খেলা আর ধুলো
ভারোত্তোলন নিয়ে বাপের জম্মে মাথা না ঘামিয়ে, সে-খেলাকে নিতান্ত দেহশক্তিসর্বস্ব ও সুতরাং মগজবিরোধী আখ্যা দিয়ে, যারা সকাল থেকে হাঁউমাঁউ-মার্কা পেশি বানায় আর জিনিসপত্তর কোঁৎ পেড়ে মাথার ওপর তোলে তাদের ঢালাও ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, আজ যেহেতু বাংলার ছেলে ওজন তুলে সোনা আনতে পারে— তাই টিভিতে আমি ফেভিকল-চিপকা? এ-ই কি দেশপ্রেম? খেলাটার ক-অক্ষর বুঝি না, আজ জেটস্পিডে নিয়মকানুনগুলো গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছি, ভারতের খেলোয়াড় আসার আগে টেনশন করছি, সে পারলে লাফিয়ে চিৎকার, না-পারলে মাথায় হাত দিয়ে ট্র্যাজিক পোজ, অন্য দেশের খেলোয়াড় (কঠিন উচ্চারণের নাম) দুরন্ত পয়েন্ট পেলে হুড়িয়ে গাল— এসব কি স্বাভাবিক? খেলার সূক্ষ্ম বাঁক-মোচড় বোঝার বদলে শুধু বোদা ফলাফলের দিকে তাকিয়ে থাকে যে, সে কি ক্রীড়ারসিক? স্বাধীনতা দিবস আসছে, অঙ্কখাতা ছিঁড়ে ফ্ল্যাগ তৈরির দিন, প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন হোলসেল বারান্দা ছাদ ঘুলঘুলি থেকে পতাকা পতপতাও, তাতে ঐক্য বাড়বে (বাক্যও)— এই শুনেই এতটা হুপুই? অবশ্য তা নয়, খেলাধুলো হলেই দেশ-দেশ বাই বেড়ে যায়, দেশোয়ালি ভাই (বা বোন) মেডেল পেলে ছাতি ফুলে ওয়েট-লিফটারেরই সমান, সে হুড়ুমতালেই কত লোক হকি শিখল ব্যাডমিন্টন বুঝল এমনকী ‘লন বোলস’ নামে একটা খেলা নিয়ে প্রাণপণ গুগল করছে, কারণ কমনওয়েলথ গেমসে এ-খেলায় ভারতীয় মেয়েদের দল চ্যাম্পিয়ন। যে-দেশের ট্যাক্স দিই না, সে-দেশের হকি-দলের হয়ে গলা ফাটানোয় শর্টকাটামো আছে না? যে-দেশ গণতন্ত্র শিক্ষা উদারতাকে অহরহ থ্যাঁতলায়, তার খো-খো ক্ষমতা নিয়ে উল্লসিত হওয়ার মধ্যে অংশ-অন্ধতা? না কি এসবই আসলে যূথবদ্ধ হওয়ার আকুতি, ভিড় যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে গাদাগাদি করে হেলে ও অন্যের ছন্দে দুলে নিজেকে ধন্য মনে করার থিম?
হয়তো এত কিছু নয়, আসল কথা হল, মানুষ এখন নিজ অস্তিত্বের নির্যাসে একপিস জাদুশব্দ গেঁথেছে: দর্শক। মানুষ আগে ছিল স্রেফ জীবনযাপনকারী প্রাণী, তারপর হল যুদ্ধবাজ কুঁদুলে, তারপর ধর্মবাগীশ অত্যাচারী, তারপর লোভ-লকলক ক্রেতা, এখন সে কেবল চক্ষুময়, আঁখি-পাবলিক, নেত্রপাখি। ২৪ ঘণ্টা চোখের সামনে জাস্ট একটা উজ্জ্বল আয়তক্ষেত্র ঝলকাও, তাতে কিছু ছবি ও শব্দ নড়ন্তিচড়ন্তি। তা সিনেমা হতে পারে, ওয়েব সিরিজ হতে পারে, খবর, তর্ক, রিয়েলিটি জলসা, ফড়িঙের রাস্তা পেরোবার ছ’সেকেন্ডের ক্লিপিং। খেলা এমনিতেই চির-জনপ্রিয়, তার গতি আছে স্পষ্ট ফলাফল আছে তারকাদের কেরদানি আছে, আর প্রধানত রাজনীতিহীন বলে তা আজকের সর্বকুচুটে যুগে একটা প্রকাণ্ড হাঁফ-ছাড়ার ময়দানও বটে। তাই লোকে ক্রিকেট ফুটবল দ্যাখে, পাবলিসিটি করতে পারলে কবাডি, অলিম্পিক চললে রুটি-সব্জি খেতে খেতে ডাইভিংও, কিংবা কমনওয়েলথে স্কোয়াশ। এমনিতে সারাদিন একটা মুহূর্তও সে স্রেফ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে না, পার্কের দিকে চেয়ে ব্রেনতরঙ্গ বাজায় না। আবশ্যিক কাণ্ডাকাণ্ড থেকে অবসর পাওয়ামাত্র মোবাইলে চুবে যায়, যদি কোনও ক্যাফেতে গিয়ে দ্যাখে টিভি চলছে, বন্ধুর দিকে একটি কান খাড়া রেখে দুই চক্ষু (এবং অন্য কানটি) তৎক্ষণাৎ স্ক্রিনে সমর্পণ করে। এই অপূর্ব অভ্যাসেরই অঙ্গ: যে-খেলা হচ্ছে তা-ই দেখতে সেঁটে যাওয়া। আর খেলা দেখলে, পক্ষ অবলম্বন হল মানুষের প্রিয় ব্যসন। কলকাতার বাঙালি যখন নাইজিরিয়া ও বেলজিয়ামের খেলা দ্যাখে (যে দেশগুলোর কোনওটার প্রতিই তার বিন্দুমাত্র অনুরাগ নেই), বা পাপুয়া নিউ গিনি আর এল সালভাদরের ম্যাচ (যেগুলো দেশ না শহর তা-ই জানে না), তখনও সে মিনিট তিনেকের মধ্যে এক পক্ষ অবলম্বন করে ও অন্য পক্ষকে ‘মর! মর!’ অভিসম্পাত হানে, কারণ তা নইলে খেলা-দেখা পানসে ট্যালট্যালে। ভারত খেললে, নীল জার্সি ঝলকালে, নির্বাচনটা সহজ হয়, ঘনিষ্ঠতা আপসেই সুডৌল পিংপং বলের মতো গড়িয়ে আসে।
কুকুর-বেড়ালের মতামত নিলে তারা অবশ্য অধিক মৌলিক স্তরে সন্দেহ ছুড়বে। সারাদিন চৌকো যন্ত্রে গপাগপ নিমজ্জন যদি অবান্তরতায় স্বেচ্ছা-দীক্ষা হয়, তাহলে ক্রীড়া ব্যাপারটাই বা কেন পূর্ণ অবান্তর নয়? কেন আদৌ একটা লোক সাদা-কালো ছকে হাফ-ঘোড়াকে নির্দিষ্ট ছাঁদে নাড়িয়ে, বা কোর্টে পালক-পালক জিনিস ঠেলে, কিংবা গোলমতো জিনিসকে প্রকাণ্ড ধাক্কিয়ে বেড়া পার করে দিয়ে আনন্দ পাবে, আর অযুত-নিযুত লোক তা দেখে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হবে? একটা বেড়াল তো জিজ্ঞেস করতেই পারে, আমি ভয়াবহ ওজন তুলে সুস্থ শরীর ব্যস্ত করব কেন? লোকে আমাকে ভাল বলবে বলে আমি বছরের পর বছর কায়িক মানসিক জুস নিংড়ে উদ্ভট কাণ্ডের তুমুল প্র্যাকটিস বাগাব? হাততালির লোভে জীবনের পক্ষে পুরোপুরি অ-জরুরি কাজে আত্মনিয়োগ কি নিজেকে অপমান নয়? সারা পৃথিবীর বহু প্রান্ত থেকে বহু মানুষ কাজকম্ম ফেলে হাঁ করে দেখছে একটা বানানো নিয়মের বানানো সংঘাতে কে জিতল, সময় ও প্রাণশক্তির এর চেয়ে বড় অপচয় আর কী? এই তিরস্কার অবশ্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রসারিত হতে পারে (কয়েকটা লোক খামখা একটা মনগড়া কাহিনিতে অভিনয় করছে কেন? বা এঁকিয়েবেঁকিয়ে বিভিন্ন লয়ে গলার আওয়াজ করছে ও সঙ্গে বাজনা পেটাচ্ছে বলে আমি কেন উত্তেজিত?), বা প্রেমের ময়দানে (যৌনতা আমার জৈবিক চাহিদা, তার দোসর হিসেবে একটা আষাঢ়ে আকাঙ্ক্ষা নির্মাণ করছি কেন, যা আমাকে প্রখর কষ্টে রাখছে? না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে ফোঁসফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করার মধ্যে, (বা প্রস্তাব ব্যর্থ হলে গলায় দড়ি দেওয়ার মধ্যে), আহ্লাদ ও সার্থকতা কোনখানে?)।
এ যেমন নির্ঘাৎ সত্য যে মানবসভ্যতার অধিকাংশ অসামান্য অর্জনেরই ভিত্তি হল: কেজো প্রয়োজনের বাইরে মানুষের নিজেকে খুশি রাখার প্রয়াস, তেমন এও ঠিক যে, ইদানীং বাড়তি আর ফাউ আর এমনি-এমনি এসে আমাদের তাবৎ গভীরতা ও সাধনাকে গিলে নেওয়ার উপক্রম করেছে। মনের পিছদুয়ারে তা বুঝি বলেই, নিজের সৃষ্টি-প্রতিভাকে গোল্লায় ফেলে যখন খেলা দেখতে বসে যাচ্ছি, নিজেকে জপাচ্ছি, ওয়াঃ, দেশের সার্ভিসে সত্তা নিয়োগ করলেম। ভাল, রাত্তির দেড়টায় শুতে আসা সার্থক হল। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আপ্রাণ লড়ে টিটি-টিমের সঙ্গে আমিও জিতলাম, বাংলার ছেলের জন্যে তার দাদার আত্মত্যাগে আমারও কাঠবেড়ালি-অবদান রইল। এতে যদি গ্যাস-অম্বল-বুকজ্বালা জেলুসিল ছাড়াই কিঞ্চিৎ কম থাকে, মন্দ না।
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন