টুকি! তোমার ঘরে ঢুকি?
বাংলা সিরিয়ালে সব হাট করে খোলা, বাড়ির সদর-দুয়ার, বা দম্পতির শয্যাকক্ষ। বাড়িতেও যে-সে যখন-তখন ঢুকে পড়ে, অভিযোগ জানায় বা চক্রান্ত শানায়, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মধ্যেও হনহনিয়ে অন্য লোকে নাক গলায় ফুট কাটে দোষ ধরে। হিন্দি সিরিয়ালে এক বড়লোকের মেয়ে (অর্থাৎ শয়তান) একটা গরিব বাড়িতে (অর্থাৎ ভাল লোকের বান্ডিল-মধ্যে) বউ হয়ে এসেছিল, তারপর জঘন্য নীচ চাহিদা ও দাবিসমূহ পেশ করতে থাকে, যেমন, সে তার স্বামীর সঙ্গে বন্ধ ঘরে কথা বলবে। অচিরেই স্বামী রুখে দাঁড়ায় এবং বলে প্রকৃত ভদ্র সংসারে কোনও দুটো মানুষের মধ্যে কোনও গোপন বার্তা-চালাচালি হতে পারে না, প্রত্যেক সমস্যাই সবার সমস্যা, এখানে ব্যক্তিগত কাণ্ড ক্রমাগত সমষ্টিগত ভাণ্ডে গলে পড়ে এবং পবিত্র সিন্নির রূপ পেয়ে চরিতার্থ হয়। লোকে এই সিরিয়াল দ্যাখে খুশি হয় বারংবার হ্যাঁ-বাচক ঘাড় নড়নড়ায়, কারণ আমাদের সমাজেও প্রাইভেসি বলে কোনও ব্যাপারের স্বীকৃতি কভু ছিল না, আজও নেই। এখানে অনায়াসে লোকে সশব্দ শঙ্কা প্রকাশ করতে পারে ‘কেন তোদের বাচ্চা হচ্ছে না?’ এবং দড়াম দড়াম বাথরুমের দরজায় ঘা মেরে ধমকাতে পারে, ‘এতক্ষণ কী করছিস?’ অবশ্যই ধাঁ প্রবেশ করতে পারে ২২ বছরের ছেলের পড়ার ঘরে, কিংবা ৪২ বছরের আইবুড়ো মেয়েকে (সুযোগ থাকলেও) না দিতে পারে নিজস্ব ঘর। আমাদের মহান সাহিত্যিক প্রবন্ধে লেখেন, বিবাহ আদৌ দুই মানুষের মধ্যে বন্ধন নয় বরং এক পরিবারের সহিত আরেক পরিবারের সম্পর্ক-বয়ন।
কিন্তু ‘আমরা খারাপ আমরা আদিম কী করবে বুঝব রোজা ভাদিম’ মুখস্থ-বুকনি আউড়ে লাভ নেই, ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী (৩৭ বছর বয়সি মহিলা) কেন উদ্দাম পার্টি করছিলেন, কেন গানের সঙ্গে লিপ দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নাচছিলেন তা নিয়ে দেশ ও বিশ্ব তোলপাড়। তাঁকে পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে, তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন না। তাও ভাল মহিলা জোরে বলেছেন তাঁর আনন্দ করার অধিকার আছে, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই সময় কাটানোর অধিকার আছে, কিন্তু সেই সহজ কথাও ইউরোপীয় একটা সমাজকে কেন এমত ঘোঁতঘোঁতিয়ে হজম করতে হচ্ছে, তা পেল্লায় বিস্ময়। ওখানে তো ব্যক্তিস্বাধীনতার কদর ও ব্যক্তিনিভৃতির সমাদর প্রকাণ্ড, বলা ভাল, সর্বোচ্চ। পারলে চার মাসের শিশুকেও লোকে অনুমতি নিয়ে চুমু খায়। আসলে এখানে বাদ সাধছে উচ্চপদের মহিমা। প্রধানমন্ত্রী শব্দটা উচ্চারণমাত্রে এক অতিমানুষিক দায়িত্বের জ্যোতি এসে ভর করে, যা মনে করায়, এই লোক বাথরুম গিয়েও দেশের কথা ভাববে, রান্নাঘরে বাজেট ভেঁজে অন্যমনে নারকোল কুরতে ঘ্যাচাং। এবং অবশ্যই সেই পদের সঙ্গে ফাউ গজাবে গাঁউগাঁউ গাম্ভীর্যের বাটখারা : মশারির মধ্যেও (নিদ্রায় বা আশ্লেষে) এ ভুলবে না গদির গুরুত্ব, ফোন দেখে খ্যাঁকখ্যাঁক খিলখিল অবান্তর আমোদে ভাসবে না কদাপি, বেড়াতে গিয়েও তনু ঢালবে না দিবানিদ্রায় ও পাশবালিশে, এর জীবন হবে হোলসেল ধীর গোমড়া দুশ্চিন্তাময় (হায় জিডিপি কেন উঠছে না আরও উচ্চে, বিশ্ব উষ্ণায়ন ক’ডিগ্রি ছুঁচ্ছে)।
এবং এখানে খেয়াল করতে হবে আনন্দবিরোধিতার ঝোঁকটাও। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু করছিলেন না, যা প্রচলিত দৃষ্টিতে কুরুচিকর বা নিম্নমার্গীয়। পার্টিতে নৃত্য করা পাশ্চাত্য সমাজে স্যুপ খাওয়ার মতোই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু তিনি এমন ভঙ্গিমাতেও নাচছিলেন, যা, অনেকের মতে, ‘তাঁর পদের সঙ্গে সমঞ্জস’ নয়। সোজা কথায়, খুব খানিক ফুর্তি করে নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর তো ফুর্তি করার কথা নয়। তিনি ওজনদার আইকন, ফলে ২৪x৭ আনন্দহীনতায় বলিপ্রদত্ত। এমনিতেই মজা প্রমোদ আহ্লাদের প্রতি সিরিয়াস লোকের, ভাবুক-বৃত্তের একটা স্বাভাবিক অসূয়া আছে, যেন যেথা সুখ যেথা ফাতরামি, এবং যে হাস্যমুখ সে লঘু, তার ওপর এখানে যুক্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষেরও ধারণা : যে এমন বেলাগাম নাচতে পারে, সে যথেষ্ট ভারিক্কি ভাবে তার দায়বদ্ধতাকে দেখছে না (যার ঘাড়ে দেশের ভার, সে নেচেহেসে একাক্কার?) তাহলে কালকে পার্লামেন্টে গিয়ে যখন দাঁড়াবে, আমরা কেন এর বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে শুনব? উত্তরটা সহজ, কারণ কাল হল কালকের দিন, আর জায়গাটা তখন নাচের ফ্লোর নয়, পার্লামেন্ট। একটা লোক বুধবার রাত্রে নেচে গেয়ে আলগা রসিকতা করে, বেস্পতিবার সকাল দশটায় পৃথিবীর সর্বাধিক জরুরি ও গভীর সন্দর্ভ পেশ করতে পারবে না কেন? এবং, উল্টোদিকে, যে বুধবার রাশভারি থিসিস ফলাবে সে বেস্পতিবার নিজ বন্ধু-সার্কলে বাঁদরনেত্য করতে পারবে না কেন?
আসলে, এখানে বগবগিয়ে কাজ করে চলেছে স্টিরিওটাইপিং-এর বিশাল পাইপ : যা তোড়ে শুধু এই সংজ্ঞা উগরে দেয় : মানুষ একমাত্রিক, তার একমাত্র তকমা অনুযায়ী তাকে চলতেফিরতে হবে। যে শিক্ষক, সে সর্বক্ষণ শুধু শিক্ষক, সে রিকশাওয়ালার সঙ্গে সমকাম করতে পারবে না, বা ইনস্টাগ্রামে সুইমস্যুট পরে ছবি দিতে পারবে না। যে সূক্ষ্ম সংবেদী কাব্যের লেখক, সে ঘনিষ্ঠ প্রেমিকার সঙ্গেও বোদা নোংরা কথা ফিসফিসিয়ে উত্তেজনা পোয়াবে না। এই সংকীর্ণ, প্রগতিবিরোধী, মানুষের মতো আশ্চর্য অতলান্ত জানোয়ারকে একবগ্গা কুঠুরিতে ঠুসে দেওয়ার মতো গামবাট ও অপরাধী চিন্তারই জয়জয়কার দুনিয়াময়। অথচ আমরা নিজেদের দিকে তাকালেই বুঝব, একটা মানুষ হাজারটা মানুষ। বাজার করার সময় আমি নিড়বিড়ে, ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষার সময় সপ্রতিভ। যৌনতায় আমি নাছোড় প্রভুত্বকামী, বন্যাত্রাণে দয়ার্দ্র ও তৃণাদপি সুদীন। মা’র প্রতি ঘৃণা ও ভালবাসা আমার হৃদয়ে একাসনে বসে পাত পেড়ে খায়। এই আসে তো এই ভেঙে যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস। যে যুবক বাবার সঙ্গে দুপুর দুটোয় মেসি-রোনাল্ডো নিয়ে হুল্লোড়ে তক্ক করেছে, সে সাড়ে-তিনটেয় নিজের ঘরে ফ্যান থেকে ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ে। এই একশোরঙা জীব নিজেই নিজেকে সারা জীবনে চিনতে পারে না, একতলায় কোকাকোলা খায় ছাদে গিয়ে গুমরোয় এবং এক্ষুনি যাকে মেসেজ করে আসতে বলেছে তক্ষুনি প্রার্থনা করে সে যেন না আসে— আর তার কাছে কেবল একমেটে আচরণ প্রত্যাশা করা মানুষেরা কিনা ঔচিত্যবাদী কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে শোধরাবেন না, বরং আপনারা হয়ে উঠুন ইতর-কৌতূহল-সামালদার, পরিণতমনস্ক। মহিলা কোনও খারাপ কাজ করেননি, নিজের সময়টা নিজের মতো কাটাচ্ছিলেন। তাঁর সে স্বাধীনতা আছে, তা তাঁর মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে আচরণবিধি নিয়ে মতামত দেওয়াটাই বরং অন্য কারও এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। দেখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর মূল কাজে কোনও ফাঁকি দিচ্ছেন কি না, তাঁর কর্তব্যে নিষ্ঠার অভাব আছে কি না। সেখানে যদি তিনি দশে দশ, তাহলে বাকি সময়ে তিনি কার বশ? জনগণেরও না, মিডিয়ারও না। একটা লোকের অবসরের কেতা-কায়দা কেউ নির্ধারণ করে দিতে পারে না কি? ধর্মগুরুরও অধিকার আছে নিরিবিলিতে দীর্ঘক্ষণ নাক খোঁটার, কয়েদিরও অধিকার আছে স্বমেহনের, বিপ্লবীরও অধিকার আছে চুটকি-অবগাহনের। ঠিক যেমন অফিসের বস বলতে পারেন না, এ কী সাহাবাবু, আপনি ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে শ্যালিকাকে চুম্বন করছিলেন কেন? তেমনই প্রজা বলতে পারেন না, প্রধানমন্ত্রী হয়ে অবসর সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে তুমি তা-ই করছিলে কেন, যা তোমার বয়সি আরও কয়েক কোটি মেয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে করছে?
অথচ আমরা জানি, অফিসের বস এ কথা শুধু বলতে পারেন তা-ই নয়, চিৎকার করে বলে চাকরিটি গপাস খেয়ে নিতে পারেন। এবং বহু সমাজে নীতির দাঁড়িপাল্লা তাঁর দিকেই ঝুঁকবে! ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে এই পার্টি-অভিযোগ শুধু শুনতে হচ্ছে তা-ই নয়, ছলছল চোখে জবাবদিহি করতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে আমি কাজে ফাঁকি দিই না। কারণ এ পৃথিবী গবেট-অধ্যুষিত, এবং মেজরিটির মার বড় মার। তবে এও জরুরি ব্যাপার যে আজকের যুগ বলেই বহু মানুষ তাঁর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার ব্যক্তিগত জীবনে কেচ্ছাপ্রবণ নাসা গলিয়ে তাঁকে হ্যারাস করা লোকেরাও মুখের ওপর জবাব ও নিন্দেমন্দ পাচ্ছেন। ভেবে ভাল লাগে, আগেকার যুগের কত মন্ত্রী কত তারকা কত খেলোয়াড় কত লেখক এবং সর্বোপরি কত সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো পুলক-যাপন করতে পেরেছেন, শুধু মোবাইল ফোন নামক একটি ঘাতক ও সর্ব-হাজির ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়নি বলে, সিসিটিভি নামক ছিঁচকে নজরদার সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠেনি বলে। প্রযুক্তি মানুষের বহু সর্বনাশ করেছে, এবার তাকে শান্তিতে মলত্যাগটুকু করতে না দেওয়ার পণ করেছে। আর আমরা সেই চুকলিবাজের খুঁট ধরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে চলেছি। হয়তো, নিজেদের সন্ধেবেলা পার্টি জোটে না বলে, বা কাঁকালের ব্যথায় নাচতে পারি না বলে, অথবা দুটোই।