মিস্টার বাটরাকে মনে আছে? হগ সাহেবের মার্কেটে ফেলুদার সাথে পরিচয় করতে এসেছিলেন ভদ্রলোক। সমস্যা তাঁর মতো অবিকল দেখতে আর একজনকে নিয়ে, যে তাঁর নাম চুরি করে নানাবিধ অপকম্ম করে বেরোচ্ছে। এই আসল এবং নকল মিস্টার বাটরার রহস্য যে আদতে ধাপ্পা— সেটা যে ফেলুদা বুদ্ধি খাটিয়ে সমাধান করেছিল, সে-কথা তো ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’র দৌলতে আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা অপরাধীর ‘আই ওয়াশ’ হলেও আসলে পৃথিবীতে দুজন মানুষের এমন ‘লুক অ্যালাইক’ হওয়া একেবারে অসম্ভব নয়।
Doppelgänger হল আদতে একটা জার্মান শব্দ। Doppel-এর অর্থ দ্বৈত আর Gänger মানে চলমান। দুইয়ে মিলে অর্থ দাঁড়ায়— দুইজন মানুষ, যারা কিনা একে অপরের ‘ট্রু কপি’— সমদর্শী। না, যমজ ভাইয়ের কথা বলছি না— এই দুজন হলেন একেবারে নিঃসম্পর্কিত দুই ব্যক্তি, যারা ঘটনাচক্রে হুবহু একই দেখতে।
বেশ আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না? যমজ ভাই বা বোনেরা নাহয় একই বাপ-মায়ের সন্তান। একই সাথে মাতৃজঠরে জিন ভাগাভাগি করে ভ্রূণ থেকে পরিণত হয়ে ওঠা। কিন্তু দুজন নিঃসম্পর্কিত মানুষ? তাদের কি কাকতালীয় ভাবে ডিএনএ-র গঠন মিলে গেছে? তার ফলেই এমন একে অন্যের ফোটোকপি হয়ে যাওয়া?
সম্প্রতি স্পেনের বার্সেলোনার লিউকোমিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটের একদল বৈজ্ঞানিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন এই প্রশ্নের। গোটা ব্যাপারটা শুরু হয় ফ্রাঁসোয়া ব্রুনেল নামে এক কানাডিয়ান ফোটোগ্রাফারের সৌজন্যে। ভদ্রলোকের আলোকচিত্রের বিষয়টা অন্যান্য আলোকচিত্রশিল্পীদের থেকে অনেকটাই আলাদা। উনিশশো নিরানব্বই সাল থেকে গোটা পৃথিবীজুড়ে তুলে বেরিয়েছেন কেবলমাত্র Doppelgänger-দের ছবি। তাঁর এই প্রোজেক্টের পোশাকি নাম : I’m not a look-alike! হঠাৎ এমন বিষয় নিয়ে ছবি তোলার শখ কেন হল? মঁসিয়ে ব্রুনেল আবিষ্কার করেন যে, তাঁর মুখের সাথে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় অভিনেতা রোয়ান অ্যাটকিনসনের মুখের অসম্ভব সাদৃশ্য। ব্যস, মাথায় চেপে বসল এমন বিষয়কে ভিত্তি করে ফোটোগ্রাফিচর্চার বাতিক। ব্রুনেলের নিজস্ব ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, তাঁর এই সমস্ত সমদর্শীদের ছবির সংগ্রহ।
লিউকোমিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডক্টর ম্যানেল এস্টেলার এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিকরা ব্রুনেলের এই সংগ্রহ থেকে বত্রিশ জোড়া এমন সমদর্শী মানুষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের মুখের ছবি সংগ্রহ করলেন। সাথে অবিশ্যি ছিল একখানা প্রশ্নপত্র। সেখানে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অভ্যাস নিয়ে। এই বত্রিশ দু-গুণে চৌষট্টিজন মানুষের অধিকাংশই এসেছিলেন উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পাঁচজন, আফ্রিকা এবং এশিয়া থেকে একজন করে।
এবার প্রশ্ন হল, দুজন মানুষকে সমদর্শী তো মনে হচ্ছে, কিন্তু তারা কি সত্যিই তাই? মানে, ধরুন আমার আপনার চোখে দুজনকে দেখে বেশ একইরকম লাগছে, কিন্তু এই আধুনিক জগতের উন্নততর টেকনোলজির সার্ভিল্যান্স কম্পিউটারের চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়! মানুষের মুখের হাই-রেজোল্যুশন ছবির প্রতিটি বর্ণ-বিন্দু বা পিক্সেলকে বিচার করে কম্পিউটার বিচার করে দুই মানুষ এক না কি আলাদা! সূক্ষ্মতম পার্থক্য পেলেও কম্পিউটার এদের সমদর্শীতার স্কোর বা সাংখ্যমান একশো শতাংশ থেকে কমিয়ে দেয়। এরা কি সেই অত্যাধুনিক কম্পিউটারের ফেসিয়াল রেকগনিশন সিস্টেমকেও বোকা বানাতে পারছে?
এমন তিন ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যারা মানুষের মুখ চিনতে ওস্তাদ, তাদের দিয়ে চলল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার। পরীক্ষার পর বত্রিশ জোড়ার মধ্যে ষোলো জোড়া পাশ মার্ক পেল। বাকিরা কম্পিউটারের চোখকে ফাঁকি দিতে না পেরে খেলা থেকে বাদ। যারা উতরে গেল, পরের পর্যায়ে সংগ্রহ করা হল তাদের লালার নমুনা। এবার এই লালার নমুনা থেকে তাদের ডিএনএ-র গঠন নিয়ে পরীক্ষা করবেন বৈজ্ঞানিকরা। এই পরীক্ষায় পাশ করে গেলেন নয় জোড়া সমদর্শী মানুষ। তিন হাজার সাতশো তিরিশ রকমের জিনের মধ্যে উনিশ হাজারেরও বেশি সাদৃশ্য! বৈজ্ঞানিকরা একবাক্যে বললেন, আপনাদের তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে, মশায়েরা!
শুরুতে জমা নেওয়া প্রশ্নোত্তরে চোখ বুলিয়ে দেখা গেল, এই নয় জোড়া মানুষের প্রতি জোড়া মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম, শরীরের ওজন, পড়াশোনার দৌড়, অভ্যাস-অনভ্যাসের মধ্যেও রয়েছে আশ্চর্য মিল। কিন্তু বংশলতিকায় বেশ কিছু পুরুষ আগে পর্যন্তও নেই কোনও আত্মীয়তার আভাস।
অতএব মানুষকে কেমন দেখতে হবে, তার পিছনে জিনই বলবে শেষ কথা। পরিবেশ, পরিস্থিতি, অভ্যাস— সব কিছুর প্রভাব এই ক্ষেত্রে গৌণ। এই কারণেই আফ্রিকা মহাদেশের এক ব্যক্তির সাথে কলকাতায় বসে থাকা আপনার বা আমার মুখের মিল খুঁজে পাওয়া খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হল, দুজন একদম আলাদা মানুষের শরীরে এই এত হাজার-হাজার জিনের হাজার-হাজার বৈশিষ্ট্যর মধ্যে ঠিক কীভাবে একই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট হয়ে উঠল— যা তাদের একে অন্যের সমদর্শী করে তুলল! এই ‘কীভাবে’র উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না জানা নেই। প্রকৃতির বুকে এমন অনেক খেলাই তো ঘটে চলে— কেউ বলেন কাকতালীয়, কেউ বলেন ম্যাথামেটিক্স, কেউ বা ঈশ্বরের উপর দায় সঁপে দিয়েই শান্তি পান।
তাহলে এমন doppelgänger-দের দিয়ে কি ভবিষ্যতে সমাধান হতে পারে অপরাধ বিজ্ঞানে অপরাধী শনাক্তকরণের মতো বিষয়? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে। এস্টেলার সে-সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি একেবারে। ফেরার অপরাধীর যদি একজন সমদর্শী পাওয়া যায়, তার স্বভাবচরিত্র বিশ্লেষণ করে অপরাধীর স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে ধারণা করা যেতেই পারে, বলে তাঁর বিশ্বাস। এর ফলে ফরেনসিক বিজ্ঞানে আসতেই পারে এক বিপ্লব। এর অবিশ্যি বিপরীত মতও আছে। অন্যান্য বৈজ্ঞানিকরা এর প্রয়োগের নৈতিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইতিমধ্যেই। তাদের মতে, এর ফলে সমস্যা হবে বৈষম্যের— চাকরিবাকরি থেকে কাউকে অপরাধী ঠাউরানো— সর্বত্রই প্রভাব পড়বে তার।
প্রয়োগ হবে কি হবে না, বা কতটা নৈতিক বা অনৈতিক— তা নিয়ে তো বিতর্ক চলবেই। কিন্তু এটা ভেবে মজা লাগে যে, আমারই অজান্তে হয়তো আমার মতো একজন মানুষ রয়েছেন অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। এ-জীবনে হয়তো তাঁর সাথে দেখা হবে না। কিন্তু আমার জিন, আমার ডিএনএ বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বংশ পরম্পরায় সেইসব জিন বয়ে চলবে তাঁর বংশধরদের মধ্যেও। তাহলে দুইজোড়া সমদর্শী নারী এবং পুরুষ যদি বিয়ে করেন, তাহলে কি তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যেও doppelgänger হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে? দেখা যাক, হয়তো এর উত্তর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে।