মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ফাইনাল সবে শেষ হয়েছে। স্টেডিয়ামের ভিআইপি বক্সের দিকটায় অনেক খুঁজেও সৌরভ গাঙ্গুলিকে পেলাম না। যে-বহুজাতিক পানীয় সংস্থার হয়ে ফাইনালে গেছিলেন সৌরভ, তাদের বক্সেও পেলাম না। খেলা শেষে তাই টেলিফোনেই কথা হল, ‘কাজকর্ম মিটিয়ে আমার হোটেলে চলে এসো। ওখানেই দেখা হবে।’ যে-হোটেলের নাম বললেন, স্থানীয় সাংবাদিকরা বললেন, সেটা বলশেভিক থিয়েটারের ঠিক উল্টোদিকে। গেলাম। সৌরভ এলেন সস্ত্রীক, সকন্যা। সেবারে ডোনা আর সানাকে নিয়েই গেছিলেন বিশ্বকাপের খেলা দেখতে। একটা সফট ড্রিঙ্কস কোম্পানি, যারা বিশ্বকাপেরও স্পনসর, তারা সৌরভকে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লবির পরেই একটা ব্যাঙ্কোয়েট। সেই রাতেই সেখানে ওই স্পনসরদের একটা পার্টি ছিল। গোটা দুনিয়া থেকে নামী সেলিব্রিটিরা ছিলেন সেখানে। বিভিন্ন দেশে যেসব সেলেবরা ওই নরম পানীয় সংস্থার ব্র্যান্ড এনডোর্স করেন, তাঁদের বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে নিমন্ত্রণ করেছিল ওই সংস্থা। ভারতে যেহেতু সৌরভ ওই সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, তাই সৌরভও ছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। যাই হোক, সৌরভরা তো ঢুকবেন পার্টিতে, কিন্তু আমি কোথায় যাব! আমি তো সেই পার্টিতে আমন্ত্রিত নই। পার্টিতে ঢোকার মুখে আমাকে দেখিয়ে ডোনাকে বললেন তিনি, ‘তোমরা একটু বাইরে ওয়েট করো। আমি ওর জন্য ভিতরে ঢোকার অনুমতি নিয়ে আসি।’
আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, সেই সময়েই ইভেন্ট টিমের এক মহিলা এলেন দুঃখপ্রকাশ করতে। ‘ম্যাডাম, স্যারের ফ্যামিলি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। এটা গ্লোবাল একটা ইভেন্ট। আমাদের গেস্ট লিস্ট আর সমস্ত ব্যবস্থা বেশ কয়েকমাস আগে থেকে তৈরি। আপনি প্লিজ ভিতরে আসুন।’ সাংবাদিকদের এসব পরিস্থিতির জন্য তৈরিই থাকতে হয়। সত্যিই তো, আমার এই অনুষ্ঠানে ঢোকার অনুমতি নেই, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারলে বাড়তি খবর, কিছু বিরল মুহূর্তের মুখোমুখি হওয়া। ডোনা একটু বিড়ম্বনায়, কী করবে বুঝতে পারছে না। এমন সময় সৌরভ নিজে বেরিয়ে এলেন। ‘চলো চলো, রুমে গিয়ে আড্ডা মারি। ওরা ওদের গেস্ট ছাড়া বাইরের লোকেদের ভিতরে ঢুকতে দেবে না বলছে।’ আমি বললাম, ‘আরে তোমরা ভিতরে যাও। আমি লবিতে অপেক্ষা করছি। গোটা পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষরা এসেছেন। তোমার থাকা উচিত।’ কিন্তু সৌরভ ততক্ষণে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তিনি আর থাকবেন না পার্টিতে। আর তাই-ই হল। আমরা ফিরে গেলাম তাঁর হোটেলের রুমে। অনেক রাত অবধি আড্ডা হল। ছোট ঘটনা। কিন্তু এই ছোট ঘটনাটা দিয়েই বোঝা যাবে, একজন মানুষের খাঁটি লিডারশিপ। সঙ্গের মানুষ, পাশের মানুষ, টিমের সদস্য যদি সমান অধিকারটা না পায়, তাহলে নিজের অবস্থানটা ছেড়ে দিতেও যার বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না, সৌরভ গাঙ্গুলি তেমনই একজন।
তখনও গ্রেগ চ্যাপেল আসেননি এই দেশে। নতুন-নতুন কীর্তির ইমারত গড়ছেন ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি। সালটা ২০০৩-’০৪; অস্ট্রেলিয়া সফরে যাচ্ছে দল। একেবারেই ফর্মে ছিলেন না অনিল কুম্বলে। নির্বাচকরা সিদ্ধান্ত নিলেন, কুম্বলেকে ছাড়াই দল তৈরি হবে সেবার। কিন্তু টিম সিলেকশন মিটিংইয়ে কিছুতেই মানলেন না সৌরভ। বললেন, ‘কুম্বলের নাম না লিখলে মিটিং থেকে উঠবই না।’ নির্বাচকরাও ধৈর্য হারালেন। এক সময় সৌরভকে বলা হল, ‘ঠিক আছে, তুমি যখন এইভাবে চাইছ, আমরা পাঠাচ্ছি। কিন্তু কুম্বলে যদি পারফর্ম্যান্স না করে, তাহলে তার দায়ও থাকবে তোমার। তোমার অধিনায়কত্ব নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন উঠে যাবে, আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস হারাব।’ সৌরভ তাতেই রাজি। শেষ অবধি কুম্বলে গেলেন অস্ট্রেলিয়া। অসাধারণ খেললেন গোটা সিরিজে। অন্য কিছুই না, ক্যাপ্টেন যদি পাশে থাকে, তাহলে গোটা সমীকরণে বাড়তি কিছু আত্মবিশ্বাস আগে থেকেই যোগ হয়ে যায়। বীরেন্দ্র শেহবাগের কথাই ভাবুন! জন রাইট বার বার বলছিলেন, উইকেটে গিয়ে তাড়াহুড়ো করবে না। কিন্তু বীরু কি সেসব শোনার মানুষ! যথারীতি চালিয়ে আউট হলেন। জন রাইট রেগে গিয়ে একেবারে শেহবাগের কলার ধরে নিলেন। ড্রেসিংরুমে প্রবল অশান্তি। কোচের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন সৌরভ। কলার ধরবে কেন! তর্কাতর্কি, কিছুদিন কথা বন্ধ, সব চলল। কিন্তু দুজনের লক্ষ্যটাই যেহেতু ছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে একটা দিশা দেখানো, ঝামেলা মিটতেও সময় লাগল না কোচ আর ক্যাপ্টেনের।
সৌরভকে আমি নিজেও ‘ক্যাপ্টেন’ বলেই ডাকি। কবে থেকে ডাকটা শুরু হয়েছে মনে নেই, কিন্তু খুব কাছ থেকে একজন মানুষের ভিশন, লিডারশিপ, জেতার চেষ্টা— সবটা দেখার পর মনে হয়, এই সম্বোধনটায় কোনও ভুল নেই। এই ক্যাপ্টেন সবার হতে পারে। যে-ছেলেটা বার বার হেরে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরাম, যে-মেয়েটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলতে পারছে না, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখলেই জয় করার আছে গোটা দুনিয়া— সবার ক্যাপ্টেন হতে পারেন তিনি। এখনও কোনও মনখারাপে, কোনও হেরে যাওয়ার মুহূর্তে ফোন করে ফেলি তাঁকে। তাঁর জীবনও তো সবটা রূপকথার মতো সাজানো নয়, তাহলে ওই খারাপ থাকার মুহূর্তগুলো কীভাবে একা-একা চালিয়ে গেছেন লড়াই? সৌরভ গাঙ্গুলির হিসেব এখানে খুব পরিষ্কার। ‘ধুর, আমি কোনওদিন এসবের পরোয়াই করিনি। আমার থিওরি খুব সিম্পল। এটা আমার রাস্তা, এই রাস্তা দিয়েই আমি হাঁটব, তোমাকে আমার সঙ্গে হাঁটতে হলে আমার রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হবে।’ অথচ সৌরভের হাঁটার রাস্তাটাও খুব সহজ, একেবারে সোজা। সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন, বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন দু’হাত দিয়ে। সে যৌথ পরিবারের ভাইবোনদের জন্য হতে পারে, বন্ধুদের জন্য হতে পারে, অফিসের সহকর্মীদের জন্যও হতে পারে। খুব কাছের বন্ধু জয়দীপ মুখার্জি একটা গল্প বলেছিলেন। সৌরভ তখন খেলছেন। জয়দীপের মা সিদ্ধান্ত নেন, আমেরিকায় মেয়ের কাছে স্থায়ীভাবে থাকবেন। কলকাতায় মাঝে মাঝে আসবেন। প্রবল মনখারাপ জয়দীপের। যেদিন মা আমেরিকা যাচ্ছেন, সেদিন নাকি এগারোবার ফোন করেন সৌরভ। টেস্ট চলছিল। ব্যস্ত ছিলেন তিনি; তবু বন্ধুর একা থাকার মুহূর্তটা ভোলেননি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি। বাবা-মা’কে নিয়ে লন্ডন বেড়াতে গেছি। মা প্রবল অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ক’দিন লন্ডনে থাকতে হবে বুঝতে পারছি না। সৌরভ তাঁর লন্ডনপ্রবাসী কাকাকে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের চাবি পাঠিয়ে দিলেন। দু’সপ্তাহের বেশি সেবার লন্ডন থাকতে হয়েছিল। মা’কে সুস্থ করেই কলকাতা ফেরাতে পেরেছিলাম। কে জানে, ওই সময়ে সৌরভ না থাকলে কী হত! আসলে সম্পর্ক মানে তো চূড়ান্ত একটা কমিটমেন্টও, আর তাঁর জীবনে ওই শব্দটার বিন্দুমাত্র খামতি নেই। মেয়ে সানা এখন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করে। স্ত্রী ডোনা তাই মেয়ের কাছে লন্ডনে। কলকাতায় এক আকাশ মনখারাপ আর শূন্যতা নিয়ে বসে থাকেন সৌরভ। মায়ের দায়িত্ব আছে। এখনও মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েন ছোট ছেলের মতো।
খারাপ থাকার অনেক মুহূর্তও খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি নিজে। পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজ। ২০০৫ সাল। আমেদাবাদে স্লো ওভাররেটের জন্য ছ’টা সাসপেন্ড হলেন সৌরভ। টিম চলে গেল পরের ম্যাচ খেলতে। একা-একা বসে আছেন আমেদাবাদের হোটেলে। টিভিতে চ্যানেলের পর চ্যানেল চেঞ্জ করে যাচ্ছেন। অন্যমনস্ক। টিম ভাল খেলছে না। নিজের ব্যাটে রান নেই। তার ওপর সাসপেনশন। যে-অপরাধে দোষী, তাতে তাঁর কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকাও নেই। কিংবা শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দিল্লিতে দ্বিতীয় টেস্টের পর যেদিন টেস্ট দল থেকে বাদ দেওয়া হল সৌরভকে, স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফেরার সময় টিমবাসে বসে খবরটা শুনেছিলেন। হোটেলে যখন ঢুকলেন চোখ টকটকে লাল। লুকিয়ে রাখা কান্নায় না কি অপমানে, কে জানে! চোখের জল ফেলার লোক খুব একটা নন তিনি। ‘কে হবে বাংলার কোটিপতি’ যখন সঞ্চালনা করছেন, এক প্রতিযোগীকে বলেছিলেন একটা কথা, যেটা বেশ মনে আছে। ‘দু’রকম মানুষ আছে। একজন চোখের জল ফেলে নিজেকে হালকা রাখতে পারে। অন্যরা তোয়ালের মতো। যত কান্নাই আসুক না কেন, তারা সবটা শুষে নিতে পারে। ভিতরটা ভারী হয়ে যায়। কিন্তু জলটা ঝরে পড়ে না।’ খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বলে, তিনি দ্বিতীয় প্রজাতির। তাঁর চোখের জল কেউ দেখে না। কিন্তু তাঁর কি নিঃসঙ্গতার মুহূর্ত আসে না? নিজের চোখেই তো বহুবার দেখা। ২০০৬। শারদ পাওয়ারের হস্তক্ষেপের পর পাকিস্তানে গ্রেগ চ্যাপেলের টিমের সঙ্গে পাঠানো হল তাঁকে। এক বছর আগে এই টিমটাই তাঁর নিজের টিম ছিল। নিজের হাতে বানিয়েছিলেন সবটা। কিন্তু সবটা অচেনা করে দেওয়া হয়েছিল তাঁর জন্য। কোনও বন্ধু ছিল না দলে। বরং চাপা টেনশন, তাঁর কাছাকাছি এলে গ্রেগের রোষানলে পড়তে হবে। প্র্যাক্টিসে যাচ্ছেন ইডেনে, ফোন এসেছে যে তাঁকে ইরানি ট্রফির দল থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। কত-কত এরকম ঘটনা কাছ থেকে দেখা। কিন্তু তাঁকে নিজের জেদ, প্রত্যয় থেকে সরানো যায়নি। বিশ্বাস রেখেছেন, করে দেখিয়েওছেন। ইরানি ট্রফির দল থেকে বাদ দিয়েছে, চলে গেছেন চণ্ডীগড়ে অখ্যাত জে পি আত্রে ট্রফিতে খেলতে। ইন্ডিয়া টিমে ফিরে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, নিজের ঘরের মাঠে সেঞ্চুরি করেছেন, রাজার মতো বিদায় নিয়েছেন আন্তজার্তিক ক্রিকেট থেকে।
একটা কথা খুব বলা হয়, সৌরভের জীবনের স্ক্রিপ্ট অন্য কেউ লেখেন, সম্ভবত ঈশ্বর নিজে লেখেন। আমার মনে হয় না। সৌরভের প্রতিটা সাফল্য, কামব্যাক, নিজের উচ্চতাকে একটু-একটু করে বাড়িয়ে নেওয়ার নেপথ্য-নায়ক তিনি নিজেই। সাংঘাতিক একটা বিশ্লেষণী মন তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। আর তার সঙ্গে যোগ করুন প্রবল পরিশ্রমের ক্ষমতা। এই যে ‘দাদাগিরি’-তে বছরের পর বছর মানুষের মনের ভিতরে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন, সেটা কিন্তু একদিনে হয়নি। বরং শুরুর দিনগুলোয় যথেষ্ট স্ট্রাগল ছিল সঞ্চালক হিসেবে। কিন্তু নিজে হোমওয়ার্ক শুরু করে দিলেন সবার অজান্তে। ‘কোন বনেগা ক্রোড়পতি’র পর্বগুলো খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। নিজেকে ভাঙতে থাকলেন প্রতিনিয়ত। নিজের সেলিব্রিটি বৃত্তটার বাইরে এসে প্রতিটা প্রতিযোগীর সঙ্গে মিশতে শুরু করলেন নিজের মতো। এপিসোড রোল শুরু করার বেশ কিছুক্ষণ আগে চলে আসতেন সেটে। প্রতিযোগীদের সঙ্গে গল্প শুরু করতেন। রিসার্চ টিম হয়তো সব ইনফরমেশনই দেবে দাদার টক ব্যাকে, কিন্তু তিনি নিজে তৈরি হয়ে নিতেন নিজের মতো করে। সঙ্গে দারুণ ইম্প্রোভাইজ করার ক্ষমতা।
একটা বাচ্চা ছেলে একবার এসেছে ‘দাদাগিরি’-তে। জনপ্রিয় হিন্দি গানের সঙ্গে নাচ হল তার, হল মজার-মজার কথা। সৌরভ এপিসোড শেষ হওয়ার আগে একটা ব্যাট নিয়ে আসতে বললেন ফ্লোরে। ব্যাট হাতে পেয়ে ওই শিশুকে নিজের হাতে ধরে ব্যাটিং শেখালেন। যুক্তিটা পরিষ্কার, ‘এই মঞ্চে এসে কিছু শিখে যাওয়াটাও জরুরি। ওইটুকু একটা ছেলে, কোনওভাবে সমৃদ্ধ হয়ে যেন ফেরে।’ শিলিগুড়ি থেকে এসেছে একটা ছেলে। বলছে, তার জীবনে আত্মবিশ্বাসের অভাব। সৌরভ তাকে বললেন, কীভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ নিজেকে বলতে হয়, আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে।
নিজের ক্রিকেট-জীবনে এই বিশ্বাসটার ওপর ভর করেই থামতে চাননি। একা-একা লড়াই চালিয়ে গেছেন। ইডেনে আন্ডার নাইন্টিন বাচ্চাদের সঙ্গে নেটে ব্যাট করেছেন, বল করেছেন। বাড়িতে একদিন বাবা চণ্ডী গাঙ্গুলি পর্যন্ত বলেছেন, ‘ক্রিকেট থেকে সব কিছু পেয়ে গেছিস তুই। ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হয়েছিস। দশ হাজার রান হয়ে গেছে। তারপরও এত অপমান মাথায় নিয়ে খেলে যাচ্ছিস কেন?’ সৌরভ কিছুদিন আগেই বলছিলেন উত্তরটা। ‘বাবার কথাটা ভাবিয়েছিল কিছুদিন। তারপর ভাবলাম, এখন আমার বয়েস ৩৫। ইচ্ছে করলে আরও দু’তিন বছর খেলতে পারব। টিমে ফেরার চেষ্টাও করতে পারব। কিন্তু আজ থেকে দশ বছর পর, বাড়ির সোফায় বসে টিভি দেখতে-দেখতে আফশোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। তখন মনে হতেই পারে, ইশ, আরেকটু চেষ্টা করলে তো পারতাম!’ এই চেষ্টার ফলটা আমরা দেখেছিলাম। কামব্যাকের পর ওয়ান ডে-তে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল তাঁর। বেঙ্গালুরু টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি। তাও তাঁকে বাদ যেতে হয়েছিল। প্রথমে ওয়ান ডে থেকে। তারপর টেস্ট দল থেকে। বলে দেওয়া হয়েছিল, এবার অবসর নিতে হবে। নিয়েছিলেন অবসর। মানসিক ভাবে খুব তৈরি ছিলেন না। ফিট ছিলেন, রান করছিলেন, তবুও যেভাবে সরিয়ে দেওয়া হইয়েছিল, সেটা মানতে পারেননি। নাগপুরে লাস্ট টেস্টে ঘরে গিয়ে দেখি, তখনও ব্যাট নিয়ে নানা খুঁতখুঁতানি চলছে। এটা ছিল তাঁর মজ্জাগত। আর সময় পেলেই ঘরে স্যাডো করতেন। জীবনের শেষ টেস্টের সময়ও তাই। ব্যাট বেছে নিচ্ছেন, আবার স্বগতোক্তির মতো বলছেন, ‘এসব আমার আর কী হবে!’ টেস্টের শেষদিন গোটা কিট্স ব্যাগটাই বিলিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সতীর্থদের মধ্যে। আর দাদার টিম ইন্ডিয়ার ওরা সবাই মিলে দাদাকে দিয়েছিল একটা জার্সি। সবার সই করা, তাতে শচীন লিখেছিলেন, ‘এ বাবা, কোথায় যাচ্ছ? আমি তোমায় খুব মিস করব বাডি।’ মিস করতেন নিজেও। এইভাবে সরিয়ে দেওয়াটা আর কে মানতে পারে!
বাড়িতে আমির খান এসেছেন। বসার ঘরে সৌরভের নানা মুহূর্তের ছবি দেখতে-দেখতে আমির প্রশ্ন করলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি ছাড়লে কেন?’ সৌরভ বললেন, ‘না, যে-পরিস্থিতির মধ্যে ক্রিকেট খেলছিলাম, সেটা খুব সম্মানের ছিল না। তোমার ব্যাটে রান না থাকলে তুমি রান করতে পারো। আরও পরিশ্রম করতে পারো, কিন্তু বাকিটা কী করে সামলাবে! আমি যখন রিটায়ারমেন্টের কথা অ্যানাউন্স করছি ড্রেসিংরুমে, শচীন আমায় বলেছিল, ‘ছাড়িস না।’ কিন্তু ওকে আমিই বললাম, ‘আমাকে কী অবস্থায় ক্রিকেট খেলতে হচ্ছে, তুই বুঝবি না!’’
অনেক কিছু মিস করেছেন সৌরভ। ২০০৮-এ যে-ফর্মে ছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, ২০১১-টাও হয়তো খেলে দিতেন। বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন ওয়াংখেড়ের ড্রেসিংরুমের উল্টোদিকে কমেন্ট্রিরুম থেকে বেরিয়ে আকাশে আতসবাজির প্রদর্শনী দেখছিলেন একা-একা। উল্লাসে ভেসে যাচ্ছে দল। গোটা দেশ। ওই আতসবাজির মতো সৌরভের মনও বোধহয় সেদিন পুড়ছিল। এই দলটা তো তাঁর নিজের হাতে তৈরি ছিল। এই মহেন্দ্র সিং ধোনিকে তো তিনি খুঁজে এনে তিন নম্বরে ব্যাট করিয়েছিলেন। ধোনি কিন্তু সামান্য কৃতজ্ঞতাও ফিরিয়ে দেননি। যেভাবে খারাপ সময়ে রাহুল দ্রাবিড় কিংবা কুম্বলেদের পাশে দাঁড়িয়ে গেছিলেন অধিনায়ক সৌরভ, সেভাবে কাউকে নিজের পাশে পাননি। কিন্তু নেতৃত্ব ওই পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষাটাই দেয়। আর আজও তাই দেশের সেরা কর্পোরেটগুলো ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির মোটিভেশনাল স্পিচ নিজেদের কর্মচারীদের শোনানোর জন্য কোটি-কোটি টাকা খরচ করে। লিডারশিপ কী, টিম বিল্ডিং কী, কামব্যাক কী— এদেশে তাঁর মতো ভাল আর কে বলতে পারবে! নিজের জীবন দিয়ে তাঁর মতো ভাল আর কে জানে, অধিনায়ক মানে আসলে কী!
তাঁর বায়োপিক করার জন্য দেশের প্রতিটা বড় প্রোডাকশন হাউস লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন শেষ অবধি, তারা প্রায় ৪০ কোটি টাকা তাঁর বায়োপিকের রাইটস নিতে খরচ করল। কারণ তারা জানে, এই ছবি শেষ করতে পারলেই জ্যাকপট মিলে যাবে। না, কোনও বর্তমান ক্রিকেটারেরও এই জনপ্রিয়তা নেই এই মুহূর্তে। সৌরভ গাঙ্গুলি মানেই একটা বিশ্বাসযোগ্যতা, একটা উত্তরণের চেষ্টা, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার তাগিদ; আর নিজের জীবন দিয়েই যেন প্রতিনিয়ত সেটা প্রমাণের চেষ্টাও করেন সৌরভ। সিএবি-র দায়িত্ব যখন নিয়েছিলেন, দেখতাম অনেক রাত অবধি ক্লাব হাউসে বসে বাংলা ক্রিকেটের কাজ করে যাচ্ছেন। যেসব ব্যক্তিগত, কর্পোরেট কমিটমেন্টগুলোতে তিনি নিজে জড়িয়ে ছিলেন, সেগুলোর ক্ষতি হলেও, নিজের দায়িত্ব থেকে কখনও নড়েননি। ওঁর সাফল্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বোধহয় ওটাই, যখন যেটা করেন, মনপ্রাণ ঢেলে দেন। ঠিক একই ছবি এখন দেখি, বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হয়েও। দিনের বেশিটাই কাটে বোর্ডের কাজে। দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, সেরাটা দিয়ে আসবেন; এমন কিছু করে যাবেন, যে-ট্রেন্ডটা সেট করে যাবেন, সেটা ছুঁতে তাঁর উত্তরসূরিদের বেশ কিছু টেস্টিং টাইম পার হতে হবে।
গোটা দেশ জুড়ে তাঁর কত সম্মান, কত ভালবাসা! সৌরভের সঙ্গে বহুবার সহযাত্রী হিসেবে ভারতে, বিদেশে সফর করেছি। হ্যাঁ, খেলা ছাড়ার পর ফ্রিকোয়েন্সিটা বরং বেড়েছে। দেখেছি, মানুষের আবেগ, ভালবাসা, তাঁর সঙ্গে একটা ছবির জন্য আকুতি দিনে-দিনে যেন বেড়ে চলেছে। এবং কাউকে ফেরান না তিনি। এয়ারপোর্টে প্রতি মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে সেলফির জন্য, কিন্তু এতটুকু বিরক্তি নেই চোখেমুখে। কলকাতায়, মুম্বইয়ে, দিল্লিতে, কোচিতে— সব জায়গায় একই ছবি। কোচিতে আইএসএল-এর ফাইনাল। স্টেডিয়ামের বাইরে দেখি, একদল ছেলে হাতে একটা বড় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে, সৌরভ গাঙ্গুলির জন্য অপেক্ষায়। এরা হল কোচির সৌরভ গাঙ্গুলি ফ্যান ক্লাব। দক্ষিণ ভারতে এরকম নানা শহরে সৌরভের নামে ফ্যান ক্লাব আছে। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোয় দেখবেন, লাখ-লাখ ফলোয়ার তাদের। এই মুহূর্তগুলো নিঃসন্দেহে গর্বিত করে। কিন্তু ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের বিসিসিআই হেড কোয়ার্টারে ওইদিনটা ওকে দেখে যেন মনে হচ্ছিল, কয়েক লক্ষ বার হোয়াইটওয়াশ করলেও এই স্মৃতিটা কোনওদিন মুছে যাবে না। প্রথম অধিনায়ক হবার ব্লেজারটা পড়েই বিসিসিআই অফিসে ঢুকলেন সৌরভ, প্রথমে দায়িত্ব বুঝে নিলেন, তারপর হাজির হলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। গোটা ভারতের মিডিয়া হাজির। গোটা দেশজুড়ে সরাসরি সম্প্রচার, আর আমাদের সৌরভ বললেন, ক্রিকেট আর ক্রিকেটাররা সবার আগে গুরুত্ব পাবে এই নতুন বিসিসিআই-এ।
ঠিক আগের দিনের বিকেল। হোটেলের স্যুটটার কাচের বিস্তৃত জানলাটা থেকে দেখা যাচ্ছিল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামটা। ঘরে বাল্যবন্ধু সঞ্জয় দাস। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ওয়াংখেড়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সৌরভ বললেন, ‘সঞ্জয় তোর মনে আছে, আন্ডার ফিফটিন খেলতে কীভাবে ভয়ে-ভয়ে ওয়াংখেড়েতে ঢুকেছিলাম আমরা!’ সৌরভের কথা শুনে সঞ্জয়ও যেন ৩০ বছর আগের কোন এক সকালে ফিরে গেছেন। কিট্স ব্যাগ কাঁধে দুই বাঙালি কিশোর দুরু দুরু বুকে ঢুকছেন দেশের ক্রিকেট রাজধানীর সেরা স্টেডিয়ামে। আর তাদের মধ্যেই একজন রাত পোহালেই এই শহরে, ওই স্টেডিয়ামে ভারতের ক্রিকেটের এক নম্বর জায়গাটা নিতে রওনা হয়ে যাবেন। কীরকম রূপকথার মতো শোনাচ্ছে, তাই না!
আমার মনে পড়ছিল, ২ এপ্রিল ২০১১-র সেই রাতটা। সেলিব্রেশনে ভেসে যাচ্ছেন ধোনি, বিরাট, যুবরাজ, শচীনরা। উল্টোদিকে একজন একা-একা জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখছিল ওই উচ্ছাস, ওই উৎসব। আর মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে দেখছিল আকাশ রঙিন করা আলোর ঝলকানি। সেদিন কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। একটা ছবি ওঠেনি তাঁর। একা-একা বেরিয়ে পড়েছিলেন মেরিন ড্রাইভের জনসমুদ্রের মাঝে। বিসিসিআই সভাপতি হবার দিন সকালে সেই মেরিন ড্রাইভ দিয়েই তাঁর গাড়ি ওয়াংখেড়ে এল। গাড়ি থেকে নামা থেকেই শুধু ফ্ল্যাশ-বালবের ঝলকানি। টিভির রিপোর্টারদের বাড়তি ব্যস্ততা। লাইভ টক। ইন্টারভিউ বুম বাড়িয়ে দেওয়া। কীভাবে সময় বদলে যায়, তাই না! আর কেউ-কেউ বোধহয় নিজের হাতেই সময়ের চাকাটা ঘুরিয়ে দিতে পারেন!
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন