প্রায় ৪০০ বছর আগে, সংস্কৃত ভাষায় একটি শাক্ত গ্রন্থ রচিত হয়েছিল এবং তা সম্ভবত তৎকালীন বঙ্গদেশেই রচিত হয়েছিল। একে বলা হত ‘রাধাতন্ত্র’। এটি লেখা হয়েছিল চৈতন্য-বৈষ্ণব আন্দোলনের (যেখানে কৃষ্ণ হলেন পরম দৈব সত্তা এবং রাধা হলেন অধস্তন) ক্রমবর্ধমান জোয়ারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে।
দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকে, ধীরে ধীরে আমরা রাধা চরিত্রের উত্থান লক্ষ করতে পারি, যিনি কৃষ্ণের চারপাশে নৃত্যকারী গোপিনীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। এবং এই চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এর রচনার অবদান অনস্বীকার্য, যার রূপ আমরা দেখতে পাই পুরী মন্দিরের চারপাশে। ‘গীতগোবিন্দ’ কৃষ্ণের ভক্তিতে একটি তান্ত্রিক স্বাদ নিয়ে আসে। সেই সময়ে ইরোটিকা বা শৃঙ্গার শিল্পের অন্তর্ভুক্তি, সন্ন্যাসী বৈদান্তিক ঐতিহ্যের সরাসরি বিপরীত ছিল যা হিন্দুধর্মে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
‘রাধাতন্ত্র’, কয়েক শতাব্দী পরে রচিত, এই সন্ন্যাস-বিরোধী স্বাদের বিস্তারিত বর্ণনা করে। এখানে বর্ণিত আছে কীভাবে বিষ্ণু একদিন শিবের কাছে আসে এবং একটি মহামন্ত্রের সন্ধান করে। বিষ্ণু সেই মহামন্ত্র পেয়ে কাশীতে জপ করতে শুরু করেন, কিন্তু কাজ হয় না। তাই, তিনি কৈলাসে ফিরে যান। শিব অনুপস্থিত থাকায় এই সময় দেবীই তাঁর সামনে আবির্ভূত হন। তিনি ত্রিপুরা সুন্দরী বা মহামায়া হিসাবে আবির্ভূত হন, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুর্গার সংমিশ্রণ, সম্পদ, জ্ঞান এবং শক্তির দেবী। তিনি বিষ্ণুকে বলেন যে, মন্ত্র ব্যবহার করা যথেষ্ট নয় কারণ এটি শুধুমাত্র মনের উপর কাজ করে। তাকেও কৌলা অনুশীলন করতে হবে। এটি এমন একটি অভ্যাস, যা তার সঙ্গীর সাথে গোপন আচারের সঙ্গে জড়িত। অন্য কথায়, তাকে শরীর অর্থাৎ তনু ব্যবহার করতে হবে এবং তাই তন্ত্র অনুশীলন করতে হবে। সুতরাং, মন্ত্রটি শুধু চিন্তা ও ধ্যানের বিষয় নয়; এটি আচার পালন সম্পর্কিতও। এর জন্য তার দরকার একটি যন্ত্র, এক্ষেত্রে একটি মাধ্যম। সতী তাঁকে, বিষ্ণুর সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ব্যাখ্যা করেম। দেবী তাঁকে একটি সুন্দর পদ্মের মালাও দেন। এই পদ্মের মালা বিষ্ণু বৈকুণ্ঠে নিয়ে যান। এটি তখন পৃথিবীতে পড়ে, বৃন্দাবনে, অন্ধকার যমুনা নদীর তীরে সুগন্ধি তুলসী বনে, এবং রাধায় রূপান্তরিত হয়।
বৃন্দাবন হল ৫২ পীঠের সেই জায়গা, যেখানে সতীর চুল পড়েছিল, যখন শিব সতীর শোকে তাঁর মৃতদেহ বহন করেছিলেন। বৃন্দাবন যেখানে পদ্মের মালা পড়ে এবং রাধার জন্ম হয়। তিনি তখন বিষ্ণুর নশ্বর রূপ, কৃষ্ণের আগমনের জন্য অপেক্ষা করেন। কৃষ্ণ এখানে আসেন এবং বয়স্ক, জ্ঞানী রাধার মুখোমুখি হন এবং প্রেমে পড়েন। তাঁদের মধ্যে কৌতুকপূর্ণ আলাপচারিতা হয়, এবং রাধা তান্ত্রিক আচারে কৃষ্ণর গুরুতে পরিণত হন। রাধা কৃষ্ণকে সমস্ত কৌল আচার শেখান এবং কৃষ্ণ জ্ঞানী হয়ে ওঠেন।
ভাগবত পুরাণে যা লেখা আছে তার তুলনায় এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প। ভাগবত পুরাণে, কৃষ্ণ মথুরায় ফিরে আসেন এবং রাধা কাঁদেন। ‘রাধাতন্ত্র’-এ, রাধা তাঁর নিজের স্বর্গীয় শাক্ত স্বর্গে ফিরে আসেন। কৃষ্ণই পিছনে পড়ে থাকেন এবং মথুরা ও দ্বারকায় তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি বৈকুণ্ঠে ফিরে আসেন এবং গোলোকে তাঁর প্রিয় রাধার সাথে পুনরায় মিলিত হন।
রাধাতন্ত্র— যা বর্তমানে জনপ্রিয় সন্ন্যাসীর ভক্তি আন্দোলনের অতি-প্রভাবের দ্বারা মানুষের চিন্তা ও যাপন থেকে অপসৃত হয়েছে এবং ‘রাধাতন্ত্র’কে সক্রিয়ভাবে দমন করা হয়েছে— সেই ‘রাধাতন্ত্র’-এ কিন্তু যৌনতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘ভাগ’ শব্দটি, যার অর্থ সাধারণত ফাটল বা কাটা, এটি ‘ভালভা’র একটি তান্ত্রিক রূপক, তাই দেবী। এইভাবে, ‘ভাগবত’কে এমন এক সত্তা হিসেবে দেখা হয় যে দেবীর কাছে দাবি করে। পুরো-এর (পূর্ণ) একটি অংশ (ভাগ) তৈরি করতে প্রথমে পূর্ণকে খণ্ড (ভাগ) করতে হবে। দেবীর কাছে তাঁর অবারিত দ্বার বলেই কিন্তু বিষ্ণু-কৃষ্ণের নানা গুণের অংশ রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে খ্যাতি, সম্পদ, জ্ঞান, সৌন্দর্য এবং আকর্ষণীয়তার মতো গুণাবলি। এই গুণগুলোই তাঁকে ভগবান করে তুলেছে।