৩ জুন, সারা বিশ্বে, বিশ্ব সাইকেল দিবস পালন করা হয়। প্রশ্ন উঠবে, হঠাৎ এই বছর এত ঘটা করে এটা জানানোর বা উদযাপনের কী প্রয়োজন ছিল? প্রয়োজন আছে। আসলে আমাদের জীবনটা গত দু-বছরে এমন বদলে গেছে যে, নিকট-অতীতের সঙ্গেই আমাদের বর্তমানের বিরাট পার্থক্য ঘটে গেছে। সে-পার্থক্য কেন ঘটেছে আমরা জানি। তার পোশাকি নাম, অতিমারী এবং ভয়াল নাম করোনা ভাইরাস।
এই করোনার আক্রমণে, আমরা যা যা চাইতাম না বা করতাম না, সেসব দায়ে পড়েই করেছে। সেই দায় থেকে অনেক ক্ষেত্রে ভালবাসা জন্মেছে, অনেক ক্ষেত্রে অভ্যেস তৈরি হয়েছে আবার অনেক ক্ষেত্রে লাভদায়ক হয়েছে। যেমন, সাইকেলের ব্যবহার। আগেও বহু মানুষ সাইকেল চালাতেন। বাহন হিসেবে সাইকেল শহরের চেয়ে ছোট শহর, মফস্বল এবং গ্রামের দিকে এর কদর চিরদিনই। কিন্তু শহুরে মানুষের জীবনে খুব প্রকট ভাবে সাইকেলের ব্যবহার ঢুকেছে এই হালফিলে, করোনার দাপটেও অনেকটা বলা যায়।
সাইকেল এখন ফিটনেসের প্রকরণ, কম খরচার বাহন, সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার, ভিড় থেকে দূরে থাকার অন্যতম উপায় এবং দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী একটি যান। এবং অবশ্যই এসবের পরিবর্তে সাইকেল চালক পাচ্ছেন তরতাজা মন ও শরীর এবং সচেতন নাগরিকের তকমা।
এই বছর বিশ্ব সাইকেল দিবসে ডাকবাংলা-র পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছিলাম জ্যোতিষ্ক বিশ্বাসের সঙ্গে, যিনি তাঁর প্রথম সাইকেল অভিযান করেছেন হিমালয়ের পশ্চিম থেকে পূর্বে, যাকে সাইকেল অভিযাত্রীদের ভাষায় বলা হয় ট্রান্স-হিমালয়ান ট্রেক। জ্যোতিষ্ক ২০০ দিনে ৮০০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এই অভিযান শেষ করেছেন। এবং এমন এমন জায়গায় সাইকেল নিয়ে পৌঁছেছেন যেখানে বাঙালি হিসাবে তিনিই প্রথম। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানালেন ডাকবাংলা-র পাঠকদের কাছে।
সাইকেল চালানোটাকেই আপনি বেছে নিলেন কেন?
আমার বেড়ানোর খুব শখ। আর যেসব জায়গায় লোকজন বেড়াতে যায়, তার চেয়ে আমার ভাললাগে সেই সব জায়গায় যেতে, যেখানে লোকজন কম যায় বা যায়ই না। কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার খরচ অনেক। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। যখন কলেজে পড়ি, তখন সেই খরচ জোগানোর ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার নেশাটা আমায় পেয়ে বসেছিল। তখন ভাবলাম, আমার সাইকেলটা তো আছে। আমি খড়দহে থাকতাম। রোজ পাঁচ-পাঁচ দশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করতাম। আর সাইকেল চালানোর অভ্যেসটা যেহেতু ছোটবেলা থেকেই ছিল, তাই আমার এই বাহনটার ওপর খুব ভরসা ছিল। তাই সাইকেল।
প্রথম সাইকেল চালানোর স্মৃতি…
ছোটবেলায় উত্তরবঙ্গে বড় হয়েছি। ওখানে সবাই যেমন মাঠে সাইকেল চালানো শেখে, তেমনই আমিও ছোটবেলায় শিখেছি, স্কুলে গিয়েছি। অরুণাচল প্রদেশে যখন থাকতাম, তখনও সাইকেল চালাতাম। খুব আলাদা করে যে সাইকেল চালানোর প্রতি মনোযোগ দিয়ে খুব সচেতনভাবে এই দিকটা বেছে নিয়েছি এমনটা নয়।
প্রথমেই আপনি ট্রান্স-হিমালয়, এই দীর্ঘ পথটা বেছে নিলেন কেন?
যখন ঠিক করি সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাব, তখন সাইক্লিং রুটগুলো নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করি। এই রুটটার খোঁজ পাওয়ার পর থেকে কেমন একটা নেশা ধরে যায়। মনে মনে স্থির করে ফেলি যে, এই রুটটাই সাইকেল চালিয়ে অতিক্রম করব। যাযাবরের মতো আবিষ্কার করব হিমালয়কে। এই রুটটা কিন্তু অনেকে পায়ে হেঁটেও অতিক্রম করেছে। কিন্তু আমার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু প্রথমেই এত বড় একটা রুটে সাইকেল চালানোর আগে তো একটু অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, একটু অভ্যেসের প্রয়োজন। তাই ঠিক করি যে প্রথমে কলকাতা থেকে মেঘালয় অবধি সাইকেল চালিয়ে যাব। গিয়েওছিলাম ১,০০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মেঘালয়ের মওলিংনঙ-এর কাছে রিওয়াই বলে একটা গ্রামে।
এর পর শুরু হয় হিমালয়ের পথে দীর্ঘ যাত্রা। এই সাইকেল অভিযানে আমায় যে তিনজন অসম্ভব সাহায্য করেছেন তাঁদের কথা না বললেই নয়— চন্দন বিশ্বাস, যিনি আমায় সাইকেল দিয়ে এবং সাইকেল অভিযানের সব খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন; (পর্বতারোহী) সত্যরূপ সিদ্ধান্ত, তিনি আমায় বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছেন আর আমার বাবা, যিনি কেবল টাকা-পয়সা দিয়ে নয়, সমানে উৎসাহ জুগিয়েছেন। শুরু হয় আমার করিমপুর থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লির দিকে যাত্রা। সেখানে থেকে জম্মু হয়ে গুলমার্গ। গুলমার্গ থেকে সোনমার্গ হয়ে জোজিলা পাস পার করে দ্রাস-এ পৌঁছই। কারগিল থেকে লে যাওয়ার সময় দুটো পাস পার করি, জাঁসকর পর্বতশ্রেণির নামিকা লা আর ফোটু লা। এই দুটো পাসে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া দেয়। লেহ-তে আমি কিছুদিন বিশ্রাম নিই। অবশ্য তার আগে আমি যাই সিয়াচেনের থাং গ্রামে। বাঙালি হিসেবে আমিই প্রথম যে থাং গ্রামে গিয়েছি।
লে-তে থাকার সময় আমার আলাপ হয় ব্রাজিলিয়ান ট্রেকার মিলানি ভিনের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে আমি জীবনে প্রথম ট্রেকিং করি। আমরা গিয়েছিলাম স্টক-কাংরি ট্রেকিং-এ।
তার পর আবার শুরু হয় সাইকেল-যাত্রা। এই সময় স্পিতি থেকে হিকিম, কাজা হয়ে মানালি পৌঁছই। এই সময় আমার সমস্ত টাকা-পয়সা শেষ হয়ে যায় আর আমার শরীরও প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। তখন আমি মানালির একটা হোটেলে বেশ কয়েকদিন হাউসকিপিং-এর কাজ করি। কিছু টাকা-পয়সা হাতে আসায় আবার শুরু করি সাইকেলযাত্রা। এর পর তো বিরাট রুট পেরিয়ে অরুণাচলের পাসিঘাটে পৌঁছে সাইকেল-অভিযান শেষ করি। ২০০ দিন ধরে ৮০০০ কিলোমিটার পথ পার করাটা খুব সহজ কাজ ছিল না।
এই পুরো পথটার কোন সময়টা আপনার কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছিল?
সত্যি কথা বলতে কী, প্রতিটি দিনই খুব কঠিন লাগত। যখন রাতে শুতে যেতাম, তখন ভাবতাম পরের দিন বোধহয় আর পারব না। সকালে যখন শুরু করতাম তখন মনে হত শরীর আর চলছে না। কিন্তু তখন ভাবতাম, যে উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি, সেই উদ্দেশ্যটাকে তো মিথ্যে হতে দেওয়া যায় না। আমি তো তাহলে যে-জীবনটার কথা ভেবেছি, সেটা চেখে দেখা হবে না, সেটার স্বাদ আমি পাব না। সবাই যেমন জীবন বাঁচে তেমনই একটা জীবন বেঁচে যেতে হবে এবং তাতে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে। আমি সেটা পারব না। সেটা ভেবেই আমি নিজেকে রোজ মোটিভেট করতাম।
এই যে দীর্ঘ পথ আপনি পেরোলেন, এত ছোট-বড় জনপদ অতিক্রম করলেন, সেখানে কোনও রকম সচেতনতা তৈরি করতে পারলেন, যেটা আপনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল?
তখন খুব একটা সুযোগ হয়নি, কিন্তু ফিরে এসে আমি আবার মেঘালয়ের রিওয়াই জায়গাটায় যাই। সেই জায়গাটা খুব নোংরামতো ছিল যখন আমি প্রথম গিয়েছিলাম ওখানে। আর প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহার ছিল। আমি আমার কিছু বন্ধু ও এখানকার স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে একত্রে মিলে জায়গাটাকে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিই। এখান থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য আবর্জনা বিক্রি করে আমরা ৭০,০০০ টাকা পাই করি এবং সেটা ওই গ্রামের উন্নতির কাজে লাগাই। এখনও এই গ্রামটার উন্নতির জন্য আমি কাজ করে চলেছি।
এখন তো অনেকেই নানান দামি সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন অভিযানে যাচ্ছেন। আপনি কী ধরনের সাইকেল ব্যবহার করেছিলেন?
আমি স্কট-৭৫০ সাইকেল ব্যবহার করেছিলাম। যে-সাইকেলটা একটি গিয়ারড্ সাইকেল, দামি সাইকেল এবং এই সাইকেলটার জন্য আমার অভিযান অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবাই তো এই সাইকেল ব্যবহার করতে পারবেন না বা তাঁদের এই সাইকেল কেনার ক্ষমতাও নেই। এই কথাটা মাথায় আসতেই, আমার মনে হয় রোজ রাস্তায় সাধারণ মানুষ যে সাধারণ সাইকেল চালায়, আমি সেই সাইকেলে যদি অভিযান সম্পূর্ণ করতে পারি, তবেই আমি সফল হব। তাই ঠিক করি আমার পরবর্তী অভিযান কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর আমি এই সাধারণ সাইকেলে ভ্রমণ করব। এই অভিযানের জন্য মেঘালয়ের এই গ্রামের মানুষরা আমায় শুভেচ্ছাস্বরূপ গৌহাটি থেকে ব্যাঙ্গালোরের প্লেনের টিকিট উপহার দিয়েছিলেন। এই রকম সব মানুষ ও তাঁদের ব্যবহারের জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
পশ্চিমবঙ্গে সাইকেল নিয়ে সচেতনতা কতটা?
পশ্চিমবঙ্গ আরও অনেক কিছুতে পিছিয়ে থাকলেও, এ ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে আগে থেকেই বহু মানুষ রোজকার জীবনে সাইকেল ব্যবহার করতেন আর এখন করোনার পরে তো আরও অনেক বেশি সচেতনতা এবং উদ্যোগ তৈরি হয়েছে। আর সরকার থেকে সাইকেল বিতরণ করার ফলে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত জায়গার মানুষরাও সংযোগের সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দিনযাপনের মান অনেকটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন। অন্তত স্কুল তো যেতে পারছে একটা ছেলে বা মেয়ে। এটাই অনেক।
সাইকেল চালানোর ইচ্ছে যদি কারো না থাকে, তা হলে তাঁকে এই দিকে উদ্বুদ্ধ কী করে করা যাবে?
প্রথমেই বলি, সাইকেল চালানোর জন্য কারোর ওপর নির্ভর করতে হয় না, এমনকী টাকা-পয়সার ওপরেও না। এ ছাড়া আপনি পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করছেন। আপনার শরীর ফিট থাকছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সাইকেল চালালে আপনার শরীর ও আত্মা, একসঙ্গে, একভাবে চালিত হয়। এতে কেবল শরীরের সক্ষমতা বাড়ে না, মনের সক্ষমতা বাড়ে, মন ভাল থাকে। তবে ভারতের বড় শহরগুলো এখনও সাইকেল চালানোর জন্য তেমন উপযোগী হয়ে ওঠেনি, কিন্তু বিশ্ব-উষ্ণায়নের কথা মাথায় রেখে এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার বলে আমার মনে হয়।