প্রথম বিলেত: পর্ব ২
ভয়াল মাঝির নৌকায়
বিলেত যাবার পথে এডেন থেকে সুয়েজ অবধি যেতে পাঁচদিন লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের। তিন বাঙালি আর এক ইংরেজ মিলে একটা আরব নৌকা ভাড়া নিলেন। তার মাঝির মুখটা যেন অনেকটা পশুর মতো। তার চোখ দুটো যেন বাঘের মতো, গায়ের রং কুচকুচে কালো, নীচু কপাল, মোটা ঠোঁট— সব মিলিয়ে ভয়ানক একটা মুখ। অন্য নৌকার ভাড়া ছিল বেশি। তাই কম ভাড়ায় এই নৌকা বাছা। রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রীদের ভিতর জনৈক ব-মশাই আরবদের নৌকায় যেতে বেশ ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আরব মাঝিরা অনায়াসে গলায় ছুরি বসাতে পারে। সুয়েজের দু’একটা ভয়ানক গল্পও শুনিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক করে তুললেন তিনি। যাইহোক, আরব নৌকায় সকলেই উঠলেন। কিছু দূর গিয়ে ইংরেজ সহযাত্রীটি কিছু কাজে সুয়েজের পোস্ট আপিসে নামবার প্রস্তাব দিলেন। অল্প ইংরেজি বলা সেই ভয়ানক চেহারার মাঝি প্রথমে কিছুটা আপত্তি করে এক সময়ে যেই বলেছে, ‘পোস্ট-অফিসে যেতে হবে কি? সে দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া অসম্ভব’, অমনি রুক্ষ স্বভাবের ইংরেজ যাত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘your grandmother.’। মাঝিও রুখে উঠলেন, ‘What? mother? mother? what mother? don’t say mother.’ সবাই যখন ভাবছেন মাঝি এবার নিশ্চয়ই সাহেবকে জলে ফেলে দেবেন, তখন তিনি আবার বললেন, ‘What did say?’ সাহেব আবার বললেন, ‘your grandmother!’ এইবার মাঝি মহা তেড়ে উঠলেন। ব্যাপার ভালো নয় বুঝে সুর নরম করে সাহেব বললেন, ‘You don’t seem to understand what I say!’ এমন একটা ভাব যেন grandmother যে কোনও গালি নয় তাই বোঝাবার একটা চেষ্টা। এইবার রীতিমতো একটা ধমক দিলেন মাঝি। সাহেব থতমত হয়ে চুপ করে গেলেন। কিন্তু তাঁকেই বা থামায় কে! কিছু দূর গিয়েই আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কতদূর বাকি আছে?’ নৌকার ভাড়া দুই শিলিং। রেগে আগুন মাঝি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘Two shilling give, ask what distance!’ নৌকার অন্য দাঁড়িরা হাসছেন, আর কিছুটা যেন বাধ্য হয়ে রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর সহযাত্রীরাও প্রতিহিংসায় একটা নকল হাসি হাসছেন। ঘোর বিবাদের মধ্যেও নৌকা সুয়েজে গিয়ে ভিড়ল। মাত্র আধ মাইল ঘুরেই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমার চক্ষে সুয়েজ শহরের নূতনত্ব এইটুকু লাগল যে, এর চেয়ে খারাপ শহর আমি আর দেখি নি।’
শ্যামাসঙ্গিনীকে দেখে নেচে উঠল বুক
বিলেতে মাঝেমধ্যে নাচের পার্টিতে যাবার আমন্ত্রণ পেতেন রবীন্দ্রনাথ। নির্দিষ্ট পোশাক পরে যেতে হত। পাছে যে-মহিলাদের হাতে হাত দিয়ে নাচতে হবে তাঁদের হাত ময়লা হয়ে না যায়, তাই সাদা দস্তানা পরে যাবার চল ছিল। ‘সত্যি কথা বলতে কী’ এইসব নাচের নেমন্ততন্নগুলো রবীন্দ্রনাথের খুব একটা ভাল লাগত না, বিশেষ করে অচেনা মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে নাচতে। কিছু নাচ শিখেছিলেন, কিন্তু অচেনা কারও সঙ্গে জানা নাচও যেন তিনি নাচতে গেলে হতভম্ব হয়ে যান। ‘প্রতিপদে ভুল হয়, লোকের গাউন মাড়িয়ে দিই, বেতালে পা ফেলি, কখনো বা অসাবধানে আমার সহনর্তকীর পাও মাড়িয়ে দিই— আর এইরকম নানাপ্রকার গলদ করে অবশেষে নাচের মাঝখানে থেমে পড়ি ও আমার সহচরীর কাছ থেকে মার্জনা ভিক্ষা করে সে দিক থেকে আসতে আসতে পিট্টান দিই।’ তাও, যাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল, তাদের সঙ্গে নাচতে তাঁর মন্দ লাগত না। যেমন এক মহিলার সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল, তাঁকে দেখতেও ছিল বেশ ভাল। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ gallop নেচেছিলেন। আর এক অপরিচিতার সঙ্গে নেচেছিলেন lancers। খিটমিটে স্বভাবের সেই মহিলাকে, ‘অতি বিশ্রী দেখতে— তাঁর চোখ দুটো বের-করা, তাঁর গাল দুটো মোটা।’ তাঁর সঙ্গে নাচতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে হচ্ছিল, ‘তিনি বোধ হয় নাচবার সময় মনে মনে আমার মরণ কামনা করেছিলেন।’ নাচ ফুরোলে যেন দুজনেই নিস্তার পেলেন। একবার রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দরী এক পার্টনার পেয়ে গেলেন। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন মেয়েটার সঙ্গে না নাচতে কিন্তু গৃহকর্ত্রীর পীড়াপীড়িতে কোনওমতে তার সঙ্গে নাচ শেষ করেই ছুটে পালিয়েছিলেন। বোধ হয় লজ্জা পেয়েছিলেন। আর একবার এক নাচের ঘরে শত-শত শ্বেতাঙ্গিনীর ভিতর রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ চোখ আটকে গেল শ্যামলা এক মেয়ের অস্তিত্বে। তিনি ভাবলেন মেয়েটা নিশ্চয়ই এক ‘ভারতবর্ষীয় শ্যামাসঙ্গিনী’। লিখলেন, সেই মেয়েটাকে ‘দেখেই তো আমার বুকটা একেবারে নেচে উঠেছিল। আমার তাকে এমন ভালো লাগল যে কী বলব! তার সঙ্গে কোনো মতে আলাপ করবার জন্যে আমি তো ছট্ফট্ করে বেড়াতে লাগলেম্। কতদিন মনে করো কালো মুখ দেখিনি!’ মেয়েটার মুখে যেন বাঙালি মেয়ের ভালমানুষি মাখানো, তার চুল বাঁধাও যেন ভারতবর্ষের মেয়েদের মতোই। শেতাঙ্গিনীদের সভায় সেই ‘কালো মিষ্টি মুখ’ যেন রবীন্দ্রনাথকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন এই মেয়ের রূপে একেবারে বিভোর, তখন জানা গেল সে এক ফিরিঙ্গি মেয়ে। শুনেই রবীন্দ্রনাথের মনটা একেবারে বিগড়ে গেল, তার সঙ্গে আর আলাপই হল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কিন্তু কালো মুখের ছাপ আমার মনে রয়ে গেল।’
স্নান যেন এক বিভীষিকা
ওদেশের প্রায় সকলের মতো গরম জলে নয়, বিলেতে রবীন্দ্রনাথ ভোরে উঠে বরফের মত ঠান্ডা জল মাথায় ঢেলে স্নান করতেন। সেবারই বিলেতে আসার পথে প্যারিসে পৌঁছেই সহযাত্রীদের সঙ্গে এক ‘টার্কিশ বাথ’-এ এক সঙ্গীর সঙ্গে স্নান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সঙ্গী যে কে, তা জানা যায় না। সে ছিল এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা! শুরুতেই বেজায় গরম একটা ঘরে তাঁদের বসানো হল। কিন্তু দীর্ঘ সময় সেখানে বসেও তাঁর ঘাম আর ঝরে না দেখে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল আগুনের মতো গরম আর এক ঘরে। সেখানে আবার চোখ খুলে রাখলে চোখ জ্বলে যায়। কয়েক মিনিটের বেশি সেখানে থাকতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ঘাম ঝরল। সেখান থেকে আর এক জায়গায় তাঁকে শুইয়ে ভীমকায় এক লোক প্রাধ আধঘণ্টা তাঁর শরীর দলন করে যেন তাঁর জন্মলগ্ন থেকে জমা ধুলোবালি শরীর থেকে উধাও করে দিল। সেই অতিকায় মানুষটার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তার সর্বাঙ্গ খোলা, এমন মাংসপেশল চমৎকার শরীর আমি আর কখনো দেখিনি।’ এক প্রকাণ্ড কামান যেন ছোট্ট এক মশাকে দলন করছে! রবীন্দ্রনাথকে লোকটা বলল, তাঁর শরীর যেহেতু লম্বা, পাশের দিকে বেড়ে উঠলে তিনি একজন সুপুরুষ হিসেবে গণ্য হবেন। শরীর আগাগোড়া মর্দন করার পর আর একটা ঘরে ভালো করে সাবান আর স্পঞ্জ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সারা গা পরিষ্কার করা হল। সেখানে একটা পিচকিরি দিয়ে গায়ে গরম জল ঢালতে-ঢালতে হঠাৎ বরফের মতো ঠান্ডা জল বর্ষিত হল। এইভাবে কখনও গরম কখনও ঠান্ডা জলে স্নান করতে করতে রবীন্দ্রনাথ একটা জলযন্ত্রের ভিতরে গেলেন। সেখানে ক্রমাগত উপর, নীচ আর চারপাশ থেকে বানের মতো জল ছুটে এসে গায়ে বিঁধে যায়। বরফের মতো ঠান্ডা জলে যেন বুকের রক্ত জমে গেল রবীন্দ্রনাথের। হাঁপাতে-হাঁপাতে বেরিয়ে এলে পুকুরের মতো একটা জায়গায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এসে তিনি সাঁতার দিতে রাজি কি না জিজ্ঞেস করা হল। রবীন্দ্রনাথ আর সাঁতারে আগ্রহী হলেন না, তাঁর সঙ্গী যদিও পুকুরে নামলেন। তাঁর সাঁতার কাটার বহর দেখে স্নানঘরের কর্মীরা বলছিল, ‘দেখো দেখো এরা কী অদ্ভুত রকম করে সাঁতার দেয়, ঠিক কুকুরের মতো।’ তারপর স্নান শেষ হল। বিচিত্র এই স্নান সেরে রবীন্দ্রনাথের মনে হল, ‘… টার্কিশ বাথে স্নান করা আর শরীরটাকে ধোপার বাড়ি দেওয়া এক কথা।’
কভারের ছবি: ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথ
ছবি সৌজন্যে: লেখক