২০২২ সালে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখলাম। কিন্তু যে আশার আলোয়, যে প্রতিশ্রুতির ঘনঘটায় ভারত ‘স্বাধীন’ হয়েছিল সে-বছর, তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? এই দেশের মধ্যে যারা বসবাস করছি এই সময়ে, তারা আদৌ স্বাধীন তো? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই পেন আমেরিকা জানতে চেয়েছিল, বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য। ‘স্বাধীন’ বা ‘স্বাধীনতা’ শব্দগুলো নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন আজকের দিনে, তাঁরা তা জানিয়েছেন। সেই শতাধিক লেখকের শতাধিক ভাবনার কথাগুলোই এবার থেকে বাংলা অনুবাদে প্রকাশ পাবে ডাকবাংলা.কম-এ।
নন্দিতা দাস (অভিনেত্রী, চিত্র-পরিচালক)
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি এক অবিস্মরণীয় উদ্যাপন। প্রায় দীর্ঘ ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে যেরকম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল দেশজুড়ে, খুব কম মানুষই ভাবতে পেরেছিল, আমরা সামলে নিতে পারব। কিন্তু শেষমেশ এই দেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। তার জন্য এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মানুষগুলোকে, এবং তাঁদের ভাবনাকে সম্মান ও ধন্যবাদ জানাই। যেমন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, বাবাসাহেব আম্বেদকর, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং আরও অনেকে। স্বাধীনতার জন্য সুদীর্ঘ অহিংস আন্দোলন এবং জাতপাত-লিঙ্গ-ধর্ম নির্বিশেষে সাম্য ও ন্যায়ের দাবিতে লড়াই ও তার সংকল্পগুলো আমাদের প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয়ের সুযোগ দিয়েছে।
কিন্তু এত কষ্ট করে পাওয়া স্বাধীনতার নামে আমরা যা কিছু পেলাম, সেসব হারানোর কাজেই আমরা যেন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি। ধসতে থাকা এই গণতন্ত্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমিত করছে। দেশের আইনব্যবস্থা আমাদের নিতান্ত সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য কারাবন্দি হতে হচ্ছে। হিংসা ও গোঁড়া ধারণাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। দেশে বেকারত্ব স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে এখনও অবধি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় এবং শীর্ষে। এই বিফলতার তালিকা দীর্ঘ এবং হতাশাজনক।
সত্যি বলতে, আফসোস করা অনেক সহজ। কিন্তু, এতরকম বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও যে মানুষগুলো সংগ্রাম করে চলেছেন, লড়াই জারি রেখেছেন অরাজকতার বিরুদ্ধে, তাঁদের কথা ভাবুন তো… আমরা যদি এরকম নিরাশ হয়ে যাই, তাহলে তাঁদের কি খারাপ লাগবে না? তাঁদের লড়াইকে ছোট করা হবে না কি? বরং, এমন ঘনঘোর সময়ে, যে-মানুষগুলো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, যুক্তির সঙ্গে কোনও আপস করছেন না, সেই ছোট-বড় সমস্তরকম লড়াইগুলো খুঁজে খুঁজে সেসবের পাশে দাঁড়ানোই কি আমাদের কাজ নয়? আমরা যে কেউ এই সংগ্রামগুলোর শরিক হতে পারি। আর এই ৭৫ বছর পূর্তিতে দেশকে স্বাধীনতার ধারণায় আরও বলীয়ান করার লক্ষ্যে সেই সংকল্পের চেয়ে ভাল আর কীই-বা হতে পারে?
শোভা দে (লেখক, সম্পাদক)
‘স্মৃতি’ এবং ‘অতীত’ : এদের সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য, কিন্তু একটু অদ্ভুত। স্বাধীন ভারতেরও বয়স হয়ে গেল ৭৫টা বছর। আমরা যারা একটু পাতা উল্টে পুরনো দিনের কথা রোমন্থন করতে ভালবাসি, তারাই বুঝি স্মৃতি ও অতীতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আবেগের কদর। ভাবি আর একে অপরের দিকে তাকাই। আমাদের চোখে থাকে বুঝে-ফেলা দৃষ্টি, ঠোঁটে থাকে বাঁকা হাসি, আর চোখে থাকে না-ফেলা অশ্রু।
আমি ঠিক ‘মিডনাইটস চাইল্ড’ (স্বাধীনতার দিন রাত বারোটায় জন্ম যে-শিশুর) না হলেও, স্বাধীনতার কয়েকমাস পরেই জন্মেছি, ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতে। স্বাধীনতাকে আমি ভেবেছিলাম আমার নিশ্চিত সম্পত্তি, অন্তত নেতা-মন্ত্রীদের মুখে সেকরমই স্বর্গরাজ্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেছিল। আমাদের ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’, মানে ‘Tryst with Destiny’-তে ছিল থরথরে উত্তেজনা ও প্রত্যাশা— একটা কার্যকরী গণতন্ত্র— নাগরিকেরা যার সমাদর করবে আর যাকে রক্ষা করবে— এনে দেবে অনন্ত সম্ভাবনা আর সুযোগ। কিন্তু এখন সেই একই শব্দ ‘গণতন্ত্র’কে পরিকল্পিত ভাবে অপবিত্র করেছে, নৃশংসভাবে খর্ব করেছে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তার মধ্যেও আমাদের কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হলে, সেই স্বপ্ন নষ্ট করেছে।
তবুও আমরা স্বপ্ন দেখব। স্বপ্ন দেখার সাহস দেখাব।
আর চিত্ত? ভয়শূন্যই থাকবে। ভারতও নিজের স্বর্গ ছিনিয়ে নিয়ে জাগরিত হবে। আবার, আরও দৃঢ়ভাবে।
শনা সিং বল্ডউইন (লেখক)
স্বাধীনতার ইয়ার্স ও চিয়ার্স
অগাস্ট ১৪/১৫
জীবন বাজি রেখে যাঁরা অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করলেন,
তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে….
পঞ্চাশ লক্ষ ভারতীয় ও পাকিস্তানি যাঁদের রক্ত দিয়ে কেনা হয়েছে স্বরাজের স্বাদ,
তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে….
দেড় কোটি বাঙালি ও পাঞ্জাবি যাঁরা ছিটকে গিয়েছেন র্যাডক্লিফ লাইনের খামখেয়ালিপনায়,
তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে….
যুদ্ধের ময়দানে অপহৃত মা-বোনেরা, যাঁদের পরিবার ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেছে,
তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে…
পরিবারের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে যে পুরুষেরা প্রাণ দিয়েছেন,
তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে….
দেশভাগের পরবর্তী প্রজন্মদের আশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর খিদেকে অভিনন্দন জানাই।
থ্রি চিয়ার্স ফর ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। অনেকটা পথ তারা পেরিয়ে এসছে, কিন্তু এখনও তারা তরুণ।
আরও বড় হোক, শান্তিতে বড় হোক।
সৌম্য রায় (লেখক)
আকাশকুসুম কল্পনা করাটা আমার বরাবরের বদভ্যাস। এরকমই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একদিন মনে হল, নিজের ভাবনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে ইচ্ছেমতো গড়ে তোলার সুযোগই বোধহয় স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে, ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কী আশা, কী আমি চাই— এসব ভাবলে আমার সেই সাফাইকর্মীদের কথাই মনে পড়ে, যাদের সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম। এই ঝকঝকে তকতকে ভারতের অনতিদূরেই দাঁড়িয়ে আছে আমার-আপনার পরিচিত সাফাইকর্মীরা। তারাও এই দীপ্যমান ভারত দেখতে পায়, কেবল কিছুতেই যেন ছুঁতে পারে না, ছোঁয়াটা সাধ্যের বাইরে থেকে যায়। অথচ তারাই এই ঝাঁচকচকে স্বাধীন আবর্জনা এককাট্টা করে।
এই আলো-আঁধারির ভারত আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার আদর্শবাদী সংবিধান, গান্ধীজির রক্ষাকবচের কথা। মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে আমাদের প্রত্যেকটা স্বপ্নপূরণ হয় নিপীড়িতদের স্বপ্ন ভাঙার বিনিময়ে। সব শেষে মনে পড়ে দেবী দুর্গার চরণে উপাসিত সেই পৌরাণিক শ্লোক, যা আজও আওড়ে থাকি প্রত্যেক রাতে—
‘অন্ধকারের অতলতায় তুমি তাদের নির্ভীক আলো দাও। কঠিন সময়ে তাদের ভয়মুক্ত করো। আলোর রোশনাইয়ে আনো পবিত্র চেতনা। তুমিই তো সেই মমতাময়ী মা, যে তার ছেলেমেয়ের কাছে ধরা দেয় দুর্গতিনাশিনী রূপে? আর দুঃখ, দারিদ্র, ভয় বধ হয় নিমেষে তোমারই হাতে।’
স্বাধীন মাতৃভূমির কাছে আমার কামনা তার সন্তান-সন্ততিরা যেন সুদূরপ্রসারী কল্পনার ভেলায় ভাসতে পারে, সেই ভেলা নিয়ে যেতে পারে আনন্দলোকে। যেখানে নেই দুঃখ, নেই কষ্ট, নেই ভয়ভীতি, নেই বঞ্চনা। নেই দারিদ্রের অন্ধকার।
শ্রুতি গাঙ্গুলি (লেখক, চিত্র-পরিচালক)
সূচনার উপাখ্যান
ঢালাই বেদির ওপর দাঁড়িয়ে ছোট্ট মেয়েটার হাত তখন থরথর করে কাঁপছে। গ্রীষ্মের চড়বড়ে গরম বইছে স্কুলের ধুলোময় প্রাঙ্গণে। আর বেদির ওপর দাঁড়িয়ে সেই শ্যামলা মেয়েটা। হাতে তার কাগজ, তাতে নিজেরই হাতের লেখা। প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের গায়ে ঘামে ভেজা সাদা জামা ও স্কার্ট-প্যান্ট। দিনটা ১৫ অগাস্ট, ওমানের মাসক্যাট শহরের ইন্ডিয়ান স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের আমেজ।
নাটক ও আবৃত্তিতে সেই মেয়ে একেবারে পারদর্শী। দর্শককে হাসাতে, আনন্দ দিতে ওস্তাদ। কিন্তু এখন মঞ্চে উঠে রীতিমতো জড়সড়। এ যে একদম নতুন অভিজ্ঞতা! স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় সে জয়ী হয়েছে। কিন্তু সে লক্ষই করেনি পুরস্কারের অন্যতম অংশটি : যে এই প্রতিযোগিতায় জিতবে, তাকে স্কুলভর্তি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সামনে পুরস্কৃত সেই লেখা পড়ে শোনাতে হবে। নাহ, এবার আর উইলিয়াম শেক্সপিয়র বা আলফ্রেড নয়েজের লেখা বা ডায়লগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তো যাবে না। এবার তাকে নিজের লেখাই পড়ে শোনাতে হবে। ফুটিয়ে তুলতে হবে তার অন্তর্নিহিত আবেগ।
দুরুদুরু বুকে সে যখন মাইক্রোফোনে কাছে গিয়ে পৌঁছল, সেই মাইক্রোফোনও যেন খানিক আনন্দেই ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ করে উঠল। যদিও তাতে তার কাঁপুনি থামছে কই। গলা শুকিয়ে কাঠ, চোখের কোনায় জল। দূর থেকে সমুদ্রের হাওয়া টিলা পেরিয়ে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে, আর ভাসিয়ে আনছে ক্যান্টিনে তৈরি হতে থাকা শিঙাড়ার গন্ধ। কেউ হিজাবের আড়ালে, কেউ বা হাতের জপমালা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে তখন, মন তাদের ছটফট। ওদিকে বাতাসে সমুদ্রের বালি তেলমাখা চুলের জেল্লা নষ্ট করবে বলেও যেন উঠেপড়ে লেগেছে।
তারপর, গলা-খাঁকারি দিয়ে মেয়েটা তার গলাটা ঠিক করে নিল। অনুভব করতে পারল— সে তার দেশকে ভালবাসে, হোক না সে প্রবাসী। সমাবেশের দিকে তাকিয়ে সে তার লেখা পাঠ করতে শুরু করল।
সৌজন্যে : https://pen.org/india-at-75/