ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • খুচরো খাবার: পর্ব ১০


    অর্ক দাশ (Arka Das) (July 9, 2022)
     

    ওয়াড়া-পাও

    ১৯৯৯ সাল। বাবা’র সঙ্গে মুম্বই হয়ে ট্রেনে পুণে যাওয়ার পথে, লোনাভলা-খান্ডালার মতো কোনও এক ছোট্ট পাহাড়ি স্টেশনে থেমেছে গাড়ি। মনে আছে, বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে, জলের তোড়ে প্রায় চোখের সামনে তৈরি হয়ে উঠছে পাহাড়ের গা বেয়ে নামা ছোট-ছোট ঝর্না, আর তা দেখতে-দেখতে ছিমছাম সুন্দর চেয়ার-কারে বসে চা আর গরম-গরম ওয়াড়া-পাও খাচ্ছি আমরা। 

    সহ্যাদ্রির সঙ্গে প্রথম পরিচয় অগাস্ট মাসের ঘোর বর্ষায়, দিগন্ত ভাসিয়ে দেওয়া এক বৃষ্টির বিকেলে। মার্চ থেকে জুন অবধি প্রচন্ড তাপে জ্বলে যাওয়া পশ্চিম ঘাটের শুখা প্রান্তরের পর প্রান্তরকে সবুজ জাদুর গালিচা পেতে নতুন করে সাজিয়ে তোলার জন্য দরকার পড়ে একটা টানা, লম্বা বর্ষাকাল, মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে সুন্দর ঋতু। পুণে ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে সেই অগাস্ট মাসেই প্রথম মহারাষ্ট্র পাড়ি, আর সেই প্রথমবার ওয়াড়া-পাও চেখে দেখা।

    বৃষ্টির সঙ্গে ভাজা খাবারের সোনায় সোহাগাটা পৃথিবী-জুড়ে সব সংস্কৃতির অঙ্গ। মারাঠি খাদ্যাভাসের সবকিছু মেনে নিতে না পারলেও, স্ট্রিট ফুডের সঙ্গে দোস্তি হয়ে যেতে আমাদের, খোদ বালিগঞ্জের ডানপিটে বাঙালিদের, বেশি সময় লাগেনি। এর প্রধান কারণ অবশ্য আমাদের হোস্টেল-বাস; প্রথমত সে-সময়ে পুণে ইউনিভার্সিটির কোনো হোস্টেলে ক্যান্টিন ছিল না, আর যেটা ছিল রেফেকটরি, সেখানে আমরা কস্মিনকালেও কেউ খেতে যেতুম না। হাতে যেহেতু টাকা-পয়সা প্রায় কখনোই থাকত না, তাই পাঁচ-দশ টাকার বাজেটে ওয়াড়া-পাও, সেঁকা ভুট্টা, কাচ্ছি দাবেলি বেশ চলত। 

    ওয়াড়া-পাও। এক নজরে, পাও রুটি আর আলুর চপ। সাধারণ ভুল। বাটাটা ওয়াড়া এবং বঙ্গদেশীয় আলুর চপ (যা এক প্রকার তেলেভাজা; কিন্তু বাটাটা ওয়াড়া তেলেভাজা নয়— পড়ুন খুচরো খাবার পর্ব ৩) ঘি আর মাখনের মতোই আলাদা, যদিও উভয় বস্তুই দুগ্ধজাত। দুটো জিনিসের আলু মাখা, সেই আলুতে কি-কি মশলা বা ইনগ্রেডিয়েন্ট পড়বে (বাটাটা ওয়াড়া-য় কাঁচালঙ্কা, মিহি কুচানো আদা, অল্প থেঁতো রসুন, কালো সর্ষে, একটু হলুদ, হালকা নারকোল আর ধনেপাতা, হিং, কারিপাতা; আলুর চপের মাখায় কুচানো পেঁয়াজ, লঙ্কাগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, গরম মশলা), এবং সর্বোপরি, যে বেসনে মাখিয়ে নিয়ে ভাজা হবে, তার পরত (coating) কতটা মোটা বা পাতলা হবে, তাতে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু ফুটন্ত তেল থেকে উঠে আসে।  

    পাও-টাকে মাঝামাঝি কেটে রাখা যে ওয়াড়া, তার সঙ্গে/উপরে দু-ধরণের চাটনি দেওয়া যেতে পারে, ড্রেসিং হিসাবে। ধনে-পুদিনাপাতা-কাঁচালঙ্কা-লেবুর চটপটা স্বাদের চাটনিতেই খেলা বাজিমাত্, কিন্তু ঠিক ওয়াড়াটার উপর ছড়ানো কোরা নারকোল-রসুনের মুম্বই-স্পেশাল ‘মিক্স’-টা, যাকে বলে, পুরো ব্যাপারটাকে ‘ওজী/তুরীয় লেভেল’-এ উত্তীর্ণ করে দেবে। খান-দুয়েক ভাজা, নুন-মাখানো কাঁচালঙ্কার সঙ্গে হাতে-হাতে, প্লেটে-প্লেটে পরিবেশন করা গরমা-গরম ওয়াড়া-পাও মহারাষ্ট্রের যে-কোনো শহর-গঞ্জ-গ্রাম-রেল স্টেশনে পাওয়া যায়। এবং এখন, পাওয়া যায় খোদ কলকাতায়। আর শুধু কলকাতা কেন, আদ্যোপান্ত মারাঠি স্ন্যাক হিসেবে ওয়াড়া-পাও-এর উত্থান এখন সম্পূর্ণ, এবং মহারাষ্ট্র ছাড়িয়ে শুধু সারা দেশ নয়, সুইডেন, জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতেও সে পৌঁছে গেছে ।

    পাও-টাকে মাঝামাঝি কেটে রাখা যে ওয়াড়া, তার সঙ্গে/উপরে দু-ধরণের চাটনি দেওয়া যেতে পারে, ড্রেসিং হিসাবে। ধনে-পুদিনাপাতা-কাঁচালঙ্কা-লেবুর চটপটা স্বাদের চাটনিতেই খেলা বাজিমাত্, কিন্তু ঠিক ওয়াড়াটার উপর ছড়ানো কোরা নারকোল-রসুনের মুম্বই-স্পেশাল ‘মিক্স’-টা, যাকে বলে, পুরো ব্যাপারটাকে ‘ওজী/তুরীয় লেভেল’-এ উত্তীর্ণ করে দেবে। খান-দুয়েক ভাজা, নুন-মাখানো কাঁচালঙ্কার সঙ্গে হাতে-হাতে, প্লেটে-প্লেটে পরিবেশন করা গরমা-গরম ওয়াড়া-পাও মহারাষ্ট্রের যে-কোনো শহর-গঞ্জ-গ্রাম-রেল স্টেশনে পাওয়া যায়। এবং এখন, পাওয়া যায় খোদ কলকাতায়



    কলকাতায় ওয়াড়া-পাও বিক্রি হতে দেখছি গত ৪-৫ বছরে। প্রথমবার দেখি সোজা-সাপ্টা খুচরো খাবার বেচে যে-সব দোকান – যেমন ‘গোলি ওয়াড়া-পাও’ বা ‘অন্নরস’— তাদেরই একটা ভিড়-উপচে পড়া স্টলে। বিশ্বাস হয়নি; লোহগড় দুর্গ, ভাজা কেভ্‌স, মালাভলি স্টেশন, আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন, দাদার স্টেশন, ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস, বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া রাতভর ট্রেকের শেষে পাহাড়ে সুর্যোদয়— এ-সব পেরিয়ে ওয়াড়া-পাও, ‘ওয়াড়াপ্পাও’, কলকাতায়, বালিগঞ্জে, ভবানীপুরে, আমার পাড়ায়? তারপর শুনলাম, শুধু বালিগঞ্জ কেন, সল্টলেক, তিলজলা, কলেজ স্ট্রিট, হাতিবাগান, কসবা, বড়বাজার – দেশজুড়ে ব্যবসা করার মডেলের সুবাদে ‘গোলি ওয়াড়া-পাও’ এ-শহরে গোটা দশেক স্টল খুলেছে, যার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। এ-রকম বেশ কিছু কাটতি-দারুণ দোকানে তো বটেই, এক পুজোয় দেখলাম এক নামী-দামী কাফের কাঁচের বেকারি ডিসপ্লেতে ওয়াড়া-পাও শোভা পাচ্ছে; এক জোড়ার দাম ২২৫ টাকা।    

    এ-ছাড়াও, একটা টিপিকাল কলকেতে আদিখ্যেতায় ওয়াড়া-পাওকে নিয়ে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করার ব্যাপার তো আছেই। চীজ, চাইনিজ, শ্যেজুয়ান, শ্যেজুয়ান চীজ (ভাবতেও পারছি না!)— ওয়াড়া-পাও-এর জনক মুম্বই-নিবাসী অশোক বৈদ্য, যিনি এই জিনিসের প্রথম স্টলটা খুলেছিলেন দাদার স্টেশনের বাইরে, কখনো ভাবতে পারতেন, তাঁর আবিষ্কার কোথায় পৌঁছে যেতে পারে? 

