আবার ভীল ‘মহাভারথ’। এভাবেই বানান করেন ওঁরা নিজেরা। সেই ভারথকথা আবার। এই লেখা বারেবারে ফিরে আসে— এই গাথা এবং এর সহযোগী গাথা ‘রোমসীতমণিকথা’ (যাকে আমরা বলি ‘রামায়ণ’) আমাকে একেবারে বিহ্বল করে রেখেছে, কেবল সেই জন্য নয়, এই লেখা নিয়ে যত ভাবি কিংবা পড়ি, আরও বেশি চিন্তাসূত্র খুঁজে পাই; আবার একই সঙ্গে ভাবি, যেহেতু এই গাথা বারবার পড়ার জন্য আমার কাছে নিত্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং ঠিক সেই কারণেই হয়তো প্রথম পড়ার সেই পরমাশ্চর্য কল্পভাবনার জগৎ আর থাকবে না। অথচ, যাঁরা এই গাথা লিখেছেন বা শুনিয়েছেন, তাঁরা আমাদের সামনে থেকে, আমাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে যাওয়া জলের মতো দ্রুত হারিয়ে যাবেন, যাচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর সাহিত্য নিয়ে।
যখন একটি সমাজ উচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার প্রতিবেশের বাস্তবতা থেকে, তখন হাজার যত্ন করলেও কিছুতে টিকে থাকে না তার শিল্প আর সংস্কৃতি, যা আমাদের এই ভূ-ভাগের মধ্যেই কোথাও ছিল, হয়তো আজও কোথাও একটুখানি রয়ে গেছে এই জাদুবাস্তবের মতো গাথাগুলি। এসব যাঁদের স্বাভাবিক পালন, সেই মানুষদের সমাজের কিছু টুকরো আজও হয়তো আছে। হয়তো। কিন্তু আমরা আর তাকে দেখতে-শুনতে পাব না। হয়তো দেখব ছোট-ছোট টিলা-ডুংরির ওপরে নিজস্ব জীবনধারায়, নিজেদের সংস্কৃতিতে, যাপনে অভ্যস্ত ছোট-ছোট গ্রামগুলির বদলে অশিক্ষিত, বোধহীন, নেশাসক্ত আরও কিছু কন্সট্রাকশন মিস্তিরিকে। অথচ এই গাথাকারেরা এদেশের, রাষ্ট্রের কোনও ক্ষতি করেননি। তবুও তাঁদের জীবনধারাকে মুচড়ে তার মোড় ফেরানো হয়ে যাচ্ছে।
মিউজিয়ামের মতো করে কিছু চিহ্ন ধরে রেখেছেন কিছু মানুষ, যাঁরা এদের প্রত্যক্ষ জানতেন, সেরকম কিছু ব্যক্তি বা সংগঠন। তার অন্যতম সরকারি সংস্থা ‘ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার ফর আর্ট এন্ড লিটারেচার’। তাদেরও আর বিশেষ কিছু করার নেই, কারণ এ-কাজের জন্য তাদের যে প্রসারিত অঙ্গনের প্রয়োজন ছিল, নয়া দিল্লির সেই কার্যালয় প্রাঙ্গণ চলে গেছে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’র বিস্তারে। এই অপরিচিত, অভিনব, অন্য মহাকাব্যকথাগুলো তাই ইচ্ছে হয় বারেবারে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে। যা খুব অদ্ভুত এবং আমাদের কাছাকাছি, প্রায় সমকালেই বাস করা কিছু মানুষদের সমাজভাবনা। কী কল্পনা! কতকাল ধরে ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে থেকে, গায়ে-গায়ে থেকে, ক্ষমতাকে দেখা! নানা ভাবে, নানা ভাঁজে।
কৌরব-পাণ্ডবের গাথাটিকে একপাশে রেখে এই যে ‘ভারথকথা’ প্রবাহিত হচ্ছে, যা কোনওভাবেই দৃঢ়পিনদ্ধ নয়, কোনও নায়ক আছে এই ‘কথা’র? এমন কোনও চরিত্র, যাকে কেন্দ্র করে এটি আবর্তিত হয়? তেমন এককেন্দ্রিক কোনও গঠন এখানে নেই। অনেক কেন্দ্র আছে, এবং সেগুলি, নদীদ্বীপের মতোই প্রবাহের সঙ্গে সরে-সরে যায়। তবু, একটি চরিত্র নানা ভাবে নানা জায়গায় ঘুরেফিরে আসে। তার নাম— বালা। অভিমন্যু। বালা অর্থাৎ বালক বলেই সে অভিহিত হয় বেশির ভাগ সময়ে, যদিও তার কাজকর্মে বোঝা যায় সেটা আসলে একটা আদরের সম্বোধনমাত্র। এই ভীল ভারথ-এ কারো কোনও জন্মকথায় কোনও রহস্য নেই— কুন্তী, গান্ধারী, যথাক্রমে কুতরমা ও গতরমা, পাণ্ডবরা, দ্রৌপদী অর্থাৎ ধোঁফা— কারো নয়। ঈষৎ প্রচ্ছন্ন জন্মবৃত্তান্ত কেবল দুজনের— কর্ণ আর বালা। বলা যায় বালার জন্মরহস্যের ওপরেই, নামমাত্র যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, তার সমস্ত ফলাফলটি নিহিত আছে। যদিও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কোনওমতেই নিয়ামক নয় এই গাথাকাব্যের।
বালা, বা যা বলে তাকে অনেক জায়গাতেই উল্লেখ করা হয়— বালা হিম্মত, কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রার সন্তান। কিন্তু অর্জুনের সাথে তার জন্মসম্পর্ক কিছু নেই। সুভদ্রা অর্জুনের বিবাহিতা স্ত্রী হওয়ার দরুন, অভিমন্যু অর্জুনপুত্র। এই গাথায় দেবী-দেবতাদের জায়গা সর্বদা খুব পাকাপাকি নয়। কৃষ্ণকে হিন্দি অনুবাদিকা যদিও অনেকবার ‘কৃষ্ণ ভগবান’ বা শুধু ‘ভগবান’ বলে উল্লেখ করছেন, মূল ভিল কাহিনিতে কিন্তু তাঁকে বলা হয় ‘অবতার’। একজন ভগবান আছেন, কিন্তু তিনি যে নির্দিষ্টভাবে ঠিক কে, সেটা বলা হয়নি। শিব এক-আধবার দেখা দেন কাউকে কোনও বর দিতে হলে, কিন্তু সাধারণ ভাবে শিব-পার্বতীর কোনও ভূমিকা নেই। সেখানে বরং অনেকখানি জায়গা নিয়ে আছেন ইন্দ্র। বা বলা ভাল, ইন্দ্রাণী। ইন্দ্রদেব অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়, রাজক্ষমতা পছন্দও করেন, কিন্তু তা খুব একটা সামলে রাখতে পারেন না। তার ওপর, অধিকাংশ ক্ষমতাগর্বীদের মতোই, ভিতু। তাঁর নানান কীর্তির মধ্যে একটি দেখা যায়, সংসারে বাস করেও তিনি সাধু— এ-কথার প্রমাণ দেবার জন্য তিনি বিখ্যাত সব মহাযোগী সন্ন্যাসীদের নিজের সংসারে আমন্ত্রণ করেন। সেই মহাতেজা সাধুরা সমাগত হয়ে ইন্দ্রের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য নানা বেচাল পরীক্ষা নিতে থাকেন। ইন্দ্র নিরুত্তর থাকলেও, বিরক্ত হতে থাকেন তাঁর স্ত্রী। শেষ অবধি তাঁদের কেউ-কেউ যুবতীর পশ্চাদ্দেশে চিমটি কাটলে মহিলা ফেটে পড়েন। গৃহপতি ও তাঁর অতিথিদের চোদ্দোপুরুষ ‘ধুইয়ে’ দেন। ইন্দ্র তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলে সেই প্রখরা ইন্দ্রাণী, ইন্দ্রকে ‘কাপুরুষ’ বদনাম দিয়ে স্বর্গ ছেড়ে মহা দাপটে ‘মর্তের কোনও বীরপুরুষের ঘর করব’ বলে চলে আসেন মর্ত্যলোকে। এসে পড়েন সমস্যায়। তিনি সুন্দরী, ঐশ্বর্যময়ী— সবই। কিন্তু তিনি যে ইন্দ্রের স্ত্রী। সুতরাং একদিকে কৌরব বীরেরা তাঁকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন, অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরাদিও তাঁকে ভর্ৎসনা করেন ও ‘আমাদের সর্বনাশ করবেন না’ বলে দ্রুত স্থানত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। এই প্রত্যাখ্যাত, উজ্জ্বলন্ত ইন্দ্রাণীকে ‘কঙ্কণ পরায়’ অভিমন্যু, বালকপ্রায় বালা হিম্মত। প্রথমে, রাস্তায় দুজনের দস্তুরমতো মারামারি হয়, ইন্দ্রাণী পথচারী তরুণটিকে অকারণে ধাক্কা মারলে, সে রূপসীকে মাথার ওপরে তুলে ছুড়ে ফেলে দেয়। অতঃপর অপমানিতা ইন্দ্রাণীর পুরুষ হয় বালা। যদিও তার দুই অধ্যায় পরেই, তুমুল যুদ্ধে ইন্দ্র-পবন ইত্যাদিকে যুদ্ধে একেবারে গো-হারান হারিয়ে দূর করে দেওয়া অভিমন্যুর কাকা-জ্যাঠাদের দেখা যায় অর্জুনকে গঞ্জনা দিতে : এই বয়সের ছেলেকে সময়ে বিয়ে না দিলে আরও কত কী বিপদ ঘটতে পারে। এই কথাই বলে এবং উদ্যোগী হয়ে নিজের পছন্দের কন্যা বিরাট রাজার তনয়া উত্তরার সঙ্গে বালা হিম্মতের বিয়ে দেন স্বয়ং দ্রৌপদী। এই দ্রৌপদী সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছিল যে তিনি দেবসভায় পরামর্শের জন্য উপস্থিত হলে সব দেবতা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। ‘ধোঁফা এত জ্ঞানী যে ডাইনির সমান’— এই উপলব্ধি ভীমের। কিন্তু বিয়ের পরও ‘দাম্পত্যযোগ্য বয়স হয়নি দম্পতির’ বিধায় উত্তরা রয়ে যায় বাবা-মায়ের ঘরেই, গওনার অপেক্ষায়। সেই বাবা-মায়ের ঘর আবার যেতে একমাস, আসতে একমাস। পরে দেখি যুদ্ধ সমাসন্ন হলে সুভদ্রা নিজের শাশুড়িকে অনুযোগ করছে, ‘এখনও ঘর-বসত হয়নি বালার, এই অবস্থায় যদি যুদ্ধে মারা যায়, তাহলে পুরো বংশে বালকহত্যার পাপ লাগবে।’ বালার বাল্য ও পৌরুষ বিষয়ে শ্রোতারা কী ভাবতেন জানি না, কিন্তু পাঠকদের কিঞ্চিৎ ধাঁধা লাগে।
সেই ধাঁধা পরেও রয়ে যায়। দুর্যোধন, যে-কোনও কারণেই হোক, রাজ্যের ঠিকমতো ভাগাভাগি চেয়ে লেজে চিঠি লাগানো বাণ পাণ্ডবসভায় যখন নিক্ষেপ করে, অর্জুন তখন রাজ্যে অনুপস্থিত। বাজারে বন্ধুদের সঙ্গে গুলিডান্ডা খেলাধুলো সেরে বাড়ি ফেরার পথে কাকা-জ্যাঠাদের ‘মুখ কালো করে’ রাজসভার হলুদ-সবুজ জাজিমে বসে থাকতে দেখে, অভিমন্যু ব্যাপারটা বুঝতে আসে। কৌরবদের পাঠানো যুদ্ধে আহ্বানের চিঠিতে বাকিদের ভয় দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সে ঘোষণা করে দেয়, ‘আমরা পাঁচ পাণ্ডব এখানে আছি, লড়াই করতে যাওয়া আর কী এমন বড় কথা! মানলাম যে কৌরবরা ৭৮ ভাই, কিন্তু কুকুর-বেড়ালকে কে কবে ভয় পেয়েছে?… আরে, যুদ্ধ তো আমি একাই জিতে নেব।’ এই আখ্যানে মাতৃগর্ভে থেকে অভিমন্যুর চক্রব্যূহ ভেদ কৌশল শেখায় প্রায় কৃতকার্য হবার বৃত্তান্তও আছে, কিন্তু তার গল্পটা একেবারে ভিন্ন।
এই যুদ্ধ-ঘোষণা, আর দেড় পৃষ্ঠায় শেষ হওয়া আটদিনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাঝখানে, বরং এসে বসে ১০ পৃষ্ঠাব্যাপী উত্তরা-রানিকে আনতে যাওয়ার অসাধারণ বিবরণ। নানা ভাবে দেরি হয়ে যাওয়ায়, পৌঁছে যাওয়া উত্তরার সঙ্গে দেখা না করেই যুদ্ধে চলে যায় বালা। তার নেতৃত্বে প্রতিদিনের শত্রুসংহার ঘটে চলে অক্লেশে। ‘গাজর মুলোর মতো কচকচ করে’ মারা পড়ে কৌরবরা। অষ্টম দিন যখন ভীম প্রকাণ্ড ঝড়ের মতো প্রচণ্ডতায় কৌরবপক্ষকে নিধন করে চলেছে, ‘বালা হিম্মত কুরুক্ষেত্রের একপাশে দাঁড়িয়ে ধনুকের মাথায় থুতনি রেখে দেখছিল… ইঁদুর গিয়ে ধনুকের মাথায় চিবুক রেখে একমনে যুদ্ধ দেখতে থাকা বালার ধনুকের গুণের দড়ি কেটে দিল। ছিলা ছিটকে সোজা হয়ে গেল, আর বালা-র মাথা ছিটকে গিয়ে পড়ল অনেকখানি দূরে। বালা হিম্মত মরে গেল। ভগবান পৃথিবীতে অন্যায় কাজ করলেন।’ দেড় পৃষ্ঠার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এই বালা হিম্মত বা অভিমন্যুই পাণ্ডবপক্ষের একমাত্র নিহত। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের সদ্গতি-প্রাপ্ত না হয়ে কিশোর নায়কটির নিধনে কেন যে ‘ভগবান পৃথিবীতে অন্যায় কাজ করলেন’, সে আবার আরেক বৃত্তান্ত। বালা-র জন্মবৃত্তান্ত।
ক্ষমতাধারীর অন্যায় লোভের উপাখ্যান।
প্রবাস থেকে ফিরে অর্জুন কিন্তু শোকে মুহ্যমান হয়ে যান, বাড়িতে থাকতে না পেরে শ্মশানে গিয়ে বালার জন্য কাঁদেন। সেইখানেই অর্জুনকে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে শ্মশানের কণ্ঠে বালা অভিমন্যুর সেই অদ্ভুত উক্তি, ‘পূর্ব কোনও জন্মে তুমি আমার পুত্র ছিলে, সেজন্য আমি তো শোক করিনি। মৃতের জন্য শোক কোরো না। মৃতের সঙ্গে জীবিতের কোনো আত্মীয়তা হয় না।’
এইখানে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সপ্তম সূক্তের সঙ্গে অভিন্ন এক মন্ত্রের সামনে পাঠককে বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি দাঁড় করিয়ে রেখে ভীল ভারথ-এর গায়েন অগ্রসর হতে থাকেন।
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত