ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দান্তের দুনিয়া


    সুকান্ত চৌধুরী (September 18, 2021)
     

    মধ্যযুগের ইউরোপে বানানো ভ্রমণকাহিনির প্রচলন ছিল। চতুর্দশ শতকে জন ম্যান্ডেভিল নামে এক কাল্পনিক ব্যক্তির ততোধিক কাল্পনিক পর্যটনের আষাঢ়ে গল্প প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছিল। মোটামুটি একই সময়ে ফ্রাঞ্চেস্কো পেত্রার্কা— যিনি রেনেসাঁসের যুগে প্রাচীন গ্রিক ও রোমক সভ্যতার নতুন চর্চার পথিকৃৎ, যাঁর প্রেমের কবিতা ইউরোপ তথা বিশ্বে প্রেমের সংজ্ঞাই পালটে দিয়েছে— মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টানদের তীর্থভূমিতে পাড়ির এক কাল্পনিক ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছিলেন: অবশ্য ধাপ্পা দিয়ে নয়, ‘যদি ওখানে যাও এই দেখতে পাবে’ এমন ঢঙে। (সফরটা তাঁর করার কথা ছিল কিন্তু করেননি।)

    তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তাঁর এক প্রজন্ম আগের মানুষ দান্তে আলিগিয়েরি, এ বছর ১৪ই সেপ্টেম্বর যাঁর ৭০০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর কাহিনি পরলোকের তিন ভুবন পরিক্রমার— পাতাল, স্বর্গ এবং দুটোর মাঝখানে যে ‘শুদ্ধিলোক’-এ রোমান ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করে। কৃত পাপের জন্য যারা মৃত্যুর আগে অনুতপ্ত হয়েছে কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের অবকাশ পায়নি, তারা শুদ্ধিলোক বা পুর্গাতোরিওতে সেই প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ করে তবে স্বর্গের পথে যাত্রা করে।

    এই অসম্ভব কাহিনির পিছনে আছে আর এক কাহিনি। তার মূলে এক নারী, নাম বেয়াত্রিচে পর্তিনারি। দান্তের মতো তাঁরও নিবাস ছিল ফিরেন্‌ৎসে বা ফ্লরেন্স শহরে। ভাবী কবি যখন প্রথম তাঁকে দেখেন, দান্তের বয়স নয়, বেয়াত্রিচের আট। দেখামাত্র বালক দান্তের বুক কেঁপে ওঠে, এক হতচকিত অভিভূত ভাবের উদয় হয়। বিশ বছর বয়সে দান্তে তা ব্যক্ত করছেন এই ভাষায়: ‘দেখতে পাচ্ছি আমার চেয়ে শক্তিমান এক দেবতাকে (অর্থাৎ কামদেব): সে আমার উপর রাজত্ব করবে।’

    নয় বছরের ছেলের এমন পাকা-পাকা চিন্তা? হয়তো দান্তে তাঁর যৌবনের অনুভূতি বাল্যকালের বিবরণে জুড়ে দিয়েছেন। যৌবনকালের পক্ষেও কিন্তু বেয়াত্রিচের প্রতি তাঁর অনুরাগ অভিনব ও বিচিত্র। সেটা অবশ্যই নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণবোধ; কিন্তু ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা যাই হোক, যে ব্যাপক বিবরণ দান্তে রেখে গেছেন তাতে যৌনতা দূরে থাক, প্রচলিত অর্থে প্রেমের প্রকাশও নেই। ‘সম্পর্ক’ কথাটাও খাটে না: দান্তের প্রতি বেয়াত্রিচের মনোভাব জানা নেই, সবটাই কবির একতরফা মনগড়া আদর্শায়িত কল্পনা। বেয়াত্রিচের সঙ্গে তাঁর কয়েকবার দেখা হয়, আড়ষ্টতার ফলে কথা প্রায় হয় না। পাতানো সম্বন্ধের সেই যুগে দান্তে বিয়ে করেন আর এক রমণীকে, বেয়াত্রিচে আর এক পুরুষকে: তাঁর প্রতি দান্তের অপার্থিব অনুরাগে দাম্পত্যের কোনও স্থান নেই। বিয়ের তিন বছর বাদে দান্তেকে বিধ্বস্ত করে বেয়াত্রিচের মৃত্যু হয়।

    ‘অ্যাগনেলো চেঞ্জিং ইনটু এ সারপেন্ট’, গুস্তাভ্‌ ড্যো, ১৮৫৭, এনগ্রেভিং
    সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্‌স

    দান্তের ঘরে তাঁর আসার প্রশ্ন ছিল না, কিন্তু মনে নিত্য আসা-যাওয়া চলল দান্তের জীবনভর, নানা অভাবিত রূপে। আশ্চর্য সমাপতনে, আধ শতক বাদে ইতালীয় সাহিত্যের অন্য আদি দিকপাল পেত্রার্কাও বিস্তারে লিখলেন তাঁর প্রেয়সী লাউরার জীবন ও মৃত্যুকাল ঘিরে তাঁর ভাবাবেগের কথা। সেই বিবরণের ঝোঁক অনেকটা দান্তের বিপ্রতীপ। দুই কবির মানসলোকের যুগ্ম বিস্তারে ইতালীয় সাহিত্য খুঁজে পেল ইহকাল-পরকাল, ব্যক্তি-সমাজ-বহির্জগৎ জুড়ে অবাধ বিচরণের ভূমি। রেনেসাঁসের প্রাক্কালে ইউরোপের মনের প্রসারের পাকা ব্যবস্থা করে গেলেন দুজনে, যদিও তারিখের বিচারে দান্তে রেনেসাঁসের কিছু আগের মানুষ। একদিকে তিনি মধ্যযুগের মানসপুত্র, অপর দিকে সেই যুগ থেকে উত্তরণের দিশারি।

    কামদেব সন্বন্ধে লাইনটা ‘নতুন জীবন’ (‘লা ভিতা নোভা’) নামে দান্তের প্রথম গ্রন্থ থেকে। তাতে আছে প্রথম দর্শন থেকে বেয়াত্রিচের মৃত্যু ও তারপর কিছুকাল কবির মানসজীবনের বৃত্তান্ত, খানিক কাব্যে খানিক গদ্যে। তার পর থেকে দান্তের প্রায় সব লেখাতেই কোনও না কোনও ভাবে বেয়াত্রিচে উপস্থিত: নিছক ভালবাসার হারানো ধন হিসাবে কিন্তু কখনওই নয়, গম্ভীর তত্ত্বদীপ্ত রূপে। একদিকে তিনি কবির কাব্যদেবী বা মিউজ; আরও ব্যাপক ভাবে তাঁর সব চিন্তা, আদর্শ এমনকী ধর্মবোধের চালক, যেন এক শাশ্বত অভিভাবক। এই ভূমিকায় তাঁকে দেখা যায় দান্তের প্রধান রচনা ‘দিব্যমিলন’ বা ‘লা দিভিনা কম্মেদিয়া’তে, যা অনেকের মতে ইউরোপের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। বেয়াত্রিচের এই ভূমিকাই সেই বিশাল কাব্যকে বেঁধে রেখেছে, তাৎপর্য দান করছে।

    ‘দান্তে অ্যান্ড বেয়াত্রিচে’, হেনরি হলিডে, তেলরং, ১৮৮৩
    সৌজন্য: ওয়াকার আর্ট গ্যালারি, লিভারপুল

    কাহিনিটা এরকম: তাঁর অবর্তমানে দান্তে বিপথে যাচ্ছেন দেখে বেয়াত্রিচে স্বর্গসুখের মধ্যেও বিচলিত হন। মাতা মারিয়ার কাছে মিনতি করেন এক অভূতপূর্ব বরের: মারিয়ার সন্তান ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিস্ট (আদতে যিনি ঈশ্বরের তিন অভিব্যক্তির একটি) যেন দান্তেকে জীবদ্দশায় সশরীরে পরলোক পরিক্রমার সুযোগ দেন। নরক-শুদ্ধিলোক-স্বর্গের বিস্তার দেখে দান্তে সম্যক বুঝবেন, ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ন্যায়নীতি ধর্মশক্তির কী অমোঘ বিন্যাস, ঈশ্বরের কোন বিধানে পাপপুণ্যের নির্ধারণ হয়। ফলে দান্তে একাই কেবল সঠিক পথে ফিরবেন না, তাঁর কাব্যের প্রভাবে সব মানুষই জানবে, শিখবে, শোধরাবে।

    কাব্যটির তিন ভাগ— নরক, শুদ্ধিলোক ও স্বর্গ। সমাপ্তি স্বর্গে পৌঁছে, ঈশ্বরের মঙ্গলময় বিধানের বাণী বহন করে, তাই এই কাব্য মিলনাত্মক, ‘কম্মেদিয়া’ (কমেডি)। ‘দিভিনা’ (ডিভাইন, স্বর্গীয়) শব্দটি দান্তে নিজে শিরোনামে রাখেননি; ওটা পরবর্তীকালে মুগ্ধ পাঠককুলের যোগ— কিছুটা বিষয়বস্তুর জন্য, কিছুটা কাব্যগুণের স্বীকৃতিতে।

    কাব্যটির তিন ভাগ— নরক, শুদ্ধিলোক ও স্বর্গ। সমাপ্তি স্বর্গে পৌঁছে, ঈশ্বরের মঙ্গলময় বিধানের বাণী বহন করে, তাই এই কাব্য মিলনাত্মক, ‘কম্মেদিয়া’ (কমেডি)। ‘দিভিনা’ (ডিভাইন, স্বর্গীয়) শব্দটি দান্তে নিজে শিরোনামে রাখেননি; ওটা পরবর্তীকালে মুগ্ধ পাঠককুলের যোগ— কিছুটা বিষয়বস্তুর জন্য, কিছুটা কাব্যগুণের স্বীকৃতিতে।

    শুরুতেই কিন্তু হোঁচট খেতে হয়। বেয়াত্রিচে পুরো আখ্যানের চালিকাশক্তি; কিন্তু তাঁকে প্রথম দেখা যায় ১০০ সর্গের কাব্যের ৬৪তম সর্গে। ততক্ষণে দান্তে পুরো নরক মায় শুদ্ধিলোক অতিক্রম করে, শুদ্ধিপর্বতের চূড়ায় নন্দনকাননের কাছে পৌঁছে গেছেন। সেখান থেকে বেয়াত্রিচেই তাঁকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। এতক্ষণ তাঁর দিশারি ছিলেন প্রাচীন রোমার অগ্রগণ্য কবি ভার্জিল।

    ‘দ্য ইন্সক্রিপশন ওভার দ্য গেট’, উইলিয়াম ব্লেক, ১৮২৪-৭
    সৌজন্য: টেট গ্যালারি, লন্ডন; উইকিমিডিয়া কমন্‌স
    ‘ম্যাপ অফ হেল’, সান্দ্রো বত্তিচেল্লি, ১৪৮৫
    সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্‌স

    ‘কম্মেদিয়া’য় এই মহান কবি এক অর্থে নরকের বাসিন্দা। তিনি মারা যান খ্রিস্টপূর্ব ১৯ সালে। খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুসারে মানুষ আদি পাপ থেকে মুক্তি পায় যিশুর ক্রুশে আত্মাহুতির ফলে, এবং দীক্ষাস্নানের দ্বারা সেই পরিত্রাণের অংশীদার হয়ে। অতএব যারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়নি (হয়তো যিশুর আগে বেঁচে ছিল বলেই), তারা যতই পুণ্যবান হোক, স্বর্গের দ্বার তাদের কাছে রুদ্ধ। (এই বিধানের হাতে-গোনা ব্যতিক্রম আছে।) অ-খ্রিস্টান পাপী নরকে যেতে পারে, কিন্তু অ-খ্রিস্টান পুণ্যাত্মা স্বর্গে যেতে পারে না। তারা যায় নরকে ঢোকার পথে ‘মহৎ বিধর্মীদের’একটি বিশেষ মণ্ডলে: সেখানে নরকযন্ত্রণা নেই, আছে স্বর্গসুখের অভাবে একটা অপূর্ণতাবোধ। হোমার প্রমুখ সব প্রাচীন কবিদের সঙ্গে ভার্জিলের সেখানে বাস। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি নরক কেন, শুদ্ধিলোকও পার হতে পারেন, কিন্তু স্বর্গে তাঁর প্রবেশ নাস্তি।

    শুধু এই একটা তত্ত্বে নয়, ‘কম্মেদিয়া’র মূলে আছে হাজার বছরের ইতিহাসসিদ্ধ প্রচলন ও পূর্ব সংস্কার। কাহিনির পটভূমি একদম খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের আদলে গড়া, বিশেষ করে তম্মাস্‌সো দাকুইনো বা টমাস আকোয়াইনাসের যে স্কলাস্টিক শাস্ত্র তৎকালীন রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান তাত্ত্বিক অবলম্বন ছিল। এর বিধানে শৈথিল্যের অবকাশ নেই: এর ভিত্তি তরল বিশ্বাস নয়, কঠোর যুক্তি। দান্তের নরকে তাই দেখা যাবে তাঁর বিশেষ সম্ভ্রম, প্রীতি বা মমতার পাত্র: শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ব্রুনেত্তো লাতিনি, বন্ধুর বাবা কাভালকান্তে দেই কাভালকান্তি, প্রেমার্দ্র রমণী ফ্রাঞ্চেস্কা, অভিলাষদৃপ্ত বীর ইউলিসিস। পাপ গণ্য করে শাস্তিদান করা হচ্ছে সমকামিতা ও আত্মহননকে। (এগুলিকে অবশ্য উদার দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়েছে নেহাতই হাল আমলে।)

    বত্তিচেল্লির ড্রয়িং অনুসরণে ব্যাক্কিও বলডিনির এনগ্রেভিং, ১৪৮১
    সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্‌স

    প্রশ্ন উঠতেই পারে, সাতশো বছর আগে যে অনুদার বিধান মানুষের অস্তিত্বকে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, আজ তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব কেন? একটা উত্তর, নিছক বৌদ্ধিক বিচারে এ এক অসামান্য সৃষ্টি। ইউরোপের মধ্যযুগ যে ‘অন্ধকার যুগ’ ছিল না, ঐতিহাসিকেরা অন্তত দুশো বছর ধরে বলে আসছেন। বহুল বিচিত্র উপকরণ একত্র করে একটা সংহত রূপ দিতে তো যুগটার রীতিমতো প্রতিভা ছিল। তার নিদর্শন যেমন বাস্তুবিজ্ঞানের অমর কীর্তি গথিক কাথিড্রাল, তেমনি স্কলাস্টিক দর্শনের সূক্ষ্ম অনুপুঙ্খ বিশ্বব্যাখ্যান। সেই দর্শন সহায় ছিল বলেই দান্তে গড়তে পেরেছিলেন তাঁর ত্রিলোক-ত্রিকালব্যাপী কল্পনার জগৎ। তত্ত্বকথা এখানে শিল্পের শত্রু নয়, দোসর। নইলে সৃষ্টিকাল থেকে কয়েক সহস্রাব্দের ইতিহাস-পুরাণ-সমাজ-সাহিত্য একটাই কাব্যের আওতায় নিয়ে আসা কি সহজ কথা? আর কোনও কবি পেরেছেন?

    আরও বড় কারণ, দান্তে এই সার্বিকতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। যা সার্বিক, তা কি ছাড়ানো-ছাপানো যায়? তার বাইরে কিছু আছে? এই অসম্ভবকে দান্তে সম্ভব করেছেন। ধর্মতত্ত্বের কাঠামো তাঁর কাব্যকে বাঁধুনি দিয়েছে কিন্তু বাঁধতে পারেনি। দান্তের বিশ্বদর্শনে সেটা শেষ কথা নয়, গোড়ার কথা। ঈশ্বরের বিধানের গর্ভগৃহে স্থান পাচ্ছে মানুষের নিজস্ব অস্মিতা, ব্যক্তির একান্ত আত্মপ্রকাশ। উপরের উদাহরণগুলি তারই সাক্ষ্য। কবির গুরু ব্রুনেত্তো লাতিনি অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে তপ্ত বালির উপর ছুটে শাস্তিভোগ করছেন; কিন্তু তাঁর ক্লিষ্ট উলঙ্গ মূর্তি দূরে মিলিয়ে গেল যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতায় ‘পরাজিত নয়, জয়ী দৌড়বীরের মতো’।

    এই ভাবটার জোরালো প্রকাশ প্রাচীন গ্রিক রাজপুরুষ ইউলিসিসের শেষ অভিযানের কাহিনিতে। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তাঁর ছোট্ট নিস্তরঙ্গ রাজ্যে হাঁপিয়ে উঠছেন, সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন শেষ নৌযাত্রায়, দুর্বিপাকে ধ্বংসও হচ্ছেন। নরকে তাঁর স্থান কুমন্ত্রণাদাতা হিসাবে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এক দুরন্ত কৌতূহলী উদ্যমের প্রতিভূ: ‘জগৎকে জানার, মানুষের গুণাগুণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে কোনও কিছুই দমিয়ে রাখতে পারল না।’ দান্তের এই কাহিনি নিয়েই পাঁচশো বছর বাদে টেনিসন তাঁর ‘ইউলিসিস’ কবিতা লিখেছিলেন। ইউলিসিসের এই অভিব্যক্তি তাঁর নরকভোগের অমোঘ বিচারকে খণ্ডন করছে না, কিন্তু তাতে একটা নতুন বিপ্রতীপ মাত্রা যোগ করছে। মানুষ থাকে মানুষের মতো, ঈশ্বর বা প্রকৃতির বিধানের সঙ্গে তার আত্মপ্রকাশের সংঘাত ঘটে। ফলে নীতিধর্মের বিচারে সে নিন্দিত হয়, দণ্ডিত হয়, প্রকৃতির প্রকোপে ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তার মনুষ্যত্বের স্বাক্ষর মুছে যায় না।

    ‘ইউলিসিস’, উইলিয়াম ব্লেক, ১৮২৪-৭, পেন অ্যান্ড ইঙ্ক এবং পেন্সিলের উপর ওয়াটারকালার
    সৌজন্য: টেট গ্যালারি, লন্ডন; উইকিমিডিয়া কমন্‌স

    দান্তে কেন রেনেসাঁসের নতুন মানবিক বিকাশের দিশারি, হয়তো খানিক বোঝা যাচ্ছে। তাঁর মানবিকতার বিস্তার নিহিত আছে তাঁর নরকের বিন্যাসে। অনেকে বলেন, ধর্মতত্ত্বের বিচারে যাই হোক, কাহিনির আকর্ষণ আর কাব্যগুণে নরকের ভাগটাই ‘কম্মেদিয়া’র শ্রেষ্ঠ অংশ, ওটাই দান্তে সবচেয়ে দরদ দিয়ে লিখেছেন। কথাটা ঠিক নয়, যদিও দান্তের ‘স্বর্গীয়’ রস এতই অনভ্যস্ত আর দুর্জ্ঞেয় যে, এমনটা মনে হতে পারে। টি.এস. এলিয়ট বলেছেন, আধুনিক জীবনে (নাকি যে কোনও কালেই?) আমরা যাকে ‘সুখ’ বলি, তা দান্তের নরকের বরং কাছাকাছি, তাঁর স্বর্গ ঢের বেশি দূরে। তবে এটা ঠিক, তাঁর নরকে বৈচিত্র্য বেশি। স্বর্গের পুণ্যাত্মারা স্বর্গসুখ উপভোগ করে নানা অভিব্যক্তিতে কিন্তু একই মাত্রায়, একই মানসিক অবস্থান থেকে। শুদ্ধিলোকের আত্মারাও বিভিন্ন পাপের জন্য বিভিন্ন প্রায়শ্চিত্ত করছে, কিন্তু এক আশায় এক চিত্তে। নরকের পাপীদের যন্ত্রণা কিন্তু ভীষণভাবে ভিন্ন ভিন্ন, তার নানা শ্রেণিভাগ।

    ‘জিরিয়ন, প্রতারণার প্রতীক’; গুস্তাভ্‌ ড্যো, ১৮৫৭, এনগ্রেভিং

    এই শ্রেণিভাগের সূত্রটা ভাবার মতো। পাতি নীতিবাগিশদের সবচেয়ে বড় চক্ষুশূল দৈহিক আসক্তি, বিশেষ করে যৌনতা। দান্তের কাছে এগুলো কিন্তু তুলনায় লঘু অপরাধ। নরকে ঢুকে প্রথমেই দেখা মেলে অবৈধ বা অনৈতিক প্রেমিকদের। এদের শাস্তি আর কিছু নয়, হাতে হাত ধরে চিরকাল অন্ধকারে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো। (এটাও কিন্তু নরকযন্ত্রণা, তরুণ পাঠকেরা খেয়াল রাখবেন।) তারপর পাতালে যত নীচে নামা যায়, আরও গুরুতর পাপের উত্তরোত্তর বীভৎস শাস্তি: প্রথমে আসক্তির আতিশয্য, তারপর আসক্তির বিকৃতি; তারও নীচে যে পাপগুলি কেবল আসক্তি থেকে নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে সম্পন্ন হয়। আসক্তি-প্রবৃত্তি পশুদেরও আছে, বুদ্ধি আছে কেবল মানুষের। মানুষকে সেটাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান, অতএব তার অপব্যবহারও সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ। ‘পাশবিক’ স্খলন তুলনায় লঘু।

    নরকের একেবারে গভীরে তাই শাস্তিভোগ করছে কামুক, পেটুক বা মারকুটেরা নয়। সেখানে আছে চোর, ঘুষখোর, প্রতারক; কুমন্ত্রণা দেয়, বিরোধ-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, জনগণের সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বা সরকারি চাকরি বিক্রি করে এমন পাপিষ্ঠের দল। যারা হিংসায় মাতে, তাদের চেয়ে ঘোর অপরাধী যারা হিংসায় উস্কানি দেয়। শাস্তিগুলোও সাংঘাতিক: কেউ ফুটন্ত আলকাতরায় হাবুডুবু খাচ্ছে, কেউ বিষ্ঠার মধ্যে; কাউকে তলোয়ারে কেটে ফের জোড়া দেওয়া হচ্ছে; কাউকে সাপ-গোসাপে গিলছে আর উগরোচ্ছে, মানুষের আকার বদলে হচ্ছে জঘন্য সরীসৃপ। সবচেয়ে নীচের চক্র আগুন নয়, বরফের। হিমজমাট জলাশয়ে নিমজ্জিত সবচেয়ে ঘৃণ্য পাপীরা: তারা বিশ্বাসঘাতকের দল।

    ইউরোপের মধ্যযুগ যে ‘অন্ধকার যুগ’ ছিল না, ঐতিহাসিকেরা অন্তত দুশো বছর ধরে বলে আসছেন। বহুল বিচিত্র উপকরণ একত্র করে একটা সংহত রূপ দিতে তো যুগটার রীতিমতো প্রতিভা ছিল। তার নিদর্শন যেমন বাস্তুবিজ্ঞানের অমর কীর্তি গথিক কাথিড্রাল, তেমনি স্কলাস্টিক দর্শনের সূক্ষ্ম অনুপুঙ্খ বিশ্বব্যাখ্যান। সেই দর্শন সহায় ছিল বলেই দান্তে গড়তে পেরেছিলেন তাঁর ত্রিলোক-ত্রিকালব্যাপী কল্পনার জগৎ। তত্ত্বকথা এখানে শিল্পের শত্রু নয়, দোসর। নইলে সৃষ্টিকাল থেকে কয়েক সহস্রাব্দের ইতিহাস-পুরাণ-সমাজ-সাহিত্য একটাই কাব্যের আওতায় নিয়ে আসা কি সহজ কথা? আর কোনও কবি পেরেছেন?

    এই বিবরণ থেকে স্পষ্ট, ‘কম্মেদিয়া’য় পরলোকের দর্পণে প্রতিফলিত হচ্ছে ইহলোকের জীবন: দুটো আলাদা করা অসম্ভব। মাঝেমধ্যে পাঠকের ধন্দ হতে পারে, এর বিষয়বস্তু কি ধর্মতত্ত্ব না রাজনীতি? ফিরেন্‌ৎসেতে থাকাকালীন দান্তে চুটিয়ে রাজনীতি করেছেন, অংশ নিয়েছেন নগর প্রশাসনে। রোমক সাম্রাজ্যের পতনের পর ইতালি আবার সংহত রাষ্ট্র হয় উনিশ শতকে। ততদিন তা বিভক্ত ছিল ছোট ছোট, প্রায়ই বিবাদমান রাজ্যে। ধর্মগুরু পোপেরও রাজ্যপাট ছিল, সেখানে তিনি রীতিমতো ঐহিক শাসক। ইউরোপের বলশালী রাজশক্তিগুলির কাছে ইতালি ছিল যুদ্ধ আর কূটনীতির লীলাক্ষেত্র। সেই টানা-পড়েনে ছত্রিশ বছর বয়সে দান্তে ফিরেন্‌ৎসে থেকে নির্বাসিত হয়ে আর কোনওদিন ফেরেননি: দিন কাটিয়েছেন বিভিন্ন রাজপুরুষের আশ্রয়ে, লেখালেখি শিক্ষকতা আর দলিল মুসাবিদার উপার্জনে। ‘কম্মেদিয়া’র চিন্তা হয়তো আগেই মাথায় খেলছিল, কিন্তু সবটাই সম্ভবত রচনা হয়েছে নির্বাসনকালে।

    ‘কম্মেদিয়া’ জুড়ে তাই ইতালি তথা ইউরোপের রাজনীতি নিয়ে দান্তের সখেদ আলোচনা: বেশিরভাগটা নিজের উক্তি হিসাবে নয়, বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে। যাত্রার পদে পদে কোনও ইতালিবাসীর আত্মা দেশের দুরবস্থা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে বা হতাশায় ভেঙে পড়ছে; জানতে চাইছে কেবল আত্মীয়-পরিজন সম্বন্ধে নয়, দেশের সাধারণ অবস্থার কথা। নরক বা শুদ্ধিলোক কোন ছার, স্বর্গবাসী আত্মারাও জাগতিক সমস্যায় বিচলিত। সেখানে ফিরেন্‌ৎসের বিপর্যয়ের কথা বলেন দান্তের অতিবৃদ্ধ পিতামহ কাচ্চাগুইদা। সন্ন্যাসীদের দুই বৃহৎ সংঘ দোমিনিকপন্থী ও ফ্রান্সিসপন্থীদের আদি সভ্যেরা বিলাপ করেন সংঘগুলির অধঃপাতের। চার্চের দুরবস্থায় আক্ষেপ করেন স্বয়ং সন্ত পিতর, প্রথম পোপ অর্থাৎ মর্ত্যে যিশুর আদি প্রতিনিধি। স্বর্গসুখ হয়তো  কিছুতেই ক্ষুণ্ণ হবার নয়; কিন্তু মর্ত্যের এই বিকারগুলি বক্তাদের চিন্তা ভারাক্রান্ত করে। ভুললে চলবে না, বেয়াত্রিচেও মারিয়ার শরণাপন্ন হয়েছিলেন মর্ত্যবাসী অনুগামীর দুরবস্থা দেখে, তার পরিত্রাণের আশায়। দান্তের স্বর্গ কখনওই মর্ত্য থেকে, মানবজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

    এই সূত্রেই চলে আসি আমার শেষ বক্তব্যে। দান্তের ভাষা আশ্চর্য সরল, মাটির খুব কাছাকাছি। তাঁর একটা ক্লান্তিকর অভ্যাস, স্থান-কাল বোঝাতে তিনি সেকেলে ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যার প্যাঁচালো হেঁয়ালির শরণ নেন। এ ছাড়া কিন্তু তাঁর ভাষায় কোনও জটিলতা নেই, নেই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনার খেলা, যেমন পাই শেক্সপিয়রের বয়ানে। দান্তের ভাষা বোঝা সহজ, অর্থ বোঝা যদিও মাঝে মাঝে ভীষণ কঠিন।

    শুদ্ধিপর্বতের গা ধরে দুই দল আত্মা বিপরীত মুখে যেতে যেতে থেমে দুটো কথা বলছে— দান্তের উপমায়, দুই সারি পিঁপড়ে যেমন যেতে-যেতে শুঁড় ঠেকিয়ে সাক্ষাৎ করে। স্বর্গের আত্মারা তাঁকে দেখে এগিয়ে আসে, পুকুরে খাবার ছড়ালে মাছেরা যেমন জড়ো হয়। গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যানের মাঝখানেও এমন উপমা: ঈশ্বরের সদ্যসৃষ্ট আত্মা যেন ছোট্ট শিশু— হাসছে, কাঁদছে, খেলছে, যা দেখে তাই ধরতে যাচ্ছে, ঠেকিয়ে-ভুলিয়ে সামলাতে হচ্ছে তাকে।

    এমন বর্ণনা এক-আধটা নয়, ‘কম্মেদিয়া’ জুড়ে। না-দেখা, প্রায় অনুমানের অতীত পরলোকের দৃশ্যপট তাঁর কল্পনায় ফুটে ওঠে বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে, নানা চেনা খুঁটিনাটির মধ্যেও অপার্থিব আবহ ষোলো আনা বজায় রেখে। স্বর্গভ্রমণের শেষে কবি ঈশ্বরের পাদদেশে দাঁড়িয়ে অবাধ দিব্যলোক প্রত্যক্ষ করছেন: স্বর্গের বিস্তার তাঁর সামনে খুলে যাচ্ছে পাপড়ি-মেলা গোলাপের মতো, আলোকময় চক্রের মতো। সেই ব্রহ্মাণ্ডদর্শনও তিনি বোঝাচ্ছেন সহজ ঘরোয়া তুলনায়: ‘বিশ্বের বইটার যত ছড়ানো পাতা, সবগুলি যেন একত্রে বাঁধিয়ে আমার সামনে ধরা হল।’

    জানি না, এটা লেখার সময় কবি নিজের বইয়ের কথা ভাবছিলেন কি না। আমাদের অন্তত ভাবতে বাধা নেই। সাতশো বছর আগের এই দুঃসাহসিক কাব্য সম্বন্ধে কথাটা বলাই যায়।

    ‘দিব্যমিলন’-এর মূল ইতালীয় থেকে একটি নতুন বাংলা অনুবাদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা থেকে বার হচ্ছে। অনুবাদক আলপনা ঘোষ, সম্পাদক সুকান্ত চৌধুরী। ‘নরক’ প্রকাশ হয়েছে, ‘শুদ্ধিলোক’ প্রস্তুত হচ্ছে।

    কভারের ছবি: ‘লা দিভিনা কম্মেদিয়া দি দান্তে’; দমেনিকো দি মিচেলিনো, ১৪৬৫

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook