অদৃষ্টের যে একাধিক অলিগার্ক আছে, তাদের থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য আজকাল বহু লোক কবজিতে লাল সুতো পেঁচিয়ে রাখে। ভক্তেরা এই রক্ষাকবচের কার্যকারিতা সম্পর্কে, বলাই বাহুল্য, প্রমাণ বা সাক্ষ্যের অপেক্ষা করে না। কারণ ভক্তের ধর্মই তাই। এই লেখার প্রেক্ষিতও ওই ভক্তি, যদিও কোনও লাল সুতো পরিহিত ব্যক্তিবর্গ এর প্রধান চরিত্র নয়। বরং এই লেখার বিষয় ওরকমই লাল সুতোবেষ্টিত একটি সদ্য-জনপ্রিয় ছবি। অনীক দত্তর ‘অপরাজিত’।
যে-কোনও ছবি যে-কোনও কারণেই জনপ্রিয় হতে পারে, তার বিশ্লেষণ সবসময় কার্যকর হয় না। আর সিনেমার মতো একটি খরচসাপেক্ষ, অতিজটিল শিল্প যদি-বা কিছু পয়সা কমায়, তাতে কারোরই খারাপ লাগার কথা নয়। খুব সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, যে-কোনও ছবি ‘জনপ্রিয়তা’ বস্তুটির চাঁদমুখ দুই কারণ দেখতে পারে। ছবির নিজগুণে অথবা বাহ্যিক কারণে। তবে কিছু ছবির ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মিশেল ঘটে। বাংলা ছবির নিরিখে যে বাঁধভাঙা উল্লাস অনীকের ছবিটির সমাদরকে চিহ্নিত করেছে, তা অবশ্যই নজরকাড়া। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, এক্ষেত্রে ছবির নিজস্ব গুণ আর পারিপার্শ্বিক এক হয়ে বাংলা ছবির সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটা মাইলস্টোন রেখে গেল? অনীকের ছবিতেই যেমন দেখানো হয়েছে যে ‘পথের পদাবলী’ সাধারণ মানুষ হলে গিয়ে টিকেট কেটে দেখবে কি না সে-ব্যাপারে অপরাজিত রায় বেশ চিন্তিত। অপরাজিত রায়ের ‘চিন্তা’র খেই ধরেই তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, অনীকের বায়োপিকের মধ্যেই কি এমন কিছু আছে যা জনগণের স্বীকৃতির জন্যে মরিয়া? তাহলে কি এই ছবির বিপুল অভ্যর্থনার সঙ্গে ওই লাল সুতোর রূপকের একটা প্রচ্ছন্ন, অগোচর সম্পর্ক আছে?
এর উত্তর খুঁজতে হলে মুখোমুখি হতে হবে দুটি প্রশ্নের। প্রথম, বায়োপিক এর সারবত্তা কী? দুই, বায়োপিক আর হ্যাজিওগ্রাফির মধ্যে উন্মুক্ত যে-প্রাঙ্গণ, সেটা কোন কৌশলে অদৃশ্য করা হয়, এবং কেন?
একটি বায়োপিক-এর অন্তত দুটো মূলধন প্রয়োজন। যাঁর জীবনীভিত্তিক ছবি তাকে অন্তত কিছুটা পরিচিত হতে হবে আর দুই, সেই জীবনীতে এমন কিছু রসদ, এমন কিছু উপাদান থাকবে যা সিনেম্যাটিক, অর্থাৎ সিনেমা-বান্ধব। তারপর আসবে সেই জীবনের কোন-কোন অংশ কীভাবে উঠে আসবে পর্দায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা।
বিশ্বের সিনেমার দু’একটি বিখ্যাত উদাহরণের দিকে তাকানোর আগে বাংলা সিনেমারই দুটো ছবির কথা খুব সংক্ষেপে না বললেই নয়। ‘নায়ক’ (১৯৬৬) আর ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ (১৯৬৭)। দুটি ছবিই বায়োপিক-এর রসদে তৈরি, বায়োপিক-এর অবয়ব দুটি ছবিতেই অতিস্পষ্ট কিন্তু প্রথাগত বায়োপিক একটিও নয়। দুটি ছবির আসল জোর সেখানেই। প্রথমটায় একদিনের রেল-সফর হয়ে ওঠে এক বিখ্যাত নায়কের ব্যক্তিগত ওডিসি, জনপ্রিয়তার আয়নায় নিজের অবস্থানকে যাচাই করার একটি দুর্লভ অভিজ্ঞতা। অথচ আমরা সবাই জানি অরিন্দম মুখার্জী উত্তমকুমার। কিন্তু তার জন্য সত্যজিৎ বা উত্তম কেউই নায়কের চরিত্রকে তুলসীপাতায় ঢেকে সাবধানে পরিবেশন করতে উদ্যোগী হন না। সেরকমই, ইতিহাসের এন্টনি আর পর্দার ফিরিঙ্গির চেহারায়, ব্যক্তিত্বে অনেক তফাত, কিন্তু সুনীল ব্যানার্জীর এই ছবি শুস্ক ইতিহাস হয়ে ওঠার চেষ্টাই করে না, বরং ট্র্যাজেডির হাত ধরে শিখিয়ে দিয়ে যায় সহমর্মিতার নিবিড় পাঠ।
ইতিহাসের সূত্র ধরেই অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’-তে (১৯৮২) ধরা পরে মহাত্মার ছয় দশক, তার মধ্যে শেষ চার দশক খুঁটিয়ে। অন্যদিকে, স্পিলবার্গ-এর ‘লিঙ্কন’-এ (২০১২) দেখা যায় ১৮৬৫ সালের কয়েকটি মাস, যখন মরিয়া লিঙ্কন চায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন কংগ্রেসে যেনতেনপ্রকারেণ ত্রয়োদশ এমেন্ডমেন্ট পাশ করিয়ে নিতে, যাতে যুদ্ধোত্তর দক্ষিণের রাজ্যগুলি কংগ্রেসে ফেরার আগেই আমেরিকা হয় ক্রীতদাসপ্রথা মুক্ত। দুটি ছবিই তাদের নির্দিষ্ট প্রোটাগোনিস্টের রাজনীতি ঘিরে, কিন্তু দুটির বিন্যাস, কাঠামো আর বিশ্লেষণ একেবারে আলাদা। বায়োপিক হিসাবে ‘গান্ধী’ অনেকটাই রোম্যান্টিক, ‘লিঙ্কন’ ততটাই কেজো, আইনি মারপ্যাঁচ আর লিঙ্কন-এর পারসুয়েশনের ক্ষমতায় নিয়োজিত| অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের বিনির্মাণ আর সেই বিনির্মাণ-এর প্রেক্ষিতে আশেপাশের ঘটনা এই দুইয়ের সংযোগস্থলের কোন-কোন দিক চিত্রনাট্য সহায়ক, সেটিকে মাথায় রেখেই এই দুই বিখ্যাত, জনপ্রিয় বায়োপিক-এর নির্মাণ। ছবিদুটি ত্রুটিহীন কেউ বলছে না, কিন্তু বায়োপিক তৈরির মূলধনের দুটোই আছে এই দুটি ছবিতে। আর তারা যে বায়োপিক, ফিকশন নয়, তার দাবিতে কোথাওই কিন্তু কোনও নাম পরিবর্তন করে বায়োপিক দুটি নির্মিত হয়নি। ওদেশে সেরকম রেওয়াজ নেই, কিন্তু ‘গান্ধী’তেও গান্ধী, আবুল কালাম, নেহেরু, প্যাটেল, এরউইন, মার্গারেট বুর্ক-হোয়াইট, গডসে এরা স্ব-স্ব নামেই পর্দায়, নাম ভাঁড়িয়ে নয়।
ছবির বিষয় বস্তুতে আসার আগেই বলা ভাল যে, এখানেই অনীকের ছবির প্রথম বড় আত্মসমর্পণ। শুরু থেকেই যেটা স্পষ্ট সেটা হল, এ আর কারোও গল্প নয়, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির নেপথ্য-কাহিনির পুনর্নির্মাণ। অনীকের চিত্রনাট্যও গড়ে উঠেছে একটিও না-জানা কাহিনি নিয়ে নয়, বরং যারা এই ক্ল্যাসিকের সম্পর্কে মোটামুটি অবহিত, তারা সকলেই প্রায় যেটা জানে, তার থেকে একচুলও নড়েনি এই ছবির বিষয়বস্তু। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত প্রশ্ন হল, যেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, সেটা ঢাকতে এত পরিশ্রম কেন? এবং সেই পরিশ্রমের স্বাক্ষর আর কিছু না, নাম পরিবর্তন। অপরাজিত, বিমলা, সর্বমঙ্গলা, মানিক, উমা, সুবীর, দেবাশিস, সুরমা, বিমান রায়, জাওহার কাউল। এই যা ‘নতুন’। বাকি তো সবই পুনরাবৃত্তি। প্রশ্ন ওঠে যে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ তো নিজেই একটা ফিকশন, তাকে ঢেকে ‘পথের পদাবলী’ করা কেন? এই পুনঃ-নামকরণের ধাঁধা হাস্যকর খেয়ালে রূপান্তরিত হয় যখন বোড়াল-এর নাম ‘সোরাল’ দেওয়া হয়। কেন? বোড়াল তো একটা আস্ত জায়গা। তখনও ছিল, আজও আছে। এই ছবির অন্যতম চরিত্র হতে কি আজকের বোড়ালের আপত্তি ছিল? তাকে কি কেউ জিজ্ঞেস করেছে? ছবির টাইটেল সিকোয়েন্স-এর আগেই জানা গেল, সত্যজিৎ-এর পরিবার এই ছবির অনুমতি দিয়েছেন। তাহলে নাম পরিবর্তন কেন? আর যদি নাম পরিবর্তনই হয়, তাহলে অনুমতির দরকার কী?
সন্দেহ হয় যে, এই প্রবৃত্তি আপাতদৃষ্টিতে কৌতুক-উদ্দীপক হলেও এর পিছনে কাজ করছে একটা ভীষণ রকমের নিরাপত্তাহীনতা। এই নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম বলি ছবিটির বিষয়বস্তু। বায়োপিক আর ফিকশনের মধ্যে সূক্ষ ফাঁরাক, যে-বুদ্ধির আনাগোনা থাকে তা এখানে একেবারেই অনুপস্থিত, বরং বায়োপিক-এর হাতছানি দিয়ে আস্ত ম্যাড়ম্যাড়ে ফিকশনের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখালাম, এতেই যেন এই ছবির মজা। এতে কার স্বার্থ রক্ষিত হয় জানা নেই, তবে এই ধরনের শিড়দাঁড়াহীন আয়োজন সিনেমার নিজস্ব ভাষাকে, তার নিজস্ব গতিকে, দেখা-না-দেখার উপাদেয় আলো-আঁধারিকে যে অনেকটাই শ্বাসরুদ্ধ করে, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই ছবি।
এতদ্সত্ত্বেও এ-কথা না বললেই নয় যে, এ-ছবি একবারও বসে দেখার অনুপযুক্ত নয়। বরং বলা ভাল, এ-ছবি চালাকিনির্ভর নয়, যা আজ কিনা বাংলা ছবির একমাত্র সম্পদে পরিণত হয়েছে। আর সেটা যে নয়, তার দুটি কারণ। এক, জীতু কমল নামে তরুণ অভিনেতার সত্যজিৎ হয়ে ওঠার সৎ প্রচেষ্টা। ছবিটির অনেকখানি তিনি একাই টেনেছেন সন্দেহ নেই। দুই, সিনেমা বা ফিল্মমেকিং যে একটা দলগত নির্মাণ, একটা মিলিত উদ্যম, এই কথাটা বারবারই উঠে এসেছে ছবিতে। আর সত্যি কথা বলতে কি, বাংলা ছবিতে পিরিয়ড নির্মাণের যে দুর্বলতা বা আলস্য ছেয়ে থাকে, তার তুলনায় ‘অপরাজিত’ সচেষ্ট এবং অনেকাংশে সফলও বটে। ছবিতে আরও বেশ কিছু ছোটখাট ভাল লাগা আর ছোটখাট কিন্তু চোখে পড়ার মতো সমস্যা আছে। যেরকম অধিকাংশ ছবিতেই থাকে|
কিন্তু শেষরক্ষা হয়তো হল না, কারণ নাম এর আজগুবি পরিবর্তন বা জানা কাহিনির পুনরাবৃত্তিই এই ছবির চরম দুর্বলতা নয়। দুর্বলতা আরও গভীরে। এই ছবির উপজীব্য একটা ক্লাসিক ছবি কী করে বাংলা বা ভারতীয় সিনেমার বহুব্যবহৃত ছাঁচ ভেঙে বেরোতে পারল। অথচ যে-ছবিটা সেই ছাঁচ ভাঙার কাহিনি শোনাচ্ছে সেটা প্রতি পদে সাবধানী আর কুণ্ঠিত। যেন পায়ে বেড়ি পরে (লাল সুতো) রয়েছেন পরিচালক, কোনওমতে কিছুতেই যেন অসাবধানী কিছু না হয়ে যায়। আর এটা করতে গিয়ে, একাগ্রভাবে পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে গিয়ে, পিরিয়ডটা সংকীর্ণভাবে ধরতে গিয়ে, ওই সময়ের, ছবির, রাজনীতির ইতিহাসটাই বাদ পরে গেছে। তার বদলে যেটা থেকে যায়, সেটা ফিকশন আর হ্যাজিওগ্রাফির একটা নীরস ককটেল।
কভারের ছবি: অনীক দত্ত পরিচালিত ‘অপরাজিত’ ছবির একটি দৃশ্য