সিংহ আর কুমির
আরে, সিংহই যদি হলি, দাঁত বার করবি না কেন? তাহলে তো গরু হলেই হত (বিজেপির সুবিধেই ঘটত সেক্ষেত্রে)। তা না, বিতর্কের বন্যা: সিংহ ঠোঁট বুজে আছে না খুলে? সে শান্ত রাজকীয় আত্মপ্রত্যয়ী, না আগ্রাসী হিংস্র আক্রমণাত্মক? সরকার বলছে আরে ভাই, অশোকস্তম্ভের সিংহগুলোকেই অ্যাক্কেরে হুবহু গড়েছি পার্লামেন্টের ছাদে, ইয়াব্বড় সাইজ বলে গুচ্ছ ডিটেল দেখা যাচ্ছে, তাই মনে হচ্ছে স্বল্প আলাদা। বিরোধীরা বলছে, ন্না, এ ভারতের মেগা-অপমান, যে ছিল স্থিতধী সে আজি দন্ত খিঁচোচ্ছে ক্যান? তার মানে তব নয়া ভারত এমনই খেঁকুরে মারকুটে কুঁদুলে? শিল্পী বলছেন, আহা, সকলই পার্সপেক্টিভের লীলা। বহুদূর থেকে এদেরই পিসফুল মনে হবে, গোলাপফুলের মতোই নিরীহ ফুটে থাকবে তোড়ায়। তেমন গিঁট্টুবাজ হলে মালকোঁচা মেরে তর্কাত: প্রাচীন চিহ্ন-সিংহের নতুন নির্মাণ যদি করতেই হয়, এট্টু অ্যাটিটুড বদলে দিলে ক্ষতি কী? বহুদ্দিন তো নির্বিকার সিংহ দিয়ে চলল, এবার গর্জন বাগালে (বা দংশন-ঘ্যাঁক দেখালে) অসুবিধেটা কোথায়? একটা চিহ্ন একবার ধারণ করলে তাকে একপোঁচ (বা একপ্যাঁচ) আপগ্রেড করা যাবে না কভু— এ রক্ষণশীল অবস্থানে গৌরব আছে, না স্থিতাবস্থা-আঁকড়া ক্ষুদ্রতা? এ তো ধর্মগ্রন্থের হসচিহ্ন আঁকড়ে ঝুলে থাকা পাবলিকের ন্যায় চিল্লানি: চ্যুত হলে একটি কমা, নাহি ক্ষমা! এ জি ও জি লো জি সুনো জি থেকে ফাইভ-জি হয়ে গেল, কারেন্সি চলে গেল কিপটে থেকে ক্রিপটো-র ঘরে, আর একটা সাংবিধানিক প্রতীকের বেলা এত শুচিবায়ু? এবং সত্যিই যদি এই সরকার মনে করে ভারত চিরকাল ভদ্র মিনমিনে নির্বিরোধী, অর্থাৎ সংকটে ম্রিয়মাণ ও বিপদে পলায়নবাজ (বা অন্তত বাহির-বিতণ্ডায় ‘নো কমেন্টস’-ধারী), কিন্তু আজি সে নূতন প্রভাতে বিরাট কোহলির মতো তেড়ে-তেড়ে উঠবে আর সূর্যকুমার যাদবের মতো কিলিয়ে কাঁটাল পাকাবে, তাহলে তার সিংহ-সিম্বলকে একটু খোঁচা মেরে জাগ্রত-তর করতে শখ হবে না কেন? পার্লামেন্ট বিল্ডিং-এর মাথায় কয়েকটা তৎপর সিংহ ধড়ফড়ালে বিরোধীদের সত্যিই খুব অসুবিধে, না কি তাদের এক গতে-বাঁধা রা: মোদী যা-ই করবে সব ভুল, লাগাও ক্রোধ ও মিমের বন্যা?
সাধারণ মানুষের আপত্তি গজানোর কথা নয়, ইন ফ্যাক্ট মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়াই দায়, কারণ যেভাবে খাবারদাবার ও রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে, তাতে চিহ্নসিংহ হাঁ করল না ওয়াক তুলল, ঘণ্টার মাথা। এগুলো হল তাত্ত্বিক ও অবান্তর ব্রুহাহা। কিন্তু সত্যিই যদি এর মধ্যে তাৎপর্য খুঁটে পেস্ট করতে হয়, দেখা যাবে সে-ব্যাখ্যানে মেজরিটির সমর্থন আছে। কত লোক মনে করে, অমুক অহিংস লতানে ধর্ম-আন্দোলন আছড়ে পড়ে এ-দেশকে প্যানরপ্যানর-গ্রস্ত ও মেরুদাঁড়াহীন করেছে। তমুক কবির নেকু-নেকু (কিন্তু প্রকাণ্ড প্রভাবশালী) কাব্যের তোড়ে এ-দেশ নির্বীর্য হয়েছে, নিস্তেজও। মানে, সকলেই লাঠি ঘোরানোকে, ধুলো মেরে ঝাঁকড়া চুল ফাঁপানোকে, অন্যের ব্রহ্মতালু সশব্দ ফাটিয়ে দেওয়াকে বেশ গৌরবের ড্রামা বলেই মনে করে। সমঝদারি ও ভদ্রতাকে: দুর্বলতা। শক-হুনদল-পাঠান-মোগল একদেহে লীন না হয়ে যদি একঘায়ে বিলীন হত, অনেকেরই ইতিহাসপাঠ পুলকে পিড়িং নাচত। সে মানসিকতায়, সিংহ চুপচাপ ঘাড় স্ট্যাটিক করে একবাগে তাকিয়ে থাকলে, নিতান্ত এনার্জি নষ্ট বলে মনে হতে পারে। মহান নাট্যকার বলেছেন, সে-দেশ দুর্ভাগা, যে-দেশের বীরের প্রয়োজন হয়। লোকে তো আর সে-কোটেশনকে দুরন্ত ও যথাযথ মনে করে না। লোকে ভাবে, যে-দেশ মার-মার-কাট-কাট থিমে ঝাঁপিয়ে নিত্যি জমি বাড়িয়ে নিতে পারে, সেই দেশ ফাটাফাটি এবং সেই রাজা মেগা-মহীয়ান। যে-লোক শত্রুকে ফটাফট পুঁতে ফেলতে পারে, তারই স্ট্যাচু নির্মিত হয়, তাকেই মেডেল প্রদান করে সব্বার চক্ষু আবেশ-বাষ্পে ভলকে ওঠে। তাহলে বীরপুজোয় (এবং নিত্য নয়া বীর বানানোয়) অভ্যস্ত একটা দেশ যদি প্রতিষ্ঠিত সিংহকে সামান্য এক্সট্রা সিংহিয়ে দেয়, তা পাবলিকের মন-নিসর্গের সঙ্গে কোয়ায়-কোয়ায় মিলন্তি।
ভুললে চলবে না, যে-লোকগুলো দর্জির গলা কেটেছে, আদালত-চত্বরে জনগণ তাদের লিঞ্চ করতে চেয়েছে, পুলিশকে কোরাসে বলেছে, এদের এনকাউন্টারে মেরে ফ্যালো। ভুললে চলবে না, যাদের কোনও এক অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর-দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে বলা হচ্ছে এগুলো বেআইনি নির্মাণ, আসলে বোঝানো হচ্ছে ক্রিমিনাল শায়েস্তার প্রকৃষ্ট ও উচিত-উপায় হল ধনেপ্রাণে ধ্বংস (অভিযোগ: এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকের ক্ষেত্রে বুলডোজার ওভারটাইম খাটতেও অধিক আগ্রহী)। এও ভুললে চলবে না, পান থেকে চুন খসলেই এ-দেশে এখন উপর্যুপর এফআইআর এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অকথ্য অপমানের প্লাবন। এবং কখনওই ভুললে চলবে না, রাষ্ট্রের সমালোচক ও ত্রুটি-নির্দেশকদের হাবিজাবি অজুহাতে গ্রেফতার করা ও জেলের লপসি খাওয়ানো নিতান্ত ফ্যাশনদুরস্ত। অসম-এর যে উনিশ বছরের মেয়ে ফেসবুকে কবিতায় লিখেছে সে উলফা-য় যোগ দিতে চায়, (কবিতার নাম: আবার বিদ্রোহ করব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে), সে দু’মাস তো জেলে পচছেই, উচ্চ-পুলিশকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, ও জেলেই থাক। তার মানে একটু চায়ের দোকান অল্প ক্যাঙারু কোর্ট এবং বেশ খানিক খাপ-পঞ্চায়েত জুড়ে তৈরি হয়েছে নয়া চণ্ডীমণ্ডপ, সেখানে হুঁকো খেতে-খেতে এর-তার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালার ঢালাও ব্যবস্থা হতিছে। অমানুষ রেপিস্ট বা পৈশাচিক খুনিকে যে ভোরবেলা রাস্তায় খুন করে দেওয়া উচিত, তাদের আদালত নিয়ে যাওয়ার দরকারই নেই, এ-দেশের বিচারব্যবস্থায় তাদের হক নেই, তাদের মানবাধিকারও নেই, এ-বিষয়ে অধিকাংশ ভারতীয় মুহূর্তে একমত। যদি রাজ-ক্ষমতার বিরোধিতা করো, তাহলে তো ভাই রাজ-ক্ষমতা তোমায় নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবেই, ইট মারলে পাটকেল কম্পালসরি, এবং পড়শি-খেউড়ের ন্যায় দেশের শাসনেও অবিকল ও নাগাড় শোধাশোধি চলবে, এ নিয়ে কারও ন্যূনতম সন্দেহ নেই। গণতন্ত্রকে যে উদার হতে হয়, রিফ্লেক্স-অ্যাকশনের ঊর্ধ্বে উঠে প্রসারিত হৃদয়বৃত্তি অনুশীলন করতে হয়, বিরোধকে অত্যাচার দিয়ে নয়— যুক্তি ও সহিষ্ণুতা দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়, এসব ধারণা এদেশে ন্যাকা আঁতেল উদ্ভট ধোঁয়াটে। তাহলে এ-ভূখণ্ডের চিহ্ন কিঞ্চিৎ উদাসীন সিংহ হলে, তাতে তো সত্যের অল্প অপমান। তাদের তো খান্ডার থাবড়াময় হতেই হবে।
অবশ্য কুমিরকে দেখেও শেখা যায়। মধ্যপ্রদেশের শেওপুর জেলায় এক সাত বছরের ছেলে নদীতে চান করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। কয়েকজন গ্রামবাসী বলে, বাচ্চাটাকে কুমিরে ধেরেছে। তখন একটা কুমিরকে জাল ফেলে ধরা হয়, তারপর তার পা বেঁধে, মুখে একটা লাঠির মতো ডাল ঢুকিয়ে দিয়ে (যাতে সে আর চিবোতে না পারে), ফেলে রাখা হয়। আর, তার পেটের ভেতর থেকে ছেলেটা যাতে বেরিয়ে আসতে পারে, সেজন্য ছেলেটার নাম ধরে বিস্তর ডাকাডাকি শুরু করা হয়। পুলিশ ও বন দফতরের লোক অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন, কুমিরটা ছেলেটাকে খায়নি (তার পেট দেখে বোঝা যাচ্ছে), খেলেও সে পুরোপুরি আস্ত অবস্থায় পেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না (স্বাভাবিক বুদ্ধি খরচা করলেই বোঝা যায়), কিন্তু গ্রামবাসীরা বলতে থাকে, পেট চিরে দেখা যাক, ছেলেটা নির্ঘাত বেঁচে আছে। পরে অবশ্য ছেলেটিকে মৃত অবস্থায় নদীতে ভাসতে দেখা যায়, বন দফতরের লোক কুমিরকে অন্যত্র জলে ছেড়ে দেন। ট্র্যাজিক ঘটনা, কিন্তু লক্ষণীয়: সাত ঘণ্টার ওপর বন্দি থেকে, কুমিরটা একবারও নড়াচড়া করেনি, অ্যাত্তটুকু অসন্তুষ্টি জানায়নি। যে-ডালটা তার মুখে ভরা হয়েছিল, তার চোয়ালের জোরের কাছে তা খড়কে-কাঠি অবধি নয়। একবার কটাস করলেই টুকরো হয়ে যাবে। তবু সে মুখে নিয়ে চুপ করে পড়ে থেকেছে। প্রতিবাদ নয়, তেড়ে যাওয়ার চেষ্টা নয়, ছটফট নয়। সে বুঝেছে, এই জাতটা আবেগের বশে প্রায়ই অন্যায় করে থাকে, এদের কাছে ‘আমার কষ্ট হচ্ছে’, বা ‘আমার দিকটা ভেবে দ্যাখো’, বা ‘কী করে নিশ্চিত হচ্ছ আমিই সেই ভিলেন-কুমির’ আউড়ে কোনও লাভ নেই। এরা যদি মনে করে জন্তুর পেটের মধ্যে থেকে নিটোল মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, তবে তা-ই মনে করে চলবে, বিজ্ঞান বা সহজবোধ ইঞ্চি-গজালও পুঁততে পারবে না সে-বিশ্বাসে। সর্বোপরি, এরা প্রতিশোধ-থেরাপিতে প্রাণপণ-বিশ্বাসী, যে-কোনও দুঃখে দুর্দশায় এরা অন্য কাউকে ক্লান্তিহীন কুপিয়ে মনোভার থেকে মুক্তি পেতে চায়। কুমির তাই শান্ত হয়ে ভেবেছে, শুভবোধ যদি জিতে যায় (সম্ভাবনা কম, বাজি রাখলে হননের পক্ষেই রাখতে হবে), এ-যাত্রা রক্ষে। নইলে, তারও লাশ ভাসবে নদীবক্ষে। এই দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা কুমির ভারতের প্রাচীন ঋষিদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, অনাগ্রহী অপ্রত্যাশী ও নিতান্ত নির্বেদী, বা হয়তো মানুষের ফর্মা দেখে এত বিরক্ত ও দীর্ঘশ্বাসমথিত যে, সাত দুগুণে চোদ্দো বললেও যা, পদ্য বললেও তা-ই, তার আর কিছু এসে যায় না। এই নির্বিকার নিরাসক্ত নিরাশ নিঝুম প্রাণীর সহস্র দাঁতে হাসিও ছলকায় না, অশ্রুত্যাগ তো কুম্ভীরদের বারণই। একেও ভারতদেবতার আত্মা-প্রতীক ভাবা যায়, যার হেল বা দোল কিস্যুটি নাই, মঙ্গল-প্যাটার্নের ওপর থেকে ভরসা যার এমন নিংড়ে মুছে গেছে, এখন জল্লাদ-প্রহ্লাদে বিভেদ করে না, শুধু বলে, লে বাবা, মারলে মার, রাখলে রাখ, কিন্তু অল দ্য টাইম ঝিমোতে দে। মকর-সংক্রান্তির দিন, ঘণ্টাফন্টা বাজিয়ে, এর একটা চারমুখো বিগ্রহ লড়িয়ে দিলে হয় না?