স্কুলের স্বাধীন দিন
স্বাধীনতা দিবস বদলে-বদলে যায়, অন্তত আমাদের কাছে। আমরা যারা বিপ্লব দেখিনি, দেশভাগ দেখিনি, মন্বন্তর দেখিনি, দাঙ্গা দেখিনি তেমন করে— যারা নকশাল আন্দোলনের মিথের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে খেয়েছি বিস্ময়ে, তাদের কাছে অন্তত বদলে-বদলে যায়। পাড়ায়-পাড়ায় বাঁধা হয় ম্যারাপ। কোথাও রক্তদান শিবির তো কোথাও প্রীতি-ফুটবল। তার সঙ্গে মাইকে ঘোষণা ও নিরন্তর বক্সে গান। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় স্বাধীনতার কোলাহল বদলাতে থাকে, আমরা রিক্সা ভাড়া গুনি যথাসাধ্য খুচরোয়। ফেসবুকে উপচে ওঠা পোস্ট দেখে বেলার দিকে বুঝতে পারি না, কী লিখলে একটু আলাদা হওয়া যাবে। বাজার যাই বৃষ্টি মাথা করে, বৃষ্টি আমাদের মধ্যে বাজার বসায় তার। এসবই চলতে থাকে ইদানীং, স্বাধীনতার ছুটি ঘিরে।
এই বছর কয়েক আগেও অবশ্য ছিল না এমন। টানা কিছু বছর ধরেই ছিল না। ‘১৫ আগস্ট আসছে’— এই বাক্যের একখানা অন্য মানে আমাদের কয়েকজনের কাছে ছিলই। আমরা যারা একসঙ্গে এক স্কুলে পড়েছি, তাদের কাছে। তার কারণ আর কিছুই নয়, অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের স্কুল এই দিনটিকে বার্ষিক পুনর্মিলন উৎসবের জন্য ধার্য করেছিল। কাজেকর্মে ছুটি থাকে, স্কুলেও ক্লাস নেই, আবহাওয়াও মসৃণ, অতএব এমন একটি দিনে স্কুলের চত্বর পুরনো চেহারায় সেজে উঠলে মন্দ হবে না, এমন ছিল ভাবনা। আর সেই ভাবনায় সামিল ছিলাম আমরা। আমরা যারা ’৯৫ সালে সাদা কেডস, সাদা ট্রাউজার, নীল পাড় সাদা শাড়ির শেকল ছেড়ে উড়ে গেছি দূরে-দূরে, তারা। শেকল লিখলাম বটে, কিন্তু উড়ে যাবার পর থেকে প্রায় প্রতিমুহূর্তে ওই শেকলের জন্যেই মনকেমন করেছে যে, এ-কথাও সত্যি। তাই আমরাও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবী মিলে ঝাঁক বেঁধেছিলাম, ১৫ আগস্টের এই আড্ডায় সামিল হবার খাতিরে।
এ তো সত্যি যে, ছেড়ে যাবার পর ফিরে আসার ইচ্ছে সকলের মধ্যে সমান রকম থাকে না। এও সত্যি যে, ইচ্ছে থাকলেও অনেকে দলছুট, মুখচোরা বলে সে-ইচ্ছের মোহর ভাঙিয়ে নিতে পারে না। ছিলাম আমরা কিছু জোটবাঁধা ছেলেমেয়ে, প্রেয়ার লাইন থেকে ক্লাসের কাটাকুটি, অঙ্ক থেকে ভূগোল, টিচার্স ডে থেকে নিল ডাউনে যারা একে অপরের হাত ছাড়িনি কিছুতেই। আর স্কুল থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়বার পর দেখলাম, হাতগুলো দিব্যি ধরা আছে তখনও। তাই স্কুলে ফিরে যাবার এমন একখানা দিন যখন পাওয়াই গেল, সে-সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না মোটেই, এইরকমই ছিল আমাদের ভাবনা।
সত্যি বলতে কী, টানা অনেকগুলো বছরই ১৫ আগস্টের সকালবেলা পৌঁছে গেছি স্কুলে, কিন্তু প্রথমবার, সেই এক প্রথমবার জোট বেঁধে স্কুলে পৌঁছনোর যে-অভিজ্ঞতা, অনেকগুলো বছর ছেড়ে থাকার পর হুট করে একদিন কাছে ফেরার যে-আবেগ, তার সঙ্গে তুলনীয় কিছুই নয়। আমরা সাকুল্যে সাত-আটজন হয়তো মিলে উঠতে পেরেছি পরস্পরের সঙ্গে। বাকি যারা আমাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, তাদেরও নিজেদের এমন বন্ধুদল আছে নিশ্চয়ই? ভাবি আমরা। আর তারাও নিশ্চয়ই আমাদেরই মতো পেয়ে গেছে এই খবর যে, এই দিনটায় দেখা হতে পারে? এইরকম এক বুক-ধুকপুক আশা নিয়ে স্কুলচত্বরে পা পড়ল আমাদের।
ঝাঁকে-ঝাঁকে অলীক ছেলেমেয়েদের দল তখন সে-চত্বর আলো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ আমাদের চেয়ে তিন ব্যাচ ছোট, কেউ চার ব্যাচ বড়। চেনা বেরিয়ে যাচ্ছে হুটহাট করে; কেউ-কেউ দূর থেকে দেখে ঠাহর করার চেষ্টা করছে কাউকে। যার কথা ভাবছি, সে-ই কি? স্মৃতি না বদলালেও, চেহারা তো কমবেশি বদলেছে সকলেরই। তাই পিঠে চাপড় মেরে, ‘আরে সৈকত না?’ বা বিনুনি ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে, ‘কী রে ঝিমলি, খবর কী?’ বলবার আগে ভেবে নিতে হচ্ছে একটু। ভুল লোক হলে ভারি বেকায়দায় পড়তে হবে নেহাত। কারও মুখ দেখে অভিমানের পর্দা সরে যাচ্ছে চোখ থেকে, কারও চোখ থেকে পুরনো রাগ মুছে গিয়ে আসছে হাসি। সময় এক আশ্চর্য রাস্তা। একই মোড় বদলে-বদলে যায় কেবল।
সবচাইতে ভাল লেগেছিল, যখন আমরা অনেকে জড়ো হয়ে আমাদের ক্লাস ইলেভন-এর ঘরে গিয়ে বসলাম। স্কুলব্যাগ নেই, খাতাপত্তর নেই, হোমওয়ার্ক নেই, ইউনিফর্ম নেই, স্যার বা দিদির আসার আশঙ্কা নেই, কিচ্ছু নেই কোথাও। কেবল সমস্ত স্কুলটা আমাদের উপর ছায়ার মতো দুলছে যেন, আর তার নীচে আমরা ক’জন— ক্লান্ত, তৃপ্ত, ভেসে বেড়াচ্ছি হাত-পা ছড়িয়ে। হয়তো প্রণমিতা এসে পড়েছে ততক্ষণে, দূরের বেঞ্চে বসে ঠাট্টায় মেতে উঠেছে কোরক আর শমীক, ঋতুপর্ণা আর পিয়ালির সঙ্গে প্রায় হাতাহাতিতে পৌঁছে গেছে সঞ্জয় আর ধৃতিমান। তাদের কারও অন্য শহর এখন, অন্য কাজ, অন্য সংসার, অন্য বন্ধুবান্ধব। কিন্তু এই একখানা দিন তারা ফিরে এসেছে পরিবারের মধ্যে, নিজেদের পুরনো গ্রামে। যেখানে লুকানোর নেই কিছু, বাড়িয়ে বলারও কিছুই নেই। কেবল হা ধরে নেবার আছে, সক্কলের।
মনে আছে, সবচাইতে ভাল লেগেছিল স্যার আর দিদিদের সঙ্গে দেখা হওয়ায়। যাঁদের পায়ের আওয়াজ শুনলে হৃদ্কম্প শুরু হত, তাঁদের পায়ে যখন হাত ছোঁয়ালাম, সে এক আশ্চর্য পাওয়া। যাঁদের হাতে অকথ্য মার খেয়েছি, তাঁরা যখন হেসে সেই হাতই কাঁধে রাখলেন আমাদের, সেও এক অনুভূতি। আর কোনও পড়া ধরা নেই, আর কোনও ওয়ার্নিং বেল নেই, আর কোনও গার্জেন কল নেই। সব দেওয়াল উঠে গিয়ে আছে কেবল ভালবাসা আর শ্রদ্ধা জাহির করবার একখানা টানা বারান্দা, যেখানে সময়ের মেঘ এসে থমকে আছে, রোদকে একটু নিভিয়ে দিয়ে যাবে বলে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে সকলে পাত পেড়ে খেতে বসেছিলাম, মনে আছে। গরম-গরম খিচুড়ি, পাঁচমিশালি তরকারি, বেগুন ভাজা, মাংস, চাটনি, পাঁপড়। এমন খাওয়া বহু জায়গাতেই হয়। কিন্তু ওই যে এক বেঞ্চে বসে এর পাত থেকে কেড়ে, ওর পাত থেকে নিয়ে, হেসে লুটিয়ে পড়ে, শয়তানির হাওয়ায় জড়িয়ে ধরে খাওয়া-দাওয়া করা— এ যেন পৃথিবীর সবচাইতে খোলামেলা টিফিন টাইম। যা কোনওদিন শেষ হবে না কোথাও। হিংসে আর মারামারির পৃথিবীতে এটুকুর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা আর কী-ই বা চাওয়ার আছে! যে-ক’দিন বাঁচব, যেন একে অন্যকে ভালবেসে এ-ওর পাতে ঝুঁকে পড়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে খেতে পারি। আমাদের ছোট-ছোট ভালবাসাগুলো যেন বেঁচে থাকে এভাবেই। কেননা এই স্কুল একদিনও ছুটি হয় না। হবে না কক্ষনও।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র