খ্রিস্টিয় পুরানে, শয়তান হল সেই ‘অ্যাঞ্জেল’ বা দেবদূত, যে কিনা ঈশ্বরকে অমান্য করেছিল। কিন্তু, ইসলাম পুরান বলছে, পরি বা ফেরেস্তা-রা সর্বশক্তিমানকে অমান্য করেনি। আলোর সন্তান ছিল তারা। তাদের কোনও স্বাধীন ইচ্ছা ছিল না। আর অ্যাডামের কাছে তারা নতিস্বীকার করেছিল, কারণ সর্বশক্তিমানই তেমনটা করতে বলেছিলেন বলে জানা যায়। তাদের কাছে, ‘ইবলিস’ শয়তান আসলে একটি জিন। ফলে, অমান্য করতে সে সক্ষম। আবার, খ্রিস্টান মতে, দেবদূতরা আসলে ইসলাম পুরাণেরই অংশ, কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমরা বিশদে জানতে পারি না। কারণ, ইসলাম ধর্মে সেসব আখ্যানের চিত্রণ নিষিদ্ধ। মসজিদে যদি আপনি যান, দেখবেন, সেখানে কেবল জ্যামিতিক চিত্রর শিল্পকলা, কোনওরকম মানবশরীরের চিত্রকর্ম সেখানে নেই। কারণ, ইসলামে মানব শরীর আঁকাআঁকি একদম বারণ। এমনটা কিন্তু চার্চ বা গির্জায় দেখা যায় না। যার ফলে, আমরা ইসলামের ফেরেস্তাদের দেখতে পাই না শিল্পীর চোখে, কিন্তু খ্রিস্টান দেবদূতদের দেখতে পাই। যেমন সেরাফিম, শেরাব এবং প্রধান দেবদূতরা তো রয়েছেই।
কোরানে খুব কম ফেরেস্তার উল্লেখই রয়েছে। বেশিরভাগ নামই পরবর্তী কালে মধ্যপ্রাচ্যের লোককথা থেকে এসেছে। খ্রিস্টান গ্যাব্রিয়েল হয়ে ওঠে জিব্রাইল। মাইকেল হয়ে ওঠে মিখাইল। জিব্রাইল যেমন বার্তাবাহক। নবী মহম্মদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। নবীকে সে বহু প্রকারে সাহায্য করেছিল। এমনকী বদরের যুদ্ধে ফেরেস্তাদের পরিচালিত করার দায়িত্বেও ছিল সে। যার ফলে, নবী মহম্মদ তাঁর শত্রুদের পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং মক্কায় ফিরতে পারেন। আর মিখাইল হল করুণার ফেরেস্তা। ধার্মিক ঔচিত্যবোধ এবং ন্যায়বিচারের ফেরেস্তা সে।
আজরাইল হল মৃত্যুর ফেরেস্তা। মিথ্যাবাদের কাছে সে ভয়ানক। সততার কাছে সে প্রশান্তির। আজরাইল এমন এক গাছের তলায় বসে থাকে, যে গাছের পাতায় পাতায় সমস্ত সজীব প্রাণের নাম লেখা রয়েছে। যে নামের পাতা খসে পড়বে গাছ থেকে, তখন আজরাইলের কাজ হল সেই নামের সঙ্গে যুক্ত আত্মার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়া। তারপর চূড়ান্ত বিচার অর্থাৎ কেয়ামতের ঘোষণা। এই ঘোষণার জন্য একটা শিঙা বাজানো হয়। তার দায়িত্বে থাকে ইসরাফিল। এবং তা বাজানোর জন্য সর্বশক্তিমানের অনুমোদনের অপেক্ষা করতে হয়। অনুমোদন পাওয়া মাত্র, প্রথম শিঙায় দুনিয়ার সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় ফুঁয়ে সমস্ত মৃত জেগে ওঠে, যাতে তারা কেয়ামতের জন্য নিজেদের উপস্থাপিত করতে পারে।
হাবিব হল সেই ফেরেস্তা যে প্রার্থনাকারী মানুষদের পরামর্শ দেয়। খেয়াল রাখে। রাদ হল বজ্রবিদ্যুতের ফেরেস্তা, তার নজর থাকে মেঘ-ঝড়ঝঞ্ঝার দিকে। কিরামান কাতিবান হল সেই ফেরেস্তা যে কিনা মানুষের সমস্ত কৃতকর্মের দিকে নজর লাগিয়ে রাখে এবং সেগুলি লিখে রাখে। হামালাত আল আর্শ্ হল সেই ফেরেস্তা, যে কিনা সর্বশক্তিমানের সিংহাসন বহন করে এবং প্রার্থনা দিয়ে ঘিরে রাখে। মুকাবিত সেই অভিভাবক ফেরেস্তা, যে খেয়াল রাখে এবং নিশ্চিত করে, যাতে কোনও মানুষ যেন তার নির্ণীত সময়ের আগে মারা না যায়।
কিছু কিছু ফেরেস্তা আবার জোড়ায় জোড়ায় থাকে। মালিক যেমন নরকের প্রতিরক্ষী ফেরেস্তা, যার মুখে কক্ষনও হাসির দেখা মিলবে না। ওদিকে রিদওয়ান হল স্বর্গ তথা বেহেস্তের উদ্যানের রক্ষী। মুখে তার সবসময় হাসি। মুনকার এবং নাকির হল কবরের রক্ষী, যাদের কাজ সম্প্রতি যাকে গোর দেওয়া হয়েছে, সে সর্বশক্তিমানের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাস বজায় রেখেছিল কি না। হারুত এবং মারুত হল সেই ফেরেস্তা, যারা প্রলোভনের কাছে বশ মেনেছিল এবং শাস্তিস্বরূপ ব্যাবিলনে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। তারা জ্যোতিষশাস্ত্র ও ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। আর সেইসব মানুষকে সতর্ক করে, যারা নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিতে না পেরে অপরিসীম জাদুশক্তির প্রার্থনা করে।
ইসলাম লোককথায় অলৌকিক শক্তির অধিকারী প্রাণ, অর্থাৎ ফেরেস্তা ও জিনের অস্তিত্বর ধারণা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ধরাধামের প্রত্যেকটা মানুষই এমন শক্তির জন্য কামনা করে, যা তাদের জীবন এবং মৃত্যুর ভয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। অনেকে সর্বশক্তিমানকে দরবারের পারিষদ এবং প্রহরী-সহ বিশাল বড় এক প্রাসাদের রাজা হিসেবে কল্পনা করে। সেখানে বাগান আছে যেমন, তেমনই আছে কারাগারও। আর এই কল্পনালতাই বিভিন্নভাবে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে এবং গানে-গল্পে ছড়িয়ে পড়ে। সেসবের বৈজ্ঞানিক অর্থ না-ও থাকতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী মনস্তত্ত্ব জড়িয়ে রয়েছে এসবের ভিতরে। মানুষ চায় ভাবতে যে, তাদের জীবনকে কেউ একজন দূর থেকে খেয়াল রাখছে। পর্যবেক্ষণ করছে। এবং তাদের মৃত্যুর মুহূর্তেও খেয়াল রাখবে কেউ। আমরা যখন অন্য লোকের পৌরাণিক কাহিনি পড়ি, তখন আমাদের কাছে দু’টি উপায় থাকে: সেগুলিকে মিথ্যা ছল এবং অযৌক্তিক ভেবে উপহাস করা। কিংবা, সেই মানুষদের নিরাপত্তাহীনতা এবং উদ্বেগের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। পুরাণের কাহিনিসমূহ আদৌ সত্য না কি মিথ্যা– এই নিয়ে সবাই তর্ক করতে চায়। কিন্তু আমাদের যেটা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা হল, পৌরাণিক আখ্যানগুলি জীবনের সমস্ত ভয়াবহতার মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। যা বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদিতার তরজা অনেকক্ষেত্রেই দিতে পারে না।