২০২২ সালে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখলাম। কিন্তু যে আশার আলোয়, যে প্রতিশ্রুতির ঘনঘটায় ভারত ‘স্বাধীন’ হয়েছিল সে-বছর, তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? এই দেশের মধ্যে যারা বসবাস করছি এই সময়ে, তারা আদৌ স্বাধীন তো? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই পেন আমেরিকা জানতে চেয়েছিল, বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য। ‘স্বাধীন’ বা ‘স্বাধীনতা’ শব্দগুলো নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন আজকের দিনে, তাঁরা তা জানিয়েছেন। সেই শতাধিক লেখকের শতাধিক ভাবনার কথাগুলোই এবার থেকে বাংলা অনুবাদে প্রকাশ পাবে ডাকবাংলা.কম-এ।
দামোদর মওজো (লেখক)
অঙ্কুর
একটা বই পড়তে-পড়তে, হঠাৎই একটা ভাবনা খেলল মনে। বেশ গভীর চিন্তাই। এমনই খিটিমিটি বাধল আমার চিন্তায় যে, ঘুমোতেই দিচ্ছিল না কিছুতে। তা সে যতই চেষ্টা করি না কেন, সে কিছুতেই আমাকে ছাড়ে না। শেষমেশ ঠিক করলাম, এই চিন্তাকে সঙ্গে নিয়েই আমি ঘুমোব।
সকালে ঘুম ভাঙল যখন, দেখি সেই চিন্তা বেশ অঙ্কুরিত হয়ে জেগে উঠেছে। আমি তো ঝটপট আমার বাড়ির সামনের উঠোনে ছুটে গেলাম, এই অঙ্কুরকে যদি রোপণ করা যায় বেশ, ভালই তো হয়। কিন্তু, মনে পড়ল, আমার উঠোনের মাটি তো তেমন উর্বর নয়। কিন্তু আমার পড়শির জমি বেশ উর্বর। তাছাড়া, সে বাগান করতেও ভালবাসে। তাই, আমি আর না ভেবে, বেড়া পেরিয়ে, যত্ন করে সেই অঙ্কুরিত চিন্তাবীজকে পুঁতে এলাম মাটিতে। আর, কী বলব, এত সুন্দর মাটি, বৃষ্টি আসার আগেই, সেই বীজ পর্যাপ্ত পুষ্টি পেয়ে একেবারে ডালপালা মেলতে শুরু করল। আর শিগগিরই গাছ হয়ে উঠল, তাতে ফুল, ফল। পড়শি তো খুব খুশি।
তারপর জানতে পারলাম, এবং জেনে অবাকই হলাম যে, সেই গাছের ফলে বেশ ওষুধের গুণ রয়েছে। তা থেকে অনেকরকম যন্ত্রণা, অসুস্থতার নিরাময় মিলতে পারে। ফলে, লোকজনের তো ভিড় বাড়ল পড়শির দরজায়। সবার অনুনয়, ‘আমায় দাও গো কিছু।’ আর পড়শিও বড় দিলদরিয়া মানুষ। কাউকে খালি হাতে ফেরায়নি। যখনই সে কোনও ছোটখাটো নেমন্তন্ন বা গণসমাবেশে যেত, সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিত সেই ফল।
ক্রমশ এই ফলের খবর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। হু-হু করে ছড়িয়ে যেতে লাগল, দিনাদিনি, রাতারাতি। যার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে, ঠিকমতো দেখতে পায় না, এই ফলের গুণে, তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল চমৎকার ভাবে। অস্থিরমনা মানুষ জীবনের মানে খুঁজে পেল সেই ফলের মহিমায়। রাস্তায় চলতে অসুবিধে হত যার, এই ফলের দাক্ষিণ্যে সে এখন দেখতে পাচ্ছে কী আসতে চলেছে আগামী পথে। জ্ঞানের জানলায় মরচে ধরে গেছিল যার, তার বুদ্ধির চাকা গড়গড়িয়ে গড়াতে শুরু করল সেই ফলের কৃতিত্বে। এমনকী যার প্রচণ্ড মাথা ধরে থাকে সারাক্ষণ, তার মাথা ছেড়ে গেল চিরকালের মতো।
আমি তো চমকে গেলাম, মাননীয় অমুকবাবু, কুটিলতায় যার যাবতীয় নামডাক, সে এখন দিব্য মিশুকে হয়ে গিয়েছে তমুকবাবুর মতোই। এমনকী, হ্যালাবাবু আর ফ্যালাবাবু, যাদের মুখে কখনও খারাপ ভাষা ছাড়া খোলে না, তাদের মুখ থেকে এখন মধু ঝরছে রীতিমতো।
তা সেই ফল ফেসবুকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার বহু আগেই, দিন-কে-দিন তার গুচ্ছ-গুচ্ছ ফলোয়ার বাড়তে লাগল।
কিন্তু যা হয়, সমস্ত ভাল জিনিসকে ঘিরেই কিছু বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে থাকে। তেমনই, ক্রমশ এই ফলকে ঘিরে ভুরু কুঁচকানির সংখ্যাও বাড়তে লাগল।
কারও সেই ফলের গন্ধ পাওয়া মাত্র পেট কামড়াতে শুরু করল। কারও বা বদহজম হয়ে গেল ফল খেয়ে। কারও বা মাথার ব্যথা বেড়ে গেল আরও দ্বিগুণ। কারও বা ফলের গন্ধ পাওয়া মাত্র বমি হতে শুরু করল। কারও-কারও আবার ঘুমই উড়ে গেল সেই ফল খেয়ে।
পরিস্থিতি ক্রমশ দুর্বিপাকের দিকে বেঁকে যাচ্ছে দেখে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা সিদ্ধান্ত নিল আমার পড়শির সঙ্গে দেখা করবে এবং কিছু মত প্রকাশ করে আসবে। তারা বলল, এই ফল কাউকে দিতে যাবেন না, এমনকী লোক চাইলেও দেবেন না। লোকে যেন নিয়ে যেতেও না পারে। কিন্তু আমার পড়শি তাদের কথায় আমল দিল না দেখে, তাদের মাথায় খুন চেপে গেল। এই ফলকে এবার নিষিদ্ধ করতে হবে, ছক কষল তারা।
গুজব ছড়িয়ে দিল তারা, এই ফলের গাছ আসলে পাশের শত্রু দেশ থেকে চুরি করে আনা। মানুষ যাতে আমার পড়শির ওপর খাপ্পা হয়ে যায়, যাতে ট্রোল করে, তার জন্য এই ফন্দি আঁটল। ব্যস। দেশভক্তদের তো ভাষণস্পৃহা জেগে উঠল— এমন দেশদ্রোহী কার্যকলাপ আমরা, আমাদের এই ভারতপ্রেমী সেনা, মেনে নেবে না!
পড়শিকে শায়েস্তা করার ছক কষতে শুরু করল তারা। আর সেই সময়, আমি কাছ থেকে লুকিয়ে শুনতে পেয়ে গেলাম সমস্ত পরিকল্পনা। আমি তখন পড়শিকে ডেকে সাবধান করলাম, সতর্ক থাকতে বললাম। সে ঈষৎ হেসে উড়িয়ে দিল গোটা ব্যাপারটাকেই।
কিছু পরেই, আমার পড়শির এলাকায়, মাঝরাতের দিকে ভয়ানক দুমদাড়াক্কা আওয়াজ পেলাম। আমার তো শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, যখন বুঝতে পারলাম, প্রায় ট্রাকভর্তি লোক এসেছে সেখানে। আমি কানে ইয়ারফোন গুঁজে ঘুমনোর চেষ্টা করলাম। মনে-মনে চাইলাম, আমার পড়শিও যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। কিছুমাত্র সময় গেল না, আঁচ করতে পারলাম, ফুলকি ছুটছে আগুনের। কাঠ ফাটছে আগুনের চোটে। আর সেই তাপ আমি অনুভব করতে শুরু করলাম। কী হল? পড়শির বাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দিল না তো?
প্রায় অনেকক্ষণ পরে, প্রায় ভোররাত নাগাদ, আমি শুনতে পেলাম, হইহই থামল।
তবু আমার ঘুম এল না চোখে। বইটার মধ্যে যে চিন্তা আমি পেয়েছিলাম, তা আমাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। পরের দিন পরিস্থিতি বুঝে, আমি চুপচাপ পড়শির ঘরে গেলাম। অবসন্ন মনে সে বসে আছে। এবং, তার ঘর নয়, জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে ওই গাছ।
‘এর চেয়ে তো আমাকেই মেরে ফেলতে পারত ওরা। কেন ওই নিরীহ গাছটাকে মারল? ফল, ফুল, শেকড় সবশুদ্ধু জ্বালিয়ে খাক করে দিল ওরা।’ পড়শি গোঙাচ্ছিল বলতে-বলতে। আমি তার চোখের জল মুছে দিলাম। তারপর সেই গাছের দিকে বিন্দুমাত্র উঁকি অবধি না মেরে বেরিয়ে এলাম তার ঘর থেকে।
ঘরে ফিরলাম যখন, আমার মনের ভিতর কী যেন একটা খচখচ করে উঠল। খুব ভাল করে কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখলাম। ইউরেকা!
কাল রাতে যে চিন্তাটা আমাকে অস্থির করে মারছিল, সে আবার অঙ্কুর গজিয়েছে।
রিয়া কির্তানির ‘কোঙ্কনি’ থেকে অনূদিত
সুকেতু মেহতা (লেখক, অধ্যাপক)
ট্রেন থেকে বাড়ানো হাত
বম্বে সাবার্বান রেলওয়ের অধিকর্তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, লোকাল ট্রেনে এক কোটি নিত্যযাত্রী কবে কিছুটা স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারবেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ-জন্মে নয়।’ মুম্বইয়ের ট্রেনে যদি আপনি চড়েন, একদম হাড়ে-হাড়ে টের পাবেন, মানুষের গা থেকেও কীরকম তাপ বেরোয়! একেবারে ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি ভিড়ে আপনার শরীরের প্রতিটি অংশকে পেঁচিয়ে রাখবে অন্যদের শরীরের অংশ, প্রেমেও এমন ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গন জোটে না!
আমার বন্ধু আসাদ বিন সইফ ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। শহরের বিভিন্ন বস্তিতে ক্লান্তিহীন ঘুরে বেড়িয়ে অসংখ্য দাঙ্গা ও ধর্মীয় হানাহানির খবর সে সংগ্রহ করে। নাগরিক ভারতে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ যে প্রবলভাবে বিপন্ন, তার একদম চাক্ষুষ সাক্ষী আসাদ। ওর সাকিন বিহারের ভাগলপুর। শহরটি শুধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য কুখ্যাত নয়, এখানেই পুলিশ কয়েকজন কয়েদির চোখে ছুঁচ আর অ্যাসিড দিয়ে তাদের অন্ধ করে দিয়েছিল। আসাদ মানুষের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো খুব ভাল করে জানে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, মানুষ জাতটা সম্পর্কে ভাবলে হতাশ লাগে না? আসাদ বলল, ‘কক্ষনও না, শুধু ট্রেন থেকে বেরিয়ে আসা ওই হাতগুলো দ্যাখো।’
ধরুন আপনি কাজে যাবেন, একটু দেরি হয়ে গেছে, মুম্বইয়ের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলেন যখন, ট্রেন এই সবে স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আপনি পড়িমরি করে ট্রেন ধরতে ছুটলেন। দেখবেন, ভিড়ঠাসা কামরার দরজা থেকে কিছু হাত আপনাকে তুলে নিতে বেরিয়ে আসছে, ফুলের পাপড়ির মতো। আর দরজার সামনে পা রাখার জন্য একচিলতে জায়গাও ঠিক জুটে যাবে। বাকিটা আপনার উপর নির্ভর করছে, হয়তো আপনাকে দরজার কোনাটা খামচে ঝুলতে হবে, অথচ শরীরটা এতটা ঢুকিয়ে রাখতে হবে যাতে লাইনের ধারে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা না লাগে। কিন্তু আরেকবার পরিস্থিতিটা চিন্তা করুন। আপনার সহযাত্রীরা এমন গাদাগাদি করে যাচ্ছে, যেমনটা গরুদেরও নিয়ে যাওয়া হয় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে ওই তুমুল ভিড়ে, যেখানে শ্বাস ফেলার জায়গাও প্রায় নেই। ঘামে ভিজে একশা। সেখানে আরেকটা তিল ঠাঁইয়ের জায়গা মাত্র নেই, এবং একটা মানুষকে জায়গা দেওয়া মানে আরওই হাঁসফাস। তবু আপনার জনন্য সহমর্মী হয়ে উঠল তারা। কারণ জানে যে, আপনি ট্রেন মিস করে লেট হয়ে গেলে আপনার অফিসের বস আপনার ওপর চোটপাট করতে পারে, হয়তো-বা মাইনেও কাটতে পারে আপনার। তাই তারা যেভাবে হোক আপনাকে টেনে নেওয়ার আয়োজনে লেগে পড়ে। হাতগুলো ভাবে না আপনি হিন্দু মুসলমান না খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ না শূদ্র, মালাবার হিলে থাকেন না যোগেশ্বরীতে। এমনকী, আপনি সাবেক বম্বের বাসিন্দা না কি ঝাঁ-চকচকে মুম্বইয়ের লোক, না কি আপনি নিউ ইয়র্ক থেকে আগত। কোনও কিছু নিয়েই তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা কেবল জানে, আপনি এই সোনার শহরে রুটিরুজির খোঁজে এসেছেন, এবং সেটাই যথেষ্ট। বেরিয়ে আসা হাতগুলো বলে ওঠে, ‘উঠে পড়ো ভায়া, আমরা ঠিক মানিয়ে নেব।’
সুজাতা গিদলা (লেখক)
৭৫ বছর আগে, ১৯৪৭ সালেই, আমার মামা সত্যমূর্তি, ১৬ বছর বয়সের এক ‘অস্পৃশ্য’ ছেলে, কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। পরিবারে এই প্রথম কেউ কলেজে ঢুকল। স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দ উদযাপন করল ক্যাম্পাসে, ভাল জামাকাপড় পরে। সরল মনে ভাবল, ব্রিটিশরা চলে গেছে, আর দারিদ্র থাকবে না, জাতপাতের শোষণও শেষ হয়ে গেল। বহু নীচুতলার মানুষই সেদিন এমনটাই ভেবেছিল, যদিও লাখ-লাখ মানুষকে রক্তক্ষয়ী দেশভাগের দরুন উদ্বাস্তু হতে হচ্ছিল। এখন, ভারতের স্বাধীনতাপূর্তির অমৃত মহোৎসবের বছর, দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গরিব। জাতিগত হানাহানিও তুমুল, মুসলমান ও খ্রিস্টানেরা অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন, তিস্তা শেতলবাদ এবং ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ফাঁসানো মানবাধিকার কর্মীরা প্রবল নিপীড়নের শিকার। ভারতবাসীর স্বপ্নের সেই স্বাধীনতা আজও অধরা।
সুচিত্রা বিজয়ন (লেখক, সমাজকর্মী, আলোকচিত্রী)
বয়স ২১
আমাকে গ্রেফতার করা হল একটা কাগজের জন্য।
কোনও শব্দ ছিল না সেখানে, শুধু একটা সাদা কাগজ।
আমার অপরাধ?
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা,
শব্দক্ষয় না করে শান্তি বিঘ্নিত করা,
এবং অনুমতি ছাড়া প্রতিবাদ করা।
মাথার ওপর সাদা কাগজ ধরে এক রাস্তার ধারে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম।
কে জানত, নীরবতাকেও সেন্সর করা যায়?
বয়স ৩২
শান্তির পক্ষে প্রতিবাদকে বলা হল ‘ঘৃণাবাচক ভাষণ’।
অপরাধ? ন্যায্য মর্যাদা দাবি করা।
গ্রেফতার এবং জামিন অস্বীকার।
বয়স ৫৫
একটি সরকারি নির্দেশে বলা হল, কোনও মৃত্যুর নথি নেই,
কেউ মারা যায়নি।
মৃতদেহ মৃত্যুর প্রমাণ নয়।
তথ্য মানেই দেশদ্রোহ।
বয়স ৩১
স্মৃতি হয়ে উঠল বাড়তি বোঝা।
নথি-রক্ষক? অদৃশ্য।
লেখক? অন্তর্হিত।
কবি? অন্তর্হিত।
সাংবাদিক? অন্তর্হিত।
চারণ কবি? নির্বাসিত।
সত্যকে দুমড়ে-মুচড়ে বদলাতে চাইলে এটাই তো ঘটে।
বয়স ৪৬
পাথর ছোড়ার অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা হল,
আর তারপর, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল তার বাড়ি।
কোনও আইন অনুমতি দেয়নি।
কোনও বিচারক বা জুরি বা তথ্যের ভূমিকাই ছিল না।
শাস্তি দেওয়া হল এমন এক অপরাধের জন্য যা সে করেনি।
কারণ, তার হাতই ছিল না যে পাথর ছুড়বে।
আর রাষ্ট্র বলল, এটা ‘বুলডোজিং জাস্টিস’।
বয়স ৫৭ এবং ৬০
ন্যায়বিচার চাওয়ার অপরাধে একজনকে জরিমানা করা হল।
আরেকজনকে পাঠানো হল জেলে।
মহামান্যরা গুলিয়ে ফেললেন,
কোনটা রায়, কোনটা প্রতিহিংসা…
বয়স ৭১
কোনও প্রতিবাদের উদ্দেশ্য ছাড়াই আমি গিয়ে দাঁড়ালাম রাস্তার এক কোণে।
ওরা আমায় গ্রেফতার করল।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
সনোরা ঝা (লেখক, অধ্যাপক)
ভারত, তোমার কি আমার জন্য তেমনই মনকেমন করে, যেমন আমার তোমার জন্যে? এক সময় আমি ছিলাম তোমার বাধ্য মেয়ে, এখন কি ঘরপালানো অবাধ্য বোন? না কি আমিই তোমার মা, যে মেয়েকে দেখে খুব ঘাড় নাড়িয়ে চলেছে, আর বলছে বটে ‘এক থাপ্পড় মারব’, কিন্তু কক্ষনও তা করছে না, আর ভালবাসা পেরিয়েও ভালবেসে চলেছে একটা দপদপে হৃদয় দিয়ে, এবং ভাবছে, শুধু যদি নিজে নিজেকে টেনে না নামায় এ বহুদূর যাবে? আমি কি সেই সাংবাদিক হব, যে তোমার সেরা গল্পগুলোকে তুলে ধরবে? না কি, সেই সাংবাদিক, যে সত্যিকথা বলেছে বলে কয়েদ হবে? না কি হব তোমার নারীবাদী মেয়ে, যাকে তুমি সুরক্ষা দিতে পারো না, ‘বেটি বাঁচাও’-এর আওতায় যাকে ধরো না? তাহলে কি আমরা এবার হাতে হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে পারি সেই ‘অন্য’দের খোঁজে, যাদের তুমি পুড়িয়ে মেরেছ, যাদের অধিকার মানোনি, যাদের তাড়িয়ে দিয়েছ?
৭৫ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে, তুমি কি আমার যোগ্য হয়ে উঠেছ? আমিও কি হতে পেরেছি তোমার যোগ্য?
যদি ফিরে আসি, তুমি কি আবার আমায় নির্বাসিত করবে, তোমার সীমানার মধ্যেই?
সৌজন্যে : https://pen.org/india-at-75/