বেঁচে থাকার মানে বুঝিয়ে গেলেন
আমাদের ছোটবেলায় সিনেমা দেখা একটা ব্যাপার ছিল। বেশ অনেকদিন প্রথমে ধরে পরিকল্পনা চলত। কে কে যাবে, কোন শো-তে… ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অবশেষে যাওয়া। আমি যখন একাদশ শ্রেণিতে, সেই সময় বাড়ির সবার সঙ্গে দেখতে গেলাম ‘ফুলেশ্বরী’। সঙ্গে ছিল আমার কনভেন্টে পড়া এক দিদি আর বোন। আমার মা ওদের দেখাতে নিয়ে গেছিলেন আদ্যন্ত বাংলা ছবি। অথচ আমাদের দেখে ঠিক বাংলা সিনেমার দর্শক মনে হচ্ছিল না। কেননা তিন বোনই সেদিন হলে জিন্স পরিহিতা ছিলাম। অন্য সবাই শাড়ি, সালওয়ার বা ফ্রক পরেছিল। ‘এই ট্যাঁস কন্যারা কারা? কেন?’ এ-ধরনের নানা মন্তব্যের মাঝেই ছবিটি দেখি, এবং এই জিন্স পরিহিতার হৃদয় সেদিন জিতে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায়। বহুদিন এই ছবি আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল। সে-সময় পরিচালকদের নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা ছিল না, কিন্তু তরুণবাবুর নামটা মাথায় আটকে গেছিল কারণ তিনি তখনও ছিলেন সন্ধ্যা রায়ের স্বামী। এবং তাঁর স্ত্রী-কে তিনি কী দারুণ পার্ট দিয়েছিলেন, তাঁর জন্য কী দারুণ সিনেমা তৈরি করেছিলেন— এটা ভেবে আমার কাছে তখন তিনি আদর্শ পরিচালক। এর পর আরও ছবি দেখি ওঁর। পুরনো ছবি ‘কুহেলী’, তারপর ‘দাদার কীর্তি’, মাঝখানে দূরদর্শনে ‘গণদেবতা’!
কলেজ পাশ করে এলাম চাকরির জগতে। অভিনয়ের শখ ছিল, সাহস ছিল না পুরোপুরি অভিনেত্রী হওয়ার। তাই অনেক কিছু করতে-করতে হলাম সাংবাদিক। ইংরেজি কাগজে যেহেতু গিয়েছিলাম বাংলা কাগজ থেকে, আর থিয়েটার করতাম একটু-আধটু, তাই বাংলা সংস্কৃতি বা সিনেমা নিয়ে লেখালিখির হলে আমাকেই পাঠানো হত। একবার এরকমই আমাকে পাঠানো হল তরুণ মজুমদারের কাছে। তখন তো আর মিডিয়া এত ভিজুয়াল ছিল না, তাই তরুণবাবুর অল্পবিস্তর ছবি বাংলা সিনেমার পত্রিকাতেই দেখা। ওঁর সম্পর্কে, ওঁর ছবি সম্পর্কে জানতাম; কিন্তু আমি খুব একটা বই পড়ে জেনেছি টাইপ নয়। তাই সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে ‘আনন্দলোক’-এ দুলেন্দ্র ভৌমিকের কাছে কিছু পরামর্শ নিয়ে গেলাম NT 1 স্টুডিয়োতে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে, যিনি আমার কাছে ‘ফুলেশ্বরী’র সুবাদে আদর্শ পরিচালক এবং স্বামী হিসেবে গণ্য ছিলেন।
আমরা তখন নতুন যৌবনের দূত, তাই আমি জিন্স, ছোট কুর্তা ও গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে পৌঁছে গেলাম ওঁর সামনে। ঢোকামাত্র উঠে দাঁড়ালেন, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক অতি নম্র-ভদ্র ব্যক্তিত্ব। তিনি মাঝারি উচ্চতার হলেও, তাঁর ব্যক্তিত্ব মনোমুগ্ধকর এবং কথার ধরনে গল্পকারের মাদকতা। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিষয় ছিল, উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর বাংলা ছবির জগৎ কি সামলে উঠতে পেরেছে? নতুন মুখ কি কিছু উঠছে? তখন ১৯৮৪ সাল। বাংলা ছবি নতুন মুখ, নতুন মোড় খুঁজছে। তরুণবাবু সেটাই কী সুন্দর ব্যাখ্যা করলেন। ‘মহীরুহ পতন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নতুন বীজ তো আমরাই বপন করছি। চিরকাল সেটাই পরিচালকদের কাজ। আমি সেটা আগেও করেছি, এখনও করছি।’ ওঁর এই কথা আমার বহু বছর কানে লেগে ছিল। এবং আমি নিজে যখন ছবি করেছি, বিষয় নির্বাচন করেছি, তখন কোথাও যেন ওঁরই স্বর শুনেছি।
প্রথম সাক্ষাৎকারের মধ্যে আমি ওঁকে ‘ফুলেশ্বরী’ দেখে আমার ওঁর প্রতি কেন শ্রদ্ধা ও ভক্তি জন্মেছিল সেই কারণটা বলায় উনি খুব হেসেছিলেন এবং বলেছিলেন, সন্ধ্যা রায়কে তিনি শুধু স্ত্রী বলে কাস্ট করেননি, সন্ধ্যা রায় খুব উচ্চমানের অভিনেত্রী, যিনি যে-কোনও চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতে পারেন। তরুণ মজুমদার আমার চোখে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন সেইদিন, আমার নারীবাদী সত্তা ওঁকে কুর্নিশ জানাল।
এর পর বহু বছর কেটে গেছে। আমি সাংবাদিক হিসেবে জীবনে উন্নতি করেছি। হয়তো ফোন করে কোনও বিষয়ে মতামত চেয়েছি, আমাদের চেনা কোনো ফ্রিল্যান্সারকে ওঁর কাছে পাঠিয়েছি, সব ময় উনি খুবই ভদ্রভাবে কথা বলেছেন। পরবর্তীতে যখন অভিজিতের সঙ্গে কাজ শুরু করি ক্যামেরার পিছনে, তখনও ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে; স্টুডিয়ো-চত্বরে চিনতে পেরেছেন এবং অভিবাদন জানিয়েছেন। ওঁর স্মৃতিশক্তি ছিল খুব প্রখর। নব্বইয়ের দশকে প্রসেনজিতের সঙ্গে অভিজিৎ কাজ করত এবং ও মুম্বই থেকে এসেছিল বলে কলকাতায় কাজ করা নিয়ে বচসা হতে থাকে। একদিন এক সহকারী অভিজিতের ওপর রেগে গায়ে হাত তোলে; অভিজিতের চশমা ভেঙে যায়। এ-নিয়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে। অভিজিৎ আজও বলে ওই চশমা ভাঙাটা আমার সার্থক হয়েছিল কারণ তরুণ মজুমদার আমাকে দেখতে এসেছিলেন এবং সমর্থন জানিয়েছিলেন আমার কাজের অধিকারকে।
তরুণবাবুর এই গুণ চিরকালীন, উনি সবসময় নতুনদের পাশে দাঁড়াতেন। আমার ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়নি, কিন্তু ওঁর কাজের প্রতি, ওঁর কাজের ধারার অনুগামী আমি। ওঁকে দেখেছি, যে-কোনও কিছু পরিচালনাকে উনি খুব নিষ্ঠা সহকারে করতেন। সে বড় পর্দা বা ছোট পর্দা যেখানেই দেখানো হোক না কেন! ডিসিপ্লিন বা নিয়মানুবর্তিতা ওঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, এবং ছবি করার সময় সকলের সঙ্গে একইভাবে খাওয়া, একইরকম ব্যবহার করতেন; নতুন আর্টিস্ট হোক বা পুরনো আর্টিস্ট। এসবই দূর থেকে দেখা।
অভিজিৎ ও আমি বহুবার ভেবেছি তরুণবাবুকে আমাদের ছবি দেখাব। সে-সুযোগ হয়ে উঠছিল না, বা যে-ছবি করেছি সেগুলো ওঁকে দেখানোর মতো কি না দ্বন্দ্ব হত। অবশেষে ‘শ্রাবণের ধারা’ দেখানোর সুযোগ আসে হায়দ্রাবাদে। সেখানে আমাদের ছবিটা দেখানো হয়, এবং তরুণবাবু ছিলেন সেই উৎসবের বরেণ্য অতিথি।
ছবিটি নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল; যেমন থাকে সব ফিল্মমেকারের। কিন্তু সেইরকম স্বীকৃতি আমরা পাইনি। প্রাপ্তি এই, তরুণবাবু ছবিটি দেখেন এবং তারপর রাত ১১টা অবধি আমাদের সঙ্গে গল্প করেন, যা অনেকাংশে না পাওয়ার ব্যথা কমিয়ে দেয়। শুধু আমাদের ছবি নিয়ে নয়, ওঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি নিয়ে গল্প হয়। ওঁকে জিজ্ঞেস করি, ছবি করার ইচ্ছে কেন হয়? সবসময় কি কিছু বলতেই হবে? মানে মেসেজ কি দিতেই হবে, না কি একটি উপলব্ধি নিয়েই ছবি করা যেতে পারে? উনি বলেছিলেন, ‘ছবি তৈরি হয় ভিন্ন কারণে, ভিন্ন বিষয়ে, ভিন্নভাবে। ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ আর ‘গণদেবতা’কে কি এক পর্যায়ে ফেলা যায়? কিন্তু আমি সব ক’টা ছবিই করেছি মনের তাগিদে, ছবি করার তাগিদে। কখনও কিছু বলেছি, কখনও আবার মনোরঞ্জন করেছি। দুটোরই আলাদা-আলাদা মূল্য আছে।’
সেদিন ওঁর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আমাদের অনেক চাওয়া বা না পাওয়ার জোট খুলে যায়। দেবশ্রী রায়, তাপস পাল, নয়না দাস, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় কিংবা মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে খুঁজে পাওয়ার কথা, অভিনেতার কাছ থেকে সেরা পারফর্ম্যান্স আদায় করার প্রচেষ্টা, চিত্রনাট্য কতটা শক্তপোক্ত হলে ছবির শুট শুরু করা যেতে পারে… এইসব নানা প্রসঙ্গ নিয়ে চলে আলোচনা। এর মধ্যেই কথা উঠে আসে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে। এই পদ্ধতিতে ছবি করায় কি ক্রাফট পালটে গেছে? তরুণবাবু অকপটে স্বীকার করেন সে-কথা এবং আমরা আগের ও আজকের পদ্ধতি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় যাওয়ার আগেই উনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আমাদের ছবির কথা বলতে শুরু করেন। এই যে আমরা ‘শ্রাবণের ধারা’য় একটি অসম প্রেম নিয়ে ছবি করেছি, তার মধ্যে বার্ধক্যের সমস্যা এনেছি, অথচ একটা ইতিবাচক দিকে শেষ করেছি; শেষ দৃশ্যে ক্রেন নয় ড্রোন ব্যবহার করেছি— এটাই ক্রাফটের পরিবর্তন বলে উনি মনে করেন।
ওঁকে আমাদের ছবি ‘বেঁচে থাকার গান’ দেখাব বলেছিলাম, কিন্তু কলকাতায় ফিরে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি, আর দেখাতে পারিনি। তারপর তো করোনাপর্ব! ওঁর বই কিনে পড়া, ওঁর শরীর খারাপ শুনে সাংবাদিক বন্ধুর মারফত খবর নেওয়া, একবার দেখা করব-করব করেও না যাওয়া, ওঁর উপর তথ্যচিত্র হচ্ছে খবর পাওয়া, উনি আবার ছবি করবেন শুনে উত্তেজিত হওয়া— সবই চলছিল। ছবির রেকি করতে পুরুলিয়া গিয়ে ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর সব শেষ। কিন্তু সত্যিই কি শেষ? মনে হয় না। জীবনের শেষ দিন অবধি এই মানুষটি ইন্সপায়ার করে গেলেন, বেঁচে থাকার মানে বুঝিয়ে গেলেন, নতুন ছবি করার উত্তেজনা কী করে শেষ অবদি ধরে রাখা যায় শিখিয়ে দিয়ে গেলেন।