‘তুলসিদাস জুনিয়র’ সম্বন্ধে কথাবার্তায় মৃদুল তুলসিদাস
তুলসিদাস জুনিয়র’, ছোটদের ছবি, আবার বড়দেরও। আদতে এক ঝলক টাটকা হাওয়া। হিন্দি ভাষায় শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্মের জন্য ২০২২-এ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে এই ছবি। আর স্পেশাল মেনশন ক্যাটেগরিতে মুখ্য শিশু অভিনেতা বরুণ বুদ্ধদেব পেয়েছেন জাতীয় জুরি পুরস্কার। এই সিনেমায় পরিচালক নিজের জীবনের গল্পই শুনিয়েছেন, ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সময়কার আনন্দ আর দুঃখের আখ্যান। ছবির সময়কাল, ডিজিটাল যুগের থাবা বসানোর আগেকার সময়। এখানে নয়ের দশকের কলকাতাকে তুলে ধরা হয়েছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে স্নুকার। বলা যেতে পারে, স্নুকারকে জীবনের রূপক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ছবির বিশেষ প্রাপ্তি, পর্দায় শেষবারের মতো রাজীব ‘চিম্পু’ কাপুরের অভিনয় দেখা। আর আছে, মধ্য কলকাতার পাড়ার প্রাক্তন স্নুকার চ্যাম্পিয়নের ভূমিকায় সঞ্জয় দত্ত, ঠিক নিজের মেজাজে।
নয়ের দশকে কলকাতায় বেড়ে ওঠা এবং সেই অভিজ্ঞতা কীভাবে তাঁর ফিল্মমেকিং-এ কাজে লাগল, এই নিয়ে আমরা কথা বললাম মৃদুল তুলসিদাসের সঙ্গে…
সিনেমাটার আইডিয়া কীভাবে এল?
সিনেমাটার আইডিয়া এসেছিল প্রায় দশ বছরেরও আগে। আমার প্রথম মুক্তি পাওয়া পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘মিসড কল’ শেষ হওয়ার পর থেকেই আইডিয়াটা মাথায় ঘুরঘুর করছিল। ২০০৭ সালে ‘মিসড কল’ কান ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিল। ওই ফেস্টিভ্যাল শেষ হওয়ার পর আমি কিছুদিন কলকাতায় ছিলাম। একটা ফিল্ম তৈরি শেষ হয়ে গেলে কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে না? মানে, ‘এখন কী করব!’ এরকম একটা শূন্যতা তৈরি হয়। এই সময়ই হঠাৎ একদিন মনে হল, এমন একটা ছবি বানাব, যার মুখ্য চরিত্রে থাকবে একটা বাচ্চা। এখন তো আর তেমন সিনেমা আমরা খুব একটা দেখতেই পাই না। এমনকী, বলিউডে হয়তো দশ বছরে মেরেকেটে একটা বাচ্চাদের ছবি বানানো হয়। অতএব এই ছবি।
প্রত্যেক চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকের কাজ করার একটা নিজস্ব পদ্ধতি থাকে। কেউ কেউ অনেক সিনেমা দেখেন, কেউ কেউ প্রচুর বই পড়েন। আমার পদ্ধতিটা হল নিজেই নিজেকে খুঁড়ে বের করা। আমি নিজের জীবনের গল্প শোনাতে ভালোবাসি।
নিজের জীবনের গল্প প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার— আমি মনে করি, আমার সৌভাগ্য যে কলকাতার মতো একটা দুদার্ন্ত জায়গায় জন্মেছি আর বড় হয়েছি। এই শহরে বেড়ে ওঠার মানে হল আপনার মন, চেতনা, বোধ এইসব যখন বয়ঃসন্ধির দোরগোড়া থেকে তৈরি হচ্ছে, তখন কলকাতার মতো আশ্চর্য বৈচিত্র্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিরন্তর চঞ্চল একটা শহরকে আপনি প্রতিটি ইঞ্চিতে শুষে নিতে পারছেন। কলকাতাই একজনের মধ্যে বসবাস করছে।
এইসব চিন্তা-ভাবনা, স্মৃতি, আর অবশ্যই স্নুকার খেলার দুনিয়া থেকেই ‘তুলসিদাস জুনিয়র’-এর আইডিয়াটা এসেছিল। আমার কাছে আমার বাবা ছিলেন একজন মস্ত সেলেব্রিটি। তিনি যখন খেলতেন, হাঁ করে দেখতাম। তিনি জিতলে আনন্দে লাফাতাম, হেরে গেলে মুষড়ে পড়তাম। আর তাই, এই গল্পটা আমাকে বাইরে থেকে নিতে হয়নি, আমার মধ্যেই গল্পটা ছিল। গল্পটা লেখার পর, সিনেমা বানাতে বানাতে দশ বছরের বেশি সময় লেগে গেল বটে, তবে ওই অতটা সময় দেওয়াটা উসুল হয়ে গেছে।
ওইসব ঘটনা আর চরিত্র — সব বাস্তব? তাহলে, আপনার স্নুকার কেরিয়ারের কী হল?
হ্যাঁ, বাস্তব বলতে অধিকাংশ ঘটনাই সত্যি। আমি খুব ভাল স্নুকার খেলতাম; রাজ্যস্তরে আন্ডার-২১ ক্যাটেগরিতে বেঙ্গল নং ৩ ছিলাম। কিন্তু ভাল স্নুকার খেললেই তো হয় না! এই জীবনটা নিয়ে আমি কী করতে চাইছি? — এটা একটা বড় প্রশ্ন ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, আমি ওই গেমটা বাবার জন্যেই খেলতাম। উনি যদি কাবাডি খেলতেন বা কুস্তি লড়তেন, আমিও হয়তো সেসব চেষ্টা করে দেখতাম।
উচ্চাশা বলব, নাকি অন্য কিছু বলব, জানি না, তবে আমি সবসময়েই এমন কোনও কাজ করতে চাইতাম, যেখানে আমি আমার সেরাটা দিতে পারব, যেখানে নিজে কাজ করে খুশি থাকতে পারব। এই খুঁজে চলার কয়েক বছর পরই ফিল্মমেকিং-এর দুনিয়া খুঁজে পেলাম। বুঝতে পারলাম, আমি যা করতে চেয়েছিলাম, বা করতে পারি, সেটা হল ফিল্মের মধ্যে দিয়ে গল্প বলে যাওয়া। সিনেমায় আমি আমার সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছা, সব উচ্চাশা নিয়ে বাঁচতে পারব।
রাজীব কাপুরকে কাস্ট করার বিষয়ে কিছু বলুন।
এই সিনেমার মূল চালক হল বাবার চরিত্রটা। আমি চেয়েছিলাম যে, এই বাবা এমন কেউ হবেন, যাঁকে ভীষণভাবে ভালবাসতে ইচ্ছে করবে। অবশ্যই তাঁকে ক্লাব মেম্বারদের মতো দেখতে হতে হবে — কলকাতার ক্লাব মেম্বারদের একটা টিপিক্যাল চালচলন থাকে। রাজীবজিকে কাস্ট করার সব ক্রেডিট আমার প্রযোজক আশুতোষ গোয়ারিকারের। একদিন কথায় কথায় আশু স্যার বললেন, এই চরিত্রের জন্য সেরা মানানসই অভিনেতা হবেন রাজীব কাপুর। শুনে আমি তো থ! ভাবুন! ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’-র পর ওঁকে তো সেভাবে কোথাও দেখাই যায়নি! আমরা একদিন ওঁকে ফোন করলাম, স্ক্রিপ্টটা পড়ে শোনালাম। উনি পছন্দ করলেন, আর পর্দায় কামব্যাক করতে রাজি হলেন!
