অস্তাচলের লাল
আজকাল আড্ডাতেও মেয়েদের নিয়ে রসিকতা করলেই চারটে আঙুল উঁচিয়ে ওঠে ‘মিসোজিনিস্ট!’, সমকামীদের নিয়ে ইয়ার্কি মারলে ‘হোমোফোবিক!’, কোনও সম্প্রদায়কে নিচু করলে অবশ্যই ‘কমিউনাল!’, এবং এই সবগুলোই অত্যন্ত উচিত-আপত্তি, কিন্তু যখন বয়স্ক লোকদের নিয়ে বিদ্রুপ করা হচ্ছে, ‘টাকলা বুড়োর আবার শখ কত, চারটে মেয়ের সঙ্গে শুচ্ছে!’, কিংবা ‘এত বয়সে প্রোপোজ? লজ্জাশরম নেই!’, অর্থাৎ বলা হচ্ছে বুড়োদের প্রেমে বা যৌনতায় কোনও অধিকার নেই, তখন কেউ ‘Ageist!’ বলে লাফিয়ে উঠছে না, বয়স্ক-বিদ্বেষ ব্যাপারটা এখনও নিন্দনীয় হিসেবে অতটা প্রচারিত হয়নি। বয়স্ক লোকের সঙ্গে তরুণীর বিয়ে হলেও লোকের ভুরু কুঁচকে ওঠে (সইফ আলি খান ও করিনা কাপুর), একটু বয়স্কা মেয়ের সঙ্গে তরুণের বিয়ে হলেও (ক্যাটরিনা কাইফ ও ভিকি কৌশল)। বয়স্কদের সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কের সম্মান দেওয়া হয় না, অন্যের সম্মতিক্রমে তাঁরা যা খুশি করতে পারেন— মেনে নেওয়া হয় না, তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কুমন্তব্য করার অধিকার সহজে জন্মায়। ভাবটা হল, বয়স বেড়ে গেলে জীবনের তাবৎ আনন্দ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা কম্পালসরি, বনজঙ্গল বা লেপতোশক খুঁজে এবার মানে-মানে কেটে পড়ো।
‘গুড লাক টু ইউ, লিও গ্রান্ড’ (Good luck to you, Leo Grande) একটা চমৎকার ছবি, যা প্রথমেই দেখায়, একজন বছর ৬২-৬৩’র মহিলা হোটেলের ঘরে ডেকেছেন এক পুরুষ-যৌনকর্মীকে, যৌনতা করবেন বলে। প্রায় গোটা ছবি জুড়ে, এই একটা ঘরেই ক্যামেরা ঘোরফেরা করে, ওদের চারবার সাক্ষাৎ হয়, আমরা মূলত দুজনের কথাবার্তা শুনি, দুজনের জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে পারি, আর পুরোটা মিলিয়ে যৌন চাহিদা ও যৌন আনন্দের প্রতি অধিকারের (এবং আরেকটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললে, আনন্দের প্রতি অধিকারের) জয়ধ্বজা ওড়ানো হয়। মহিলা নিতান্ত রক্ষণশীল এক প্রাক্তন স্কুলটিচার, সমগ্র জীবনে একটা কাজও করেননি যা সমাজনির্দিষ্ট লক্ষ্মণরেখার বাইরে এক-কণা পা ফেলেছে, এই প্রথম এমন কাণ্ড করে বসলেন যা তাঁর চরিত্র ও প্রচলিত সমীচীনতা-পরিধির উল্টোদিকে যায়। হয়তো একাকিত্ব আর সহ্য না করতে পেরে, বা ভেবে, মরেই তো যাব, বরং একবার একটা ঝাঁপ দিয়ে দেখি। জীবনে যৌনতা তাঁর হয়েছে শুধু স্বামীরই সঙ্গে (ভদ্রলোক বছর দুই মারা গেছেন), এবং স্বামী মনে করতেন কোনওমতে নিয়মমাফিক সঙ্গম সেরে ঘুমিয়ে পড়াই হল দাম্পত্যের কর্তব্য-তালিকায় যথাযথ টিক-প্রদান। মিশনারি পোজিশনে সঙ্গম ছাড়া, আর সব কিছুকেই তিনি বিকৃতি মনে করতেন। মহিলার শখ ছিল ওরাল সেক্সের, কখনও ভদ্রলোক তা প্রশ্রয় দেননি। তিনি মনে করতেন, ও-কাজ করলে মানুষ ছোট হয়ে যায়। এ-কথা বলতে গিয়ে মহিলা কেঁদেও ফ্যালেন, কারণ তাঁর কোনও আকাঙ্ক্ষা কোনওদিন গুরুত্ব পায়নি। তাঁর সারাজীবনে কখনও, একবারের জন্যও, অর্গ্যাজম হয়নি। মহিলার মা বলতেন আত্মশ্লাঘা খুব খারাপ, তাই আয়নায় তাকিয়ে কখনও তিনি নিজের শরীরটাকে অসঙ্কোচে অবলোকন করতেই পারেননি। অন্যের সামনে নাচলেও অচিরিক্ত সচেতন থেকেছেন, জড়সড়। যখন ক্লাসে পড়াতেন, তখন তিনিও মনে করতেন ছোট স্কার্ট পরলে মেয়েদের চরিত্র নষ্ট হয়, ছাত্রীদের ধমকও দিয়েছেন। যৌনকর্মীটিকে প্রথম সাক্ষাতের কিছুক্ষণ পরেই তিনি বলেন, আমার ভুল হয়ে গেছে, তুমি চলে যাও, আমি অর্ধেক টাকা দিয়ে দেব। আর তার কিছুক্ষণ পর : আমার বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছিল যে আমি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম, (ইস, আমার সন্তান জানতে পারলে কী ভাববে!), তুমি চলে যাও, পুরো পেমেন্ট-টাই করে দিচ্ছি। ছেলেটি বারবার তাঁর সহস্র আড়ষ্টতা ভেঙে তাঁকে সহজ করে নিতে চায়, বোঝাতে চায়, আনন্দ চাওয়ার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। সে প্রশ্ন করে, যা চাও, তা যখন নাগালে এসে গেছে, তখন তা হাত বাড়িয়ে নিতে এত বাধা কীসের? ছবিটি জুড়ে বার্ধক্যের সঙ্গে যৌবনের দেখা হয়, প্রাচীনপন্থার সঙ্গে আধুনিক চিন্তার, নিরন্তর অপরাধবোধের সঙ্গে ফুরফুরে আহ্লাদ-প্রয়াসের। নিজেকে বঞ্চিত করার পাঠশালার সঙ্গে, নিজেকে যত্ন করার স্কুলের।
দিদিমণি প্রথমেই বলেন, তুমি এত সুন্দর দেখতে, ফোটোর চেয়েও এতটা সুন্দর, যে, কথা বলতেই অসুবিধে হচ্ছে। ছেলেটি রসিক, বলে, হ্যাঁ, আমি 3D-তে বেশি ভাল। ছেলেটি দু-একটি কথায় দিদিমণিকে অবাক করে, কারণ তার শব্দচয়নে শিক্ষার পালিশ, সে বলে নাইজেলা লসন (ব্রিটিশ কুক-শো’র তারকা, রান্নার বই লিখেও বিখ্যাত, এখন বয়স ৬২) ‘empirically sexy, at any age’, এবং মহিলার প্রশ্ন ‘সবচেয়ে বুড়ো কার সঙ্গে যৌনতা করেছ?’-র উত্তরে বলে, ‘That’s a bit reductive.’ হয়তো দিদিমণির ধারণা ছিল, এ-লাইনে যারা আসে তারা নিশ্চিতভাবে অশিক্ষিত, বা নির্বোধ। ছেলেটি মহিলাকে এ-বিষয়েও আশ্বস্ত করে যে তাকে কেউ পাচার করেনি, বা সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে এ-কাজ করছে না, তার ভাল লাগে, ফলে তাকে কোনওভাবে শোষণ করা হচ্ছে না, নিগ্রহও নয়। ছেলেটি বলে, কাজ করে পয়সা পাওয়ার মধ্যে অশ্লীল কিছু নেই, আমি নিজে এই কাজটা বেছে নিয়েছি, তুমি আমাকে কিনে নাওনি, আমার কয়েক ঘণ্টার পরিষেবা কিনেছ মাত্র, একটা দর আমি দিয়েছি আর তুমি সম্মত হয়েছ, এইটুকুই। সাধারণত যৌনকর্মের সঙ্গে যে বাধ্যতার ধারণাটা থাকে, নেপথ্য-নির্যাতনের গ্লানি, বা মনে করা হয় শৈশবে অত্যাচারের দরুন লোকটার মধ্যে আত্মসম্মানের এমন অভাব যে এই কাজটা বেছে নিয়েছে এবং লাঞ্ছনার নকশাটাই বুঝে উঠতে পারছে না— এই ছবি তার নায়কের ক্ষেত্রে সেগুলোকে বাতিল করে। এখানে চিত্রনাট্যকার কেটি ব্র্যান্ড আর পরিচালক সোফি হাইড, ছবির মহিলাটির মতো দর্শককেও ধাক্কা দেন, কারণ ছেলেটি তার দুরন্ত রূপ-প্রখর বুদ্ধি-সস্নেহ সমঝদারি ও ঝকঝকে রসবোধ নিয়ে কোনও কৃপাপ্রত্যাশী ও নিরুপায় যৌনকর্মীর ছাঁচে আদৌ পড়ে না। সে অন্য যে-কোনও কাজের মতোই এই কাজটিকে দ্যাখে, দিব্যি সুষ্ঠুভাবে কাজটা সম্পন্ন করতে চায়, মহিলা যখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, যখন ছেলেটির কাউকে অনাকর্ষণীয় মনে হয় (যেমন একজন বছর তিরিশের ছেলের না-ই ভাল লাগতে পারে বছর ষাটের মহিলাকে), তখন সে কি উত্তেজিত হওয়ার জন্য একটা ওষুধ খেয়ে নেয়? ছেলেটি বলে, সবার মধ্যেই ভাল লাগার কিছু না কিছু আছে। সেটুকু খুঁজে নিলেই হবে। ছেলেটিকে এই যৌন পরিষেবার দিক থেকে পূর্ণ ইচ্ছুক ও সতত উৎসাহী, প্রায় ‘পবিত্র যৌনদূত’ চরিত্র হিসেবে তৈরি করার সুবিধে হল, সে দৃঢ় ও একঝোঁকা ভাবে যৌনতার (যৌনতা চাওয়ার, দেওয়ার ও তার আবহে কোনও মালিন্য না-রাখার) সমর্থনে সওয়াল চালাতে পারে। মহিলা যখন এক সময় তাকে একটু ব্যঙ্গ করে বলেন, তুমি তো দেখছি যৌনতার একটি সন্ত, প্রায় সমাজকল্যাণের স্তরে ব্যাপারটা নিয়ে যাচ্ছ, যেন লোকাল কাউন্সিল থেকে এই পরিষেবার বন্দোবস্ত থাকা উচিত— সে জবাবে বলে, যদি তা সত্যিই করা যায়, নোংরামি ও হাবিজাবি ঝামেলা কতটা কমে যাবে, ভেবে দ্যাখো। কত সভ্য হয়ে উঠবে যৌনতার পুরো নিসর্গটা, কোনও লজ্জা, নিন্দে, ভাল-খারাপ ছাপ্পা দেওয়ার অবকাশই থাকবে না। তুমি যৌনতা চাও, কিন্তু কোনও কারণে পাও না, হয়তো তুমি লাজুক, বা অসুস্থ, বা শোকাকুল। যৌন হতাশা কাটাতে তখন তুমি কাউকে ভাড়া করলে, সে তোমাকে সাহায্য করল, বা আরও ভাল, আনন্দ দিল। সবাই খুশি। ঝামেলাটা কোথায়?
আসলে ঝামেলাটা হল : সমাজ, বাই ডেফিনিশন, আনন্দবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী। তাই ছবিটা কিছু জটিলতা পরিহার করে সেই সমাজকে স্পষ্ট কয়েকটা কথা শোনাতে চায়। তাও এখানে আলোচনা করা হচ্ছে ইউরোপীয় সমাজ নিয়ে (ছবিটা ব্রিটিশ, এ-বছরেই তোলা)। যদিও মহিলা বারবার বলছেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় লন্ডন একটা আলাদা ‘দেশ’ ছিল, পুরোপুরি অবদমিত আবেগ দিয়ে তৈরি, কিন্তু এখনকার কমবয়সি মেয়েরা বেশ আলাদা, তারা জীবন অন্যভাবে বাঁচছে’— তবু যৌনতা নিয়ে এখনও যে কত শ্যাওলা জড়িয়ে আছে, কত গোঁড়ামি আর বিদ্রুপ মেশানো গেঁড়ি-গুগলির খোঁচওঠা খোলে ক্রমাগত হৃদয় ছেঁচে যাচ্ছে লোকের, ইয়ত্তা নেই। আর অ-ইউরোপীয় সমাজের কথা তো ছেড়ে দিলাম, সেখানে যৌনতা প্রায় সর্বত্র পাপ বলে গণ্য। ছবিটি গোটা সময় শুধু যৌনতা বিষয়ে কথা বলে না, মা-সন্তানের সম্পর্ক নিয়েও বলে (মনে রাখতে হবে, যৌনকর্মীটি মহিলার ছেলের বয়সি), এক সন্তান চূড়ান্ত প্রথাগত বলে তাকে মহিলার বোরিং মনে হয়, অন্য সন্তান আবার বড্ড বেশি উচ্ছৃঙ্খল ও গৎভাঙা বলে তাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়। উনি বলেন সন্তানেরা তাঁর গলায় ভারী পাথরের মতো ঝুলে আছে, আগে জানলে তিনি মা হতেন না। আবার যৌনকর্মী ছেলেটির উল্টো অভিযোগ আছে, তার মা তার স্বাধীন পছন্দ ও আচরণ সহ্য করতে পারেন না বলে তাকে ত্যাজ্য করেছেন, রাস্তায় মুখোমুখি হলে পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু এসব সহ-প্লট ছাড়িয়ে ও পেরিয়ে, ছবিটা শেষ অবধি বলে, তোমার জীবনের প্রার্থিত আনন্দ নিয়ে তুমি লজ্জিত হয়ো না, বরং যেভাবে পারো (অন্যকে কষ্ট না দিয়ে) তা জোগাড় করো। মহিলা এক সময় বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পরে মহিলার পুরুষবন্ধু কেউ-কেউ যৌনতা করতে চেয়েছেন, ‘কিন্তু তারা তো বয়স্ক, আমি তো চাই তরুণ পুরুষ-শরীর।’ এক সময় ছেলেটির সুগঠিত পেশিবহুল দেহে হাত বোলাতে-বোলাতে মহিলা প্রায় ছিটকে সরে যান, কারণ লোভের এমন তরঙ্গ তাঁকে ঝাপটা দেয় যে তিনি তা সহ্য করতে পারেন না। বেহায়া আহ্লাদে এতদিনে দীক্ষিত মহিলা তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্রীকে (এখন ওই হোটেলের ওয়েটার) ছবির শেষদিকে বলেন, তিনি ক্ষমা চাইছেন তাঁর কাছে (এবং তার মাধ্যমে সব ছাত্রীর কাছে) কারণ তিনি ওদের বকতেন পোশাক-আশাকে সংযমী না হওয়ার জন্য, কিন্তু আজ তিনি বুঝেছেন, আনন্দের মধ্যে (ভোগেচ্ছার মধ্যে) অন্যায় নেই।
বয়স্ক মানুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আরও ছবি হয়েছে, অস্ট্রিয়ার চিত্রপরিচালক উলরিখ সিডল-এর ‘প্যারাডাইস: লাভ’ ছবিতে (প্যারাডাইস ট্রিলজির অংশ) অস্ট্রিয়ান এক বছর-পঞ্চাশের মহিলা কেনিয়ায় বেড়াতে যান, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ যৌনকর্মীদের সঙ্গে শুতে থাকেন, তারা বারবার জানায় তিনি তাঁর মোটা ও বেঢপ শরীর সত্ত্বেও খুব সুন্দর, তাঁকে বহু মিষ্টি নামেও ডাকে, তারপর বোঝা যায় তারা শুধুমাত্র, যে কোনও অজুহাতে, তাঁর টাকা খাবলাতে চায়। যার সঙ্গেই আলাপ (ও যৌনতা) হয়, সে-ই কিছুক্ষণ পরে একটা করে দুঃখের গল্প পেড়ে আনে আর প্রচুর টাকা চায়। মহিলা প্রায় ফতুর হয়ে যান, এক সময় বুঝতে পারেন, তিনি নিরন্তর ঠকছেন, এভাবে ভালবাসা কেনা যাবে না, এই যৌনকর্মীরা তাঁর প্রতি ন্যূনতম আগ্রহী নয়, তারা নিষ্ঠুর ও জোচ্চোর। এক দৃশ্যে হোটেলে এক পুরুষ-যৌনকর্মীকে ঘিরে অনেক বয়স্কা মহিলা তাকে নগ্ন করে বহু চেষ্টা করেন, তবু সে উত্থিত হয় না। শেষে মহিলা বার-এর এক কর্মীকে ঘরে এনে তাকে তাঁর গায়ের বিভিন্ন অংশে চুমু খেতে বলেন, কিন্তু সে যৌনাঙ্গে চুমু খেতে অস্বীকার করে। মহিলা তাকে ঘরে থেকে বের করে দেন ও কাঁদতে থাকেন। উলরিখের ছবি তীব্র নিঃসঙ্গতার, কড়া তিক্ততার, সেক্স-ট্যুরিজমে যাওয়া বড়লোক শ্বেতাঙ্গ ও তাকে ফিরতি-বঞ্চিত করা শঠ কৃষ্ণাঙ্গের ছবি। ‘গুড লাক…’-এর সঙ্গে তার তুলনা করা যাবে না, কারণ এই ছবির মূলে আছে যৌনকর্মী ও বয়স্কা মক্কেলের একটা সুস্নিগ্ধ বন্ধুত্ব। যেখানে যৌনকর্মীটি ঠকাতে চায় না, কোনওমতে পয়সা নিংড়ে পালাতে চায় না, বরং এক ত্যক্ত বিধবাকে, আজীবন যৌনতা-বঞ্চিত মহিলাকে, টাকার বিনিময়েই কিছু নিখাদ আনন্দ দিতে চায়, আর সেই আনন্দ পাওয়ার অধিকারটুকু বিষয়ে তাঁকে সচেতন করতে চায়। সে বলে, আনন্দ-উপভোগের মুহূর্তে একজন মানুষের মুখটা দেখতে তার অসম্ভব ভাল লাগে। সেই মানুষটি যখন নিজেকে সুখের হাতে ছেড়ে দেয়, সংস্কার আর একশোরকম শেকল ভাসিয়ে যখন শুধু নিখাদ আবেশের কাছে সমর্পণ করে, তার শরীর জুড়ে যে অসামান্য তাপ আর আরামের অনুভূতিটা ঘুরতে থাকে— সেই ঘোরকে ছেলেটির অসামান্য মনে হয়। নিজের ঘনিষ্ঠ অবদানের ফলে অন্যের এই অপার পুলকের বিবরণ দিতে-দিতে ছেলেটি কায়িকভাবে উত্তেজিতও হয়ে ওঠে। তাই উলরিখ যেখানে শুধু একটা শুকনো দেনা-পাওনার সম্পর্ক এবং তজ্জনিত খড়খড়ে অমানুষতা খুঁজে পান, সোফি হাইড পান একটা অসমবয়সি সখ্য ও ধারণা-বদলের আখ্যান। দুটি ছবিতেই কেন্দ্রীয় নারীচরিত্রের প্রতি দরদ থাকলেও, ‘গুড লাক…’ নির্জন বন্ধ্যা হৃদিপ্রান্তরে শেষ হয় না, বরং সিনেমার শেষে মহিলা আয়নায় নিজের নগ্ন (ও প্রথাগত দৃষ্টিতে স্পষ্টই অসুন্দর) শরীরের দিকে অলজ্জ ভালবাসা নিয়ে তাকাতে পারেন, জীবনে এই প্রথম। সিডল-এর ছবিতে মহিলা বারবার তাঁর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, কিন্তু সে কখনও ফোন ধরে না, ফোন করে না। ‘গুড লাক…’ ছবিতেও সন্তানের সঙ্গে এই বয়স্কার দূরত্বের কথা বলা হয়, কিন্তু মোক্ষম মুহূর্তে, যখন মহিলা পুরুষটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছেন তখনই, কিংবা যখন একটি গানের সঙ্গে ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে নাচতে শুরু করছেন তখনই, তাঁর মেয়ে ফোন করে। তিনি আবার বলেন, যখন তাঁর ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না, তখনও তিনি ধরেন, বরং তখনই বিশেষ করে ধরেন (কারণ তিনি আত্মবঞ্চনার মহিমাই শিখেছেন)। ছবিটা মহিলার গা থেকে এই জংধরা তালাগুলো খুলে নেওয়ারই কাহিনি বলে। উলরিখের ছবিটি অসামান্য (এবং হয়তো অধিক বাস্তব), কিন্তু বিপরীত মেজাজের। ‘গুড লাক…’ হয়তো একটু বেশিই নরম ও রোম্যান্টিক, স্বল্প চোখ-ঠারা, এবং কিছুটা উপদেশধর্মীও বটে (প্রতিবার ছেলেটি মহিলাকে স্পর্শের সময় বা মহিলা ছেলেটিকে স্পর্শের সময় অনুমতি-নেওয়ানিইয়ি হয়), কিন্তু যৌনতা নিয়ে, তার প্রয়োজনীয়তা ও তার গা থেকে নোংরামির মামড়ি ছাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে, বয়স্কেরও যৌন কামনায় পূর্ণ অধিকার নিয়ে এমন একটি স্পষ্ট ছবি এ-বছরের বড় প্রাপ্তি।