সেদিন আকাশ কালো। মেঘ করে প্রচণ্ড বৃষ্টি এল। আকাশ ব্যথা ভাগ করে নিল। বৃষ্টি থামল না। স্যমন্তকদা শেষবারের মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তাই অজস্র চোখের জল ঢাকতে বৃষ্টির জল এল। অনেকে ভিজছে, অনেকে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে। দূর থেকে ভেসে আসছে গান। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ২০১৯-এর এক সকাল।
নবনীতা দেব সেন চলে গেলেন। কত কথা না বলেই চলে গেলেন উনি। আরও কত শোনার ছিল ওঁর কাছে। আমাদের যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের ঘরগুলোয় তাই নৈঃশব্দ্য বেশি। হঠাৎ ক্লাসের মাঝে জানলাম, উনি এসেছেন, শেষবারের মতো প্রিয় যাদবপুরের পরিবারকে বিদায় জানাতে। নীচে গিয়ে দেখি সেই দৃশ্য। মেঘ করেছে, আকাশেরও মন ভার। দূর থেকে ভেসে আসছে গান। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা গাইছেন। কবিতা পাঞ্জাবি ম্যাম গাইছেন জোন বেজের ‘হাউ দা উইন্ডস আর লাফিং, দে লাফ উইথ অল দেয়ার মাইট…ডনা ডনা ডনা…’, গলা মেলাচ্ছেন মৌসুমী ভৌমিক ও বাকি অধ্যাপকেরা। চোখ ভিজে, গলা শুকিয়ে আসছে। সবটা দেখে মনে হল, এটাই যাদবপুর। এটাই এই পরিবারের শক্তি, ভালবাসার শক্তি। বিদায়বেলায় গান দিয়ে শেষ আলিঙ্গন সেরে নেয় যাদবপুর।
সেই সকাল আবার যেন ফিরে এল। এবার আরও ব্যক্তিগত ব্যথা। স্যমন্তকদা চলে গেছেন। বিশ্বাসও করতে চাইছি না। অনেক কিছু মনে পড়ল।
সবে ক্লাস টেন-এর বোর্ড পরীক্ষা শেষ করে হাইস্কুলের ছাত্র হয়েছি। ভবিষ্যতে কী নিয়ে পড়াশোনা করব, তা নিয়ে সবসময়েই একধাপ এগিয়ে চিন্তা করতে পছন্দ করি। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য চর্চা করতে হবে। কী পাঠ্যক্রম! শিক্ষকদের নাম শুনে অভিভূত! সারা বিশ্বের শিল্পের দরজার সামনে দাঁড়াব।
পরিচিত সকলের কাছে খোঁজখবর শুরু করলাম। হঠাৎই একদিন এক অনুষ্ঠান-বাড়িতে, আমার প্রিয় শুচিস্মিতাদি (ডিজাইনার ও পোশাক পরিকল্পক) আলাপ করালেন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম স্যমন্তক দাস। তাঁকে শুচিস্মিতাদি জানালেন আমার ইচ্ছের কথা। তিনি বোঝালেন যাদবপুরের ভর্তির পরীক্ষার প্রক্রিয়া।
তারপর বহু লোকের কাছে শুনেছি এই মানুষটির নাম। শিক্ষক, বক্তা, পণ্ডিত, লেখক, নাট্য-নির্মাতা, বিভাগের প্রধান। প্রথম আলাপেই আমি ফ্যান হয়ে গেলাম! এঁর কাছে পড়ব, ভেবেই লোভ বেড়ে গেল!
সেই স্বপ্ন নিয়ে স্কুলের শেষে কলেজের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। আবার স্যমন্তকদার সাথে কথা, তাঁর পরামর্শ নেওয়া। ভর্তি হওয়ার দিন আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘এই তো! এসে পড়েছ তাহলে!’ হাসির মধ্যে আপনজনের ছোঁয়া। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম, মুখে আর বলা হল না যে আপনার পরামর্শ না পেলে, আপনার সাথে দেখা না হলে, এই স্বপ্নে দৃঢ়তা পেতাম না। আর বলাও হবে না।
তারপর প্রথম সেই দিন। পরিচয়ের দিন। সব নতুন ছাত্রছাত্রীর সাথে পুরো বিভাগের আলাপের দিন। কারা সব এসেছেন! যাঁদের নাম মুগ্ধ হয়ে শুনেছি, সেই সব প্রফেসর। এঁরা আমাদের পড়াবেন, এই সৌভাগ্য হল তাহলে? ভেবেই আনন্দে আত্মহারা! হঠাৎ স্যমন্তকদা নিজের মেল আইডি ক্লাসের বোর্ডে লিখলেন, ভারী মজার নাম, ‘কোকো পেলি’। তারপর বললেন, ‘এখন যাদবপুরে এসে মনে হবে পাখনা গজিয়েছে, তাই এখন ফ্যাতাড়ু হয়ে উড়বে আর সবার মাথায় হাগবে! সাবধান! পড়াশোনা কিন্তু মন দিয়ে করতে হবে। কোনও সাপ্লি পরীক্ষার গল্প না!’
মনে হল, কী চমৎকার মানুষ। কতটা আপন করে নিলেন এই নতুন শিক্ষার্থীদের প্রথম দিনেই। মনে মনে সবটা বললাম নিজেকে। আবারও, ওঁকে বলা হল না। আর বলাও হবে না।
স্নাতকের ছাত্র হয়ে ওঁর অনেক ক্লাসে বসেছি। শুনেছি মন দিয়ে, কত সহজে স্যমন্তকদা সাহিত্য, বিশ্ব, সমাজ, মানুষ, অনুভূতির সংযোগ ঘটাতে পারেন কথা দিয়ে। আমার পড়াশোনার খিদেকে উনি ক্রমাগত খাদ্য দিয়েছেন, পুষ্টি দিয়েছেন। সেই শিক্ষা জীবনের অঙ্গ হয়ে থাকে, প্রতিফলনে পরিচয় দেয়। তার জন্য ধন্যবাদ বলা হল না।
যখন অতিমারীর সময় কলেজ বন্ধ, স্যমন্তকদার সাথে কতবার কথা হয়েছে। আমার শরীর ভাল আছে কি না, সেই খোঁজখবর নিতেন নিয়মিত। বিভিন্ন কমিউনিটি কিচেন, সেফ হোম, ত্রাণের উদ্যোগ নিয়ে কথা হয়েছে। তারই মাঝে হঠাৎ আমার একটা পত্রিকায় লেখা প্রবন্ধ ও একটি ইন্টারভিউ পড়ে উনি জানালেন, উনি আপ্লুত। বললেন আমাকে নিয়ে ওঁর গর্ব হয়। এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে গেছিল সেদিন। যাঁর কথা শুনে এই বিভাগে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই শিক্ষার প্রাঙ্গণে এসেছি, তাঁর কাছে এই সাধুবাদ শুনে আবেগপ্রবণ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এখন মনে হচ্ছে, সেদিন প্রত্যুত্তরে আরও কথা বললে কী ভাল হত।
কত কথা বলার ছিল স্যমন্তকদা তোমাকে, কিছুই বলতে পারলাম না। সেই ব্যথাটাই সবচেয়ে বেশি জ্বালাচ্ছিল আমাকে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টির জলে ভিজে গলার কাছটায় কথা ঠেলে আসছিল। এ ক্ষতি আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এভাবে তো তোমার ফেয়ারওয়েল হওয়ার কথা ছিল না প্রফেসর! বিভাগ থেকে কেউ চলে গেলে তাঁকে আনন্দ, গান, কবিতা, খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে নতুন জীবনের শুভেচ্ছা জানানো হয়। কান্নাকাটি হয় নিশ্চয়ই, কিন্তু তার সঙ্গে আজকের কান্নার মিল নেই। এই কান্না তো শূন্যস্থানের জন্য, যা কিছুতেই আর পূরণ হবে না।
অরবিন্দ ভবন থেকে স্যমন্তকদার দেহ নিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে যেতে থাকল। বৃষ্টি থামল। তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, এইভাবে তো শেষবারের মতো প্রিয় ক্যাম্পাসে আসার কথা ছিল না প্রফেসর! এইভাবে তো একতরফা কথা বলার ছিল না আমার স্যমন্তকদা! একদিন সময় দিলে না? একটু বসে আড্ডা দিতাম যে! এটা একা আমার মনে হচ্ছিল না। ওখানে উপস্থিত সকল প্রিয়জনেরা একভাবে ভেঙে পড়ছিলেন। বুকে ঠাসা ব্যথাটা কান্না হয়ে বেরিয়ে এল। আর মনে পড়ল উনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে ওঁর গর্বের কথা। এবার তাহলে দায়িত্ব বেড়ে গেলো শতগুণ!
ছোটবেলায় শুনেছি প্রয়োজনীয় মানুষ ক্ষণজন্মা হন। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর, ওঁর লেখা পড়তাম, খবরের কাগজে, পত্রিকায়। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি শেখাতেন, আলোচনার বিষয় বাড়ত, তর্ক চলত ছাত্রদের মধ্যে। এবং সেই মানুষটাই চলে গেলেন। চলে গেলেন এমন এক সময়ে, যখন ওরকম এক শিক্ষকের প্রয়োজন বড্ড বেশি। আমার মতো কত শিক্ষার্থী মুখিয়ে থাকে এমন একজন মানুষের সান্নিধ্য পেতে। চলে গেলেন তখন, যখন ওঁর মতো একজন লেখক, চিন্তক ও বক্তার প্রয়োজন ছিল, যিনি দুচোখ মেলে পৃথিবী দেখে তার বিশ্লেষণ করতে পারেন সহজ ভাষায়। উনি চলে গেলেন মধ্যমেধার ভিড়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে। এই ভিড় থেকে মাথা তুলে মাঝেমাঝে স্যমন্তকদা নামের যেই আলোর সন্ধান করতাম আমরা অনেকেই, সেই আলো নিভে গেল।
এক ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু শিল্পচর্চা ও বিদ্যাচর্চার পরিবেশে এইরকম মানুষকে হারানো এক বিশাল ধাক্কা। আমরা বেড়ে উঠছি নিম্নমানের শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান দেখে। কত মানুষ এই ভেজালের ভিড়ে জানলেন না সত্যিকারের ভাল কাজের মান। প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োগে সক্ষম এক মানুষের বিয়োগ এই সময়ে সাংঘাতিক এক ঘটনা। রাজনীতি ও সমাজের জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিলেন স্যমন্তকদা, যিনি দুদিকের যুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে এক সুস্থ আলোচনার মঞ্চ গড়ে তুলতেন। উনি থাকলে আরও কিছু প্রাণ ছুঁয়ে যেতেন এইভাবেই।
এ ইতিহাসের মৃত্যু, শিক্ষার মৃত্যু, স্পষ্টতার মৃত্যু ও সর্বোপরি, স্পর্ধার মৃত্যু। যে স্পর্ধা ছাত্রদের জন্য নিজে বুক পেতে ব্যারিকেড গড়ায় ছিল, যখন দুষ্কৃতীরা হুমকি দিয়েছিল। যে স্পর্ধা এক অতি কঠিন পৃথিবীতে বন্ধুত্বের দুঃসাহস দেখাত, ছাত্রদের ভালবেসে প্রকাশ্যে ‘অপদার্থ’ বলে সম্বোধন করতো, বিপদের সময়ে সহকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মনোবল বাড়াত। যে স্পর্ধা এই ইঁদুর-দৌড়ের পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিত। এই স্পর্ধা চলে যাওয়ার অর্থ, সামগ্রিক শিরদাঁড়া আরও নত হয়ে যাওয়া।
এই লেখার সঙ্গে যুক্ত ছবিটি এঁকেছেন আমারই এক বিভাগীয় সিনিয়র, দীপশুভ্রদা। এই ছবিটি আসলে আমাদের ডাম্বলডোর স্যমন্তকদার হৃদয়কে অবিকল ধরেছে রং দিয়ে। ওঁর ভাষায় আসলে আমরা সবাই অপদার্থ। এই ডাকে কতটা ভালবাসা ছিল, সেটা বুঝলাম যখন অনেক অনেক অপদার্থ, অর্থাৎ উনি যাদের জীবনে বৃহৎ প্রভাব বিস্তার করেছেন ও করে যাবেন, সেই বৃষ্টিভেজা দিনে একসাথে গান গাইতে গাইতে তাদের প্রিয় মানুষের দেহ নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। আবারও মনে হল, এটাই ভালবাসার শক্তি।
ছবি এঁকেছেন দীপশুভ্র