তবে ব্যাপারটা এতটাও সহজ ছিল না। প্রথমবার যখন রাজীবজিকে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল উনি একটা অবসরপ্রাপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন। অনেক মোটা হয়ে গেছেন, চুল প্রায় সবই সাদা হয়ে গেছে। মনে হয়েছিল, ১৩ বছরের একটা বাচ্চার বাবার চরিত্রে দেখতে খুবই বুড়ো লাগবে।
আমি জানি না আশু স্যার ওঁকে কী বুঝিয়েছিলেন! কিন্তু তিন মাস পর যখন উনি লুক টেস্টের জন্য এলেন, আমি দেখে চমকে গেলাম! আসলে, আশু স্যারের চেষ্টাতেই, কামব্যাক ফিল্মের জন্য সম্পূর্ণ লাইফস্টাইল পালটে ফেলে উনি প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন।
ফিল্মমেকার হিসেবে, সবথেকে বড় কাজ হল একদম ঠিকঠাক কাস্টিং করা। যে চরিত্রে অভিনেতা কাজ করবেন, সেই চরিত্রের অনুভূতি যেন তাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া। রাজীবজি করেছিলেন সিনিয়র তুলসিদাসের চরিত্র। ওঁর সঙ্গে কাজ করে ভীষণ ভাল লেগেছিল।
এই দুনিয়ায় অনেক কিছু খুব অদ্ভুত হয়, যার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। মারা যাওয়ার আগে, রাজীবজি আর আমার বাবা, দুজনকেই সিনেমাটা দেখাতে পেরেছিলাম। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বাস্তবের আর পর্দার তুলসিদাস সিনিয়র আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এখন, যখন ফিল্মটা নিয়ে লোকজন এত আলোচনা করছেন, আমি চুপ করে ভাবি, দূরে অনেক ওপরে কোথাও থেকে ওঁরা দুজন দেখছেন, আমাদের আশির্বাদ করছেন।
সঞ্জয় দত্তের কাস্টিং সম্বন্ধে বলুন…
একমাত্র সঞ্জয় দত্তের কথা মাথায় রেখেই সালাম ভাইয়ের চরিত্রটা লিখেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি সঞ্জয় দত্তের বিশাল ভক্ত। আমার মনে আছে, মেনকা সিনেমা হলে ‘খলনায়ক’ দেখতে গিয়েছিলাম। সেইসময়ে হলে মানুষের ভিড় উপচে পড়ত! টাইটেল সং-এ ওঁর এন্ট্রি হওয়ার পর প্রায় ১৫ মিনিট ধরে হাততালি, সিটি! ওঃ, আর কিচ্ছু শুনতেই পাচ্ছিলাম না! সেসব অদ্ভুত পাগলামি ছিল।
আমার সিনেমায় একদিন সঞ্জয় দত্ত কাজ করবেন, এরকম একটা স্বপ্ন পূরণের আশায়, তাঁর চরিত্রের জন্য একটা জোরদার এন্ট্রি লিখেছিলাম। তিনি কীভাবে সবসময় ওয়েলিংটন ওয়াইএমসিএ-র একটা বেঞ্চে ঘুমোবেন, পর্দায় শুধু একটা রুমাল-ঢাকা, রহস্যময়, কিংবদন্তী স্নুকার চ্যাম্পিয়নের কথা বলা হবে, কিন্তু দেখানো হবে না, আর শেষমেশ রুমালের আড়ালে থাকা মানুষটা উঠে বসবেন! মুম্বাইতে একটা হলে ২০০ জন বাচ্চাকে এনে একটা স্ক্রিনিং করিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন, সেই ২৮ বছর আগে মেনকায় সঞ্জয় দত্তের এন্ট্রিতে যেরকম অনুভূতি হয়েছিল, ঠিক সেরকম এখানেও হল! হল যেন ফেটে পড়ছিল, বাচ্চাগুলো চিল-চিৎকার করছিল, সিটি বাজাচ্ছিল, হাততালি দিচ্ছিল — সেই একই অদ্ভুত পাগলামো!
যখন ২০১২-১৩ সালে সঞ্জয় দত্তকে কাস্ট করার কথা প্রথম ভেবেছিলাম, তখন উনি জেলে ছিলেন। ওঁকে ফিল্মটা পিচ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তখন সেটা করতে পারিনি। আশু স্যার আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর, একদিন সঞ্জয় দত্তকে কাস্ট করার বিষয়টা বললাম। তিনি জাস্ট ফোনটা তুলে ওঁকে কল করলেন; বললেন যে, একটা স্ক্রিপ্ট আছে, শুনতেই হবে। দিন দুই পর, সঞ্জয় দত্ত ‘তুলসিদাস জুনিয়র’ শুনলেন আর ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন! মানে, আমি ১০ বছর ধরে যেটা করার চেষ্টা করছিলাম, সেটা দু দিনেই মিটে গেল…
প্রভাবশালী স্নুকার চ্যাম্পিয়ন জিমি ট্যান্ডনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দলিপ তাহিল, পর্দায় তাঁকে আমরা কুখ্যাত ভিলেন হিসেবেই দেখতেই ভালোবাসি…
উনি হলেন পারফেক্ট ভিলেন, তাই না? উনি এত নিপুণ যে, ওঁর নেক্সট মুভ কী হবে সেটা জাস্ট দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। মানে, ওঁকে যতই অপছন্দ হোক, কিছু করার নেই। একটা খল চরিত্রে, কোনও প্রায়শ্চিত্ত না করা একটা ভয়ংকর শয়তান হলেও পর্দায় ওঁকে শুধু দেখে যেতে হয়… (হাসি)!
মিডিকে কীভাবে খুঁজে পেলেন?
বরুণকে খুঁজে পাওয়ার আগে আমরা প্রায় ১৫০-২০০ জন বাচ্চার অডিশন নিয়েছিলাম। আমার কাস্টিং ডিরেক্টর আর অন্যরাও বরুণের ব্যাপারে বলছিলেন। একদিন ওকে ডেকে এনে অডিশন নিলাম। ছেলেটা দুর্দান্ত অডিশন দিল। অডিশন নেওয়া বাচ্চাদের মধ্যে শেষ তিনজনের শর্ট-লিস্টে ও ছিল।
সেইদিনই রাত্রে, আমার স্ত্রী আমার ১৩ বছর বয়সের একটা পুরনো ছবি ঘেঁটে বের করেছিলেন। সেটা দেখে, আমার, মিডির, আর বরুণের মধ্যে এত মিল পেলাম যে, ভাবতে পারবেন না! আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, বরুণ একাই নিজের কাঁধে ফিল্মটা উতরে দিয়েছে, দুর্দান্ত পারফর্ম করেছে!
বড়ো ভাই গোটির চরিত্রে চিন্ময় চন্দ্রনশুহ…
মিডির চরিত্রে বরুণ বুদ্ধদেবকে পাওয়ার পর, আমরা বরুণকে সঙ্গে নিয়ে, অনেক বাচ্চাদের অডিশন নিতে শুরু করলাম। কারণ, দুই ভাইয়ের মধ্যে মিল থাকতে হবে। আমার কাস্টিং ডিরেক্টর ‘কুইন’-এ চিন্ময়ের কাজ দেখে, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ছেলেটা এল। কিন্তু এত শান্ত, এত চুপচাপ যে, আমি বুঝতে পারছিলাম না একে নিয়ে কী করব! মনে হয়, পৃথিবীর সবথেকে সরল সিধাসাদা বাচ্চাদের মধ্যে চিন্ময় একজন। আমার মাথা কাজ করছিল না! তখন শুট শুরু করতে আর মাত্র দু সপ্তাহ বাকি! আমার খালি একটাই কথা মনে হচ্ছিল, এই ছেলেটার কাজ যেন উতরে যায়! তো, আমরা অডিশন শুরু করলাম। যেইমাত্র ক্যামেরা চালু হল, কী বলব! ছেলেটা পুরো ১৮০ ডিগ্রি পালটে গেল! তখন সে একদম সেই চরিত্রে ঢুকে সেইরকমভাবে কথা বলছে! সেইরকম মস্তান-মার্কা চোখে চারিদিকে দেখছে, ছোট ভাইয়ের উপর চোটপাট করার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে সাবলীল হয়ে পড়ছে! ওই হঠাৎ বদলে যাওয়াটা বলে বোঝানো মুশকিল! আমি বুঝতে পারলাম এই হল আসল অভিনয়। নিজের সঙ্গে যার কোনও যোগাযোগই নেই। ব্যাপারটা প্রায় অলৌকিক!
টুটু বোসের চরিত্রে ডন (রামাদিত্য) রায় আর ওই ট্রাম কনডাক্টর, এঁরাও পর্দায় ওইটুকু এসেই বাজিমাৎ করে দিয়েছেন…
এঁরা হলেন টিপিক্যাল কলকাতার চরিত্র, তাই না? (হাসতে শুরু করলেন)
আসলে, ফিল্মে একটু হাসি-মজার দরকার হয়। আশু স্যার একদিন বললেন এমন কোনও চরিত্র রাখতে, যেটা খানিকটা অসিত সেনের মতো হবে। আমার তক্ষুনি মনে পড়েছিল শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের কথা। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, শাশ্বত এই দেশের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা। তাছাড়া, এই চরিত্রে বোধহয় তাঁকে মানাবে না।
আমরা টুটুর চরিত্রের জন্য অভিনেতা খুঁজছিলাম। আমি তখন ডনকে চিনতাম না। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর স্ত্রী ইন্দ্রাণী ওঁকে চিনতেন। উনি আমাকে বললেন, এই ডাক্তারবাবু ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার, আর অনেক বছর আগে থিয়েটার করতেন।
ডনের কথা বলার একটা ভিডিও ইন্দ্রাণী আমাদের পাঠালেন। ভিডিওটায় কলকাতার একজন বিখ্যাত ডাক্তার অভিনয় করছেন না, শুধু কথা বলছেন। কী বলব! আমরা ভিডিওটা দেখে হো-হো করে হাসতে শুরু করেছিলাম! একজন ভদ্রলোক একটা সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলছেন, কিন্তু যখনই আমি দেখছি, বা যাঁকেই দেখাচ্ছি, সকলে হেসে ফেলছেন! অডিশনের জন্য আমরা ওঁকে কয়েকটা লাইন পাঠিয়েছিলাম। উনি রাত ১টায় সেটা রেকর্ড করেছিলেন। এত মিষ্টিভাবে, এত আন্তরিকভাবে করেছিলেন যে, আমরা ওঁকে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম! টুটু বোসের ঝামেলা মিটে গিয়েছিল!
ট্রাম কনডাক্টরের চরিত্রটা করেছেন মন্টু দাস, যিনি কলকাতার থিয়েটারের একজন পরিচিত অভিনেতা। হ্যাঁ, উনিও একদম ঠিকঠাক ছিলেন। পর্দায় যখনই মুখ খুলেছেন, দর্শকের মনে ছাপ রেখে গেছেন!
আমার মনে হয়, কলকাতার এইসব খাঁটি, ছোটোখাটো চরিত্রগুলো তাঁদের খুঁটিনাটি নিয়ে এই সিনেমাটাকে আরও জ্যান্ত করে তুলেছেন; আরও ‘লোকাল’ করে তুলেছেন। ফলে, শেষমেশ, এটা দর্শকের হৃদয়ে সাড়া জাগাতে পেরেছে।
সিনেমাটার OST আর আবহসঙ্গীত…
আমার প্রথম ছবি ‘মিসড কল’-এর মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন ড্যানিয়েল বি. জর্জ। উনি শ্রীরাম রাঘবনের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন, ‘অন্ধাধুন’ যার মধ্যে অন্যতম। এখানে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরটা উনি ম্যাজিকের মতো করেছেন। ওঁর কমফোর্ট জোনের বাইরে হলেও, থিমটা একেবারে জমিয়ে দিয়েছেন। দুটো বা তিনটে থিম উনি বানিয়েছিলেন, যেটা পরে মূল স্কোর করতে কাজে লেগেছিল।
‘উড় চলা’ গানটা দারুণ! বাবা-ছেলের থিম নিয়ে এটা বানানো হয়েছিল। প্রথমে আমরা বুঝতে পারছিলাম না ফিল্মের শেষে কী রাখব! কোনও গান রাখব, নাকি শুধু একটা স্কোর রাখব! তো, গানটা স্বানন্দ (কিরকিরে) খুব সুন্দর লিখলেন। আর, সচেত ট্যান্ডন চমৎকার গাইলেন। গানটা খুবই ইন্সপায়ারিং হয়ে উঠল। মনে হয়, অনেক বাচ্চাই এই গানটা লুপে শুনেছে!
কলকাতা, বিশেষ করে মধ্য কলকাতার ওয়েলেসলি আর ওয়েলিংটন, নিজেই এক একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে…
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, আমি পার্ক স্ট্রিট এলাকায় বড় হয়েছিলাম। আমরা থাকতাম সেন্ট জেভিয়ার্সের পিছনদিকের গেটের ঠিক বাইরে, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে। আমি পড়াশোনা করেছি লা মার্টিনিয়ারে আর ভবানীপুর কলেজে। মানে, বলতে পারেন, আমি সবদিক থেকেই কলকাতার ছেলে। তবে, ওই জায়গাগুলো কলকাতার একটা অংশ, পুরো কলকাতা নয়।
আমি আর আমার দাদা মধ্য কলকাতায় স্নুকার ক্লাবগুলোতে ঘোরাঘুরি শুরু করার পর, ওই চত্বরে আমার সত্যিকারের যাতায়াত শুরু হয়েছিল। প্রথমদিকে আমরা ওয়াইএমসিএ-চৌরঙ্গিতে যেতাম, পরে ওয়েলিংটনে যেতাম। আমরা প্রথমবার ট্রাম দেখেছিলাম রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে। নোনাপুকুর ডিপো থেকে ট্রামটা বেরিয়ে, ক্রাউন সিনেমা হল ক্রস করে, মৌলানা আজাদ কলেজের দিকে যাচ্ছিল। মাথার ওপর জটলা পাকানো তার, নানা রকমের লোকজন, চেঁচামেচি, একটা ছোট্ট সরু গলির মধ্যে সবরকমের গাড়িঘোড়া ঢুকে একটা আরেকটাকে গোঁত্তা মারছে! এর আগে কলকাতার ওই জায়গাগুলো আমি দেখিনি। আমার মনে আছে, দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমরা কী কলকাতার ভেতরেই আছি! দাদা তখন ‘দুনিয়ার আরেক দিক’ এরকম কিছু-একটা বলেছিল। আমার মনে হয়েছিল, আমার কপাল খুব ভাল যে, এইসব দেখতে পারছি। এখনও দেখবেন, কলকাতার ওইসব জায়গা একইরকম আছে!
‘তুলসিদাস’-এর কয়েকটা দৃশ্য নোনাপুকুর ডিপোয় শুট করা হয়।
এই সিনেমার কাহিনি, চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি, এমনকী অভিনয়ও এই ডিজিটাল যুগের আগের সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ওই সময়টা নিয়ে একটা সিনেমা বানানো কতটা কঠিন লেগেছে?
আমার একটাই সুবিধা ছিল যে, আমি ওই সময়টাকে নিজে দেখেছি। আমাদের প্রোডাকশন ডিজাইনার আর কস্টিউম ডিজাইনার নানান জিনিসপত্র বানিয়ে আমাকে দেখাতেন। আমি ঠিক ধরতে পারতাম ওগুলো সেই সময়ের মতো দেখতে লাগছে কিনা। জামার কলারের শেপ, জুতো, পোশাকের টেক্সচার, এইসব তো আমি নিজেই জানি। সেগুলো নতুন করে বানানো বেশ কঠিন কাজ বটে, কিন্তু দেখে-টেখে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলাটা সহজ। যদি সিনেমাটা পাঁচের দশকের কোনও কাহিনি হত, তাহলে আমার পক্ষে বেশ মুশকিল হত। কারণ, ওইসময়ের কোনও রেফারেন্স আমার হাতে নেই।
এই ছবিতে স্নুকার শুধুমাত্র একটা খেলা নয়, সেটা একটা অ্যাটিটিউড। একজন ফিল্মমেকার হিসেবে, স্নুকার আপনাকে কী শিখিয়েছে?
স্নুকার আমাকে শিখিয়েছে নিষ্ঠা, মনোযোগ, অঙ্গীকার, অধ্যবসায়, ধৈর্য… এইগুলোই হল স্নুকার খেলার চাবিকাঠি। আপনাকে ভীষণ ধৈর্য ধরতে হবে। আরেকজন বল পটিং করছেন দেখে যদি আপনি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনি হেরে যাবেন। সত্যি কথা বলতে, এই খেলাটার ৯৯% হল মাথা ঠাণ্ডা রাখা। এখানে হাত ছাড়া বাকি শরীরের খুব বেশি নড়াচড়ার দরকার পড়ে না। ফিল্মমেকিং-ও হল মাথার খেলা। পর্দায় জ্যান্ত হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত আপনার ফিল্ম আপনার মাথাতেই থাকে। আসলে, এই প্রশ্নটা কেউ আমাকে করেননি (হাসি), তবে আমি নিশ্চিত যে, ফিল্মমেকার হিসেবে আমার দক্ষতায় শান দেওয়ার জন্য স্নুকার খেলার এইসব গুণ আমার কাজে লেগেছে।
আপনার পরবর্তী ছবির জন্য কী পরিকল্পনা করছেন? ‘তুলসিদাস’-এর এই সাফল্যের সঙ্গে তাল মেলানো কতটা সহজ বা কঠিন হবে?
আমি অনেক কিছু লিখি, লিখতে থাকি। আগে ভাবতাম, ‘তুলসিদাস’ একদিন রিলিজ করবে, সকলে পছন্দ করবে, তাহলে আমি আরও সিনেমা বানানোর সুযোগ পাব, আরও গল্প বলতে পারব। অনেক সময় চট করে গল্প, চিত্রনাট্য, স্ক্রিপ্ট এসব লিখে পিচ করি। আমি জানি না এর পর ঠিক কোনটা বানাতে পারব (হাসি)। হ্যাঁ, এখন এই জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার ফলে পরের সিনেমা নিয়ে সকলের প্রত্যাশা নিশ্চয়ই বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি ওইসব ভেবে কাজ করব না। আমার প্রথম পরিচয় থাকবে একজন গল্পকার হিসেবেই। এগুলো পজিটিভ চাপ হিসেবেই নেব। দ্বিগুণ পরিশ্রম করব। মানুষকে আনন্দ আর ফুর্তি দেওয়ার চেষ্টা করব। ছোটোদের প্রেরণা দেওয়ার মতো কিছু বানাতে চেষ্টা করব। আর, অবশ্যই অতীতের সব অভিজ্ঞতায় আবার ফিরে যেতে চাইব।
‘তুলসিদাস জুনিয়র’-এ টুটু বোসের চরিত্রে অভিনয় করা সম্বন্ধে বললেন ডাঃ রামাদিত্য রায় ওরফে ডন রায়
এক কথায়, ব্যাপারটা চমৎকার! আমি খুব ভেবেচিন্তেই কলকাতার ফিল্ম আর টিভি জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। যদিও একসময়ে জোছন দস্তিদারের চার্বাক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, গ্রুপ থিয়েটার করেছি, কিন্তু ওইসব জায়গায় ফিরে যাওয়ার কথা আর ভাবতাম না। তাছাড়া, একজন ডাক্তার হিসেবে হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্টের পেশায় আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে হ্যাঁ, সবসময়েই ওই জগতের মানুষদের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ ছিল।
টুটু বোসের চরিত্রে প্রথমে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে অভিনয় করানোর কথা ছিল, কিন্তু কী-একটা কারণে সেটা হল না। তো, সেইসময়ে ফিল্মমেকার পাগলের মতো খুঁজছেন চরিত্রটা কাকে দিয়ে করানো যায়! তখন, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর মাধ্যমে মৃদুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হল। ওঁরা সকলে আমার ফটো আর ভিডিও দেখলেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আমি ছাড়া অন্য কেউ টুটু বোসের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন না। তবে, আমাকে বোঝাতে ওঁদের অনেক সময় লেগেছিল।
কলকাতা আর মুম্বাই — দু জায়গাতেই শুট করা হয়েছিল। বেশিরভাগ ইন্ডোর সিন মুম্বাইতে শুট করা হয়েছিল। কলকাতায় তোলা সিনগুলোর সঙ্গে সেগুলো ওঁরা একদম ঠিকঠাক মিলিয়ে ছিলেন। শুটিং করে দারুণ লেগেছে আমার, যেন একটা স্বপ্ন সত্যি হল! সবজায়গায় সবসময়ে পুরো প্রফেশনাল মেজাজ। ওঁরা সত্যিই, একদম সত্যিই, সময়ের কদর করেন। শুটিং-এর শিডিউল যেভাবে করা হয়, একদম সেইভাবে ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ করা হয়। আর, মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিতে সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও অন্তরঙ্গতা দুর্দান্ত। সকলেই খুব হেল্পফুল। মানে, একসঙ্গে কাজ করে একটা ফিল্ম বানাতে হলে যেমনটা চাই। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা ইউনিট আমার সেকেন্ড ফ্যামিলি হয়ে গেছিল।
প্রথমদিন আমার শুট ছিল সঞ্জু বাবার (সঞ্জয় দত্ত) সঙ্গে, আর ঠিক আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আশুতোষ গোয়ারিকার! সত্যি বলতে, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না! দৃশ্যটা ছিল এইরকম— স্নুকার গেমের ফাইনাল চলছে, সঞ্জয় দত্তের অভিনীত চরিত্র সালাম ভাইয়ের পাশে এসে বসে টুটু এবং ক্যাবলার মতো হাসে, এবং পরমূহুর্তেই হাসি সম্বরণ করে নেয়। কিন্তু সালাম ভাই টুটুকে একটা বিরল হাসিমুখ উপহার দেন! প্রথম শটেই সেটা ‘Okay’ হয়ে গেছিল! সঞ্জয় দত্ত পরে আমাকে বলেছিলেন যে, আমার পারফর্মেন্স নাকি সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল!
আমাকে এক মাস ধরে স্নুকার খেলার ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। কারণ, আগে কখনও ওই গেম খেলিনি। একজন যাচ্ছেতাই স্নুকার প্লেয়ার হিসেবে টুটুর চরিত্রটা অত ভালোভাবে ফুটে ওঠার কারণই ছিল যে, আমি নিজে একজন শোচনীয় স্নুকার প্লেয়ার। এমনকী ক্যামেরার সামনেও আমি একটাও বল পকেটে ফেলতে পারিনি! বুঝে দেখুন, ওগুলো একদম রিয়েল টেক ছিল! মৃদুল যখন ছোট ছিলেন, তখন নিশ্চয়ই টুটু বোসকে দেখেছিলেন। আর, খাওয়াদাওয়া ও খেলাধুলোয় তাঁর সমঝদারি সম্বন্ধে মুগ্ধ হয়েছিলেন। একরকমভাবে বলা যায়, এই চরিত্রটা ছিল আসল টুটু বোসের প্রতি মৃদুলের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
বাচ্চাগুলোও সাংঘাতিক দুরন্ত ছিল, বিশেষ করে বরুণ। ওই ছেলেটা বোধহয় সেই জেকিল-অ্যান্ড-হাইড! শটের ৩০ সেকেন্ড আগে পর্যন্ত পুরো জায়গাটায় হুড়োহুড়ি করবে, যেইমাত্র শট শুরু হবে, ব্যাস, নিজেকে একদম পালটে ফেলবে! ফ্লোরের ভেতরে যতরকম কাণ্ড করা যায়, সব করবে! ক্লাইম্যাক্স সিনে আমি যে বিশাল বো-টাইটা পরেছিলাম, একদিন দেখি সেটা ধরে টানাটানি করছে! ঠিক শটে ডাকার আগের মুহূর্তে সে এসে হাজির, এদিকে আমার বো-টাই পাওয়া যাচ্ছে না!
দলিপ তাহিলকে মনে থাকবে ওঁর আন্তরিকতার জন্য। ঘটনা হল, ফ্লোরে তিনি একদিন অসুস্থ বোধ করায়, আমি ডাক্তারের ভূমিকায় নেমে পড়লাম। ব্যাস্, তারপর থেকে আমাকে দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হত, একজন অভিনেতা, আরেকজন গোটা ইউনিটের ডাক্তারবাবু!
আশু স্যার (আশুতোষ গোয়ারিকার) আমাকে একদিন ফোন করে আরও কাজ করার কথা বলছিলেন। আমি বললাম, আমি শুধুমাত্র ওঁর ওই দুর্দান্ত ইউনিটের সঙ্গেই কাজ করতে চাই! এই চরিত্রে অভিনয় করার পর আমি কয়েকটা অ্যাড ফিল্মে কাজ করেছি। ভবিষ্যতে হয়তো কমিক ভিলেনের একটা চরিত্র করব। দেখা যাক, কী হয়!
ছবি সৌজন্য মৃদুল তুলসিদাস এবং ডা: রামাদিত্য রায়