টিনটিন-স্রষ্টা এরজে-র মতো বিখ্যাত ভূমিপুত্র কিংবা উল্লুস স্বাদের বেলজিয়ান চকোলেটকে আকর্ষণে টেক্কা দিয়েছে ব্রাসেলস শহরের যে-খুদে, কয়েক শতাব্দী প্রাচীন সেই হিসুরত শিশুর ব্রোঞ্চমূর্তি ‘ম্যানেকেন পিস’-এর নেপথ্যে রয়েছে কোন মিথ? ১৯৯৩ সালে মার্কিন মুলুকের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে কি সত্যিই মূত্রবোমা ব্যবহার করে আঘাত হেনেছিল সন্ত্রাসবাদীরা? উনিশ শতকে ভারতীয় পীতবর্ণের উৎস খুঁজতে গো-চোনা নিয়ে কী গবেষণা করেছিলেন আমাদের ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়? শরীর থেকে দু-চার ঘণ্টা অন্তর যে-তরলটিকে অবজ্ঞাভরে বের করে দিয়ে হালকা হই আমরা, তাকে ঘিরে গপ্পগাছা কিংবা ঘটন-অঘটন দুনিয়ায় কম নেই। বিস্ময়কর সেইসব মূত্রসূত্রের হদিশ মিললে প্রশ্ন তো জাগবেই, তাহলে কি ‘ছোট কাজ’ ব্যাপারটা মানুষের জীবনে সত্যিই অত ছোট নয়?
ছোট বাইরে নিয়ে গান বাঁধতে বাঙালিকে দেখা গিয়েছে। ‘একদিন সুন্দর সকালে / এরকমই নামিদামি স্কুলে / থার্ড পিরিয়ডে দেখা গেল এক ছাত্র / ছোট্ট করে আঙুল তুলে’। চন্দ্রবিন্দু-র ‘বাথরুম’ গানটির মতো সাম্প্রতিক অতীতের ‘হাওয়া বদল’ সিনেমাতেও মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে প্রকৃতির ডাককে কেন্দ্র করে। বাংলা কবিতায় কখনও এই প্রসঙ্গ এসেছে রূপক কি উপমা হয়ে, কখনও সরাসরি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন লিখেছিলেন, ‘রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায়— / থুতু ও পেচ্ছাপ সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে—’। বিনয় মজুমদার লেখেন, ‘মাঝে-মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে / প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝ’রে যাবে।’ কিন্তু এই প্রস্রাব বিষয়ক গোটা কোনও বই? নাহ্, বাংলায় তেমন ইউরিন কালচার দেখেছি বলে খেয়াল পড়ে না। কাজেই হাতে যখন এসে পড়ল এমন দু-দুটি মূত্রাধার, তখন আর চেপে রাখা গেল না উত্তেজনা।
বিষয় যেমন ছোট বাইরে, বই দুটি তেমনি সাইজেও ছোট, আঁটোসাঁটো। একটির ভাষা ইংরাজি, আরেকটি চেক ভাষা থেকে ইংরাজিতে অনূদিত। প্রথমটি স্কটিশ সাংবাদিক স্যালি ম্যাগনুসন-এর লেখা ‘লাইফ অফ পি: দ্য স্টোরি অফ হাউ ইউরিন গট এভরিহোয়্যার’ (২০১০)। ইংরাজি বর্ণমালার আদ্যক্ষর অনুযায়ী সাজানো বিবিধ বিচিত্র বিষয়ের সমাহারে এই বই যেন এক মূত্রাভিধান! দ্বিতীয় বইটি ‘দ্য বিগ বুক অফ পিইং’ (২০১৫), রচনা ও অলংকরণ প্রাগ শহরের তরুণ শিল্পী য়াকুব প্লাখি-র। মূল চেক সংস্করণ ‘Velká Kniha Čůrání’ থেকে ইংরাজি তরজমা করেছেন অ্যানা লর্ড্যান এবং অ্যান্ড্রু ল্যাস। ছোট-ছোট ক্যাপশনধর্মী লেখা আর মজাদার ছবিতে বিন্যস্ত বইটি এক কথায় প্রস্রাবের এনসাইক্লোপেডিয়া! কালো কালিতে হাতে লেখা ও আঁকার ‘ক্যাসুয়াল’ ঢং বজায় রেখে বইটি তৈরি হয়েছে; ক্ষেত্রবিশেষে কেবল একটিই রঙের একেবারে যৎসামান্য ব্যবহার। তুখোড় দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঝকঝকে মূত্রহলুদ বর্ণের এই মিনিমালিস্ট প্রয়োগ বইটিকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। সব মিলিয়ে শুকনো তথ্য বলতে এখানে এটুকুই। বাকি পুরোটা, মলাট-টু-মলাট ভিজে চুপচুপে, তথ্যরসে টসটসে।
কেমন সেইসব আর্দ্র তথ্যের বৈচিত্র্য? খান কতক নমুনা দেখা যাক। সপ্তদশ শতকে আ্যালকেমি বা কিমিতিচর্চায় মানুষের মূত্র নিয়ে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। মূত্র থেকে সোনা তৈরি করতে গিয়ে কীভাবে বিস্মিত করে মিলেছিল আলোকবাহী ফসফরাস, সেই বৃত্তান্ত দিয়ে শুরু হয়েছে ম্যাগনুসনের আভিধানিক প্রয়াস। আধুনিক রসায়নের জনক রবার্ট বয়েলের প্রসঙ্গও সেখানে উঠে এসেছে। আবার গত শতকের শেষদিকে এডিনবরা ফেস্টিভ্যাল কেমন সাক্ষী ছিল মূত্রসংগীতের, টানা একটি সন্ধ্যা ড্রামের উপরে মূত্রত্যাগ করে সুরসৃষ্টি করে গিয়েছিলেন ক্রাইস্টচার্চের শিল্পী জন কাজিন্স, স্বীকৃত হয়েছিলেন প্রথম ‘মূত্রশিল্পী’ হিসেবে— বর্ণিত হয়েছে সেই বিচিত্র ঘটনাও। প্লাখি-র সাইক্লোপেডিয়াও এমন সব বৈচিত্র্যময় তথ্যে ভরপুর। অধিক ঘর্ষণে কড়া যাতে না পড়ে, সে-কারণে বেসবল খেলোয়াড়দের হাতে মূত্র মেখে নেওয়া কিংবা বিশেষ এক মার্কিন আদিবাসী গোষ্ঠীর পাঁচ মাস ধরে মূত্রে ফল ভিজিয়ে রেখে সুস্বাদু আচার তৈরি করা— মূত্র ব্যবহারের হরেক তরিকা উঠে এসেছে ছোটখাট হলদে বইটিতে।
মূত্রের ব্যবহার ছাড়া আরও পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে এই বইয়ে। মূত্রত্যাগ কী, মূত্র কী, মূত্রত্যাগের ইতিহাস, মানুষ কীভাবে মূত্রত্যাগ করে এবং চূড়ান্ত অবস্থায় মূত্রত্যাগ। এই শেষ পরিচ্ছেদটি বলেছে ‘কোনওমতেই আর চেপে রাখা গেল না’ অবস্থায় কার কর্মপন্থা কী হয়, সেই কথা! সাধারণ মানুষ থেকে সুমো পালোয়ান, ট্রাক ড্রাইভার থেকে মহাকাশচারী— ধরাধাম ও তার বাইরের আবহেও নানা গোষ্ঠীর কায়দা ধরা দিয়েছে। মূত্র বা প্রস্রাবের বিভিন্ন প্রতিশব্দ এবং মূত্রত্যাগের বিবিধ পদ্ধতি অবশ্য দুটি বইতেই কম-বেশি জায়গা পেয়েছে। একটিতে ছবি-সহ, আরেকটিতে ধরা হয়েছে মূলত তাদের উৎস বা ইতিহাসের দিকটি। কোনও-কোনও ক্ষেত্রে ভারতীয় অনুষঙ্গও উঠে এসেছে। তার মধ্যে শরীর রোগমুক্ত রাখতে মূত্রপানের বিষয় যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ইউরোপীয় চিত্রকলায় বিস্ময় সৃষ্টিকারী ‘ইন্ডিয়ান ইয়েলো’ রংটির ব্যাখ্যা। বিহারের মুঙ্গেরে গিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় যে-অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, দেখেছিলেন স্রেফ আমপাতা আর জল খাইয়ে রেখে দিনের পর দিন কীভাবে অত্যাচার করা হয় গোরুদের উপর, তারপর তাদের মূত্র থেকে প্রস্তুত হয় জমাট সেই উজ্জ্বল হলুদ রং, সংক্ষেপে এসেছে সেসব প্রসঙ্গও।
পানাহারের আসরে কড়া পানীয়ের সমর্থকদের কাছে বিয়ার-প্রেমীরা প্রায়শই ‘ঘোড়ার প্রস্রাব’ পানের জন্য গালমন্দ শুনে থাকেন। ‘বোতল-বোতল বিয়ার’ খাওয়া জার্মানিতে না হোক, পোড়া বঙ্গে অন্তত এই কাল্পনিক অপবাদের ব্যত্যয় দেখিনি। কিন্তু বিয়ার আর মূত্রের সম্পর্ক যে সত্যিই একদা তুমুল বিবাদের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, প্রস্রাবের জল গড়িয়েছিল একেবারে আদালত পর্যন্ত, সেই মূত্র-বিয়ার বিসংবাদ এই বই পাঠ না করলে জানতে পারতাম কি? হ্যানিকেন আর করোনা— দুই বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের লড়াই সেবার থেমেছিল মোটা অঙ্কের গ্যাঁটগচ্চার বিনিময়ে।
এসেছে মূত্রপানের সুপ্রাচীন কিংবদন্তিও। যেমন, সান্তা ক্লজের একটি মিথ বলছে, তিনি সাইবেরিয়ার ওঝা ছিলেন। লাল-সাদা ম্যাজিক মাশরুমের উড়ুক্কু নেশা চক্রাকারে শরীরে ধরে রাখতে নিজের মূত্রই নাকি বুড়ো নিজে পান করতেন। কিংবা জাদু মাশরুমের বিষক্রিয়া হ্রাস করতে বলগা হরিণ তা খাওয়ার পর, হরিণের মূত্র পান করতেন সান্তা। আর, সাইকেডেলিক নেশায় উড়ু-উড়ু ভ্রমণে মেতে উঠতেন। সে-কারণেই নাকি তাঁর কালার স্কিম লাল-সাদা, জাদু মাশরুমের পীঠস্থান হিসেবে পাইন গাছের গোড়ার প্রতীক ক্রিসমাস ট্রি এবং সেখানে বলগা হরিণের উপস্থিতি! বস্তুত, মূত্রের ইতিহাস, ভূগোল, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, এমনকী ভাষা ও সাহিত্যে তার ভূমিকা— মাইনাস করার কোনও পরিপ্রেক্ষিতই এখানে মাইনাস করতে চাননি লেখক।
কবি পুরন্দর ভাট লিখেছিলেন, ‘চারদিকে ছনছন / সারা গায়ে ঘিনঘিন / থই থই ছপছপ / ইউরিন! ইউরিন!’ এই পাঠের অভিজ্ঞতাও যেন অবিকল। কেবল সেখানে ‘ঘিনঘিন’ অনুভূতিটির চিহ্নমাত্র নেই। বরং যা আছে, তা ঘেন্নার ঠিক উলটো। বিষয়বস্তু থেকে নির্মাণ— সবেতেই বইদুটি তাক লাগিয়ে দেয়! যথেচ্ছ ট্যাবু গুলে হেলাফেলা করে ছুড়ে ফেলা বস্তুটির প্রতি তৈরি করে বিশেষ আগ্রহ। মানবশরীরের হাল বুঝতে বিবিধ পরীক্ষার মতো মূত্রের কেজো দিকটির কথা তো সকলেই জানে; কিন্তু তাকে ঘিরেও যে শিল্প-সংস্কৃতি চক্কর কাটতে পারে, সেই তরল সত্যের সরল হদিশ এখানে রয়েছে। শরীরের প্রয়োজনেই প্রাত্যহিক যাকে ত্যাগ করতে হয়, তাকেও কীভাবে আপন করে নেওয়া যায়, কানে-কানে সেই হিসিডাক শোনায় এই কিতাবদ্বয়। যেখানে তথ্য আছে, তথ্যের ভার নেই— দুইয়ে মিলে যেন টিপ করে পাঠকমনের দেওয়াল। নিরন্তর কাটাকুটি খেলে চলে দুষ্টু বালকের মতো।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
ছবি সৌজন্যে: লেখক