সেই যুগের ‘ইন্টারনেট’
ভারতে, ১৮৪৪ সালে, অ্যাবেল হোসুয়া হিগিনবথাম একটা বইয়ের দোকান খোলেন। ভারত তখন ব্রিটেনের দখলে, আর হিগিনবথামের বয়স মাত্র ২৫। তিনি বোধহয় কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁর এই বইয়ের দোকান একদিন অনেকগুলো শাখা-সমেত, মুদ্রণ ও প্রকাশনার সংস্থা মিলিয়ে, এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
হিগিনবথাম ছিলেন জাত বই বিক্রেতা। সারা পৃথিবী থেকে তাঁর দোকানে বই আসত, আর তিনি গ্রাহকের চাহিদা বুঝে নিয়ে, অত বইয়ের মধ্যে থেকে ঠিক বইটি সুপারিশ করতে পারতেন। ব্রিটেন থেকে পালিয়ে তিনি মাদ্রাজে আসেন, ভ্রাম্যমাণ বাইবেল-ফিরিওয়ালার কাজ করতে থাকেন, তারপরে লাইব্রেরিয়ান হন। সেখানেই আবিষ্কার করেন, ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য বইয়ের প্রতি তাঁর অসম্ভব আকর্ষণ রয়েছে। এও বুঝতে পারেন, বই নিয়ে তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন, আর বিরল ও বিখ্যাত বইপত্র খুঁজে, জোগাড় করে ফেলতে পারেন।
১৮৯১ সালে তাঁর ছোটছেলে ব্যবসার ভার নেয়। ততদিনে মাদ্রাজ শহরে বই, স্টেশনারি এবং আর বইপত্র-সংক্রান্ত সব জিনিসের প্রধান ঠিকানা হয়ে উঠেছে এই দোকান। ১৯০৪ সালে, দোকানটা উঠে আসে, এখনকার ঠিকানায়। বাড়িটা বিশেষভাবে বানানো হয়, তার উঁচু ঢালু সিলিং আর কমসংখ্যক জানলা বইপত্রকে ধুলো থেকে বাঁচায়, বই নষ্টও হয় কম। আরও একটি দোকান খোলা হয় ব্যাঙ্গালোর-এ। ওই শহরে ওটাই প্রথম বইয়ের দোকান, অচিরেই একনিষ্ঠ ভক্তের দল তৈরি হয়ে যায়। বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাজ এবং দক্ষিণ ভারতের প্রায় সব রেলস্টেশনে হিগিনবথামের বইয়ের দোকান খুলে যায়। পড়ুয়াদের কাছে তাই এই দোকান হয়ে ওঠে একমাত্র পছন্দ— যেদিকে তাকাও এ উপস্থিত। প্রকাশনার কাজও চলতে থাকে। এখনকার ফুড-ব্লগার বা খাদ্য-লেখকরা, মাদ্রাজের এই ঠিকানায় তাঁদের শিকড় খুঁজে পেতে পারেন, কারণ ভারতে প্রথমদিকের ‘কারি কুকবুক’-এর অনেকগুলোই হিগিনবথাম অ্যান্ড কোং থেকে প্রকাশিত।
১৯২৪-’২৫ সালে ডিপার্টমেন্ট স্টোর ‘স্পেন্সার্স’, হিগিনবথামস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স-কে কিনে নিয়ে, অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশার্স (মাদ্রাজ) তৈরি করে। ১৯৪৯ সালে, অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশার্স চেন্নাই-ভিত্তিক ব্যবসায়িক সংগঠন অ্যামালগামেশনস গ্রুপের অংশ হয়ে ওঠে। সেই অর্থে, হিগিনবথামস দেশটির বাকি অংশের চেয়ে কয়েক দশক আগে ব্রিটিশদের জোয়াল ছুড়ে ফেলেছিল। চিফ অপারেটিং অফিসার নাসির আহমেদ শরিফ বলেছেন, ‘সেই বছর এই সংস্থার মালিকানা বিদেশির হাত থেকে দেশিদের হাতে চলে এল।’
১৯৪৪ সালে, হিগিনবথামস আক্ষরিক অর্থেই চাকা গড়গড়িয়ে নতুন যাত্রা শুরু ক’রে, ৫০টি রেলস্টেশনে নিজেদের দোকান খোলে। এই ‘চলমান’ বইয়ের দোকান সেইসব যাত্রীদের বই কেনার ও পড়ার সুযোগ করে দেয়, যাঁরা রাতভর ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছেন। দক্ষিণ ভারতের যে-কোনও মানুষের হিগিনবথামের স্টল দেখার অনুভূতিটা অনেকটা কলকাতার সেই লোকটির মতো, যিনি হঠাৎ ফ্লুরিজ-এর কিয়স্ক দেখতে পেয়েছেন। এই বইয়ের স্টলগুলো কিছু যাত্রীর কাছে ‘রেলগাড়িতে বই পড়া’-র সমার্থক।
‘আপ্পা সকাল দশটায় এগমোর স্টেশনে বইয়ের দোকানটি খুলতেন। ২০টির মতো তাক টেনে বার করা হত, যেখানে সব বই সাজানো থাকত। রাত ১০টায় যতক্ষণ না শেষ ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে যেত, আপ্পা ততক্ষণ দোকান খুলে রাখতেন। ছুটির সময় আমি আর আমার ভাই দোকানে বসে অপূর্ব সব ছবি ভর্তি ‘লে মিসারেবল’ কিংবা ‘কাউন্ট অর মন্টোক্রিস্টো’র পাতার পর পাতা ওল্টাতাম। এখনও বোধহয় মুখস্থ বলতে পারি’, বললেন শ্রীমতী আশা শিবকুমার।
আগেকার মাদ্রাজ এবং ব্যাঙ্গালোরের বহু প্রজন্মের কাছে তাদের সময়ের হিগিনবথামস-এর অসামান্য স্মৃতি রয়েছে।
লেখক রঘু করণাড জানালেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম, মানে ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে, হিগিনবথামস-এর কিছুটা মন্দা চলছিল। শহরের ওই অঞ্চলে অন্য বইয়ের দোকানও গজিয়েছিল, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছিল। তবে হ্যাঁ, হিগিনবথামস-এর একটা জিনিস ছিল, যা অন্য কোনও দোকানের ছিল না, তা হল— ঐতিহ্য। হিগিনবথামসকে জড়িয়ে আমার মায়ের অপূর্ব সব স্মৃতি রয়েছে। মা যখন খুব ছোট ছিল, মানে ১৯৪০-’৫০-এর দশকে, তখন ক্রিসমাসের সময় হিগিনবথামস একটা আশ্চর্য মায়ানগরী হয়ে উঠত। উপহার বেছে নেওয়ার জন্য মা’কে নিয়ে যাওয়া হত ওই দোকানে। আর ছোটদের বইয়ের স্তূপ দেখে মনে হত, একটা বিশাল স্তম্ভ উঠে গেছে। সেগুলো বেশির ভাগই ছিল বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থার বই। বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছোটদের বার্ষিকী পত্রিকা: বড়, বাঁধানো, ছবিতে ভর্তি নানা গল্প, কার্টুন, খেলার সম্ভার। নামগুলোও ছিল দারুণ। যেমন, ‘গার্লস ওন পেপার’। ছোট্ট মেয়ে হিসেবে মায়ের যে-উত্তেজনা ছিল, সেটা আমাদের মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছিল মায়ের সেই সব পুরনো বইগুলোতে ভর করে। আর সঙ্গে ছিল সেই পুরনো দিনের পরিবেশ, সেই পুরনো চার্ম— আর দোকানের নামটাও তেমন, ঠিক যেন একটা গল্পের বই থেকেই সোজা বাস্তবে এসে নেমেছে। এম জি রোডের এই বিশেষ বইয়ের দোকানটা তাই অন্য সব দোকানের চেয়ে আলাদা ছিল।’
বেশির ভাগ বইপ্রেমীদের একই রকম স্মৃতি থাকবে, কারণ এই বইয়ের দোকানটা প্রতিটি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীর জীবনের একটা অংশ। যখন অন্য সব দোকান ব্যর্থ হবে, তখন উদ্ধার পাওয়ার একটাই রাস্তা— হিগিনবথামস। একটি নির্দিষ্ট রেফারেন্স বই বা পাঠ্যবই— যা কোথাও পাওয়া যাবে না, শুধুমাত্র হিগিনবথামস-এ পাওয়া যাবে। আমরা সকলেই বিশ্বাস করতাম : যদি একটা বই কোথাও খুঁজে না পাওয়া যায়, হিগিনবথামস-এ খোঁজো, আর যদি সেখানে না পাওয়া যায়, পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে লাভ নেই। বলতে গেলে, হিগিনবথামস আমাদের কাছে ছিল সেই যুগের ‘ইন্টারনেট’— জ্ঞানের সবচেয়ে বড় সম্ভার।
বই পড়ার ধারাটাই এখন বদলে গিয়েছে। মানুষের মনোযোগ কমে গেছে, পড়ুয়ার সংখ্যাও কমে গেছে। ক্রমবিবর্তনশীল এবং প্রচণ্ড গতিময় একটা পাঠ-সংস্কৃতির সঙ্গে কি একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী এঁটে ওঠে? ভারতের যে কোনও বইয়ের দোকানে গেলে মনে হবে, বইয়ের চেয়ে সেখানে বিক্রি হওয়া অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর পাল্লাই ভারি।
হিগিনবথামস চেন-এর ডিরেক্টর, গৌতম ভেঙ্কটরামানি জানালেন, ‘বহু বইয়ের দোকান এখন বইয়ের জাযগা কমিয়ে অন্য জিনিস বিক্রি করছে, কিন্তু আমরা শুধু সেই জিনিসই বিক্রি করব— বইয়ের সঙ্গে যার সম্পর্ক আছে। আমাদের আসল কাজ বই বিক্রি, বিশেষত পড়ার বই।’
এটা নিশ্চিত ভাবেই একটা জবরদস্ত প্ল্যান—ভারতে এখন বই-পড়ার ব্যাপারটা একটু বিরল হয়ে গেছে, কিন্তু পাঠ্যবইয়ের বাজার বেশ ভালই। হিগিনবথামস-এর আকর্ষণ এখনও আছে, বইয়ের প্রতি যে ভালবাসা দুই শতাব্দী আগে এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতাকে আচ্ছন্ন করেছিল, সেই নেশা এখনও তো কিছু লোককে তাড়িয়ে বেড়ায়। সম্প্রতি একটা নতুন পালক যোগ হয়েছে হিগিনবথাম-এর টুপিতে— রাইটার্স ক্যাফে। কফির মাদকতার সঙ্গে বইয়ের ম্যাজিক— পুরনো উঠোনে পরিবর্তনের হাওয়া যে বেশ বইছে, তা বোঝাই যাচ্ছে।
তথ্য সহায়তা : https://scroll.in/magazine/883493/the-higginbothams-story-how-a-sea-cadet-from-kerala-set-up-indias-oldest-book-chain-in-1844