঞ্চিত করে। আমাদের সম্ভার নম্বর বা অ্যালগোরিদম দিয়ে নির্ধারিত হয় না। বলতে পারেন, হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মিলিত অ্যালগোরিদমে চলি আমরা। প্রত্যেক পৃষ্ঠপোষকের পছন্দ অপছন্দ ব্যক্তিগতভাবে জেনে রাখাটাই আমাদের মূল চালিকাশক্তি।
‘রচনা’-তে যে বইয়ের সংগ্রহ আছে, তা অনেকটাই অন্যরকম। ‘রচনা’ কি সর্বদাই তার হিমালয়ান পরিচয় এবং দর্শন মেনে বই রেখেছে, নাকি এটা গত কয়েক দশকে সচেতনভাবে তৈরি করা হয়েছে?
উল্টোটাই বলা যায়। অর্থাৎ আমরা বরাবর এই প্রত্যাশার বিপরীত মেরুতে থেকেছি, যে পাহাড়ে বইয়ের দোকান মানেই কেবল পাহাড়-সম্পর্কিত বইই সেখানে থাকবে। নানা প্রকাশনা বা ডিস্ট্রিবিউটারদের দোকানে দোকানে যখন বই আনতে যাই, দেখি সেই বিক্রেতারা বৌদ্ধধর্ম কিংবা পাহাড়ে চড়া সংক্রান্ত বই আমাদের বেশি করে বেচতে চান, পাহাড়ে দোকান বলে। সেটা আটকাতে হয়। পাহাড়ের নিসর্গ, পাহাড়ের ছবি দেওয়া কফি টেবল বুক বিক্রি করতে চান ক্রমাগত। খানিকটা বিরক্তই লাগে তখন। আসলে বইয়ের দোকানের কাজটা অনেকটা সেতুর মতো, যে সেতু বেয়ে অন্য এক পৃথিবীর, সময়ের, পরিসরের ধ্যানধারণা আমাদের কাছে আসবে, আবার আমাদের জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, কিংবদন্তী বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। বইয়ের দোকান আদতে আবিষ্কার, শিক্ষা এবং আদানপ্রদানেরই একটা অবকাশ।
‘রচনা বুকস্টোর’ এখন গ্যাংটকের একটা উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। বিশেষত ক্যাফে ফিকশন এবং বুকম্যান’স বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট তো বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে (গ্যাংটকে আমার প্রিয়তম গন্তব্য)। কীভাবে এই দুটি জায়গা তৈরি হয়ে উঠল যদি বলেন…
বইয়ের দোকান শুরু করার একেবারে গোড়ার দিকে— বইয়ের সংগ্রহ, অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, সব মিলিয়ে ‘রচনা’ শহরে একটা তৃতীয় বিকল্প পরিসর (Third Space) তৈরি করতে পেরেছিল। স্বাভাবিকভাবেই শুধু ‘বই’ দিয়ে আর আমাদের তেষ্টা মিটছিল না। নতুন নতুন ভাবনার জন্য দরকার ছিল আরও নতুন কিছু। এদিকে অনলাইন বিপণির বাড়বাড়ন্ত শুরু হতে, কিছু খদ্দের আমাদের দোকান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। মনে হল, ভাবনার আদানপ্রদানের জন্য আরও প্রাণবন্ত, জীবন্ত কোনও কিছু চাই। গ্যাংটক তার জন্য এখন তৈরি। এভাবে বইয়ের দোকানের নীচের তলায় শুরু হল ক্যাফে ফিকশন। আর সেখানেই আমরা এমন অনেক শিক্ষার্থী, গবেষক, শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, পর্যটকের দেখা পেলাম, যাঁরা গ্যাংটকে একটা থাকার জায়গা খুঁজছেন। যেখানে কাঁধের ব্যাগটি নামিয়ে রেখে দু’দণ্ড বিশ্রাম করা যাবে, শুয়েবসে ভাবনাচিন্তা করা যাবে। তখনই বইয়ের দোকানের ওপরতলায় চারটে ঘর করে সরাইখানা বানাবার কথাটা মাথায় এলো।
দুপুর দুটোর চায়ের আড্ডার ব্যাপারে কিছু বলুন।
এ একরকমের কিংবদন্তী বলা যায়। এক ভারী মিশুকে বই ব্যবসায়ী নাকি যেমন দুরন্ত বই সংগ্রহ করতেন, তেমন ভালো চা বানাতেন। প্রত্যেকদিন ঠিক দুপুর দুটোয় তিনি তাঁর বইয়ের দোকানের কোনও খরিদ্দারকে দোকান দেখবার ভার দিয়ে (বইয়ের দোকানের মালিক হওয়া যেহেতু অনেকেরই গোপন স্বপ্ন) উপরে চলে যেতেন চা বানাতে। সেই কিংবদন্তী মেনেই রচনার বন্ধুরা (Friends@Rachna) দুপুর দুটোয় চা খেতে আসতেন। শেষে এমন ভিড় হতে লাগল ওই সময়, যে নিয়মিত খদ্দেররা বিনামূল্যে চায়ে চুমুক দিতে অস্বস্তি বোধ করতেন। তখন ওঁদেরই অনুরোধে ক্যাফে খোলা হল।
প্রকাশনা বিভাগ দেখছি কলেবরে বাড়ছে। আরও আরও মানুষের কাছে ‘রচনা’কে পৌঁছে দেবার কী পরিকল্পনা রয়েছে আপনার?
চার দশকের বই বিক্রি থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা হল: এই এলাকা বিষয়ে বইয়ের সংখ্যা খুব কম, যা আছে তা একেবারেই প্রামাণ্য নয়। আর বিদেশি বইগুলোর প্রচুর দাম, পাওয়াও যায় না। আমাদের এখানে থেকে গবেষকরা বছরের পর বছর গবেষণা করেন। অথচ সেই বইগুলো প্রকাশিত হয় বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাখানাগুলো থেকে। ফলে তার দাম থাকে আকাশছোঁয়া, কেনার সুযোগও দুর্লভ। এর থেকেই প্রকাশনার কথা আমাদের মাথায় আসে। আমরা নিজেরা এখন এই ধরনের বই করছি। ফিকশনও করছি, যা সহজলভ্য এবং পকেটেও চাপ পড়ে না। অল্পবয়সী স্কলাররা, ছাত্রছাত্রীরা এখন অনেক সহজে প্রয়োজনীয় বই পাচ্ছেন।
আজকের নবীন প্রজন্মের কাছে বই আকর্ষণীয় হচ্ছে কি? আপনার কী মনে হয়…
অবশ্যই। আগের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। এই যে সাধারণের মধ্যে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে, বইয়ের চাহিদা নাকি কমে যাচ্ছে, এটাকে এবার মাথা থেকে ঠেলে বের করে দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের দোকানে যাঁরা আসেন, তার আশি শতাংশই তরুণ-তরুণী। যাঁরা বই কেনেন, তাঁদেরও অন্তত সত্তর শতাংশ এই প্রজন্মের। আসলে একদল লোক এমন আছেন, যাঁরা ‘বই পড়ার অভ্যাস চলে গেল হায়, কেউ আর আজকাল বই পড়ে না’ বলে বিলাপ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আমার উত্তর— আপনারা নিজেরাই বই পড়া ছেড়ে দিয়েছেন (যদি অবশ্য আগে কখনও পড়ে থাকেন।) যাঁরা বই পড়েন, তাঁরা আগেও পড়তেন, আজও পড়েন। নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গ্যাজেট এবং বই পাশাপাশি দেখেই বড় হচ্ছে। বরং পুরনো প্রজন্মই সুযোগসুবিধে মতন বই ছেড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার বিনোদনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন।
বাংলায় এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁরা হিমালয়ের জীবনযাপন নিয়ে লিখেছেন। যদিও পরিমল ভট্টাচার্যের মতো কেউ কেউ দ্বিভাষিক আছেন, বাকিদের জন্য অনুবাদ করানোর কথা ভাবছে ‘রচনা’-র প্রকাশনা বিভাগ?
আজকাল পাহাড়ের এ দিকটা নিয়ে প্রচুর লেখাপত্র হচ্ছে। সময়টা খুব ভালো। ফিকশন, নন ফিকশন, কবিতা, সবরকম লেখা হচ্ছে। পরিমল ভট্টাচার্যের দার্জিলিংয়ের কথা অসম্ভব সুন্দর। আমার তো মনে হয় সব পাহাড়ি শহরের এমন একটা গীতিকাব্য থাকা উচিত। পাহাড়ের মানুষজন, সংস্কৃতি যিনি ভেতর থেকে বোঝেন, এমন কারও রচনা করা উচিত সে কাব্য। জানেন, সম্প্রতি একজন নেপালি লেখক বাংলায় একটা উপন্যাস লিখেছেন? আর তার নেপালিতে অনুবাদ করেছেন একজন বাঙালি অনুবাদক!
আমাদের সংস্থা থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আশির দশকের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চুদেন কাবিমো-র লেখা উপন্যাস ‘সং অফ দ্য সয়েল’। জেসিবি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই মনোনীত হয়েছে এই বই। ইংরিজি, বাংলা আর হিন্দিতে অনূদিতও হয়েছে। এ বছর আর একটা খুব ভালো উপন্যাস প্রকাশ করছি আমরা। আমাদের বইগুলো পাঠকমহলে যেরকম সমাদৃত হচ্ছে, তাতে খুবই উৎসাহ পাচ্ছি। প্রায় প্রত্যেক পনেরো দিনে কেউ না কেউ নতুন লেখা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
মাঝে মাঝে আমার ভাবতে সত্যিই আশ্চর্য লাগে! একসময় লোককে বইয়ের দোকানে টেনে নিয়ে আসাই ছিল চ্যালেঞ্জ! সেখান থেকে শুরু করে আজ শুধু পাঠক নয়, লেখকদের সঙ্গেও সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েছি আমরা!
ছবি সৌজন্য লেখক