    বৈদ্য সাহেবের ওয়াড়া-পাও-এর প্রধান খদ্দের ছিলেন শহরতলীর টেক্সটাইল মিলগুলোতে খাটতে যাওয়া শ্রমিকের দল; পারেল আর ওরলিতে কাজ করে ঘরে ফেরার পথে যাঁরা খুবই অল্প পয়সায় চটজলদি এই খুচরো খাবারে পেট ভরিয়ে রাখতেন। ১৯৭০ এবং ৮০-র দশকের উত্তাল শ্রমিক-আন্দোলনের পটভূমিকায় যখন বম্বেতে একের পর এক মিলগুলো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, বহু মিল শ্রমিকেরা নিজের-নিজের ওয়াড়া-পাও বিক্রির ঠেলাগাড়ি নিয়ে পথে নেমে পড়েন, এবং বহু ক্ষেত্রে তাঁদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে থাকে বালাসাহেব থ্যাকারে এবং তাঁর রাজনৈতিক দল শিব সেনা একটি প্রত্যক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্য বিশেষজ্ঞ মেহের মির্জার কথায়, মুম্বই জুড়ে দক্ষিণী খাদ্যের ‘প্রতিবাদে’ ওয়াড়া-পাওকে ‘মারাঠি’ খাবার হিসাবে জনপ্রিয় করে তুলতে শিব সেনা’র এই অবস্থান অদ্ভুত, কিন্তু অনস্বীকার্য। ভেবে দেখুন তো, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে আমাদের তেলেভাজার ছোট্ট একফালি দোকানগুলো যদি রাজনৈতিক সচেতনতায় দীক্ষা ্নিয়ে ফেলত, ভর্জিতপ্রেমী জাতি হিসাবে বাঙালি আজ কোন উচ্চতার শিখরে… 

    ঠিক কোন সাল মনে পড়ছে না। রাত ৯টায় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা বাস, আর তারপর কিছুটা ট্রাকে হিচ হাইক করে যেখানে পৌঁছলাম, সেটা ঘন জঙ্গল। নির্ঘাৎ একগাদা ভয়ানক অ্যাগ্রেসিভ পিট ভাইপার সাপ আর লেপার্ডের ডিপো। কে কার কথা শোনে! হরিশ ভাই বললেন, “নাও, শুরু করো!” মানে, হাঁটো! এই আধা-সামরিক, আধ-পাগলা লোকটাকে নিয়ে মহা মুশকিল! যত্তসব অদ্ভুত ট্রেকে নিয়ে যাবে! কিছু দেখতেই পাচ্ছি না; দলে আছে ১২ জন, আর সাকুল্যে তিনটে টর্চ। যাই হোক, সেই জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে, গোটা রাস্তা পিছলে-সামলে-হুমড়ি খেয়ে এবং নির্ঘাৎ গোটা পাঁচেক সাপকে জড়িয়ে-থেঁতলিয়ে, এবং বেশ কিছু লেপার্ডের পিলে চমকে দিয়ে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গে যেখানে বেরোলাম, সেই জায়গাটা দেখে তো আমরা স্পিকটি-নট! একদিকে, ছোট্ট একটা পাহাড়ের চুড়োয় কোন্ডেশ্বর মন্দির। যে ক্লিয়ারিংটায় এসে বেরোলাম, সেখানে একটা অপূর্ব সুন্দর ঝর্না, যার উৎপত্তি হচ্ছে একটা উষ্ণ প্রস্রবন। কিন্তু থামা যাবে না— আমাদের গন্তব্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রাজমাছি দুর্গ। হট স্প্রিং-টিং ফেরার পথে। কিছুটা রাস্তা গাড়ি পেয়ে গেলেও, দুর্গে ওঠা-নামা ধরলে প্রায় ২০ কিমি হাঁটা পথ বাকি আছে। ওদিকে, সারা রাত জেগে, চলার ধকল, এবং বলা বাহুল্য, কিছুটা হ্যাংওভারে সবাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। কিন্তু, খিদেয় তো পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে! টুক-টুক করে হেঁটে মন্দির অবধি পৌঁছলাম, বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মন্দির-প্রাঙ্গণ ছেড়ে বেরিয়ে অন্য দিকের রাস্তা ধরব, এমন সময়ে দেখি, একটা ঠেলাগাড়ি। এই ঘোর জঙ্গলে? 

    কেস আর কি হতে পারে! মাথায় গান্ধী-টুপি, ফোকলা দাঁতের হাসির এক কাকা—বড় কালো কড়াইয়ে ভেজে চলেছেন, সম্ভবত আমাদের দেখেই ফুটন্ত তেলে ছাড়া বাটাটা ওয়াড়া… 

    সব কিছুরই একটা স্থান-কাল-পাত্র রয়েছে। সহ্যাদ্রির কোনো গভীর জঙ্গলের প্রত্যন্ত কোণে, পেশোয়া-তৈরি দুর্গের রাস্তায় অঝোর শ্রাবণের ভোরে দাঁড়িয়ে যে পাইপিং হট ওয়াড়া-পাও, তার স্বাদ কি ভবানীপুরে, ট্রাফিক সিগনালের আলোয় ভাসা মোড়ের দোকানে, বা ঝক্ঝ‌কে বালিগঞ্জী কাফেতে পাওয়া যায়, যেতে পারে, যাওয়া উচিৎ? সব কিছু মেনে নেওয়া যায় না…   

    ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook