নাম ছাঁটাই
ইউক্রেন জুড়ে এখন সমস্ত রাস্তার নাম থেকে বিখ্যাত রুশদের ছেঁটে ফেলা হচ্ছে, রাশিয়ান রাজা বা রানির নাম তো ঘুচিয়ে দেওয়া হবেই, লিও তলস্তয়ও কাঁচি-গ্রাস থেকে বাদ যাবেন না। আবার যে সাবওয়ে-স্টপের নাম ছিল অমুক দেশের তমুক শহরের নামে, সেই দেশ যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে বলে, ওখানে বসবে বন্ধুদেশের শহরের নাম। রাশিয়ার ‘সাংস্কৃতিক উপনিবেশ’ ইউক্রেনে গড়ে ওঠার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও মুছে ফেলতে এ প্রকল্প। ঠিকই, যে দেশ আক্রমণ করে শহরের পর শহর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, যে দেশের সৈন্যরা সাধারণ নাগরিকদের গুলি করে মারছে লুঠপাট চালাচ্ছে, সে দেশের বিরুদ্ধে ভয়ানক রাগ জন্মানোই স্বাভাবিক, এবং নিজদেশ থেকে সেই নিষ্ঠুর মারকুটেদের তাবৎ চিহ্ন মুছে দেওয়ার চেষ্টায় দেশপ্রেমই প্রকাশ পায়। কিন্তু যে প্রতিক্রিয়াগুলো চট করে গজিয়ে ওঠে, তাকে একটু সন্দেহের চোখে দেখে, দুবার পরীক্ষা করা ভাল।
এমনিতে রাস্তার/ দোকানের/ বাড়ির নাম সেই নামগুলোর পূর্ণ ব্যঞ্জনা নিয়ে আমাদের কাছে মোটে উপস্থিত হয় না, ‘রবীন্দ্রনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ থেকে দানাদার কেনার সময় আমরা বিশ্বকবির সাহিত্যসুধা সম্বন্ধে একটা কথাও ভাবি না, ‘উত্তমকুমার স্টেশনের সামনে দাঁড়াবি’ বললে আমাদের মাথায় নায়কের হাস্যমুখের বদলে স্টেশন বা সামনের রাস্তার ছবিই ভেসে ওঠে। মানুষের ক্ষেত্রেও, একটু পরিচয়ের পরে নামের শব্দটা শুধুই সেই ব্যক্তির দ্যোতক হয়ে যায়। একটা লোকের নাম যদি হয় ‘জীবনানন্দ’, আর সে যদি সারাক্ষণ পাঁশুটে গোমড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাহলে তার নামের অর্থটার বদলে, তার মুখের পার্মানেন্ট বিমর্ষ ছবিটাই আমাদের কাছে ‘জীবনানন্দ’ শব্দের দোসর। তাই রাস্তার নাম নিয়ে হইহই করার কিছু নেই। ১০০ বছর ধরে যা ‘তৈমুর লং সরণি’, তা পাল্টে ‘দাতা হরিশ্চন্দ্র স্ট্রিট’ করে দিলে বাসে টিকিট কাটতে এবং ঠিকানা বলতে এত অসুবিধে হবে যে, এতদ্দ্বারা হত্যার বদলে দানের গুণগান করা হল কি না সে কথা বিরক্ত ব্যক্তির মাথায় থাকবে না। অধিকাংশ সময়ে তাই এই চেষ্টাগুলোকে অবান্তর ভাবাই ভাল। কিন্তু ইউক্রেনীয় প্রয়াসটাকে গা-জোয়ারি বা আকাশ-থেকে-পেড়ে-আনা বলা শক্ত, কারণ যুদ্ধ এমন প্রত্যক্ষ ক্ষতি করে এবং স্পষ্ট ঘৃণা জাগায়, আক্রমণকারীকে কোনওভাবে প্রত্যাঘাত করার প্রকল্পকেই অসঙ্গত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই সদ্য-স্বাধীন দেশে চেষ্টা হয় আগের শাসকদের নাম ঘুচিয়ে, স্বাধীনতা-সংগ্রামী বা গুণী দেশিদের নাম বহাল করার। এখন একটা যুদ্ধ-ধ্বস্ত দেশ যদি বলে, রাশিয়ানদের কাছে মিসাইলে হারতে পারি কিন্তু আমাদের সাইনবোর্ড থেকে ওদের গুষ্টি সাফ করে ছাড়ব, সেই ক্রোধ ও আক্রোশ স্বতঃস্ফূর্ত এবং বোধগম্য।
মুশকিলটা হল, দেশপ্রেম, বা সেই জাতীয় যে কোনও ঝাঁঝালো একবগ্গা ঝোঁক, একটা সরলীকরণের ঝ্যাঁটা আছড়ায়। বহু ধরনের, বিচিত্র রঙের ব্যাপারকে একই জাঁতায় পিষতে থাকে। বুঝতে হবে, রাশিয়ার এক রানির নাম আর তলস্তয়ের নাম— একই গুরুত্বের নয়। রানি হয়তো রাজ্যবিস্তার করেছিলেন পুকুর কেটেছিলেন এবং শহরটারই পত্তন করেছিলেন, আর সাহিত্যিক দেশটার সরাসরি উপকার মোটে করেননি, কিন্তু এমন দর্শন ও অন্তর্দৃষ্টি জোগান দিয়ে গেছেন, যা যুগ যুগ ধরে চেতনার স্রোত বদলে দিতে পারে, চিন্তার নয়া কক্ষপথ তৈরি করতে পারে। (গান্ধীজির মতো রাজনীতিক হলে আলাদা, যিনি জন্ম দিয়েছেন এক সম্পূর্ণ নতুন ভাবনার, নতুন প্রতিবাদ-ধরনের, তাই তাঁর নামে পৃথিবীর এত দেশের এত রাস্তা। সেই দর্শন ভারতের স্বাধীনতা-আদায়ের পরিসর ছাড়িয়ে মানবতার দিকে চলে গেছে বলেই, ভারতের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকলেই গান্ধীর নামটার ওপর কালি বুলিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না)। অধিকাংশ বড় শিল্পীই যা বলেন, তা একটা নির্দিষ্ট ভাষায় বলেন ও তাঁর লেখা (বা ছবি বা গান) কিছু নির্দিষ্ট দেশ ও কালের চিহ্ন বহন করে বলেই তা সেই গন্ডিতে আটকে থাকে না, কারণ শিল্পে নিহিত ধারণা সমগ্র পৃথিবীর যে কোনও মানুষকে আচ্ছন্ন ও উত্তীর্ণ করতে পারে। তলস্তয় তাই রাশিয়ার লেখক নন, উনি একজন অসামান্য লেখক যিনি রাশিয়ায় জন্মেছিলেন। বিশ্বের বিপুল সাহিত্যের (বা ভাবনা-পসরার) সঙ্গে যখন কোনও ইউক্রেনীয় পাঠক পরিচিত হতে চাইবেন, তিনি কি চেকভ দস্তয়েভস্কিকে বাদ দিয়ে সেই কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন? পুশকিন গোর্কিকে রাশিয়ান বলে দূরে ঠেলে রাখবেন? আইজেনস্টাইনের সিনেমা-পাঠ আর তারকভস্কির সিনেমা-শিল্পের স্বাদ নেবেন না? স্তানিস্লাভকির অভিনয়-ম্যানুয়াল বাদ দিয়ে যাবেন? ভাইসকল, স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। রাজাকে অপছন্দ করলেও বিদ্বানকে একটা দেশের পরিচয়ে আবদ্ধ রেখে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। প্রতিটি শিল্পী বিশ্বনাগরিক, এবং প্রতিটি শিল্পের উত্তরাধিকার বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের যে কোনও শিল্প-পিপাসু মানুষের। ‘বাঙালি হয়েছিস আর রবীন্দ্রনাথ পড়লি না?’ আর্তনাদটা তাই একটু গাঁইয়া, সাম্প্রদায়িকও বটে, কারণ আসল প্রশ্ন হবে: ‘সাহিত্য ভালবাসিস আর রবীন্দ্রনাথ পড়লি না?’ যা একই তীব্রতায় তক্ষুনিই বলবে, ‘সাহিত্য ভালবাসিস আর জেমস জয়েস পড়লি না?’ কারণ শিল্পীর জাত নেই, তিনি সত্যকুলজাত। শিল্পভোক্তার গ্রহণ-স্থলেও দেশাভিমান বা যে কোনও ছোঁয়াছুঁয়ি-বিচার রাখলে, নিজেরই জ্ঞানের পরিধিকে সীমাবদ্ধ, সঞ্চয়ের ভাঁড়ারকে দরিদ্র করে দেওয়া হয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধনষ্ট অবস্থায় ইউক্রেনের রাজধানী কিভ-এ নাটকের হল খুলে দেওয়া হয়েছে এবং তিনটে নাটকের টিকিটই সমস্ত বিক্রি হয়ে গেছে। অর্থাৎ যুদ্ধের মতো সাংঘাতিক মরণবিস্তারী কাণ্ড চললেও লোকে শিল্পকে এড়িয়ে যেতে পারছে না। সেই শিল্পের যাঁরা শ্রেষ্ঠ কারিগর, তাঁদের স্মরণ করা মানে একজন অমুক দেশের নাগরিককে স্মরণ করা নয়, একজন চিন্তানির্মাতাকে স্মরণ করা, দর্শন-গঠককে শ্রদ্ধা জানানো, প্রশ্ন-স্রষ্টাকে মর্যাদা দেওয়া। যে দেশেই জন্মাও আর যে দেশেই থাকো, তোমার আদত সঙ্গী তো মাথার ভেতর নিরন্তর বহমান ভাবনাস্রোত। তাকে যে লোকগুলো সার্থক ভাবে উসকে দিল, তাদের ত্যাগ করলে তোমার অস্তিত্বের ভরসা-খুঁটি ফসকে যেতে পারে।
তবে এও ঠিক, রাস্তার নাম বদলালেই তো আর বই ব্যান করা হয় না। যদি তলস্তয়ের নাম রাস্তা থেকে মুছে ফেলা হয়, আর লাইব্রেরিতে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ থাকে, যদি ‘দস্তয়েভস্কি লেন’ বদলে ‘স্কি লেন’ করা হয় (বেশি শ্রম হবে না), আর বইয়ের দোকানে ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ জ্বলজ্বল করে, তাহলে অসুবিধে নেই। কিন্তু যদি এই জঙ্গি সংস্কারকদের দৃষ্টি সেখানেও গিয়ে পড়ে, আর ধমক মারা হয় ‘কে মায়াকভস্কি? ওসব হাটাও।’ ‘ওখানে দেখছি কানদিনস্কির ছবি? নামিয়ে দাও, এমনিতেই অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের মাথামুন্ডু নেই!’, তাহলে সাড়ে-সর্বনাশ। এবং তা হওয়া খুব সম্ভব, কারণ ‘ওদের চিন্তাভাবনা যাতে আমাদের গিলে না ফ্যালে তার বন্দোবস্ত করব’-ই তো এই পথনাম-পরিবর্তনের রোলার চালানোর থিম। [জটিলতাও আছে, মায়াকভস্কি জন্মেছিলেন জর্জিয়ায়, আইজেনস্টাইন লাটভিয়ায়, সেগুলো এখন স্বাধীন দেশ, তাই এঁদের রাশিয়ান শিল্পী ভাবা হবে, না এই দেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের কূটনৈতিক সম্পর্কের নিরিখে গ্রহণ/বর্জন করা হবে, তা ঠিক করার জন্য কমিটি গঠন প্রয়োজন]। দেশপ্রেমের (বা পার্টিপ্রেমের বা আদর্শপ্রেমের) উগ্রতা মানুষের বহু সর্বনাশ করতে পারে, তার সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হল আত্মধ্বংসী চেতনা-কর্তন। নিজের মগজ কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করতে গেলে, তা শেষ অবধি নিজেকে চিবিয়ে খাবে, কারণ কল্পনা বিচার যুক্তির মেশিন যদি বিগড়ে যায়, তবে নিজেকে ও নিজের দেশকে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সব দেশে আমার চিন্তার ঘর আছে, আমি সেই ঘর লব খুঁজিয়া, এই সুবর্ণ সুযোগ এবং প্রশস্ত বহুবর্ণ মেলা ছেড়ে কেউ যদি ‘অ্যাট লিস্ট ওই দেশে আমার ভাবনার আশ্রয় খোঁজা চলবে না বাপু’ বলে গোঁজ হয়ে বসে থাকে, তাহলে সে বিশ্বনিখিলের পরিবর্তে নিজেকে মাত্তর দু’বিঘা লিখে দিল। তা নিজের ঘাড়ে মিসাইল ফেলারই শামিল।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী