হনু
মরুভূমি ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়? যতদূর অবধি দেখা যায়, সবটাই ন্যাড়া, তুমি নেই, কেউ নেই, সেখান থেকে? যেখানে একটা গাছও নেই? শুধু বালি? এখানে একটু পাথুরে মাটি। মাথা তুলতে না পারা ঝোপ, একা গাছ। ডালপালা মেলা, ছড়ানো, ছায়াগাছ নয়। বল্লমের মতো উদ্ধত। কিছুটা বেড়ে ওঠার পর আরও কিছু ডাল। আর পালা। সাংঘাতিক রোদ। আন্দাজ করতে পারি, নীচে জল আছে কোথাও। ডালে যত না, পাতায় তার চেয়ে কাঁটা বেশি। ছিরিছাঁদ নেই। শ্রী নেই। রোমান্সের ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। কীভাবে জন্মায় এই গাছ? কোন পাখি আসে এখানে? যে, বীজ ফেলে যায়? দুনিয়ার কোথাও মরুভূমি আর আছে বলে মনে হয় না। যেদিকে তাকাই, ইলেকট্রিক ট্রান্সমিশন লাইনের টাওয়ার। মুড়ে রেখেছে দুনিয়াকে। আর যা চোখে দেখা যায় না, যাকে আমার প্রধান ভয়, তাও আছে। সিগন্যাল। ফোন বন্ধ করা ছিল। একবার অন করেই আবার বন্ধ করে দিলাম। টাওয়ার আছে ! যাকে দেখা যায় না, তাকে ধরাও যায় না। ভুল ধারণা। কে যে কোথায়, তা জানতে চাইলে সবাই জানতে পারে। আজ নয় কাল। যদি সে কোথাও কোনও সিগন্যাল দিয়ে ফেলে।
এই অঞ্চলে এসে পড়াটা কিছুটা কাকতালীয়। আমার দরকার ছিল এমন জায়গা যেখানে লুকিয়ে থাকা যায়। ভিড়ের মধ্যে না থাকা। মরুভূমির দিকে সরে যাচ্ছি বুঝতে পেরে গতিপথ বদলানোর চেষ্টা করিনি। সম্পূর্ণ জনমানবহীন, তা তো নয়! মরীচিকা মনে হলেও আসলে বাড়িঘর। দূরে-দূরে। কাছে, কখনওই নয়। এদেশে কাছেপিঠে থাকার রেওয়াজ নেই। বাসের ছাদে, ট্রাকে, কিছুটা হেঁটে, সরে এসেছি এতদূর। যেখান থেকে আসছি, সেখানকার মানুষের চেহারার সঙ্গে অন্য জায়গার তফাত নজরে আসছে। এর মানে, লোকে দেখে বুঝতে পারছে যে, আমি এখানকার বাসিন্দা নই। হয়তো দেখছে না, কিন্তু আমার ভয় আছে। জামাকাপড়ের আর চেহারার ওপর স্থান-কাল-সময়ের ধুলো পড়েছে প্রচুর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি চাপা পড়ে গেছি তার তলায়। কেউ দেখেও বুঝবে না। ভয় ওই টাওয়ারগুলোকে। একটার ছায়া বেয়ে-বেয়ে তার তলায় গিয়েছিলাম। অনেক ওপর থেকে সঙ্গে-সঙ্গে সরসর-হিসহিস শব্দ শুরু হল। পালিয়ে এলাম। যে-পিচের রাস্তা ধরে এতক্ষণ হেঁটে এসেছি, সেটাই চলে গেছে অন্য দিকে। ওটা ধরে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই। রাস্তার একটা সুবিধে হল, সে কম্পাসের মতো নড়ে না। দূর থেকে যদি চোখে পড়ে কোনও জনপদ, তাহলে সাবধানে এগোতে হবে। যে-ব্যাপারটায় আমি অবাক হচ্ছিলাম তা হল, ক্লান্ত লাগছে না। রাস্তাটাকে নজরের মধ্যে রেখে চলেছি। তবে অনেকটা দূর দিয়ে। দেখতে পাচ্ছি, ট্রাক-বাস-গাড়ি যাচ্ছে মাঝে মাঝে। এক জায়গায় একটা বেশ বড় গর্ত। মানুষে কেটেছে বলে মনে হল না। অনেকটা গভীর। সাবধানে নেমে গেলাম তার মধ্যে। মাথাটুকু জেগে রইল। আদর্শ জায়গা। পায়ের কাছের মাটিটা নরম। ভিজে-ভিজে। গাছের মতো জল শুষে নেওয়া যায় এখান থেকে? যদিও আমার তেষ্টা পায় নি। গর্তের ছায়ায় গলা থেকে পা অবধি খুব আরাম হল। এই খোলা বাঙ্কারে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। হয়তো দেখতে পেলাম, কেউ যাচ্ছে, এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে, সম্ভবত আমাকে খুঁজছে, তখন মাথা থেকে পা অবধি কীভাবে ছোট হতে হয়, লুকিয়ে পড়তে হয়, সে আমার জানা আছে।
ডাক শুনে আন্দাজ করা যায় আশেপাশে পাখি আছে কি না। কিচমিচ। পি পি। খরখর। প্রথমে বুঝিনি, এখন আন্দাজ করলাম, এখানেও আছে। ঝোপের মধ্যে ধামসাধামসি করছে। ডাক শুনতে পাচ্ছি। একটা ডাক একটু অন্য ধরনের। বেশ কিছুক্ষণ পর পর, কুঁই কুঁই। আসছে সামনের গাছটার নীচ থেকে। গাছের কাছে পৌঁছতে আওয়াজটা ম্রিয়মাণ হয়ে এল। তারপর থেমে গেল। মানুষ দেখে সতর্ক হয়ে উঠেছে। আবার শুরু হল। সামনে এসে দেখি পাখি নয়, হনুমান। বাচ্চা। চুপ করে বসে আছে একা-একা। এদের মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা যায় না। মনে হল না যে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। মহা দুশ্চিন্তায় পড়া মানুষের মতো তার চোখের দৃষ্টি। ক্লান্ত যেন। আমার দিকেই তাকাচ্ছে না। এদিক-ওদিক দেখছে। কী সব বিড়বিড় করছে। মানুষের সঙ্গে খুব মিল। এখানে হনুমান আছে না কি? এরা তো দলে থাকে শুনেছি। বাচ্চারা মায়ের সঙ্গে। ধেড়েরা সামনে। খুব হিংস্র হয়। জনবসতিতে ঘুরে বেড়ায় মানুষের নাগালের বাইরে-বাইরে। সবজি নষ্ট করে। অযথা ডাল ভাঙে, দৌড়য় ছাদের ওপর দিয়ে। গুলতি, পটকা দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা হয়। আবার আদিখ্যেতাও চলে। এটা বোধ হয় দলছুট। মা-র নজর এড়িয়ে আলাদা হয়ে গেছে কোনওভাবে। বাকি দলটা খেয়াল করল না? গেল কোথায়? দূরে ওই যে বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে, ওখানে? ফিরে আসবে কি? আমি কী করব? একে এখানে ফেলে চলে যাব? অসুস্থ মনে হয়। কোনও এক দিকে যে এগোবে, সে-ক্ষমতা আছে বলে মনে হল না। মরে যেতে পারে। তাতে কী এমন ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে? হনুর বেঁচে থাকার গুরুত্ব মানুষের মতো নাকি? আমি আর একটু এগোতে সে চেষ্টা করল গাছ বেয়ে ওঠার। কতদূর উঠবে? ফুরিয়ে যাবে গাছ। সুবিধে হল না। কাঁটাভরা ডাল জড়িয়ে সে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।
কখন যে আমার পাশে একটা ছায়া পড়েছে বুঝতে পারিনি। একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে হাত জোড় করে। স্থানীয় কেউ। পাগড়ি নয়, একটা কাপড় মাথার ওপর জড়ানো। লাঠি আছে। ঝোলাও আছে। বয়স বোঝা গেল না। চোখাচোখি হতে বলল, ‘রাম সিং’। হনুকে দেখে কী একটা বলল যা আমি বুঝলাম না। আমিও বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবারে কী করা যায়?’ অচেনা লোক, চিনি না, সেও চেনে না। তবু কথা গড়াতে লাগল। একটা শব্দ চেনা লাগল, ইংরিজিতে, ‘অ্যাব্যান্ডন কর দিয়া।’ মোটামুটি ঠিক হল যে, একে এখানে ফেলে রাখা যাবে না। আমি যেদিকে যাচ্ছিলাম, সে যাচ্ছিল তার উল্টো দিকে। যেখানে কিছু গাছপালা পাওয়া যাবে, সেখানে ওর বাবা-মা’র খোঁজ করতে হবে। বিপদ আছে। ছোট হলেও ভয় পেয়ে আঁচড়ে-কামড়ে দিতে পারে। আমরা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি এটা বুঝবে কী করে? যদি হনুমানের দল না পাওয়া যায়, তাহলে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গতি নেই। হনুর বাচ্চাকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠল বেশ। রাম সিং নিজের কথা বলতে লাগল, যা প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, আমিও না। শুখা জায়গার মানুষের মন অন্য রকম হয়। ইচ্ছে, চাহিদা শুকিয়ে যায়। সারাজীবন চলতে থাকে, চলতে হয় বলে। আমিও চলছি, তবে অন্য কারণে। ওর একটা কথা, ‘ভাগ রাহা হ্যায়’, কানে এসেছিল। সেও কি ভাগছে একা-একা? কেউ নেই তার?
নিজের চাদরটা খুলে হনুর দিকে এগিয়ে গেল রাম সিং। হনু আবার ওপরে উঠতে চেষ্টা করল। দেখতেই পাচ্ছি হাত-পা, পেটের কাছটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। বেশিক্ষণ এটা হতে দেওয়া যাবে না। প্রথমে লাঠি দিয়ে চেষ্টা করা হল। হনু একবার লাঠিটা ধরল। তারপর ছেড়ে দিল। মানুষের লাঠির চেয়ে কাঁটা-ডাল তার কাছে চেনা জিনিস। চিঁ চিঁ চিৎকারটা চলছেই। মুখে আতঙ্কের ছাপ। এর আগে যা ঘটেছে, আর এখন যা ঘটছে, কোনটা তার দুশ্চিন্তার কারণ, আমরা বুঝতে পারলাম না। ‘কিছু হবে না, ভয় নেই, নেমে আয়, সব ঠিক হয়ে যাবে’, এমন কথা বলা হচ্ছিল তাকে। বুঝবে এমন আশা না করে। শেষপর্যন্ত তার ল্যাজ পাকড়ে ধরা হল। লাঠিটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল আগেই। দু’হাতের টানে গাছে ওঠা আটকে গেল। ল্যাজ টানলে হনু আসবে। সাবধানে একটু নামিয়ে নাগালের মধ্যে আসতেই নিজের চাদর দিয়ে মুড়ে, ওকে পেড়ে ফেলল রাম সিং। তারপর হনু কোলে এগিয়ে এল আমার দিকে। লাঠি হাতে আমি চললাম তার পিছন-পিছন। পায়ের গোড়ালিতে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। আগে দেখিনি। আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ‘তোড় দিয়া।’
বাজারের মধ্যে যেতে চাইছিলাম না। বাঁ-দিকে বেশ কিছু গাছ দেখা গেছে। সেখানে খোঁজাখুঁজি করে কাউকে পাওয়া গেল না। আবার এগোতে লাগলাম। আমরা কেন এখানে, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাব, কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করছি না। হনুর কিছু একটা গতি করে আবার যে যার রাস্তায় চলে যাব। আর কোনওদিন দেখা হবে না। মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল। হাইওয়েতে উঠলাম। এর পরে কোথায় গ্রাম আছে, বা আদৌ আছে কি না জানা নেই। চাই শুধু গাছ। রাম সিং আগে হাঁটছিল, আস্তে-আস্তে, পা টেনে-টেনে। হনু এখন চেঁচাচ্ছে না বিশেষ। চোখ বন্ধ করে চাদরের মধ্যে থেকে মুখ বের করে আছে। কিছু খাবার, জলের ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হত। একটা ট্রাক আসছিল। দাঁড়াল। কীসব কথা হল। চলে গেল।
একটা কথা মনে হল, এই অঞ্চলে কি এরা থাকে? মনে হয় না। তাহলে এল কোথা থেকে? অনেক দূরে আবার কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেয়ে সেদিকে এগোলাম আমরা। একটাও লোক নেই। কোনও সাড়াশব্দ নেই। এক জায়গায় ব্যা ব্যা শুনে বুঝলাম ভেড়া আছে। হনুও পট করে চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। পালাতে চাইল না। আবার ঝিমিয়ে পড়ল। ঘরের ভেতরে মানুষের বাচ্চার কান্না শুনতে পেলাম। কেউ আছে? খোঁজ করা হল হাঁক পেড়ে। লম্বা ঘোমটা ঝোলানো এক মহিলা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আমার কিছু বলার নেই। মহিলা হনুকে দেখল একবার। আঙুল তুলে দূরে দেখিয়ে দিল। বেরিয়ে এলাম। তার আগে জল খেলাম, বোতলে ভরলাম। হনু খেল না। এটা চিন্তার বিষয়। ডিহাইড্রেটেড হয়ে যেতে পারে। হয়তো গেছেও। একে আবিষ্কারের আগে কতক্ষণ কিছু খায়নি তাও জানি না। আমরা আর কতক্ষণ এভাবে চলব একটা অর্ধমৃত জানোয়ারের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে? ঠিক কখন হাল ছেড়ে দিতে হবে? রাম সিংকে এত কিছু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। সে চলেছে নিজের মতো, কথা বলে চলেছে নিজের সঙ্গে। একটা বড় গাছ, তার তলায় বেদি দেখতে পেয়ে বসলাম। হনুকে কাপড়ের পুঁটুলি থেকে বের করা হল। পালিয়ে গেল না। পাশে শুয়ে পড়ল। একটা পা তুলে দিল রাম সিংয়ের ঊরুর ওপর। আমরা দুজনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বেদির পাশে একটা কমলা চুড়ো ছোট মন্দির। তার ভেতরে উঁকি মারলাম। প্রসাদ রেখে গেছে কেউ। হনুও গুটি গুটি সেখানে এসে হাজির হয়েছে। মূর্তিটা অবাক হয়ে দেখছে সে। তার স্বজাতি। এবারে নিজেই একটু এগিয়ে প্রসাদ তুলে মুখে দিল। পাশে মাটিতে জল জমে ছিল। খেল উপুড় হয়ে। খেয়ে ভ্যাবলার মতো সেখানেই বসে রইল। আমরা টানাটানি করলাম না। নিজেদের জায়গাতে ফিরে গেলাম। হনু একটু পরে আবার সেখানে ফিরে এল ক্লান্ত পায়ে।
হাঁটা শুরু করলাম আমরা। কোনও ঝামেলা না করে সে ফের যথাস্থানে। এর মধ্যে রাম সিং ঝোলা থেকে রুটি বের করেছে। খেলাম অল্প। এর চেয়ে কাঠের তক্তা চিবোনো সহজ। ক’টা বাজে খেয়াল নেই, মনে হয় বিকেল হয়ে আসছে। একই সময়ে আমার নিজের ঘরের আকাশে নিশ্চয়ই সন্ধে নামছে। এখানেও নামবে। তারপর রাত। তখন কী করব, কোথায় থাকব ভেবে দুশ্চিন্তা হল। এতদিন হয়নি। যেদিক থেকে ও এসেছিল, আমরা সেদিকেই যাচ্ছি আবার। এই রাস্তা ওর চেনা। হনুর ব্যবস্থা হয়ে গেলে রাম সিং নিশ্চয়ই তার গন্তব্যের দিকে মুখ ঘোরাবে। আমি একা হয়ে যাব। এই অবধি ভেবে মন খারাপ হল। আমরা কি একসঙ্গে কোথাও চলে যেতে পারি? ও যদি কোথাও মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়, তাহলে আমার সঙ্গে খুব একটা তফাত নেই। আমার পিঠে কালশিটে পড়েনি, সেটা সত্যি। হনু আহত, কেউ আঘাত করেছে বলে মনে হয় না। তিনখানি প্রাণী আপাতত জানা-অজানা ক্ষত নিয়ে এগোচ্ছি অনির্দিষ্ট দিগন্তের দিকে মুখ করে। রাস্তার ধারে একটা ঘর পড়ল অনেকটা হাঁটার পর। পরিত্যক্ত। দেওয়ালে পলেস্তারা খসে গিয়ে লুপ্ত এক দেশের ম্যাপ। পথিকের কথা ভেবে কেউ বানিয়েছিল। এই পথে মানুষের আসার কথা নয়। এলেও, হেঁটে কখনওই নয়। আমরাই কি প্রথম? এই ঘরটার অপেক্ষা যে শেষ হয়েছে, তা কি সে জানে? ঢুকে পড়লাম একটিমাত্র পাল্লাহীন দরজা দিয়ে।
খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে রাস্তার ধারে মাটিতে বসলাম। হনু ছাড়া আছে। যাচ্ছে না বেশি দূর। যেদিকেই তাকাই, আকাশ আর জমির বিভাজনরেখা ছাড়া আর কিছু নেই। হাওয়া নেই। ঠান্ডা নেই। গরম নেই। কোনও শব্দ নেই। কিচ্ছু নেই। একদিকে আকাশের ফরসা হওয়া দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। রাম সিং কিছু বলছে না। আমিও না। আলো ফুটলে কথা হবে। হনু আমার উপস্থিতি নিয়ে বিচলিত নয়। আমার দিকে দেখছে না। আমিও না। চিঁ চিঁ ডাক শুনে দেখি সে একটু দূরে গিয়ে কী যেন দেখছে। মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আবার দেখছে। কিছু বলতে চাইছে বোধ হয়। যেদিকে তার নজর, সেই দিগন্তে ফুটে উঠেছে কয়েকটা বিন্দু। উত্তর দিক থেকে আসছে কেউ। কেউ নয়, অনেকে। উটের পাল। সঙ্গে লোক আছে। আমাদের দিকেই আসছে, রাস্তা পেরিয়ে দক্ষিণে চলে যাবে। তারা যত কাছে আসতে লাগল, আমাদের সবার উত্তেজনা তত বাড়তে থাকল। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওদের। মরুদেশের গাছের মতো চেহারা। খাড়া শরীর। স্লো মোশনে পৌঁছল তারা, আমাদের দেখে থামল। উটের চলার শব্দ শুনিনি আগে। দাঁড়িয়ে থাকলে, শরীরে বাঁধা এটা-সেটা, ঘণ্টা বাজতে থাকে। উটওয়ালা এগিয়ে এল আমাদের দিকে। রাম সিংয়ের সঙ্গে কথাবার্তা হল কিছু। এদের গন্তব্য থাকলেও তাড়া নেই। হাবভাব দেখে বুঝলাম বসবে কিছুক্ষণ। বসল মুখোমুখি। আরও দুজন এল। পিছনে ভেড়ার পাল। তারা এসে উটের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন ইস্কুলের মর্নিং প্রেয়ার হবে। একটা-দুটো গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক যাচ্ছিল। লাঠি দেখিয়ে তাদের ফের দলে গুঁজে দেওয়া গেল। উট বেয়াদপি করে না। সারাক্ষণ ডাকাডাকি করে শান্তিতে বিঘ্ন ঘটায় না। আমি গুটি গুটি এগিয়ে গিয়ে বসলাম লোকগুলোর সঙ্গে। দুর্মূল্য সম্পদ, তাও বের করলাম সিগারেটের প্যাকেট। নির্বিকার ভাবে নিল কয়েকজন। ওদের ছাড়া-ছাড়া কথাবার্তা চলতে লাগল।
এদিকে হনু এসে রাম সিংয়ের কোলে উঠে পড়েছে। সেও সবার কথা শুনছে। উটওয়ালা একবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সূর্য উঠল বলে। উটেরা গলা দিয়ে নানা রকম শব্দ করছে। কিছু একটা খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। এরা খাবার না দিলেও নির্বিকার মুখে হওয়া চিবোতে পারে। ওদের মালিক বুঝতে পারে কার কখন কী চাই। মাঝে মাঝে সামনের উটকে সে কীসব বলছিল। উট মুখ ঘুরিয়ে পিছনের উটকে মতামত জানাচ্ছিল। সে তার পরের জনকে। এরপর হয়তো আস্তে-আস্তে উটদের কথোপকথনও বুঝতে পারব। লিডার উট বার বার মুখ ঘুরিয়ে অন্যদের কীসব বলতে লাগল। অনেকটা লম্বা গলা। বেশ কিছুটা সময় লাগে যেতে-ফিরতে। সে একটু এগিয়ে এল আমাদের দিকে। গলা নামিয়ে বাড়িয়ে দিল। তার মাথা এখন একদম আমাদের মধ্যে। মালিক তার মাথাতেও হাত বুলিয়ে দিল। সে মাথা সরাল না। ঠিক এই সময় হনু একলাফে উটের মাথায় চেপে বসল। তারপর ঘাড়ের ওপর দিয়ে এক দৌড়। শেষবারের মতো তাকে দেখতে পেলাম কুঁজের টপ-এ, সূর্যের মধ্যে, সিলুয়েট অবস্থায়। তারপর উটের পর উট টপকে কোথায় মিলিয়ে গেল কে জানে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র