এক ‘ভৌতিক’ চলচ্চিত্রে জাক দেরিদার চরিত্রে অভিনয় করছেন জাক দেরিদা স্বয়ং। অথচ কয়েক বছর আগেও, ১৯৭৯ অবধি, তিনি নিজেই কঠোরভাবে নিজের ছবি তুলতে বাধা দিতেন। জনসমক্ষে সে ছবি প্রচারে তো আরওই আপত্তি ছিল। সেই কারণেই ১৯৭১-এ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সাথে যখন দেরিদার প্রথম দেখা হয়, একই ঘরে বসে থাকলেও স্পিভাক দেরিদাকে চিনতে পারেননি। দেরিদাই এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেন। অকস্মাৎ এই আলাপে স্পিভাক প্রায় ভিরমি খেয়েছিলেন।
দেরিদার প্রেত-বিষয়ক ভাবনা, আর চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি— এ দুটি তাঁর জীবনে প্রায় হাত-ধরাধরি করে চলে। দেরিদার বিভিন্ন সময়ে প্রেত-সম্পর্কিত কিছু লেখা আছে, তবে তার মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ধারণা হল Hauntology। ইংরেজি শব্দটা পড়ে অনেকেই নিশ্চয়ই লুকিয়ে থাকা শব্দ দুটোকে চিনে গেছেন। ‘Haunt’ (আতঙ্ক) এবং ‘Ontology’ (সত্তাতত্ত্ব)— এ দুয়ে মিলেই ‘Hauntology’। একে ‘প্রেতসত্তাতত্ত্ব’ বলা যেতে পারে। কীভাবে এই খটোমটো শব্দ এসে দেরিদার অভিধানে জুটল?
বার্লিন প্রাচীরের পতন হয় ১৯৮৯-এ। দুবছর পরেই, ১৯৯১-এ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে অনেক টুকরো হয়ে যায়। ১৯৯২-এ, ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বইয়ে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা দাবি করেন— সমগ্র মানবসভ্যতার মতাদর্শগত বিবর্তন সোভিয়েত পতনের সাথে সাথেই সমাপ্ত হল। পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক গণতন্ত্রই মানব শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায়। স্বাভাবিক কারণেই, বইটা সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন ফ্যালে। আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বজা সদা-উড্ডীন থাকবে, আর কী চাই? কিন্তু সাম্যবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া কী এতই সোজা? দেরিদার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারসাইড কনফারেন্সে দেওয়া বক্তৃতা বই হিসেবে বেরোয় ১৯৯৩ সালে। নাম ‘মার্ক্সের ভূতগুলি’। তার প্রথম লাইনেই কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টোর ভূত। মার্ক্স ম্যানিফেস্টোর প্রথম লাইনে লিখেছিলেন ‘A spectre is haunting Europe— the spectre of communism’, অর্থাৎ সাম্যবাদের ভূত ইউরোপকে তাড়া করছে। সোভিয়েত পতনের পর দেরিদা দেখালেন, মার্ক্সের ভূত ইউরোপকে তাড়া করছে। কোনও মতাদর্শকে অত সহজে মৃত বলে ঘোষণা করা যায় না। করলে, কবর থেকে উঠে এসে জ্যান্ত মতাদর্শকে ত্রস্ত করবে মৃতেরা। এতে ‘পুনর্জীবিত’ (Revenant) এবং ‘অনাগত’ (Arrivant)— এই ধারণার তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রস্তুত করেন তিনি। খুব সাদামাটাভাবে বললে, এই পুনরাগমনই প্রেতসত্তাতত্ত্বের মূল।
‘হ্যামলেট’ নাটকে সংলাপ আছে, ’Thou art a scholar; speak to it, Horatio’. দেরিদার হ্যামলেট-পাঠে এই সংলাপে জোর দেওয়া হয় ও পাঠককে মনে করানো হয়, ভূতের সাথে কথা বলার জন্য মারসেলাস হোরেশিওকে পীড়াপীড়ি করে। কেন? না, হোরেশিও ‘স্কলার’। অর্থাৎ এই নব্যহ্যামলেটপাঠে ভূত আর হেঁজিপেঁজি কেউ রইল না, সে নতুন খাতির অর্জন করল দেরিদার ভাষ্যে— ভূতের সাথেও কথা বলতে মেধার প্রয়োজন।
দেরিদার ভূত আমাদের চেনা ভূতের মতোই, কিছু একটা ‘নেই’ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন দেখা যায় তা ‘আছে’। এ গপ্পো শুরু করা যায় এক নাটকীয় ঘটনা দিয়ে। ১৯৮২ সালে, বছরের এক্কেবারে প্রথম দিনেই, ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ খবর বেরোল, বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক জাক দেরিদা প্রাগ শহরে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের জন্য ধরা পড়েছেন চেকোস্লোভাকিয়ার সরকারের হাতে। ফ্রান্স সরকার অবিলম্বে তাঁকে মুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে। আসলে চেক সরকার তখন বিদেশি বুদ্ধিজীবীদের ভয় দেখানোর জন্য এসব করছিল। দেরিদা গিয়েছিলেন প্রাগ-এ, সেখানকার কুচক্রী সরকারের বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের সম্মেলনে যোগ দিতে। কেউ নাকি এয়ারপোর্টেই তাঁর ব্যাগে মাদক ঢুকিয়ে দেয়। পরের দিন রাতে জেল থেকে যখন বেরোলেন, তখন পুরো অভিজ্ঞতাকে কাফকাধর্মী বলে আখ্যায়িত করেন। মজার ব্যাপার, কাফকার প্রতি কৌতূহল তাঁর প্রাগে যাওয়ার পিছনের প্রচ্ছন্ন কারণ ছিল। আর সেখানে গিয়ে নিজেই বিচারব্যবস্থার হাতে যেন কাফকার গল্পের চরিত্র বনে গেলেন।
এই ঘটনার পর তিনি ফ্রান্সে আরও জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। আগেই উল্লেখ করেছি, তখন মাত্র কয়েক বছর হয়েছে, যখন তিনি নিজের ছবি তোলার অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ যে স্ব-ঘোষিত কারণের জন্য তিনি ছবি তোলা থেকে বিরত ছিলেন অধ্যাপনার প্রথম দুই দশক— জনসাধারণের কাছে দার্শনিকের চিন্তার চেয়ে তাঁর মুখাবয়বটুকু যেন বেশি বিখ্যাত না হয়— প্রায় সেটিই ঘটতে লাগল। এমনই আকর্ষক আর নাটকীয় তাঁর ফোটোগ্রাফ, কয়েক বছর পর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ বেরোনো দেরিদার একটা ছবি দেখে সমালোচক ডেভিড সুমওয়ে লিখেছিলেন, ‘আলো-আঁধারির খেলাতে অন্ধকারের মধ্যে এক দার্শনিক… এমনকি দেরিদার পোশাকও নাটকীয়, অন্য অধ্যাপকদের মতো সাধারণ টুইড স্পোর্টস কোট না পরে, তিনি কালো কর্ডুরয় জ্যাকেট পরে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে পাক্কা কোনও চলচ্চিত্র-তারকা।’ প্রাগে জেল থেকে ছাড়া পেতেই কাগজে দেরিদার একটা ছবি বেরোল সাংবাদিক পরিবৃত হয়ে। কারামুক্ত দার্শনিক এবং তাঁর সেই ছবির দৌলতেই হয়তো, সে বছরেই ব্রিটিশ ব্যান্ড ‘স্ক্রিটি পলিট্টি’ তাদের অ্যালবাম ’Songs to Remember’-এ গান বেঁধে ফেলল দেরিদাকে নিয়ে: I’m in love with a Jacques Derrida/ Read a page and know what I need to/ Take apart my baby’s heart/ I’m in love।
একে দার্শনিক মহলে চরম বিতর্কিত, অবিনির্মাণবাদের জন্য কালাপাহাড়ি ইমেজ তো ছিলই, সঙ্গে ১৯৮২-তে অকস্মাৎ হাজতবাস। এসব মিলেমিশে এমন এক স্টারডম এসে হাজির হল দেরিদার জীবনে, আড়ালবিলাসী ছবিবিমুখ দার্শনিক ১৯৮৩ সালে সত্যি সত্যিই রুপোলি পর্দায় এসে হাজির। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র-নির্মাতা কেন ম্যাকমালেন-এর আর্জিতে চিড়ে ভিজেছিল। ‘Ghost Dance’ ছবিতে সামান্য সময়ের জন্য নিজের চরিত্রে নিজেই অভিনয় করতে রাজি হলেন বিশ্বখ্যাত জাক দেরিদা। ছবির মুখ্য চরিত্রে দুটো মেয়ে, তারা লন্ডন থেকে প্যারিস চষে বেড়ায়, কখনও ঘুমে কখনও জাগরণে। নদীর ধারে যায়, গোপন আস্তানায় যায়, মৃতদের মাঝে বসে আলাপচারিতা করে; ভূত-প্রেত, জন্ম-মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হয়। গোটা সিনেমায় নেপথ্যের কন্ঠস্বর দেরিদার লেখাপত্র থেকেই বাছাই প্রেত-সংক্রান্ত উদ্ধৃতি পড়ে চলে। মুখ্য দুটো চরিত্রে অভিনয় করেন পাস্কাল ওজিয়ের এবং লিওনি মেলিঞ্জার। ছবিতে দেরিদাকে দেখা যায় দুটি দৃশ্যে। দুটিতেই পাস্কাল উপস্থিত। প্রথম দৃশ্যে তাঁকে এনে আলাপ করানো হয় ক্যাফেতে বসে কাপে চুমুক দেওয়া দেরিদার সাথে। দেরিদা প্রশ্ন করেন, ‘পাস্কাল, তোমার আইডিয়ার নেপথ্যের আইডিয়াটা কী?’ সে উত্তর দেয়, ‘আমার আইডিয়ার নেপথ্যের আইডিয়াটা হল যে আমার কোনও আইডিয়া নেই।’ সহমর্মিতা নিয়ে দেরিদা তাকান পাস্কালের দিকে।
এর পরের দৃশ্যটা দেরিদার অফিসে তোলা। শুধু পাস্কাল আর দেরিদা মুখোমুখি বসে। পাস্কাল প্রশ্ন করে, দেরিদা ভূতে বিশ্বাস করেন কি না। দেরিদা এর লম্বা উত্তর দেন: ‘তুমি একটা বেশ কঠিন প্রশ্ন করলে। প্রথমত, তুমি একটা ভূতকে জিজ্ঞেস করছ, সে ভূতে বিশ্বাস করে কি না। এখানে ভূত হলাম আমি। যেহেতু আমি নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করছি এমন একটা ছবিতে, যেটা কমবেশি improvised, আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন আমার জায়গায় একটা ভূতকে কথা বলতে দিচ্ছি। আশ্চর্য ভাবে, আমার অজ্ঞাতসারেই, একটা ভূতকে প্রশ্রয় দিচ্ছি, সে-ই আমার ভূমিকায় অভিনয় করছে, আমার কথাগুলো বলছে, যেটা আরও মজার ব্যাপার। সিনেমা একটা ভূতের শিল্প, অশরীরীদের যুদ্ধক্ষেত্র। সিনেমা যখন একঘেয়ে নয়, তখন তা এমন একটা শিল্প, যেখানে ভূতেদের ফিরে আসার অনুমতি আছে। আমরা এখন সে-কাজটাই করছি। তাহলে, যদি আমি একটা ভূত হই, যে বিশ্বাস করছে সে নিজের গলায় কথা বলছে— সত্যি বলতে কী, নিজের গলায় কথা বলছি এই বিশ্বাসটা আছে বলেই আমি অন্য স্বরকে আমার স্বর অধিকার করে নিতে দিচ্ছি, আমার ভূতেদের স্বর অধিকার করে নিচ্ছে আমার স্বরকে। তাতে প্রমাণিত হয় ভূত আছে, এবং ভূতেরাই তোমার কথার উত্তর দেবে।’ এরপর এও বলেন, সিনেমা প্লাস সাইকোঅ্যানালিসিস ইকুয়ালটু ভূতের বিজ্ঞান। কথার মাঝে ফোন আসে একটা, সেটা রেখে দেরিদা এও বলেন, এই ফোনের গলাও তো একটা ভূত, কাফকা চিঠিপত্রে যোগাযোগ বিষয়ে যা বলেছিলেন তা এক্ষেত্রেও বলা যায়, এবং হরেদরে সিনেমাটোগ্রাফি, টেলিকমিউনিকেশন— এসব আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা ভূতেদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছি, আমাদেরকে ভয় দেখানোর তাদের যে ক্ষমতা— তা বাড়িয়ে দিচ্ছি। শেষে বলেন, ‘ভূতে বিশ্বাস করি আর না করি, আমি বলি, ভূত দীর্ঘজীবী হোক!’ তারপর পাস্কালের দিকে তাকিয়ে দেরিদা প্রশ্ন করেন, ‘তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?’
ঠিক পরের বছর, পাস্কালের জন্মদিনের ঠিক আগের রাতে, এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে, ড্রাগ ওভারডোজের কারণে হার্ট অ্যাটাকে পাস্কাল ওজিয়ের মারা যান। কেউ কেউ একে আত্মহত্যা ভেবেছিলেন। পরের দিন তিনি ২৬-এ পা দিতেন। এ খবরে দেরিদাও প্রভাবিত হন। সিনেমায়, ভূতে বিশ্বাস করে কি না, তাঁর প্রশ্নের উত্তরে পাস্কালের সংলাপ ছিল, ‘হ্যাঁ, করি। এখন পরোপুরি করি।’ কোনও কারণে পরিচালকের এই সংলাপ বলাটা ঠিক যেন মনঃপূত হচ্ছিল না। পাস্কালের ওই ছোট্ট সংলাপটারই তিনি প্রায় ৩০বার শট নেন। পরে দেরিদা বলেছিলেন, ওজিয়ের মারা যাওয়ার পর দেরিদা যতবার সিনেমাটা দেখেছেন বা ছাত্রছাত্রীদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন, ততবার তিনি আতঙ্কিত বোধ করেছেন ওই ৩০টা শটের কথা ভেবে: ‘ভাবুন তো, আপনি স্ক্রিনে এক মৃত মহিলার মুখাবয়ব দেখছেন, যাকে আপনি জিজ্ঞেস করছেন, সে ভূতে বিশ্বাস করে কি না। সে বলেই চলেছে, সে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে…’
১৯৯৯-এ মিশরীয় কবি এবং তথ্যচিত্রকার সাফা ফাথি দেরিদার উপর তথ্যচিত্র বানান। নাম Derrida’s Elsewhere। ক্যামেরার সামনে দেখি এক দার্শনিক। কিছু লং-শটে তোলা দৃশ্য যেন বিবিক্তিকে আরো বাঙ্ময় করে তোলে। নেপথ্যকণ্ঠ সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের ঘটনাগুলোকে তুলে আনতে থাকে, যা তাঁর চিন্তাবিশ্বকে তৈরি করেছে। দেরিদা তাঁর ইহুদি শৈশব, সুন্নত-সংক্রান্ত দর্শন, রাজনীতি, ধর্মীয় চিহ্ন, পরিচিতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে চলেন। গোপনীয়তা বিষয়ক তাঁর ভাবনাচিন্তার কথাও বলেন। দেরিদার গোপনীয়তা কেন্দ্রিক লেখায় ফ্রয়েডের গা-ছমছমে বা অদ্ভুতুড়ে (Uncanny) সম্পর্কিত লেখার প্রভাব ছিল জোরালো।
দেরিদার জীবনের একদম শেষে, মৃত্যুর দুবছর আগে, বেরোয় এক তথ্যচিত্র: ‘দেরিদা’। দুজন পরিচালক, কিরবি ডিক আর অ্যামি কফম্যান, প্রায় সর্বত্র ছায়ার মতো দেরিদাকে অনুসরণ করে বেড়ান। যা ফুটেজ পাওয়া যায়, সেটা থেকেই এ ছবি তৈরি। সিনেমার আখ্যান এগোয় সাল ধরে ধরে, বইয়ের নাম উল্লেখ করে উদ্ধৃতি দিতে দিতে। শুরুর দৃশ্যে দেরিদার গলা শোনা যায়: ‘আমি সাধারণত ভবিষ্যৎ আর ভবিতব্যের পার্থক্য করার চেষ্টা করি। ভবিষ্যৎ হয়তো কিছুটা হলেও অনুমানযোগ্য— কাল, পরে বা পরবর্তী শতাব্দীতে কী ঘটবে। ভবিতব্য কেউ জানে না। এই যে নিয়তির হাতে কী আছে, কেউ আগে থেকে কিছু বলতে পারে না, একেই আমি আসল ভবিষ্যৎ বলি।’ স্ক্রিনে ফুটে ওঠে ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা দ্রুতগতিতে অপস্রিয়মাণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। ‘মার্ক্সের ভূতগুলি’তে দেরিদা লিখেছিলেন নজরদারের কথা— যে সবাইকে দ্যাখে, কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পায় না। এও যেন এক অশরীরী উপস্থিতি। দেরিদা সশরীরেই যেন সেই নজরদারে পরিণত হন। সত্তরের দশক থেকেই দেরিদা ক্রমশ যে পপ কালচারের অংশ হয়ে উঠছিলেন সে কথা আগেই বলেছি। ‘There is nothing outside the text’, ‘I always dream of a pen that would be a syringe’, ‘There is no simple answer to such a question’, ‘I have nothing to say about love’— ইত্যাদি লেখা টি-শার্ট পরে ছেলেমেয়েরা তখন ঘুরে বেড়াত। ১৯৯৭-এ উডি অ্যালেন তাঁর এক ছবির নাম দেন ‘Deconstructing Harry’, যদিও নামটা ছাড়া দেরিদার তত্ত্বের সঙ্গে তার খুব একটা সম্পর্ক ছিল না।
বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে ফরাসি নবতরঙ্গের সঙ্গে যে পত্রিকাটির নাম ওতপ্রোত, সেই ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’ ১৯৯৮ আর ২০০০ সালে দু’দফায় গিয়েছিল চলচ্চিত্র সম্পর্কে দেরিদার সাক্ষাৎকার নিতে। তখনও তাঁর শেষ ছবি ‘দেরিদা’ বেরোয়নি। ফলে প্রথম দুটো ছবি নিয়েই কথা হয়। কথা হয়, ‘ইকোগ্রাফিজ অফ টেলিভিশন’ বই নিয়েও, যেখানে বার্নার্ড স্টিগলারের সঙ্গে তিনি বিশেষত টেলিভিশন এবং ক্যামেরায় তোলা ছবি নিয়ে বেশি আলোচনা করেন। সে বইতে বিস্তৃত আলোচনা ছিল ছবি এবং প্রেতভাবনার। কাইয়ে দ্যু সিনেমাকে দেরিদা জানান, তিনি দার্শনিক হলেও, সিনেমা দেখেন একদম সাধারণ মানুষের মতো চোখ নিয়ে। ভাল-মন্দ কিছুই বাছবিচার করেন না। তাঁর জীবনের প্রাথমিক যৌনচেতনাও সিনেমার হাত ধরেই তৈরি। খুব ছোটবেলায়, যখন তাঁর ১০-১২ বছর বয়স, তখন আলজেরিয়ায় সিনেমা দেখতে যেতেন। সেই প্রেক্ষাগৃহগুলোর নাম তাঁর মনে ৭০ বছর বয়সেও জ্বলজ্বল করছে— দ্য ভক্স, দ্য ক্যামিও, দ্য নুন মিডনাইট, দ্য অলিম্পিয়া…। থিয়েটারের সাথে চলচ্চিত্রের প্রধান পার্থক্য একাকিত্বে। থিয়েটারে তবু সমবেতভাবে রসাস্বাদন সম্ভব, চলচ্চিত্রে তা সম্ভব নয়। ছবি দেখার সময় সবাই যেন পর্দার সামনে একা হয়ে যায়।
‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’ তাদের সাক্ষাৎকার নিবন্ধ শুরু করেছিল এই প্রশ্ন দিয়ে: ‘চলচ্চিত্র দেখে একজন দার্শনিক যখন স্বীকার করেন তাঁর ‘সম্মোহিত বিস্ময়’, তখন এটা কি খুব কাকতালীয় যে তাঁকে প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে তাড়া করে ফেরা ভূতের মুখোমুখি হতে হবে?’
প্রশ্নটা ঝুলতে থাকে।