বেহালা বাজানো লোকটা
মাঝেমধ্যেই দিলীপ জেঠুর কথা মনে পড়ে । যেমন ছোটবেলাকে ঘিরে থাকা আরও মানুষজনকে মনে পড়ে, তেমনই। গড়িয়ায় যখন উঠে আসি আমরা, সেই কোন আমার ছোটবেলায়, তখন থেকেই তিনি আমাদের প্রতিবেশী, বয়স একটু বেশি হবার সুবাদে পাড়ার অভিভাবকও। যে-বাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা, তার পাশের একচিলতে সরু গলি দিয়ে হেঁটে গেলে শেষ মাথার দিকে ওঁদের বাড়ি। পরে অবশ্য সেই গলির গোড়ার দিকেই জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন বাবা-মা, তখন দিলীপ জেঠুদের বাড়ি আমাদের আরেকটু কাছাকাছি চলে এসেছিল, এই যা।
আগে চেহারার একখানা বর্ণনা দিয়ে নিই। খুব মাঝারি উচ্চতা, ফর্সার সঙ্গে একটুখানি হলদে মেশানো রং ছিল দিলীপ জেঠুর। চুল ব্যাকব্রাশ করা, পুরনো দিনের কায়দায়। পরনে সারাক্ষণ খাদির পাঞ্জাবি বা ফতুয়া এবং ঢোলা পাজামা। দেখবার মতো ছিল তাঁর চোখদুটো। ওরকম টানা টানা প্রশস্ত চোখ আর ঢেউ খেলানো চাহনি আমি খুব একটা কারও দেখিনি। দেখতাম দিলীপ জেঠুর চেহারায়। সেইসঙ্গে অবশ্য বেশ ভারী রকমের ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। কথা কমই বলতেন, ভেবেচিন্তে বলতেন এবং ঠিকঠাক বলতেন। চট করে তাঁর সামনে কেউ বেফাঁস কথা বলবার সাহস পেত না। সে-সময়ে সব পাড়াতেই এমন কিছু কাকা-জেঠুরা থাকতেন, নানা বিষয়ে যাঁদের মতামত নেওয়াটা অবশ্যম্ভাবী জরুরি ছিল, কিন্তু একটা সম্ভ্রমের বেড়া ডিঙিয়ে তবেই পৌঁছতে হত। দিলীপ জেঠু ছিলেন সেই শ্রেণির মানুষ।
গড়িয়ারই এক নামী স্কুলে অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন তিনি। এবং অঙ্ক বিষয়টা হাতের তালুর মতো স্বচ্ছ ছিল তাঁর কাছে। ভালবেসে যেমন পড়াতেন, তেমনি শাসন করেও পড়াতেন। ছাত্রেরা রীতিমতো ভয়ে থাকত দিলীপ স্যারের ক্লাসে। এসব কথা আমি সে-স্কুলের পড়ুয়াদের কাছে জেনেছিলাম। অবিশ্যি তারা না-বললেও, দিলীপ জেঠুকে দেখে বেশ বুঝতে পারতাম, বিষয় যদি অঙ্ক হয়, তাহলে ওঁর কাছে ভুলের ক্ষমা নেই। কেননা অঙ্ক তিনি ভালবাসতেন। আর চাইতেন, তাঁর পড়ুয়ারাও যেন অঙ্ককে ভয় না পায়, ভালবাসে।
তাঁর বাড়িতে এমনি ঢুকে পড়াটা ভয়ের ব্যাপার হলেও, আমাদের কারও কারও যাতায়াত ছিল অবাধ, কেননা তাঁর ছোট মেয়ে ছিল আমাদের ভারী বন্ধু। ভাল নাম তার শ্রাবণী হলেও, পাড়ার চালু নাম ছিল ‘ছোট টুম্পা’। এহেন নাম হবার কারণ অবশ্য এই যে, তাদের ঠিক পাশের বাড়িতেই আরেক টুম্পা থাকত, যে বয়সে আমাদের থেকে কিঞ্চিৎ বড়। তাই স্বভাবতই তারও পাড়াতুতো নাম ছিল ‘বড় টুম্পা’। তা এই ‘ছোট টুম্পা’র বন্ধু হিসেবে যখন সন্ধের পর ঢুকে পড়তাম সে-বাড়িতে, দেখতাম, দিলীপ জেঠু হয় মন দিয়ে খাতা দেখছেন, নয় পাড়ার কোনও ছেলেমেয়েকে একমনে অঙ্ক বোঝাচ্ছেন। এ-জিনিস তখনও পাড়ায় পাড়ায় চালু ছিল। কারও কোথাও অঙ্ক আটকে গেছে, গিয়ে দিলীপ স্যারের দ্বারস্থ হওয়া যেত। তিনিও নাওয়া খাওয়া অন্য কাজকম্মো ভুলে সেই ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকতেন, যতক্ষণ না তার মাথায় অঙ্কের প্যাঁচ ঢুকছে।
এই দিলীপ জেঠুর আমাদের বাড়ি আসতেন আড্ডা দিতে। হয়তো মায়ের ক্লাস শেষ হয়েছে দেরিসন্ধের দিকে, বাবা সবে ফিরেছেন অফিস থেকে, দিলীপ জেঠু ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বসলেন আমাদের বৈঠকখানায়। চারপাশের কী খবর, একবার ঝালিয়ে নিলেন বাবা’র থেকে, সামনে কোথায় কোথায় অনুষ্ঠানের ডাক, মায়ের কাছে খবর নিলেন। নিজেও পাড়ার হাল হকিকত জাহির করে গেলেন। সামনে ভোট হলে তো কথাই নেই। দফায় দফায় চা চলবে রাত এগারোটা অবধি। এমনই ছিল তখন পাড়াপড়শিরা, এমনই ছিল আমাদের খোলা ঘরদোর। কিন্তু এই যে স্বল্পবাক, স্মিতহাস, ব্যক্তিত্বময় শিক্ষক শ্রী দিলীপ কুমার দে, তাঁরও এক আশ্চর্য নিভৃতচারণ ছিল। সে-আবিষ্কার আমরা করেছিলাম পাড়ায় আসার ক’দিন পরে।
সেসব দিনকালে ছোট ছোট পাড়াগুলোয় সন্ধের পর শব্দ-আওয়াজ তেমন হতো না। কয়েক বাড়িতে টিভির আওয়াজ, কোথাও রেডিও নাটক চলছে, আবার কিছু বাড়ির জানলায় নিয়মমাফিক গলা সাধা। সেসব আমাদের কানে আসত রোজই, মন্দ লাগত যে, এমনও নয়। কানে আসত আরও একটা স্বর। বিশেষত, সন্ধের পর বা রাতের দিকে লোডশেডিং হলেই শুনতে পেতাম, দিলীপ জেঠুদের বাড়ির জানলায় বেহালা বাজছে। তেমন যে খুব তৈরি হাত, তা নয়, কিন্তু ঠাহর করে শুনলে গান দিব্যি বোঝা যেত। পুরনো বাংলা গানের কলি চিনতে পারতাম, অনেকবার শোনা রবি ঠাকুরের গানও কানে আসত। ওই, লোডশেডিং হলে। গরমকালে বা বসন্তে পাড়ার আলো নিভে গেলে বাকিরা যখন এ-মোড়ে ও-মোড়ে জটলা বেঁধে আড্ডা দিত, দিলীপ জেঠু অঙ্কের বইখাতা সরিয়ে রেখে একমনে বসতেন নিজের বেহালা নিয়ে, এ আমরা জেনেছিলাম তখনই। শিখেছিলেন এককালে ধরেবেঁধে, নিয়মমাফিক চর্চা তেমন আর রাখা হয়নি শিক্ষকতার চাপে, কিন্তু সুযোগ পেলেই বেহালাটি বাঁ কাঁধে ফেলে ডান হাতে ছড় তুলে নিতেন দিলীপ জেঠু।
সে-বেহালা একদিন আমাদের ছোট্ট বসার ঘরে এসে পড়ল। অবশ্য সকাল সন্ধে আমাদের বসার ঘরটাই হয়ে উঠত গানের ঘর, ভরে উঠত মায়ের ছাত্রীছাত্রের ভিড়ে। তবে সামনে কোনও বড় অনুষ্ঠান থাকলে একটানা গানের ক্লাস বন্ধ থাকত ক’দিন। তখন মায়ের বাছাই ছাত্রীছাত্রেরা আসতেন, মা’কে রেওয়াজে সঙ্গ দিতে। টানা দশ কি বারো দিন রেওয়াজ চলত, সামনে অনুষ্ঠান থাকলে। তেমনই কোনও এক রেওয়াজের সন্ধেয় দিলীপ জেঠু চলে এসেছিলেন। পরে বুঝেছিলাম, নেহাত থাকতে না-পেরেই চলে এসেছিলেন। নইলে অমন ব্যক্তিত্বপূর্ণ অথচ মুখচোরা লোকের পক্ষে বেহালার বাক্স হাতে আমাদের বাড়ি ঢুকে পড়াটা সহজ কথা নয়। সেই থেকে তাঁর আসা শুরু হল। কিছুই না, মায়ের নিয়মিত চর্চার সঙ্গে জুড়ে যেতে পারলে তাঁরও যদি একটু হাত সচল থাকে, এই আর কী।
একেকদিন ঢুকেই জিগ্যেস করতেন, ‘আজ কী ধরেছেন?’। মা হয়তো বললেন, ‘এই একটু মালকোষ চেষ্টা করছি’। শুনেই, ‘দাঁড়ান, মিলিয়ে নিই’ বলে কালো গম্ভীর বাক্সের ডালা খুলে বার করে আনতেন তাঁর পোড় খাওয়া, পুরনো বেহালা। তারগুলো বেঁধে নিয়ে বসে পড়তেন মায়ের পাশে। মা সুর লাগাতে লাগাতে যখন ছেড়ে দিচ্ছেন কোথাও, রাগের রাস্তা ধরে নিচ্ছেন দিলীপ জেঠু। কোনও দিন মালকোষ, কোনও দিন শুদ্ধকল্যাণ, কোনও দিন বাগেশ্রী। সুর যে টানটান থাকত সারাক্ষণ, রাগের রাস্তাঘাট যে বাঁধানো থাকত সব সময়, এমনটা নয়। কিন্তু ওঁর ওই বেজে ওঠবার ইচ্ছেটুকু এত সৎ ছিল যে, ওঁর বেহালা তাকে ফুটিয়ে তুলত চমৎকার। রাশভারী সেই অঙ্কের শিক্ষক, কড়া সেই পাড়ার অভিভাবক তখন মিলিয়ে যেতেন কোথায়। বদলে ফুটে উঠত একজন প্রেমিক বেহালাবাদকের মুখ, যা আগে দেখিনি কখনও। আর ওই বেহালা বাজাতে দেখেই আমি বুঝতাম, এই টানা, বিস্তৃত চোখ কোনও অভিভাবক বা শিক্ষকের নয়। একজন ইচ্ছুক বাজিয়ের চোখ এরা। তাই এত সমীকরণের মধ্যেও উদাসীন থাকতে পেরেছে এতদিন ধরে।
দিলীপ জেঠু আর নেই। লোডশেডিং নেই কোত্থাও। আমাদের সেই পাড়ায় বাসও উঠে গেছে বহুদিন। গানের ঘর বলতে এখন কেবল স্মৃতি। সেই স্মৃতির মধ্যেও হুট করে কোনও সন্ধেবেলা আলো নিভে গেলে আমি দূর থেকে ছড় টানার আওয়াজ পাই। বুঝি, অতীতের কোনও এক টিমটিমে জানলায় বেহালা কাঁধে তুলে নিয়েছেন দিলীপ জেঠু…