ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শুভারম্ভ: পর্ব ১৯


    শুভা মুদ্গল (Shubha Mudgal) (August 27, 2022)
     

    সহবতের অভাব

    সঙ্গীত বা নৃত্যের অনুষ্ঠান বা ফেস্টিভাল করার জন্য যে স্পনসর, পৃষ্ঠপোষক এবং শ্রোতা-দর্শকদের প্রয়োজন, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মাঝেমধ্যেই শিল্পীদের ধরাকে সরা জ্ঞান করা স্পনসর বা উদ্ধত পৃষ্ঠপোষকদের দিক থেকে নানাবিধ ঝামেলায় পড়তে হয়, যাঁদের আসলে শিল্পের কদর করার মতো রসবোধই নেই,  বা থাকলেও তা খুবই সামান্য। যে সব শিল্পীদের নিদেনপক্ষে কয়েক বছরও ভারতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদের সবার মুখেই যে এ বিষয়ে ভয়ানক রোমহর্ষক সব কাহিনী শোনা যাবে, তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই। নিজের চোখে কাছ থেকে দেখেছি বা বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে জেনেছি, এমন কিছু ঘটনার কথা এখানে বলতে চাই। এ সব কাহিনীর মুখ্য চরিত্রদের নামগুলোকে আমি রেখেঢেকে বলছি। বলা যায় না, স্পর্শকাতরতার আতিশয্যের এই মহামারীর যুগে কার আবার “অনুভূতিতে আঘাত” লেগে যায়! তবে যাঁরা শিল্পের অনুষ্ঠান নষ্ট করেন বা সমস্ত উদ্যোগে জল ঢেলে দেন, তাঁদের কথা লিখতে বসে গোড়াতেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, এঁদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের সংখ্যা বিপুল ও অবিরল।

    এমন একটি ঘটনার কথা বলে শুরু করি, যা জনসমক্ষেই এসে পড়েছে, অতএব রাখঢাক করার কোনো দরকার নেই। ইদানীং বিহারের কথা খবরে যেহেতু প্রায়ই উঠে আসছে, সেহেতু আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগে, অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে, ওই বিহারেরই বাৎসরিক রাজগীর নৃত্য উৎসবে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা দিয়ে শুরু করা সমীচীন বোধ করলাম। সে অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রখ্যাত নাচিয়ে সংযুক্তা পাণিগ্রাহী মহোদয়াকে। তিনি সেখানে মঞ্চে ওঠার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু তাঁর নাচের আগে কিছু সরকারি কর্মচারী, আমলা এবং রাজনৈতিক নেতা বক্তব্য রাখবেন, এই বলে তাঁর অনুষ্ঠানটি শুরু হতে দেরি হচ্ছিল। সে অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব, এবং লম্বা লম্বা ভাষণ শুনে ক্লান্ত হয়ে তিনি দাবি করেছিলেন, নাচের অনুষ্ঠানটাকে অল্পের মধ্যেই সেরে ফেলা হোক। সঙ্গত করার বাজনদারেরা যখন সবে মঞ্চে উঠে একটু ধাতস্থ হয়ে বসছেন, বাজনাগুলোকে সুরে বাঁধছেন, তখন তিনি তাঁদের দিকে আঙুল তুলে রীতিমতো শাসাতে শুরু করলেন, দু’ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে। অত্যন্ত অপমানিত এবং লজ্জিত বোধ করে শিল্পীরা চেষ্টা করলেন অনুষ্ঠানটাকে ভালো করে করার, কিন্তু গোটা অনুষ্ঠান জুড়েই মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর অনুচর-বিদূষকদের চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাইয়ে যাওয়া হল,, সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললো তাঁদের রঙ্গ-রসিকতা, হাসাহাসি, জোরে জোরে কথাবার্তা এবং শিল্পীদের ক্রমাগত উত্যক্ত করে যাওয়া। সবচেয়ে লজ্জার বিষয়ে, প্রখ্যাত শিল্পী পাণিগ্রাহী যখন নিজে মঞ্চে উঠে তাঁরই একটি নাচের বিষয়ে কিছু ভূমিকা দেবার চেষ্টা করছেন, শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রী রূঢ়ভাবে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, আপনি আরো নাচবেন নাকি অন্য কাউকেও নাচতে দেবেন? আপনি না হয় আবার পরে নাচবেন। পাণিগ্রাহী পেশাদারিত্বের প্রতিভূ, তিনি উত্তর দিলেন, আমি আর পাঁচ মিনিট নেব। এই বলে শেষ নাচটি পরিবেশন করে তিনি আসর গুটিয়ে ফেললেন। 

    এ গল্প শুনেও যদি যথেষ্ট ভয়ানক না মনে হয়, দেশের প্রাচীনতম শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবের থেকে একটি শোনা কাহিনীর কথা বলি। এ উৎসবে সেদিন মঞ্চে রয়েছেন একজন বর্ষীয়ান এবং অত্যন্ত অভিজ্ঞ যন্ত্রশিল্পী, তাঁর পাশে সঙ্গত করার জন্য রয়েছেন একজন তবলিয়া। সবে তিনি শান্ত, স্থবির, গভীরভাবে চিন্তাশীল সুরে একটি রাতের রাগের আলাপ ধরেছেন, এমন সময়ে উদ্যোক্তারা অত্যন্ত উদ্ধতভাবে তাঁর বাজনা থামাতে হুকুম দিলেন, কারণ একজন ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতা তখন অনুষ্ঠানে ঢুকছেন, তাঁর আসেপাশে তাঁর অনুচরেরা, বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী এবং পিছনে পিছনে কিছু উটকো লোকেও ভিড় করে এসেছে। তিনি এসেছেন একটি প্রতীকী উপস্থিতি দেখাতে, কাজেই সেই মুহূর্তে তাঁকে আসরের মধ্যমণি করতে হবে। অতএব এই গোটা দলটি জুতো পায়েই গটমট করে গানের মঞ্চে উঠে পড়লো, সঙ্গে বন্দুকধারীরাও উঠলেন। একটি ছোট ভাষণ হল, এবং তার পরেই আবার গোটা দল জুতো মশমশিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে প্যান্ডাল থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গীতের মাধুর্য এবং শিল্পীর একনিষ্ঠ বাজনাকে যে এতে অশালীনভাবে বিঘ্ন ঘটানো হল, তার মধ্যে ঔদ্ধত্য ছিল ষোলো আনা, এবং দুঃখপ্রকাশের ছিঁটেফোঁটাও পাওয়া গেলো না। সঙ্গীতের প্রসার এবং এ দেশের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যের অর্চনার প্রতি নিষ্ঠাবান শিল্পীরা চুপচাপ আবার নিজেদের অনুষ্ঠান শুরু করলেন, উদ্যোক্তাদের কেউ একবারের জন্যেও তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইবার প্রয়োজন বোধ করলেন না!

    রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানের দ্বারা আয়োজিত যে সব শিল্পের অনুষ্ঠান, তার প্রচারে ব্যবহৃত পোস্টারে বা ছবিতে যে বড় করে রাজনৈতিক নেতাদেরই ফোটোগ্রাফ দেওয়া থাকে, তা প্রায়ই চোখে পড়ে। এ সব ছবিতে তাঁদের ভূমিকা দেখলে মনে হয়, এ সব মন্ত্রী-নেতারাই বুঝি মহাতারকা শিল্পী! এদিকে অনুষ্ঠানে যাঁরা বাজাবেন, সেই সব শিল্পীদের ছবি বড়জোর ডাকটিকিটের আয়তনে পোস্টারে থাকে, কখনও তা-ও থাকে না। প্রচারের সবরকম বিজ্ঞাপন থেকে সঙ্গতকারী শিল্পীদের নামটুকুও মাঝেমাঝে বাদ পড়ে যায়।

    ঘটনাচক্রে বলে রাখি, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানের দ্বারা আয়োজিত যে সব শিল্পের অনুষ্ঠান, তার প্রচারে ব্যবহৃত পোস্টারে বা ছবিতে যে বড় করে রাজনৈতিক নেতাদেরই ফোটোগ্রাফ দেওয়া থাকে, তা প্রায়ই চোখে পড়ে। এ সব ছবিতে তাঁদের ভূমিকা দেখলে মনে হয়, এ সব মন্ত্রী-নেতারাই বুঝি মহাতারকা শিল্পী! এদিকে অনুষ্ঠানে যাঁরা বাজাবেন, সেই সব শিল্পীদের ছবি বড়জোর ডাকটিকিটের আয়তনে পোস্টারে থাকে, কখনও তা-ও থাকে না। প্রচারের সবরকম বিজ্ঞাপন থেকে সঙ্গতকারী শিল্পীদের নামটুকুও মাঝেমাঝে বাদ পড়ে যায়। সম্প্রতি এমন একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে আমারও গাইবার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে সব পোস্টার আর হোর্ডিংজুড়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মাননীয়া ভার্যার ছবি, ফোটোগ্রাফ থেকে তাঁদের ভক্ত প্রজাদের দিকে তাঁরা দয়ালু রাজার দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছেন। আর অনুষ্ঠানে যাঁরা বাজাবেন, সেই সব শিল্পীরা? তাঁদের নামও ছাপা হয়েছে, তবে এই টুকু টুকু রুগ্ন, ক্লিষ্ট হরফে, যা আতসকাচ দিয়ে না দেখলে চোখে পড়াই দুষ্কর।

    যেহেতু সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে টাকাপয়সা বা স্পনসরশিপ মাঝেমাঝে রাজনৈতিক নেতাদের দাক্ষিণ্যেই আসে, সেহেতু উদ্যোক্তারা (এমনকী যাঁরা আগে শিল্পী ছিলেন, পরে উদ্যোক্তা হয়েছেন, তাঁরাও) তাঁদের দাক্ষিণ্য এবং দানের জন্য তাঁদের প্রতি একেবারে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এই আর্থিক সাহায্যের কৃতজ্ঞতায় তাঁদের অনুরোধ জানানো হয়, তাঁরা যদি প্রধান অতিথি বা সভাপতি হিসেবে এ সব অনুষ্ঠানে “পায়ের ধুলো দিয়ে ধন্য করেন।” শিল্পীদের হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দিয়ে তাঁদের সম্বর্ধনা জানানোর সম্মান এঁদেরই দেওয়া হয়। এমনই একটি পরিস্থিতিতে আমি একবার জানতে পারলাম, আমাকে যে রাজনৈতিক নেতা সম্বর্ধনা দেবেন, তাঁর নামে একাধিক ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির অভিযোগ রয়েছে। আমি কঠিন রাস্তাটা বেছে নিয়ে জানিয়েছিলাম, যে এ অনুষ্ঠান থেকে আমি নিজেকে প্রত্যাহার করছি। তবে এটা করার সুযোগ আমার ছিল, কারণ অনুষ্ঠানের কিছুদিন আগে আমি এ কথা জানতে পেরেছিলাম, উদ্যোক্তা আমাকে অনুষ্ঠানে কীসের পরে কী হবে সে বিষয়ে অনুগ্রহ করে জানিয়ে দিয়েছিলেন বলে। আমি জানি না, শেষ মুহূর্তে আচমকা মঞ্চে সেই লোকটির মুখোমুখি হলে আমি প্রতিবাদে ঘাড় ফিরিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে পারতাম কি না। 

    অনুষ্ঠানে যে সহবত, যে আদবকায়দা এবং যে সৎ ব্যবহার করতে হয়, স্পনসর, পৃষ্ঠপোষক, শিল্পী, এমনকী শ্রোতাদের থেকেও সেই ভালো ব্যবহারটুকু হয়তো আমাদের দাবি করার সময় হয়েছে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook