নোবেলজয়ী ব্রিটিশ পদার্থবিদ (এবং গণিতজ্ঞ) স্যার রজার পেনরোজ তাঁর জনপ্রিয় বই Emperor’s New Mind-এ অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্বে আমাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা ১/(১০)১২৩০।১ ভগ্নাংশের হরটি এতই বড় যে, কোনো মানুষের পক্ষে জীবৎকালে সংখ্যাটি খাতায়-কলমে লিখে যাওয়াও সম্ভব নয়। পেনরোজের এই সংখ্যাটি নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বা গণিতবিদ্যার তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতার মধ্যে না গিয়েও বুঝতে অসুবিধা হয় না ২০২২-এ বসে ডাকবাংলা ওয়েবসাইটে লেখা পড়তে পারাটা নেহাতই অচিন্ত্যনীয় সৌভাগ্য।
অথবা নয়।
বৌদ্ধ দর্শনে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা বলবেন ওই যে শূন্যসম সম্ভাবনা, সেও তো ঠিক করে দেওয়া। আর তাই যে-স্থিতিকে আপাতদৃষ্টিতে অচিন্ত্যনীয় সৌভাগ্য বলে মনে হচ্ছে, সে আসলে অফুরান যন্ত্রণাভোগের মেকি বহিরাঙ্গমাত্র।
ভালো আছি না খারাপ, এই চিরন্তন প্রশ্ন এবং তৎসম্বন্ধীয় দ্বন্দ্ব থেকে আপাত-পরিত্রাণের একটি পথ দেখিয়ে গেছেন ঘরের কাছের এক মানুষ। কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। অন্নদামঙ্গলের পাতা থেকে ভারতচন্দ্রের সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিগুলি মনে করুন— ‘নিদ্রাবেশে সুখ যত, জাগ্রতে কি হয় তত/ বুঝ লোক যে জান সন্ধান’। হ্যাঁ, ভারতচন্দ্রের প্রোটাগনিস্ট এ-যুগের হিসাবে কিছুটা creepy হাবভাব করছিলেন বটে, কিন্তু সে-প্রসঙ্গ অন্য। ওই যে নিদ্রাবেশে সুখ, সেই হিসেবটা বোধহয় দেশকাল নির্বিশেষে আমরা ভালই বুঝেছি। নাহলে এই যে দু’বছর ধরে একটা অতিমারীর ঝড় বয়ে গেল, এবং তার পর পরেই শুরু হয়ে গেল ইওরোপব্যাপী ঘোরতর যুদ্ধ, এবং ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর হুমকিতে মোটের ওপর সবাই থরহরিকম্প, তার পরেও মা-র আদি এবং বর্তমান রূপে এত মিল থাকে কী করে?
আমি বর্তমানে যে-দেশের বাসিন্দা, সেই ইংল্যান্ডের কথাই ধরুন। গত দু’বছরে অর্থাৎ কোভিডের পুরো সময় ধরে দেখা গেল কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ বা এশিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বেশি মার খেয়েছেন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের যে-গবেষকরা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন২, এক ব্রিটিশ কবির পঙ্ক্তি ধার করে তাঁরা বলেছেন, ‘We are in the same storm, but we are not all in the same boat’। এ তো গেল অতিমারীর সময়ের কথা। অতিমারী আপাতভাবে শেষ হওয়ার পরেও কি বিশেষ কিছু বদলেছে? এই মে মাসের কথা, এক সরকারি নিরীক্ষার ফলের হিসাবে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ান জানাচ্ছে জ্বালানি এবং খাদ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির দরুন এই মানুষগুলিরই স্বাস্থ্য রীতিমতন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।৩ যে-সরকার কোভিড চলাকালীন কিছু ভর্তুকি এই পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীগুলির হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন, তাঁরাও ফের মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলবেন এ-সমস্যা কাঠামোগত, সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদরা বলবেন আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া এ-সমস্যাকে কিছুভাবেই দূর করা যাবে না। হয়তো তাঁরা ঠিক কথাই বলছেন, কিন্তু অতিমারী-উত্তর পৃথিবী এই সমস্যাকে কিছু নতুন আঙ্গিক থেকেও দেখতে পারে। অতিমারীর সময়কালে সম্পন্ন গবেষণা দেখাচ্ছে পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষ বারংবার স্বার্থপরের মতন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে নিজের বাড়িতে গাদা-গাদা অক্সিজেন সিলিন্ডার জড়ো করেই হোক বা সুপারমার্কেট থেকে সমস্ত টয়লেট টিস্যু তুলে নিয়ে গিয়েই হোক বা সামাজিক দূরত্ববিধি না মেনেই হোক, উদাহরণের কোনও অভাব আমরা রাখিনি। কিছু গবেষক বলছেন দীর্ঘদিনের একাকিত্ব আমাদের বেশি স্বার্থপর করে তুলেছে; কেউ-বা আবার বলছেন এ আমাদের ‘Original Sin’, সামান্যতম বিপদের আশঙ্কা দেখলেই আমাদের এক জান্তব প্রবৃত্তি বেরিয়ে পড়ে। উল্টোদিকে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, আমেরিকা হোক কি আফ্রিকা, মানুষ এই অতিমারীর সময়েই অনেক বেশি টাকা দান করেছেন। এই বৈপরীত্য আমাদের নিশ্চিত ভাবেই ভাবিয়ে তুলবে, কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে ধাঁধাটি হয়তো বুঝতে অসুবিধা হবে না।
যে-মুহূর্তে আমরা নিজেদের জায়গাটি নিরাপদ করে তুলতে পারছি, আর্থিক সুরক্ষার নিশ্চিত বলয়ে ঢুকে পড়তে পারছি, তারপর দানধ্যান নিয়ে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যে-মুহূর্তে সেই নিরাপত্তার জায়গাটি বিঘ্নিত হচ্ছে, আমাদের নখদাঁত বেরিয়ে পড়ছে। মনে হতেই পারে যে, নেহাতই স্বাভাবিক মনুষ্যপ্রবৃত্তি, যুগে-যুগে এমনটাই ঘটে এসেছে। তাই কী?
এ-আলোচনায় ঢুকতে হলে মাদার টেরিজার এক বিখ্যাত উক্তিকে মনে করতেই হবে, ‘If I look at the mass, I will never act. If I look at the one, I will’।৪ এই উক্তি এতই বিখ্যাত যে, অনেকে একে ‘মাদার টেরিজা এফেক্ট’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। হ্যাঁ, সমষ্টির থেকে ব্যক্তির প্রতি আমাদের সহমর্মিতা অনেক বেশি। যে-দুঃখে একজন মানুষকে কাতর হতে দেখলে আমাদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে, সেই একই দুঃখে লাখখানেক মানুষকে পীড়িত হতে দেখলে আমরা হয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কিন্তু একবিংশ শতকে এসে বিশ্বব্যাপী জটিলতার মাত্রাও আমাদেরকে জবুথবু করে তুলেছে। ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতিটি মানুষ গড়ে ১.৭ মেগাবাইট ডেটা উৎপাদন করে চলেছেন প্রতি সেকন্ডে। রোজের হিসাবে আমরা তৈরি করছি ২.৫ কুইন্টিলিয়ন ডেটা বাইট, কুইন্টিলিয়ন মানে ১-এর পর আঠারোটা শূন্য। এই অত্যধিক জটিল পৃথিবীতে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া অতি কঠিন ব্যাপার। যে-কারণে তাত্ত্বিক গবেষণাও ক্রমেই কমে আসছে। বিশেষজ্ঞরাই কূল খুঁজে পাচ্ছেন না, সাধারণ মানুষ তো কোন ছাড়! শুধু সহমর্মিতা দিয়ে এই জটিলতার সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব ব্যাপার। একাধিক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এও দেখাচ্ছে, সমষ্টিগত দুঃখের খবর আমরা যত বেশি পড়ছি-শুনছি-দেখছি, আমাদের ব্যক্তিগত অশান্তিও ততই বাড়ছে। ফলে বহু মানুষ এই তথ্য আদান-প্রদানের জগৎটি থেকে নিজেদের পুরোপুরি ভাবে গুটিয়ে নিচ্ছেন।
অতএব, ধরো তক্তা, মারো পেরেক। দানধ্যান ব্যাপারটা খারাপ নয় কিন্তু এক হিসাবে দানধ্যানের মানসিকতাটি পুরাতনী, বিংশ শতাব্দীর মানসিকতা। বর্তমান পৃথিবীর জটিলতাকে না বুঝে চটজলদি এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা। ওই যে লিখছিলাম, নিজেদের নিরাপত্তার জায়গাটা বিঘ্নিত হলেই নখদাঁত বেরিয়ে পড়ছে, এই আগ্রাসনটা কিন্তু বহুলাংশেই আমাদের বৌদ্ধিক অক্ষমতার দরুন। মস্তিষ্ক জবাব দিয়ে দিচ্ছে বলে ভয় পেয়ে যাচ্ছি, আধুনিক জটিলতা যে-পদক্ষেপগুলো নিতে বলছে, সেগুলি সম্পূর্ণভাবে বুঝেই উঠতে পারছি না। ভয় তো হওয়ারই কথা! এই তো সবে বছর পঁচিশ হল বিশ্বায়নের সুফল ভোগ করতে শুরু করেছি, এর মধ্যেই যদি পশ্চিমি দেশের বিজ্ঞানীদের বলতে শুনি ট্রান্সআটলান্টিক উড়ান নেওয়া ক্রমেই কমিয়ে দিতে হবে, মনে হতেই পারে আমাদের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র গড়ে উঠছে। যে-মুহূর্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উচ্চবিত্ত হওয়ার সিঁড়িতে কয়েক ধাপ পা ফেলেছে, অমনি ক্লাইমেট ক্রাইসিস শুরু হয়ে গেল!
মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন, ফেক নিউজ— এও এই জটিলতারই অঙ্গবিশেষ। যে-প্রশ্নের দিকেই তাকাই, সরাসরি উত্তর মেলে না। একমাত্রিক উত্তর মেলে না। অথচ একটা সোজাসাপটা উত্তর পেলে আমাদের মাথা ঠান্ডা থাকে, মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় যাকে বলে ‘Cognitive Dissonance’ কমে আসা। এই যে প্রায় দেড় কোটি মানুষের প্রাণ গেল কোভিডে, দায়টা কার? অতিমারীর দু’বছর পরেও কোনও সরল উত্তর নেই, স্বাভাবিক ভাবেই মন চাইবে একটি বিশেষ দেশের ওপর দোষ চাপিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে। এদিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বোঝার চেষ্টা করছেন অতিমারী আর জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যের কার্যকারণ সম্পর্কটিকে। কার্নেগি ফাউন্ডেশন দেখাচ্ছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বিদেশনীতির ব্যর্থতার সঙ্গেও কোভিড মহাসঙ্কটের একটি নির্দিষ্ট যোগাযোগ আছে। আমরা বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রসংঘের তহবিলে টাকা দিয়ে দায় সেরে ফেলছি।
ডাকবাংলা-র সম্পাদক আমার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন— কোভিড ঠিক কী কেড়ে নিল? প্রাণ, আর্থিক সুরক্ষা, চাকরির নিরাপত্তা এসব তো কেড়ে নিয়েছেই। আমি এক ধাপ এগিয়ে এটাও বলতে চাই, কোভিড আমাদের মানসিক স্থিতাবস্থাটিকেও পুরোপুরি ভাবে কেড়ে নিয়েছে। অন্য ভাবে বললে আধুনিক পৃথিবীতে ওই স্থিতাবস্থাটি যে নেহাতই ছেলেভুলোনো গল্পমাত্র, এই কঠিন সত্যটিকে আমাদের ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনওই শুভশক্তি একতরফা রাজত্ব করে যায়নি। কিন্তু ওই আপাত-স্থিতাবস্থায় আমরা ভাবতাম, কে শুভশক্তি আর কে অশুভশক্তি সেটুকু আমরা জানি। কিন্তু ওই আড়াই কুইন্টিলিয়ন ডেটার দুনিয়ায় সে-বিভ্রমটুকুও গেছে।
অসাম্য, এক ‘নিউ নর্মাল’
একবিংশ শতকের শুরু থেকেই এ-যুগের একাধিক দার্শনিক বলতে শুরু করেছিলেন ধনতন্ত্রের বিকল্প নেই, এ-যুগের একমাত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সত্য বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তা হল ধনতন্ত্রের অক্ষয় পরমায়ু। এক হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকেই একাধিক পশ্চিমি চিন্তাবিদ এই তত্ত্বকে তুলে ধরছিলেন, উৎসাহী পাঠক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি’ প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে মোটের ওপর কিছু উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। কিন্তু তার বছর কুড়ি পর যখন ব্রিটিশ চিন্তাবিদ মার্ক ফিশার তাঁর অধুনাবিখ্যাত বই ‘ক্যাপিটালিস্ট রিয়ালিজম: ইজ দেয়ার নো অল্টারনেটিভ?’ লিখছেন, তখন ধনতন্ত্রের একাধিপত্য মেনে নিতে হচ্ছে এক নেতিবাচক বাস্তব হিসাবে। সাধারণ মানুষও যে বুঝতে পারছিলেন না তা নয়। কিন্তু বিকল্পহীনতার আশু বা সুদূরপ্রসারী পরিণাম কী হতে পারে, তা নিয়ে তাঁদের সম্যক ধারণা তৈরি হচ্ছিল না। এখানে বলে রাখা ভাল, ধনতন্ত্রের যে-আধিপত্যবাদ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তা সার্বিক, কোনও একটি দেশের প্রেক্ষিতে এ-আলোচনা নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই বিশ্বায়নের যে-জোয়ারে তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলিও ভেসে গেছিল, সেই জোয়ারের জল সরে যাওয়ার কোনও লক্ষণ তখনও দেখা যায়নি, এখনও দেখা যাচ্ছে না।
অতিমারী কিন্তু এক ধাক্কায় এই বিকল্পহীনতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিণাম আমাদের সবাইকে বুঝিয়ে ছেড়েছে। অসাম্য। অসাম্য নিয়ে আলোচনা আজকের নয়। সেই আঠারো শতকের চিন্তাবিদদের কাজে ফিরে যান। দেখবেন ডেভিড হিউম বা জঁ-জাক রুশো জানাচ্ছেন সুখী সমাজ গড়ে তোলার এবং টিকিয়ে রাখার অন্যতম শর্ত হল সাম্য। যে-সাম্যের কথা হিউম বা রুশো বলেছিলেন, তা মূলত অর্থনৈতিক সাম্য। হিউম বলেছিলেন আদর্শ সমাজে পরিশ্রমী এবং পরিশ্রমবিমুখ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য থাকা উচিত নয়, আর ঠিক একই কারণে শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির দরুন যে-মানুষগুলি শ্রমিকশ্রেণিকে বঞ্চিত করে তুলছেন তাঁরা আদর্শ সমাজের পরিপন্থী। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক অসাম্যের পেছনে রয়ে গেছে শ্রমের অসাম্য, এ-কথাই ছিল হিউমের মূল বক্তব্য। রুশো আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, অর্থনৈতিক অসাম্যের মূল কারণ হল ব্যক্তিগত মালিকানা। বলা বাহুল্য যে, রুশোর চিন্তা ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল, এবং ফরাসি বিল্পবের সাফল্যের মধ্যে লুকিয়ে ছিল রুশ বিপ্লবের বীজ।
একুশ শতকের অসাম্য কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, দূষণমুক্ত বাতাস, অসাম্য সর্বক্ষেত্রেই। অতিমারীর পর দেখা যাচ্ছে পুনরুজ্জীবনের পথেও রয়ে যাচ্ছে বিস্তর অসাম্য। ভারতের মতন দেশে অতিমারী-উত্তর পুনরুজ্জীবনের পথ আদপেই ইংরেজি অক্ষর V-এর মতন দেখতে নয়, খানিক ক্লিশে শোনালেও আসলেই এ-পথ K-র মতন দেখতে। অর্থনৈতিক তত্ত্ব জানায় যে, মানুষগুলি অপরিসীম ঝুঁকি নিতে পারেন, তাঁদের গন্তব্য ওই ঊর্ধ্বগামী পথ। বাস্তব দেখাচ্ছে ঝুঁকি নয়, যাদের হাতে একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য তাঁরাই ওই পথ ধরতে পেরেছেন। বিশ্বব্যাঙ্ক, ব্লুমবার্গ এবং একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে গোটা দুনিয়ার প্রেক্ষিতেও কথাটি মোটের ওপর সত্যি। যে-দেশগুলির পুঁজি কম, অতিমারী আক্ষরিক অর্থেই তাদের কোমর ভেঙে দিয়ে গেছে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক কোন পুঁজির কথা বলছি আমরা? রাষ্ট্রীয় সম্পদ অর্থাৎ জি-ডি-পি? ব্লুমবার্গ পত্রিকার Covid resilience ranking-এর৫ দিকে তাকালে দেখতে পাব তিপান্নটি দেশের তালিকায় ভারত ৩৭, ব্রেজিল ৪১, দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৯, চিন ৫১ আর রাশিয়া ৫২তম স্থানে। কেন এই দেশগুলিকেই বেছে নিলাম? কারণ একুশ শতকের শুরুতে এই পাঁচটি দেশকে বেছে নিয়ে বলা হয়েছিল আগামী পৃথিবীর প্রগতির চাবিকাঠি রয়েছে এদের হাতেই, যে-কারণে বাজারে চলে আসে এক নতুন অ্যাক্রোনিম ‘BRICS’। যথেষ্ট রাষ্ট্রীয় সম্পদ না থাকলে এই তালিকায় যে ঢোকা যেত না সে-কথা বলাই বাহুল্য। তৎসত্ত্বেও দেখুন পাঁচটি দেশেরই কী করুণ অবস্থা। অর্থাৎ, শুধু জি-ডি-পি’র দিকে তাকিয়ে এ-ধাঁধার উত্তর পাওয়া যাবে না। উত্তর পেতে গেলে একবার তাকানো দরকার ২০২০-র World inequality database-এ৬। দেখতে পাবেন এই প্রতিটি দেশই অতিমারীর আগে থেকেই ভুগছিল প্রবল অর্থনৈতিক অসাম্যে। নির্দিষ্ট কার্যকারণ সম্পর্কটি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে কিন্তু মোটের ওপর একটা ধারণা করা যায় যে, কোভিড-পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক অসাম্য যত বেশি, কোভিড-পরবর্তী পুনরুত্থানের পথও ততই দুর্গম।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে একটা মাইক্রোভিউ নিয়ে কথা হচ্ছিল, অতিমারী জাতীয় সমস্যার মধ্যে ব্যক্তিমানুষ কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এই অধ্যায়ে কথা হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির প্রতিক্রিয়া নিয়ে, সেই হিসাবে একে ম্যাক্রোভিউ বললে খুব অত্যুক্তি হয় না। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রর প্রতিক্রিয়াকে পাশপাশি বসিয়ে দেখলে মনে হবে, যথেষ্ট সাযুজ্য রয়ে গেছে। ব্যক্তিমানুষ জটিলতার কূলকিনারা না পেয়ে খানিক জান্তব প্রবৃত্তির হাত ধরে চলতে চান, চলতে চান খানিক অতিসরলীকৃত পথে। রাষ্ট্র নিজেও আর্থসামাজিক গতিপ্রকৃতির যে বিশেষ হালহদিশ বুঝতে পারছে তা নয়। ২০০৮-এ বিশ্বজোড়া যে-অর্থনৈতিক মন্দা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছিল, রাতারাতি নিঃশেষ করে দিয়ে গেছিল মার্কিনমুলুকের অসংখ্য সাধারণ মানুষের সঞ্চয়, তার আঁচ ক’জন রাষ্ট্রনেতা পেয়েছিলেন? বা ধরুন, এই অতিমারীর সময়ে যে লাখ-লাখ শ্রমিককে পায়ে হেঁটে হাজার-হাজার কিলোমিটার পেরোতে হবে বা চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতার দরুন গঙ্গার ধারে-ধারে হাজার-হাজার মানুষের শব বালিচাপা দিয়ে দিতে হবে, এ-কথাই বা ক’জন ভারতীয় নীতিনির্ধারক অনুমান করতে পেরেছিলেন? কিন্তু আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। মার্কিন মুলুকের ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরেও সর্বরকমের অসাম্য সে-দেশে গত চোদ্দো বছরে ক্রমেই বেড়েছে, ২০২০-’২১-এর নারকীয় স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ে গেঁথে থাকলেও তা ভারতীয় নীতিনির্ধারণে সামান্যতম হেরফেরও ঘটাতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যে ফের একটা অতিমারী এলে দেশের প্রান্তিক মানুষগুলি যে নিরাপদে থাকবেন, সে-কথা আদৌ বলতে পারছি না।
চরম অসাম্যও আজকের পৃথিবীর জটিল অর্থব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। হ্যাঁ, বহু রাজনীতিবিদ স্বার্থপর, তাঁরা নিজেদের লক্ষ্যপূরণেই অস্বাভাবিক বেশি ব্যস্ত, এসব মেনে নেওয়ার পরেও বৌদ্ধিক অসহায়তার কথাটি নেহাত উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতিমারী নিয়ে আমাদের যা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, বা উষ্ণায়ন নিয়ে সারা পৃথিবীর যা শ্লথ পদক্ষেপ, তাতে আমাদের অসহায়তাই প্রকট হয়ে উঠেছে। জটিল থেকে জটিলতর হয়ে চলা পৃথিবীতে টিকে থাকতে গেলে তাহলে করণীয় কী? সেটা বুঝতে গেলে একবার কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার দিকে তাকালে মন্দ হয় না। বহু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন অগুন্তি আরও বিশ্বে অগুন্তি আমি-আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছি, এবং প্রতিনিয়ত এই অজস্র ‘আমি’রা একই বিষয়ে ভিন্ন-ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছি। দৃশ্যমান পৃথিবীর জটিলতার প্রেক্ষিতে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাকে টেনে আনলে অনর্থক চটক দেখাচ্ছি এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চটক নয়, একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে এখানে। যদিও ‘মাল্টিভার্স থিয়োরি’ সর্বজনগ্রাহ্য নয়, কিন্তু বহু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন৭ এই তত্ত্ব অতি জটিল একটি সমস্যার সবথেকে বোধগম্য সমাধানমাত্র— চরম সত্য খুঁজে পাওয়া সহজ নয় কারণ একই প্রশ্নের অসংখ্য উত্তর থাকতেই পারে, এবং সব উত্তর যে আমাদের দৃশ্যমান পৃথিবীর জন্য খাটবে সে-কথাও বলা যায় না। বিজ্ঞানের এই তত্ত্বটির দার্শনিক আঙ্গিকটি বোঝা জরুরি, এবং আমাদের নীতিনির্ধারকরা সেই আঙ্গিকটি বুঝতে পারলে ক্রমবর্ধমান জটিলতার সঙ্গে লড়াইটা কিছুটা সহজ হতে পারে।
যন্ত্র-মানুষ পরিপূরকতা
গত এক দশক ধরেই বিষয় নির্বিশেষে তাত্ত্বিক গবেষণার জায়গাটি ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। ব্যাপারটা ভাল হচ্ছে না খারাপ, সে-বিতর্কে আপাতত না ঢুকে এটুকু বলা যায় যে, মানুষের বানানো তাত্ত্বিক মডেলের থেকে যন্ত্রের ভবিষ্যৎবাণীর ওপরে আমরা বেশি নির্ভর করছি। ওই কুইন্টিলিয়ন প্রমাণ ডেটা নিয়ে যদি যন্ত্র মোটের ওপর সবই বলে দিতে পারে, তাহলে খামোখা মডেল বানিয়ে লাভটাই বা কী? হয়তো সাধারণ মানুষকে কার্যকারণ সম্পর্ক বোঝাতে সুবিধা হবে, কিন্তু তার বাইরে আর কোনও লাভ আদৌ আছে? এই যুক্তির পথ ধরেই বলা যায় অতিমারী-উত্তর পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট নীতিপ্রণয়নের দিন গেছে, বরঞ্চ সমস্তরকম প্রয়োজনীয় তথ্য সাজিয়ে নিয়ে একই প্রশ্নের একাধিক সম্ভাব্য উত্তর কী কী হতে পারে সেটা জেনে নেওয়াই এখন আশু কর্তব্য। ঠিক যেমনটি করেছেন নিউ ইয়র্কের একঝাঁক চিকিৎসাবিদ্যা-গবেষক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেছেন কোভিড-আক্রান্ত মানুষের শ্বাসযন্ত্র কীভাবে সময়ের সঙ্গে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে অসুখের মাত্রায় হেরফের ঘটাতে পারে এবং দেখিয়েছেন যে, মূল অসুখটি কোভিড হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা কিন্তু এক-এক মানুষের জন্য এক-একরকম হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু এ-গবেষণার সবথেকে জরুরি কথা হল শ্বাসযন্ত্রের শুধুমাত্র বর্তমান স্ক্যান দেখে একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসাপ্রণালী ধরে এগোলে বিপদের সম্ভাবনা সমূহ।
শুধু তো অতিমারী নয়, উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েও বিজ্ঞানীরা একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে এগোচ্ছেন না, তৈরি হচ্ছেন একই প্রশ্নের একাধিক সম্ভাব্য উত্তর নিয়ে। অদূর ভবিষ্যতে কী কী করা দরকার, সে-বিষয়ে তাঁদের সম্যক ধারণা থাকলেও, সুদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে দেখছেন একই প্রশ্নের জন্য রয়েছে একাধিক উত্তর, পড়ে রয়েছে একাধিক পথ। এবং তাঁরা বেশ বুঝেছেন যে, সেই সব উত্তর এখনই না জানলে ভবিষ্যতে লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকুও পাওয়া যাবে না— উন্নয়নশীল দেশগুলি পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলি রাখবে কি না, বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থার মধ্যে ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেন’কে সরলীকৃত করা যাবে কি না, এমনকী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অতিরিক্ত শক্তিসম্পদ ব্যয়ে উষ্ণায়নকেই ত্বরান্বিত করে বসব কি না, অনিশ্চয়তার যে অন্ত নেই! আর এই সমস্ত অনিশ্চয়তাকে একসঙ্গে ফেলে নিছক একটি উত্তর খুঁজতে যাওয়া যে বাতুলতামাত্র, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মনে হতে পারে যে উপরের কথাগুলি ধ্রুব সত্য, এ-নিয়ে এত আলোচনা অর্থহীন। কিন্তু অতিমারীর সময়ে আমরা যেভাবে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছি বা উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এখনও অবধি যে যে পদক্ষেপ আর্থ-রাজনৈতিক ভাবে নিয়েছি, সেগুলি দেখলেই বোঝা যায় এই আলোচনা কতটা জরুরি— বস্তুত অধিকাংশ সময়েই আমরা এগিয়েছি চটজলদি ‘ফিক্স’ অবলম্বন করে এবং ভয়ঙ্কর ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের একাধিক পিছিয়ে পড়া দেশে কোভিডের টিকার বন্দোবস্ত না করে স্বার্থপরের মতন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে টিকা মজুত করেছি। ফলে আফগানিস্থান, ইরাক, গুয়াতেমালা, ভেনিজুয়েলা, এরিট্রিয়ার মতন দেশের যে-মানুষগুলি এতদিন অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও নিজের দেশেই থাকতে মনস্থির করেছিলেন, এবার তাঁরাও তাঁদের বন্ধু এবং পরিবার-পরিজনের পথ ধরে ইওরোপ বা আমেরিকার পথে পা বাড়াবেন। কোভিড-সমস্যা কিছুটা কমতেই-না-কমতেই শরণার্থী-সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠার পথে। আবার যদি উষ্ণায়নের দিকে তাকাই, দেখব আমরা অর্থনৈতিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত অসাম্যের দিকে প্রায় না তাকিয়েই আমাদের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছি। ফলে নরেন্দ্র মোদী যখন ২০২১-এর গ্লাসগো অধিবেশনে ঘোষণা করেন ‘নেট জিরো এমিশন’-এর লক্ষ্যে পৌঁছতে ভারতবর্ষের লেগে যাবে আরও পঞ্চাশটি বছর, উন্নত দেশগুলির নেতারা অতীব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। অথচ তাঁরা খেয়াল করেন না, ভারতের মতন একটি চরম অসাম্যের দেশে অসংখ্য মানুষ কয়লা ব্যবহার করতে না পারলে স্রেফ মারা পড়বেন; আমাদের দেশে শক্তিসম্পদের যা চাহিদা তার ৮০%-ই মেটাতে হয় কয়লা ব্যবহার করে। ভারতের অর্থনৈতিক অসাম্য ঘোচাতে না তাঁরা রাজনৈতিক চাপ দিয়েছেন, না করেছেন কোনও সাহায্য, অথচ দিব্যি ভেবে নিয়েছেন ইওরোপ বা আমেরিকার পথ অনুসরণ করে আর বছর পঁচিশ-তিরিশের মধ্যেই আমরাও কার্বন নিরপেক্ষতার তকমা বাগিয়ে ফেলতে পারব!
একমাত্রিক উত্তর খুঁজে যে আর লাভ নেই, বা একমাত্রিক উত্তর যে শুধু লুকিয়ে আছে ফেক নিউজ আর মিসইনফরমেশনের মধ্যে, এ-উপলব্ধি অবশ্য ব্যক্তি এবং সমষ্টি উভয়েরই দরকার। কেন? সেটা বুঝতে গেলে ব্যক্তি এবং সমষ্টির পাটিগণিত-মার্কা সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে আসা দরকার। ফরাসসি দার্শনিক মিশেল ফুকো জানিয়েছিলেন চরম সত্য বলে কিছু হয় না, তাই সে-সত্য নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল। যে-সত্যান্বেষণের জন্য আমাদের এই উদগ্র বাসনা, সেটি শুধুমাত্র কিছু নিয়মকে ঠিক করে দেয় যা আমাদের সহজে বলে দেবে সত্যির থেকে মিথ্যা ঠিক কীভাবে আলাদা। আর এই নিয়মকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এক ক্ষমতার বৃত্ত— যে-বৃত্তের কেন্দ্রে থাকতে পারেন কোনও শিক্ষক বা কোনও কারাগারের অধিকর্তা, যারা তাঁদের অধীনে থাকা মানুষদের জ্ঞানের নিগড়ে বেঁধে ফেলেন। এবং একই যুক্তি অনুযায়ী এহেন বৃত্তের কেন্দ্রে অবশ্যই রয়েছেন একটি দেশের নীতিনির্ধারকরা। ব্যক্তি এবং সমষ্টির মধ্যে যে-সম্পর্ক, শাসক এবং শাসিতর মধ্যে যে-সম্পর্ক তাকে হিংসামুক্ত করতে গেলে দরকার এই বিশেষ ক্ষমতা, যাকে ফুকো জ্ঞানের অপর পিঠ বলে চিনেছেন। অতিমারী-উষ্ণায়ন-শরণার্থী সমস্যা গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ক্ষমতা এবং হিংসার তফাত করতে পারাটা জরুরি। ওপর থেকে একতরফা ভাবে চাপিয়ে দেওয়া প্রেক্ষিতনির্দিষ্ট নীতি কাজ করছে না বলেই হিংসা বাড়ছে, বাড়ছে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, বাড়ছে উভয়ত অবিশ্বাস। আর এই কারণেই সত্যের স্বরূপকে কিছুটা আলাদা ভাবে চেনার দরকার পড়েছে। ফুকোর কথা ধরলে বলতে হয়, এটা কোনও অনৈতিক কাজ নয়, স্রেফ যুগধর্ম পালন।
তাহলে অতিমারী-উত্তর পৃথিবীতে সত্যি বলতে কী বুঝব? বুঝব এটাই যে, ক্রমবর্ধমান জটিলতার দুনিয়ায় একমাত্র সত্যিকে খুঁজতে যাওয়াটা একটা বিলাসিতামাত্র। একটিমাত্র সত্যকথন, একটিমাত্র উত্তর থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তা আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই যে-কোনও রকম একমাত্রিক উত্তরকেই সন্দেহের চোখে দেখা হোক, জানানো হোক এহেন উত্তর শুধু হিংসাকেই তোল্লাই দিতে পারে, ক্ষমতার সুচারু রূপায়ণে কাজে আসে না। মার্ক ফিশারের আশঙ্কা ধরে এগোলে বলা যেতেই পারে The revolution will not be televised, কারণ ধনতন্ত্রই একমাত্র বাস্তব। অর্থাৎ, অসাম্য থাকবে, থাকবে ক্ষমতার কাঠামোটিও। কিন্তু সেই কাঠামোর মধ্যে থেকেও যদি মানুষের মতন বাঁচতে হয়, হিংসাবিহীন ভাবে বাঁচতে হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই একটি সমাধান নয়, সম্ভাব্য সমাধানগুচ্ছের কথা ভাবতে হবে।
মনে রাখতে হবে সব সমাধানই যে যন্ত্রের হাত ধরে আসবে তা নয়। যে কুইন্টিলিয়ন প্রমাণ তথ্যের কথা বলছিলাম, সেই তথ্যের বহুলাংশ আজ ব্যবহার হচ্ছে নজরদারি পুঁজিবাদের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে। যন্ত্র, মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, এখনও অবধি মানুষের দাস। মানুষ কীভাবে যন্ত্রের ব্যবহার করবে তার ওপর নির্ভর করছে যন্ত্রের ভবিষ্যৎবাণীও। তাই মূল প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে এগোব? প্রথমত, ভয় পেলে চলবে না, কারণ ভয় যত বাড়বে তত বাড়বে একমাত্রিক মিথ্যা, উবে যাবে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা। কিন্তু এ-কথাও মনে রাখা উচিত যন্ত্র হোক বা মানুষ, সমস্ত যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারবে না। আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ কার্ট গোডেল একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছিলেন। তাঁর Incompleteness theorem জানায়, যে-কোনও জটিল ব্যবস্থাতেই হয় সামঞ্জস্য থাকবে অথবা পূর্ণতা। অর্থাৎ, সমস্ত সত্যিকে যদি চিহ্নিত করতেও পারি, তার সব ক’টিকেই ব্যাখ্যা করতে পারব না। গোডেলের দেখানো পথে চললে যন্ত্র এবং মানুষের পরিপূরকতা ছাড়া গতি নেই। যন্ত্র চিহ্নিত করুক সব সত্য, আমরা কাজ করি কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে। যন্ত্র শুনিয়ে যাক কেন শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর, আমরা খুঁজতে থাকি এমন সমাধান যাতে শেষের সেদিনের সম্মুখীন এখনই না হতে হয়। যন্ত্র বলুক পরের অতিমারীর ধ্বংসলীলা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, আমরা বার করি এমন এক পথ, যা ধরে পরিযায়ী শ্রমিকরা ভরা পেটে, ন্যায্য মজুরি নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন তাঁদের পরিবারের কাছে।
—
১. https://www.ws5.com/Penrose/
২. https://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371/journal.pone.0257286
৩. https://www.theguardian.com/business/2022/may/17/cost-of-living-crisis-health-worse-poll-britons
৪. shorturl.at/pyzKN
৫. https://www.bloomberg.com/graphics/covid-resilience-ranking/